যেখানে ঝরাপাতা নিজের শব্দে বন
৮
পরের দিন স্কুলে গিয়ে বেদম মার খেলাম। অংক পারি নি। হাইবেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকিয়ে পাছা লাল করে দিয়েছিলেন স্যার। বিচিত্র সব শাসন ছিল তখন। আঙুলের ফাঁকে কলম ঢুকিয়ে চাপ মারতো কেউ, কেউ আবার হাঁটুর নিচে খোয়া রেখে কান ধরিয়ে রাখতো। চক আর ডাস্টার তো ফ্রিই ছিল। ক্লাসে যাদের সঙ্গে ঝগড়া ছিল তারা খুশি হতো খুব। ক্যাপ্টেন ছিল পরাক্রমশালী শাসকের মতো। একটু কথা বললেই বোর্ডে নাম লিখতো। ঝগড়া বশতও নাম লিখতো কারো। আমরা তখন ছোট ছোট কাগজের পুরিয়া বানিয়ে চোর-পুলিশ খেলতাম। স্টিলের হাই বেঞ্চে কান লাগিয়ে কথা বলতাম ফিসফিস করে। সে কথা মাঠ বিছিয়ে থাকা দূর্বা ঘাসের আলোয় চিকচিক করতো। হাইবেঞ্চের দুই পাশের পাত ছিল একটু বাঁকানো, সেখানে কলম রাখতাম। টিফিনের সময় হলে আমবাগানে যেতাম, গোল হয়ে উবু-দশ-বিশ-তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুর-আশি-নব্বই-একশো গুনে গুনে দল ঠিক করতাম। বাগানের পাশেই বিশাল এক আড়া। কাঠগোল আর ক্ষুদিজাম খেতে প্রায়ই ঢুকতাম ওখানে। বাঁদা বাঁদা কাঠগোলের গোটা আর ক্ষুদিজাম ধরে থাকতো গাছে। খয়েরি সেই জাম আর কাঠলিচুর গাছ ছিল গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের নিঃশ্বাসও সবুজ হয়ে উড়ে যেতো বউকথাটির পাশে।
কেউ কেউ ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে বন্দুক আনতো। তল্লা বাঁশের আগা দিয়ে তৈরী বন্দুক। বন্দুকের ফুঁটাতে কাঠগোলের বিচি ঢুকিয়ে পিস্টনের মতো সরু লাঠি দিয়ে জোড়ে ধাক্কা দিলেই ঠাস করে ফুটে উঠতো। হালকা ধোঁয়া বের হতো বন্দুকের নল দিয়ে। কাঠগোল না পাওয়া গেলে কচুর পাতা দুমড়ে মুচড়ে ঢুকিয়ে ধাক্কা দিলেও অমন শব্দ হতো। কেউ আবার সাইকেলের স্পোক দিয়ে পটকা বানাতো। ম্যাচের বারুদ ঠেসে ঢুকানো হতো স্পোকের মাথায় থাকা বল্টুতে, তারপর মাপমতো পেরেক ঢুকিয়ে দেয়ালে আঘাত করলেই পিস্তলের মতো অনেক শব্দ হতো। টিনের পিস্তল কেনা হতো না যাদের এটাই ছিল তাদের ভরসা। রিলের মতো প্যাঁচানো গুলি পাওয়া যেতো। লম্বা কাগজের মধ্যে হালকা উঁচু বারুদ সাপের মতো প্যাচানো থাকনো। বারুদে আঙুল রেখে ইট অথবা শানের উপর ঘঁষা দিলেই শব্দ করে ফুটে উঠতো।
