‘রঙ্গা বঙ্গা ভুতু’ ও ‘কুঁজো বুড়ি’র গল্প প্রথম শুনি বড় বোনের কাছে। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। গল্প শুনে আমরা তিনভাই ছড়া কাটতাম– ‘আয় আয় তুতু, রঙ্গা বঙ্গা ভুতু’। এরপর কুঁজো বুড়ি ও রঙ্গা-বঙ্গার সাথে পরিচয় পাঠ্যবইয়ে। এখনকার শিশুদের গল্প শোনার বা পড়ার চেয়ে গল্প দেখার প্রতি ঝোঁক বেশি। মাধ্যম পাল্টেছে ঠিকই কিন্তু পাঠের আবেদন এখনও কমেনি। তো রঙ্গা বঙ্গা ভুতু আমাদের শৈশবের একটা রঙীণ অংশ হয়ে আছে। যেহেতু লোকগল্প ও রূপকথা মানুষের আচরিত জীবন থেকে এসেছে তাই মনে হয়, পরের গ্রামের পাহাড়ি জঙ্গলেই যেন এ ঘটনা ঘটেছিল। আজ এই বয়সেও রঙ্গা বঙ্গা ভুতু আর তাদের বুড়িকে ভোলা যায়নি। শৈশবস্মৃতির মধ্যে বুড়ি বলে- লাউ গুড়গুড় লাউ গুড়গুড়/ বুড়ি গেল অনেকদূর।
বাড়িতে কুকুর ছিল আমাদের। আটানব্বই সালে বাবা সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ছয়শ’ টাকায় কিনে এনেছিলেন। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল- রকি। সাদা রঙের, ঘাড়ে অল্প কালো। রকির আগে ছিল লালু। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। আর রকির আয়ু ছিল চার মাসের মতো। চার মাসে সে চারজনকে কামড়েছিল। তারপর একদিন রক্তবমি করতে করতে লুটিয়ে পড়েছিল। পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যা, উঠোনের মান্দার গাছতলায় কবর দেওয়া হয়েছিল তাকে। শেকল সমেত। শেকল পরিয়ে আমরা তাকে পোষমানাতে চেয়েছিলাম। এখানেই যেন বাহাদুরি মানুষের। নিজের একাকীত্ব লাঘব আর বিবিধ দূরভিসন্ধি হাসিলে বিকাশ পর্বের সময় হতে মানুষ বন থেকে ধরে এনেছে পশুদের। তারপর তাদেরকে ‘আমার’ দাবি তুলে নিজেরা যেমন গোষ্ঠীবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসেছে তেমনি তাদের করে তুলেছে গৃহপালিত। মানুষ তাদের নিজেদের মতো করে নামও ঠিক করে দিয়েছে; যেন সেই নামে ডাকলে তারা মানুষের মতো সাড়া দেয়, আদেশ পালন করে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ নামক বিখ্যাত উপন্যাসে বলেছেন- কুকুর দাস শ্রেণীর। আর বিড়াল সুবিধাভোগী।
মহাভারতে আছে, স্বয়ং ধর্মরাজ একবার কুকুরের ছদ্মবেশ নিয়ে মর্ত্যে এসেছিলেন। ধর্মপূত্র যুধিষ্ঠির যখন স্বর্গে যাওয়ার আগে পর্বত অতিক্রম করছিলেন তখন ধর্মরাজ কুকুরের ছদ্মবেশে আগে আগে হাঁটছিলেন। বৌদ্ধ জাতকে বোধিসত্ত্বাকে বিভি্ন্ন প্রাণীর রূপে জন্মাতে দেখা গেছে; যেমন- হরিণ, হাতি, ময়ুর, কচ্ছ্বপ, সাপ, কাঁকড়া, মানুষ প্রভৃতি। কিন্তু কখনও কুকুরজন্ম হয়নি তাঁর। এতেই বোঝা যায় কুকুরকে কী কুৎসিত আর গুণহীন প্রাণী হিসেবে ভাবা হতো। আদৌ কি সে তাই? আমরা গালি অর্থে বলি- তুই একটা কুত্তা! চরিত্র বোঝাতে বলি- কুকুরের বাঁকা লেজ কখনও সোজা হয় না। ভাববার বিষয়, কুকুর এতো গুণ নিয়েও কিভাবে ঘৃণার উপকরণ হয়ে গেল! প্রভুভক্ত কুকুর, এই শব্দগুচ্ছের ভেতর’ই যেন লুকিয়ে আছে কুকুরের প্রতি মানুষের চিন্তাভাবনা। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তসলিমা নাসরিনকে লিখেছিলেন-
তুমি বরং কুকুর পোষো
প্রভুভক্ত খুনসুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়,
তোমার জন্য বিড়াল’ই ঠিক,
বরং তুমি বিড়াল পোষো
খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়
খুঁজে এবার পেয়েছো ঠিক দিক ঠিকানা
লক্ষী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো।
গৃহস্থবাড়ির খেদমত ছাড়াও এমন খবরও তো আমরা জানি যেখানে কুকুর অবতারের পর্যায়ে উঠে মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। অনেক রহস্যময় ঘটনার সমাধান বের করেছে। গ্রাম অঞ্চলে কুকুর হচ্ছে বাড়ির দারোয়ান। গাছ থেকে পাতা ঝরলেও সে ঘেউ করে ওঠে। তাহলে কোন দোষে সে আপামর মানুষের গালি হয়ে গেল আর পৌঁছে গেল অশুচির পর্যায়ে। কুকুরকে বলা যেতে পারে রাগী ও গোঁয়ারগোবিন্দ প্রাণী। যে জানে সে মনুষ্য দ্বারা শোষিত হচ্ছে কিন্তু অন্য পাড়ার কুকুরকে সে নিজের সংরক্ষিত এলাকায় এক বিন্দুও ছাড় দিতে রাজি নয়। এটা ঠিক যে, কুকুর ও মানুষ চরিত্রগত দিক থেকে সমপর্যায়ের। তবু কুকুর হয়ে উঠলো মনিবের স্বার্থসিদ্ধির অস্ত্র। তাকে লেলিয়ে দেওয়া হলো শিকার ও শত্রুর পেছনে। মানুষ তার মধ্যে সৃষ্টি করলো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী এক অবয়ব।
মনুষ্য সমাজে নিপীড়িত ও দলিত প্রাণী কুকুর আর জঙ্গলে ফিরে যেতে পারবে না। সেখানে গিয়ে বেঁচে থাকা তার জন্য আরও ভয়ঙ্কর হবে। ফলে সে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ে গেছে। তার যে একটা কুকুরচরিত্র আছে, তা মানুষ তাকে বুঝতেই দিচ্ছে না। নগরসভাগুলোতে বছর-বছর চলছে নির্বিচার নিধন। কুকুরকে হাতে রাখার জন্য মিডিওকার মানুষ আওড়াচ্ছে- কুকুর মানুষের প্রকৃত বন্ধু। অথচ যে ভালবাসা নিয়ে একদিন মানুষের সঙ্গে বন থেকে বেরিয়ে এসেছিল কুকুর, সে বিশ্বাস ও ভালবাসার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে মানুষ। এখন মানুষের কাছে এর চেয়ে বেশি আশা করে না কুকুর।