যেভাবে শঙ্খ ঘোষের অ্যাডমায়ারার হয়ে উঠলাম | নাজমুস সাকিব রহমান

‘আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না, কলকাতায় থাকে’। এটা আমার পড়া প্রথম কোনো কবিতার লাইন, যেটা লিখেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)। আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন। জানতাম না, শঙ্খ ঘোষকে কবি হিসেবে জানা অনুচিত। তিনি আসলে একটা স্কুল। এমন একটা স্কুল যেখানে অনেকগুলা ক্লাসরুম। সেসব রুমের একটিতে কবিতা, অন্যটিতে অনুবাদ। একটিতে প্রবন্ধ, অপর একটিতে জার্নাল। মানে একেকটা ঘরে একেকটা ফর্ম। আর যে কেউ পছন্দমত একটা ঘরে ঢুকে বসে থাকতে পারে।

 

অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ কাউকে বের করে দেন না।

 

সেই কবে, ১৯৫৬ সালে বেরিয়েছিল শঙ্খ ঘোষের প্রথম কবিতার বই : ‘দিনগুলি রাতগুলি’। প্রস্তুতিপর্ব বাদ দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ধরি। বয়সের দিক থেকে ধরলে ৮৯ বছরে মারা গেছেন তিনি। অভিজ্ঞতার দিক ধরলে লিখেছেন ৬০ বছরের বেশি। এত সময় পাওয়া যেকোনো লেখকের জন্য ঈর্ষণীয় ব্যাপার। কম করে হলেও তিন ডজন কবিতার বই আছে তার। গদ্যের ভাণ্ডার তো আরো বেশি। তাকে ভার্সেটাইল বললে বিশেষণটা হালকা হয়ে যায়।

বড়-ছোট-মেজো—ঘরের সবার জন্য লিখেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন সামাজিক। বিভিন্ন ফর্মে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার উপস্থিতি। ফাঁকি নেই কোথাও। না কাব্যভাবে, না দায়বদ্ধতায়। উপমহাদেশের অনেক কুৎসিত আচরণ তার লেখায় উঠে এসেছে। দেশভাগ তার একটি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে অনেকগুলো ভাল বই লিখেছেন তিনি। বড় লেখকদের ক্ষেত্রে সচরাচর তা হয় না। দেখা যায়, কারো বইয়ের কয়েকটি কবিতা ভাল হয়, কারো কয়েকটি গল্প। উপন্যাস হলে বড়জোর একটা চরিত্র ভাল লাগে। শঙ্খ ঘোষ এখানে ব্যতিক্রম। তার বই যেন পুরোটাই ভালো হতে বাধ্য হয়।

শঙ্খ ঘোষের লেখা বহুল পঠিত একটা কবিতা, ‘যমুনাবতী’। সরাসরি বললে, প্রগ্রেসিভ পাঠকরা এটা খুব পছন্দ করেন। এক স্মৃতিচারণায় শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন, ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে একটা অনুষ্ঠানে তৎকালীন সমসাময়িক কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ পড়ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গতই সেখানে উঠে এসেছে ‘যমুনাবতী’। অনুষ্ঠানে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সেদিন ক্লান্তির কথা বলে চুপ থাকবেন বলে ঘোষণা দেন বুদ্ধদেব। কিন্তু যেই না ‘যমুনাবতী’ শেষ হলো, তার মুড সুইং হলো। শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, আক্রান্ত হলো তার কবিতা।

 

এই ২০২১ সালে তিনজনের কেউ পৃথিবীতে নেই। ‘হাহাকার কবিতা নয়’ বলা বুদ্ধদেব মারা গেছেন সেই কবে। নেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। অথচ এখন আমি বুদ্ধদেবের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের অদ্ভুত একটা মিল দেখতে পাই। মিলটা অবশ্য রবি ঠাকুরকে ঘিরে। ঠাকুরকে নিয়ে তিনটা বই লিখেছেন বুদ্ধদেব। শঙ্খ ঘোষও কম যাননি। অসাধারণ সব প্রবন্ধ রেখে গেছে তার গবেষক মন। অবশ্য শঙ্খ ঘোষের লেখা আমার সবচেয়ে পছন্দের বই জার্নাল (১৯৮৫)।

 

অনেকগুলো বছর আমি শঙ্খ ঘোষকে ফলো করেছি। তার দরজা খোলা দুয়ারের কথা জেনেছি। লাইফ স্টাইল তো অবশ্যই। তার সাদা কাপড়-চোপড় মনে করিয়ে দিয়েছে সলীল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মনের স্মৃতি। বোঝার চেষ্টা করেছি, সাদা কেন বাঙালির রঙ? গুলজার কেন বাঙালি না হয়েও এই রঙের প্রতি ফ্যাসিনেটেড? অথবা ফ্যান না হয়ে আমি কীভাবে শঙ্খ ঘোষের অ্যাডমায়ারার হয়ে উঠলাম?

আমার ভীষণ পছন্দের একজন লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর পর তার কাছে অনুভূতি জানতে চেয়েছে আনন্দবাজার। আমার মনে হয়, সেখানেই শেষ প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন শীর্ষেন্দু। তিনি বলেছেন, ‘শঙ্খদাকে শুধু কবি বললে ব্যাপারটা একপেশে হয়ে যায়। তিনি আসলে সাহিত্যের অভিভাবক। সত্যিকারের অভিভাবক সবাই হতে পারে না। এক বার দেখলাম, জুনিয়র এক কবির কবিতা সংশোধন করছেন। এত বড় মাপের কবির কি এটা কাজ? কী দরকার ওর? কিন্তু ওই যে! দায়িত্ববোধ আর স্নেহ’।


নাজমুস সাকিব রহমান

কবি, গদ্যকার

শেয়ার