একটা অদ্ভুত ফ্যাসিস্ট অন্ধকার চারপাশে। প্রতিরাতে আমরা এমন থকথকে অন্ধকারে বসে থাকি। জানালা আংশিক খুলে দিলে আমাদের গরিব ঘরেও সামান্য বাতাস ঢোকে। প্রতিবেশীদের আলো। আমরা গুম হয়ে যাওয়া মহল্লায় বসেও ভালো লাগার কথা বলতে থাকি। একটা কুকুরের গোল হয়ে ঘুমানো মাঝে মাঝে আরাম দেয় চোখে৷ বন্ধুদের কথা মনে পড়ে৷ আজ কে কোথায় নিজস্ব দুঃখে সাবলম্বী হয়ে আছে! সেসব মনে পড়ে।
মশারীর মধ্যে শুয়ে দেখি কিভাবে অন্ধকার চোখ সয়ে আসে৷ তুমি আমাকে শোনাতে চাও “তিতির গোল ঠোঁট তোমাকে ডাকছে কাঠে, মাতৃ-মর্মর জলে—”! আমার চোখে মৃদুমন্দ ঘুম। এমন ফ্যাসিস্ট অন্ধকারেও একটু সুখ, একটা কল্পনা আমাকে তলায়া নিয়ে যায়! তুমি গেয়ে ওঠো ” পেয়্যার নে জাহাপে রাকখা হে ঝুমকে কাদাম একবার “…… …..
আমার ঘুম এসে যায়—
মাঝে মাঝে আমারো মনে হয়, আত্মবিলাপ থেকে দূরে সরে যাই। নদীর রুপালি আলো আমাকে কাতর না করুক
বন-তেউরির ফুল, তোমাকে দেখিনি। আমি কেবল
বারান্দায় কাপড় মেলে বুঝতে চেয়েছি বাতাসের গতি-প্রকৃতি
খুব বেশি দুঃখের কথা বলতে চাই না কাওকে
ঝড়ের পূর্বাভাসে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালে কিছুক্ষণ নিজেকে সুখী মনে হয়—
মনে হয় একটা গজলের মতো আমার জীবন এলায়া পড়ে আছে। আবার এমন লাগে আমি যেন হঠাৎ বোঁটা খসে ছিঁড়ে যাওয়া পাতা, বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে পড়তেছি৷ আমার রুহের ভেতর তোমার নাম। তুমি কী কাঁপতেছো, পাখি?
*
বাতাসে গোলাপি ফুলগুলো দুলতেছে। আরও উপরে তাকালে বাতাসের শন শন শব্দ। সে বাতাস কেন যে গায়ে এসে লাগতেছে না তাই নিয়ে উঠানে বিহ্বল দাঁড়ায়ে থাকি৷ ছোট বাগানটায় যাই। প্রতিটা ভেজা পাতার উপর নাক রেখে নিজের বয়স আন্দাজ করি। নিজের ব্যর্থতার ঘ্রাণ বুঝি লাগে৷ মনে পড়ে অনেক আগের কোনো রাতের কথা। সেদিনও আমি ব্যর্থতা নিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটতেছিলাম। আব্বা আমার হাত হয়তো ধরে রাখছিলো৷ বাজার থেকে বাড়ির দিকের রাস্তায় যেখানে বাঁশঝাড় নুয়ে পড়ে অন্ধকাররে আরেকটু মর্যাদাপূর্ণ করে তুলছিলো সেইখানে আব্বা আমারে বলছিলো, আল্লা মানুষের জন্য সব দরজা একসাথে বন্ধ করে দেয় না৷ সম্ভাবনার কোনো না কোনো দরজা সবসময় খোলা থাকে। এই ভেবে ভেবে নিজের পিঠে হাত বুলাই৷ সারাটা জীবন৷ যেহেতু কিছু হইতে পারি নাই কিছু হইতে পারার সম্ভাবনা কোথাও হয়তো জারী আছে।
*
বিষ্টি আসারও নানারকম কায়দা কানুন আছে৷ দেখতাম ছোটোবেলায়। কখনো উঠানে দাড়ালে অনেক দূরের বিষ্টির শব্দ শোনা যাইতো, বুঝতাম তুমুল জোরে আসতেছে। উঠানের শুকনা কাপড়, ধান জড়ানোর তাড়াহুড়ায় ভুল হইতে থাকতো সব৷ আবার কখনো উত্তরে মেঘ জমে এক পশলা বিষ্টি হয়ে আবার পুবে জমতো তারপর আবার এক পশলা। তারপর দক্ষিণ আবার পশ্চিম। কী এক নাটকীয়তার ভেতর জীবন উন্মুখ হয়ে থাকতো৷ তুমি আসো, দেখো কীভাবে বাঁশের পাতায় নাচতেছে বাতাস৷ ঘন মেঘ আর সামান্য আলোয় জেগে আছে আমাদের মুখ।
*
