‘লাল স্কার্ফ আর একটা করে ষাঁড়’ পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা ।। শারমিন রাহমান

২০১৪ সালের আগে আমি যেসব কবিতা লিখেছি, প্রায় সবই ফেলে দিয়েছি। আমার সঙ্গীত র্চচা, স্ট্রিট মিউজিক, র্আট সেন্টার, পারিবারিক জীবন এবং দেশের রাজনীতিতে একের পর এক অসংলগ্ন পরিস্থিতির উদ্ভব আমাকে কবিতার ভিতর ডুবিয়ে দেয়, আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি কবিতা আমাকে মৃত্যুর তলদেশ থেকে ভাসিয়ে তুলবে। বই প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত ছিল শুরুতে, কিন্তু ২০১৫ সালে মনে হল বই না ছাপালে আমার কবিতা হারিয়ে যাবে। হয়তো ব্যাপারটা মানসিক ছিল, কী জানি! ২০১৫ সালেই অনুপ্রাণন প্রকাশন প্রকাশ করল আমার প্রথম কবিতার বই “অপ্রাকৃত কবচ”, তাদের খরচে। প্রচ্ছদ করেছিলেন র্নিঝর নৈ:শব্দ্য। ২০১৬ তে চৈতন্য প্রকাশন থেকে বই আসার কথা থাকলেও আমি আরও এক বছর সময় নিলাম যথেষ্ট ভাল কবিতা পান্ডুলিপিতে রাখতে চেয়েছি বলে। ২০১৭ বইমেলাতে আসছে আমার দ্বিতীয় কবিতার বই “ লাল র্স্কাফ আর একটা করে ষাঁড়”, চৈতন্য প্রকাশন থেকে। প্রসঙ্গত, কবি মুজিব ইরমের অকুণ্ঠ প্রেরণা ছিল এই বই প্রকাশে।

– শারমিন রাহমান


শহর সংক্রান্ত

১.

একবার ভুল করে গিলে ফেলো কোন এক ছোট্ট শহর।
তোমার উপর-দম হবে।
দেখবে সেখানে তুমি গিলে বসে আছো পাঁচশো বছরের মত বয়স।
সেখানে ঐতিহ্যবাহী তরবারি আর বন্দুক থাকবে।
সেখানে থাকবে সহোদরের প্রতিলিপি যার পায়ের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে থাকতে
ঝরে গেছে তোমার চোখের ধূসর পাপড়ি,
তোমার চোখের পাতা হা হয়ে গেছে গুটিখোরের মতন।
সেই শহরের একটামাত্র গ্যালারিতে তুমি টাঙিয়ে দিয়েছ হেরেমখানার নামফলক।
তোমার উপর-দম হচ্ছে।

হঠাৎ ঘোঁৎ করে শহরটা বেরিয়ে পড়ল।
তুমি দেখলে সেটা শহর নয়, ফুলের তোড়া।
তুমি দেখলে ফুলের বদলে অসংখ্য শিল্পীর চোখ, সেইসব চোখে নাই সবুজ
কিংবা ধূসর পাপড়ি।

 

২.

দোলাচল বেশি বেশি বন্য হলে হাতির পীঠে চলার মতন।
এড়িয়ে পেরিয়ে ঝমঝম খনিজের মতন।
অনিরাপদ রাতে সবথেকে বড় খোঁজ পড়ে সিটি কর্পোরেশনের সস্তা টিমটিমে লাইট।
নগরীর কোন এক মাজারের দেয়ালে কার্পাস কারবারীর মাথা ডলে দিয়ে
বুট জুতা ভুম ভুম করে পীচে ঠুকে দিয়েও মানুষ কতইবা বড় হবে?
কতইবা মানুষের ব্যাস?

 

চেক

চার দেয়ালের শহরে
রাজাদের দেড় ছক
মন্ত্রিসভায় আড়াই কিস্তি মাত।
জওয়ানদের জন্য
বরাদ্দ হোক লাল স্কার্ফ আর
একটা করে ষাঁড়। জুয়ানের জন্য
শীতের সকালে একজন খালামনি।
এর চেয়ে অনেক অনেক বেশী কীর্তিমান হবে
আগুনের সার্কাজম পেটে বেঁধে
যাকে দিয়েছ
ওলন্দাজের দিনের গনিমত।
 

 

বৃদ্ধের গায়ে তখন ঘোড়ার ঘুম

আজ দিনটা ভাল।
এস্কেলেটরে আধা ইঞ্চি উঠতে না উঠতে
বৃদ্ধ হাঁপিয়ে যাচ্ছে না। অন্যান্য
পাটে দাঁড়ানো তুখোড় ক্লাউনগুলা
তার প্যাঁপো নাক টিপে
হেসে বলছে
‘হ্যালো!’
এস্কেলেটর থেমে যাবে
রাতের দুইটা বাজে।
বৃদ্ধের গায়ে তখন ঘোড়ার ঘুম।

 

 

লেইম্ব্রেইন

১.

