মেলা থেকে এবার যে বইগুলো সংগ্রহ করেছি সেগুলোর মধ্যে প্রথম পড়া শুরু করলাম গল্পকার ও ঔপন্যাসিক রাশিদা সুলতানার ‘শূন্যমার্গে’ উপন্যাসটি। আমি মোটামুটি স্লো রিডার। রয়ে সয়ে পড়তে ভালো লাগে। তবে উপন্যাসের ক্ষেত্রে গল্পের বিষয়বস্তুর চেয়ে ডিটেইলিং-এর স্টাইল যদি আমার ভালো না লাগে তো সেই উপন্যাস আমাকে টানে না।
শূন্যমার্গে এগিয়েছে অদ্ভূত সুন্দরভাবে। এর গল্প বলার ধরনটাই সম্পূর্ণ আলাদা। প্রকৃতির সাথে মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অতিসূক্ষ্ম আদান-প্রদানও যে কতটা ব্যাপকতা তৈরি করে, তার সার্থক ও দুর্দান্ত কাব্যিক রূপায়ন ঘটেছে উপন্যাসটিতে। আরেকটি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তা হলো, গল্পের কথকের কোন চরিত্র, ঘটনা বা বিষয়বস্তুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিলো না। যেনো এ উপন্যাস কারো দ্বারা রচিত হয়নি, শ্রেফ ঘটনাগুলো নির্বিকারভাবে ঘটে চলেছে। যেখানে কারও মতামত, নৈতিকতা, উচিত-অনুচিত এসব ভাবনা কোনভাবেই এই ঘটনাগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে না। মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বের যে বহু অমিমাংসিত ও ব্যাখ্যাতীত ব্যাপার থাকে তা উপন্যাসে স্পষ্টতই উঠে এসেছে। আরেকটি বিষয় হলো, রাজনৈতিক উপন্যাস না হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের গোপন অন্ধকার বাস্তবতা দক্ষভাবে চিত্রায়িত হয়েছে এ উপন্যাসে। আমার মনে হয়েছে, কথাসাহিত্যের আন্তর্জাতিক নির্মাণকৌশলের প্রতিটি অনুষঙ্গে, যেমন আখ্যান-নির্মাণ, ভাষারীতি, শব্দসৃজন, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বাক্যবিন্যাস, সংলাপ-নির্মাণ, রূপক-উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদিতে এই উপন্যাস বিশ্বমানের।
মূলত শিউলি, রামিম, মিজান ও নাজিয়া, এই চারটি চরিত্রকে আবর্ত করে গল্প এগুলেও কারো সাথে কারো যেন কোন সাযুজ্য নেই, আবার নিবিড়ভাবে আছেও। রামিম আমাদের সমাজের সেই শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী, যাদের জীবনে সবকিছু পারফেক্টলি হওয়া চাই। তাদের সবকিছু আমিত্ব দিয়ে শুরু এবং আমিত্বেই শেষ। আর তাদের সেই পারফেক্ট স্মুদ জীবনে অপরজনের গুরুত্ব ও স্থান ততক্ষণই থাকে, যতক্ষণ না তারা নূন্যতম জটিলতারও কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই সে কখনও দুর্দান্ত প্রেমিক, তো কখনও অতি নির্দয়ভাবে নির্লিপ্ত। রামিম হচ্ছে এই উত্তরাধুনিক ভদ্র সমাজের আধুনিকতার মোড়কে সুসজ্জিত আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা কট্টর পুরুষতন্ত্রেরই ধ্বজ্জাধারী। তাই সে শিউলির উন্মত্ত প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতাবোধসম্পন্ন রামিম এই সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে শুরুতেই শিউলিকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলো, তাদের এ সম্পর্কের কোন ভবিষ্যত নেই। আবার সে-ই রামিমই তার অবদমিত মনে যে শিউলির মূর্তি চিরস্থাপিত হয়ে যায়, তাকে আজীবন অন্য নারীদের মাঝে গোপনে খুঁজে ফেরে। যদিও এ কারণে তার জীবনপ্রবাহে কোন ছন্দপতন হতে দেয়নি সে কখনও।
আর শিউলির মতো বাস্তবতা-বিবেচনা বর্জিত সম্পূর্ণ আবেগতাড়িত অপরিনামদর্শীর সাথে আমি রিলেট করতে পারি আমাদের আশেপাশে থাকা অনেককে। তবে এতো ক্ষুদ্র পরিসরে শিউলি চরিত্রটিকে ভাবলে চরিত্রটির ওপর অন্যায় করা হবে। শিউলি মেয়েটি শরতের ভোরে ফোটা চিরকালীন শুদ্ধ ও স্বল্পায়ু ফুল শিউলির মতোই। তার আবেগ শুদ্ধ, সেখানে কোন ভান নেই। তার ব্যক্তিত্ব এতোটাই দৃঢ় যে, রামিমকে দেয়া কথা রাখতে নিজের ভবিষ্যৎ, এমনকি জীবন পর্যন্ত তুচ্ছজ্ঞানে তছনছ করে দিয়ে হলেও সে তার ওয়াদা ভঙ্গ করেনি। আর তাই সে নিজেও একই বংশের মেয়ে হয়েও প্রেমের দাবী নিয়ে রামিমের সামনে এসে দাঁড়ায়নি। বরং বেছে নেয় সমাজের নিচুস্তরের কালিমালিপ্ত অন্ধকার জগতের বাসিন্দা মিজানের অনুগ্রহে চরম অনিশ্চিত ভবিষ্যৎহীন এক জীবন।