সকাল, হইতে পারে মধ্যরাত থেকেই ছেড়া ছেড়া বৃষ্টি। যার কোনো ছন্দ নাই। পতন আছে শুধু এলোমেলো। চারপাশ এত সবুজ হয়ে আছে যেন চোখ ফেরালেই আমাদের অন্ধ করে দেয়া হবে৷ আর আমি ভাস্করের কবিতার মতো ছোট ভাইয়ের ঘুমের পাশে শুয়া আছি৷ বাতাসের শব্দ এত প্রবল, এত রকম তার কতটুক আমরা জানি। যেমন জানি না সিনেমার দৃশ্যের মতো মেলায় ঘুরতে গিয়ে সন্তান হারায়ে ফেললে কেমন লাগে৷ আমার তখন বয়স ৭। আব্বা আমারে ঢাকার রাস্তায় সিনেমার দৃশ্যের মতোই হারায়ে ফেললো। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। শাদাকালো টিভিতে আলিফ লায়লা দেখি৷ ভেলা বানায়া জলীতে হাপায়া বেড়াই৷ জ্বর আসলে ভাল্লাগে কারণ মা স্কুল থেকে দ্রুত ফিরা আসে৷ সেই আমারে আব্বা এমন ছেলেধরা শহরে হারায়া ফেললো। আমার তখন ৭ বছর। গায়ে হলুদ জ্যাকেট। চেইন খোলা৷ সারাদিন বুকের সাথে বাইন্ধা রাখতে গিয়া আব্বা আমারে এক লহমায় হারায়ে ফেলছে৷
*
সমস্ত ঋতু শুধু কী স্মৃতিক্রান্ত করার মহড়া! শাদা ফুলের ঘ্রাণে রাত মৌ মৌ করে এইখানে৷ ঘুমের ভেতর তোমার মুখ হাতড়ানো স্বভাবের আমি—আকাশের দিকে মুখ করে শুই। অন্ধকার, তারও ফাঁকে দু-একটা তারা জ্বলার বাসনা নিয়ে উঁকি দিতে থাকে—
আমি সারাজীবন এমন জায়গায় থাকতে চাইছি যেন মা ডাকলেই বাতাসকে সহজ আত্মীয় মনে হয়, যে আমাকে বাড়ি পৌঁছায়া দিবে ঘণ্টার ব্যবধানে। এমন জায়গা যেন আমার ভাই দ্বিধাগ্রস্থ না অধিকারেই বলতে পারে, বাড়ি আসো। এখনি। তোমাকে বলতে পারি, দেখো কী ভয়ানক দুলতেছে কাঁঠাল গাছ। তুমি তো পাশেই , শুধু কি তাই , হয়তো ভয়—কাঁপাচ্ছে ভেতর বাহির!
শুধু কি নস্টালজিয়াই লিখে যাব আমি! এত বৃষ্টি এসে পাতাদের সবুজ করে দিচ্ছে তবু কেন মাথা নীচু করে হাঁটাই রপ্ত করে যাচ্ছি।
একটা ফরসা সকালে আমরা হাত ধরে হেঁটে আসলাম মৃত্যুর বুদবুদ প্রান্তর ধরে। তখনো কোথাও বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিলো! জানলাম, শুধু পাথরই অনন্ত নয়!
এখনো দরজা খুললে হাসপাতালের করিডোর ভেঙে বাতাস আসে। আর সেই বাতাসে নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে পড়ছে মৃত্যুপথযাত্রী পিতার তুলতুলে শিশু । আমি কান পেতে আছি তোমার ফুসফুসের হাওয়ায় যেন তুমি বলছো, “তোমার ভঙ্গিমা—মনে হয় একটা হাসের ছানা দৌড়ে যাচ্ছে দীঘির ঢেউয়ে”
দেখো, জীবন এমন—আমাদের অন্তর কেবল ইশকের দিকেই ঝুকে যাইতেছে বারবার!
জানি না আজও, স্মৃতি আপার বাড়ির দিকে গেলে উত্তরের বাতাস এতটা নরম হয়ে আসে কেন? কেন একই লেখা বারবার লিখে যাই আমি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কোনো গল্প আজ আমাদের নাই তবু রাত জেগে তোমাকে শুনতে ভালো লাগে। ভালো লাগে কল্পনায় আমাদের মেয়েটার হাই তোলা গোল গোল মুখ—
যে রাস্তায় বন্ধুর হাত ধরে হেঁটে গেছি অপার, মাতৃসম গাছের নীচে আমাদের ক্লান্ত মুখ সবুজ হয়েছে খানিক, ইচ্ছা করে সেইখানে যাই। দেখি পাতা ঝরে গেছে, বিকালের বাতাস এসে মনে করায় বন্ধুর মুখ। মনে পড়ে আমরা আজও ক্লান্ত, আজও সন্ধ্যা হলে আমাদের একা একা লাগে—
আমার লাগানো গাছে দুইটা ফুল, যদি ফোটে, তোমাকে দেবো। এমন সামান্য রাতে যদি ঝমঝম বৃষ্টি আসে আমার সমস্ত ছেলেবেলা ভিজে যায়, উঠানে মা হাঁটছে, মা ভিজে যায়, আমার সন্ধ্যামালতী, তার গোলাপি রঙ ভিজে যায়, আমার ভাইয়ের পশমি মোজা—ভিজে যায়!
এমন বিহ্বল রাতে যদি ঝমঝম বৃষ্টি আসে আবার, তোমাকে নিয়ে মরে যেতে ইচ্ছা করে হঠাৎ—
রুম্মানা জান্নাত
জন্ম : ২৬ মার্চ, ১৯৯৩, গাইবান্ধা, বাংলাদেশ।
পড়াশোনা : ভাষাবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত বই : ‘মিস করি’ সিনট্যাক্সের বাইরে, তোমাকে (নভেম্বর, ২০২২)