পথে ঘাটে ছাদে এত সব পাহাড়ের সমাগম
পাহাড়ের পাশে বসতেই মাথার মধ্যে পাহাড় ঢুকে পড়ে।
ভয়ের মধ্যে বাঘ ঢুকে পড়ে।
মেঘের মধ্যে ঝমঝম শরীর।
শরীরের মধ্যে নিশপিশ করে মদ। ঘাসের মতন প্রেমিকারা গান গায়
গুনগুন করে, ঘাসের শরীর ভরা ছিপছিপে
প্রেমিকারা ধোঁয়া ছাড়ে, ছাড়ে আভরণ। ঘাস শরীরে প্রেম,
ঘাসের মধ্যে শরীর শুকায়ে যায় , গলা ভাঙে,
প্রেমের শরীর ভরা নিঃসীম সবুজ।

 

২.

আমাদের ঘরে যে সম্পর্কের কল আছে তার নাম হাত মেশিন।এই হাত মেশিন থেকে একদিন উৎপন্ন হবে বড়মা। বড়মা একদিন নানী ছিল যার ঘরের পেছনে মজা পুকুর থাকতো। শামুকের পেট ঘষা ধারালো ছুরির ভিতরে আমের পাশাপাশি ঘুম যেত ওষুধের বোতল। এইসব ভুলে গেলে তো হবে না, যেহেতু ওই বোতলের পেটের ভিতর আমরা ঘুমায়ে পড়েছি প্যাঁচাপেঁচি করে, সহোদরার মত। সেই ঘুম আর ভাঙে নাই।

এখানে কান পাতো, নানীরা এখানে গান গাচ্ছে স্ট্রবেরি ফিল্ডের, ব্লু হেভেনের । গান গাইতে গাইতে স্পষ্টই তাদের বয়স কমছে, তারা মা হয়ে উঠছে এবং যথেষ্ট কুমারী। এইসব ভুলে গেলে তো হবে না। এই সেলাই কলে হাত রাখো, হাতটা আপনাআপনি ঘুরে ঘুরে চলবে। এখান থেকেই উঠে দাঁড়াবে সিঙ্গার।সে গাইবে আর মেশিন থেকে এক দৌঁড়ে বের হয়ে যাবে। সে গাইবে নানীর অন্ধ সহোদরার গান যে আলখেল্লা পরে হেলেদুলে পাহাড়ের গুহায় অদৃশ্য হয়েছে, যে গান গেয়ে গেয়ে অন্ধ হয়েছে।

আমাদের এই সম্পর্কের কলের নাম হাতমেশিন।এই হাত মেশিনে সেলাই ছোটবড় হয় কেননা এই মেশিন এর সম্পর্ক জুড়ে সুতার অস্থির ওঠানামা। এই মেশিনে অস্থির সুতায় পেঁচিয়ে যাচ্ছে জামা আর চকোলেট।
 

 

স্পৃশ্যের সামনে বায়স্কোপ  

একটা সুরের রাত গত হওয়া
মানে কিছু নয়। একটা রাতের সুর,
পদাঙ্কে ঘুরতেছে একটা রাতের সুর-
নৈ:শব্দ্যের অলীক ব্যাঞ্জনায় একটা রাতের সুর-
পায়ের নিচে দলিত একটা নিছক সুর, সুরেলা অসুখ।

অসাড় অন্ধকারে ঐশ্বর্যের শহরে
লাল নীল হলুদ সবুজ টিমটিমে রশ্মিগুলা
তারকাপ্রতিম মনে হয়। এমন উজ্জ্বলতায় কোপ দিয়ে
ঝরেনি সুরের আগুন। এই ওলন্দাজমুক্ত, জলদস্যুমুক্ত শহর
আজও মুক্তির নামে দস্যুতা। এই নগরের ঢলে,
রাস্তার ছাদে অপ্রতুল উড়াল সেতুর স্তনে
ভর্তি ভর্তি রাখা আছে দুধ- ক্ষুধার অক্ষিগোলক বরাবর।
এইসব সর্পিল ঐকতান একদিন হয়ে ওঠে
হা-ভাতের স্বপ্নিল সুর।


কবি পরিচিতি

শারমিন রাহমান
জন্মঃ ১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৩।
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাগত যোগ্যতাঃ পরিচালক, ধ্যান চট্টগ্রাম আর্ট সেন্টার।
বাংলাদেশের কয়েকটা স্বনামধন্য ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে ১৫ বছর ইংরেজি ও সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষকতা।
সঙ্গীত গুরুঃ ওস্তাদ নিরদ বরণ বড়ুয়া, সুরবন্ধু অশোক চৌধুরী ।
প্রকাশিত কবিতার বইঃ অপ্রাকৃত কবচ (২০১৫)
এখন পর্যন্ত একমাত্র গানের এ্যালবামঃ একা একা  (২০০৮)
পরিবেশকঃ সঙ্গীতা
কথা, সুর, সঙ্গীতঃ শারমিন রাহমান
এখন পর্যন্ত  নির্মিত একমাত্র শর্টফিল্মঃ ব্লার, ( ডিসেম্বর, ২০১৬)
পরিবেশকঃ ইউটিউব
একাধিক র্শটফিল্ম ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম র্নিমাণাধীন

শেয়ার