সেদিকে মিজান রামিমের ঠিক বিপরীত মূর্তি। সমাজের নিচুস্তরের ভাড়াটে খুনি ও লম্পট হয়েও সে ভানহীন- অকপট। চরিত্রহীন হয়েও শিউলিকে দেয়া কথা শেষ পর্যন্ত রাখা ও তাকে তার উপযুক্ত সম্মান সব সময়ই দিয়ে যাবার মাধ্যমে সে মানুষ হিসেবে রামিমের চেয়েও উঁচুশ্রেণির। আর এখানেই তৈরি হয়েছে সমাজের ভালো-মন্দের চিরাচরিত সংজ্ঞার ধ্যান-ধারনাকে আঘাত দেবার মতো টুইস্ট।
সারাজীবন শিউলিকে খুঁজে ফেরা রামিমের জীবন থেকে শিউলি হারিয়ে গেলেও, রামিম তার ব্যক্তিত্বের ছায়া দেখতে পায় উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত নাজিয়ার মাঝে। তখন সে নাজিয়াকে পাবার জন্য আকুল হয়ে পড়লেও যথারীতি এখানেও সে তার সামাজিক ভাবমূর্তি ও আত্মগৌরবের পুরনো খোলস থেকে একচুলও বের হয়নি। এখানেও সে সমানভাবেই আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নির্দয় ও পুরুষতন্ত্রের ঝান্ডাধারী।
অথচ এই নাজিয়া একেবারেই অদ্ভূত এক চরিত্র। তার কোমল প্রেমপূর্ণ ভঙ্গুর চরিত্রের মাঝে একইসাথে বসবাস করে প্রচণ্ড শক্তিশালী একরোখা দৃঢ় ব্যক্তিত্বের আরেক নাজিয়া। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থান তাকে বহু রুঢ় বাস্তবতা ও চির একাকিত্বের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালেও সে জীবনযুদ্ধে হার না মানা উন্নতচিবুকের যোদ্ধা। এমনকি সম্পূর্ণ সমাজের বিপরীতে গিয়ে বিবাহবহির্ভূত অবস্থায় রামিমের সন্তানের মা হতেও সে পিছপা হয়নি।
আপনাদের হয়তো এপর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে উপন্যাসটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। না, তা নয় একেবারেই। খুব সুচারুভাবে লেখক এই উপন্যাসে উঠিয়ে এনেছেন বর্তমান পোস্ট-মর্ডান সমাজব্যবস্থায় বাড়তে থাকা মানুষের নিঃসঙ্গতা, প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক-চিন্তাচর্চা, এক ধরনের চূড়ান্ত নিহিলিজম। উঠে এসেছে বাংলাদেশের আর্মড ফোর্স কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ঔপনিবেশিক ডায়াগ্রামে সাজানো সাব-কন্টিনেন্টাল আর্মড ফোর্সের ভেতরকার কুৎসিত শ্রেণিকরণ এবং এই অত্যাধুনিক যুগেও সিভিল সোসাইটির শ্রেণিসংঘাতের আরেক কদর্যরূপ। সেনাবাহিনীর অফিসারদের গণহত্যা— যা আমাদের দেশের একটা বড় জাতীয় ঘটনা, অথচ তাকে নিয়ে কিছু লেখা দূরে থাকুক, মুখ খোলবার সাহস আর কারও হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। বিস্ময় জেগেছে যখন দেখলাম, ‘শূন্যমার্গে’ উপন্যাসে অসীম সাহসে ভর করে লেখক সেই নির্মমতা, সেই নৃশংস নির্যাতনের ভয়ালরূপ অত্যন্ত সুস্পষ্ট চিত্রকল্পে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
আসলে উপন্যাসটি ব্যাখ্যা করার বিভিন্ন এঙ্গেল বা বহুরৈখিক জায়গা রয়েছে। আমার কাছে সব থেকে যেটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, তা হলো শূন্যমার্গে আমাকে পাঠক হিসেবে চুম্বকের মতো ধরে রেখেছে এবং শেষ পর্যন্ত নিরাশ করেনি। উপন্যাসটি শেষ করে যখন বইটি হাত থেকে নামিয়ে রাখলাম, আমাকেও বেশ অনেকটা সময় ধরে কি যেনো এক নিহিলিজম আবিষ্ট করে রাখলো…
উপন্যাস: শূন্যমার্গে
লেখক: রাশিদা সুলতানা
প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২