একবার সামিউলের ব্যাগের মধ্যে অনেকগুলো পটকা পাওয়া গেল। স্যার পড়াচ্ছিলেন আর পেছনে বসে বসে সামিউল পটকা নিয়ে দুষ্টামি করছিল। অনেকবার সাবধান করার পরেও সামিউল শোনে নি। এর কিছুক্ষণ পরেই স্যার ওকে এমন মার মারলেন যে সামিউল সহ্য করতে না পেরে স্যারকে গালি দিতে শুরু করে—’ওই নটি মাগীর ব্যাটা, ঘুপশি মাগীর ব্যাটা কী করছি হামি! চুদির ব্যাটা স্যার দেখিস তোর হামি কী করি!’ চিৎকার করতে করতে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর কয়েক দিন স্কুলে আসে নি ভয়ে। শুনেছিলাম সামিউলের খুব জ্বর হয় তারপর। ওর আব্বাকে ভয় করতো সবাই তাই বাড়ির কাছে গিয়েও আর ঢুকতে পারতাম না। স্যারও দেখতে গিয়েছিল ওকে।
স্কুলের পাশধরে লম্বা খাল। সারা বছরই জটিল শ্যাওলায় ভরা থাকতো। কলমির ডাল ভেঙে ছুড়ে মারতাম পানিতে। ডালের আঠায় শ্যাওলা চিড়ে চিড়ে এগিয়ে যেতো পানি। দেখতে, বিদ্যুত চমকনোর মতো লাগতো। এই খালের শেষ মাথাতেই ধরমপুর বাজার। আব্বুর ডিস্পেনসারি। ভাঁজ করা কাঠের পাল্লা দেওয়া ঘর। নিচে পানি। স্কুল ছুটির পর মাঝে মাঝেই ডিসপেনসারিতে যেতাম। তখন প্রতিদিন রাতে আব্বু আমার জন্য মিষ্টি আনতো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা মিষ্টি আর শবরি কলা খেতাম। মিষ্টি না পেলে বাড়ি মাথায় তুলতাম। আব্বুর দোকানে যেতাম হোমিওপ্যাথির ছোট ছোট মিষ্টি গুঁড়া খাওয়ার লোভে। আব্বু যদি আমাকে বসিয়ে একটু বাইরে যেত তখনি ঝটপট কাচের শিশি থেকে মিষ্টি গুঁড়া ঢেলে মুখ ভর্তি করে নিতাম। আবার আব্বু আসার আগেই হাওয়া করে ফেলতাম। যেন কিছুই হয় নি। একবার হাত থেকে শিশি পড়ে সব সুগার গড়িয়ে পড়ে সারা মেঝেতে। ভয়ে জিউ শুকিয়ে গেছে আমার। দ্রুত ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করি। একেকটা ছোট ছোট দানা যখন টুপটুপ করে পানিতে গড়িয়ে পড়ছে, মনে হচ্ছিল—দানাগুলো মাছের চোখের থেকে ঘ্রাণ নিয়ে অনন্তকাল ধরে ডুবতে থাকবে পানিতে। তারপর যেদিন সোনালু ফুলের গাছটি হলুদ হলুদ হয়ে ঝুঁকে পড়বে ছায়ায়, সেদিন অরিয়ন নক্ষত্রের সাথে কথা হবে তাদের। আলোর বাবল হয়ে উড়ে যাবে বিষ্ণু তারার পাশে।
আমাদের সময় ছিল ইকোনো ডিএক্সের। আমাদের সময় ছিল রাইটার কলমের। আর ছিল রেডলিফ। আমি বিশ্বাস করতাম রেডলিফ কলম দিয়ে পরীক্ষা দিলেই পাশ। রিফিল করা যেত। ভেতরে ছোট্ট তুলা থাকতো। নিচে সরিষার তেলের মতো লিকুইড। একদম পরিস্কার হয়ে কালি নেমে যেত। ইকোনো বা রাইটার দিয়ে লেখলে একটু পর পরই নিবে কালি জমে যেত। তালুতে মুছে নিতাম। সারা তালু কালির দাগে ভরে থাকতো। কতদিন আব্বুর কাছে রেডলিফ কলম কিনে চেয়েছি কিন্তু দিত না। দাম বেশি ছিল বলে। আট টাকা বা দশ টাকা দাম ছিল রেডলিফের। আমার ইকোনো আর রাইটারের ফুঁটা দিয়ে শরিষার তেল ঢেলে দিতাম। ভাবতাম রেডলিফের মতো আচরণ করবে। সে ভাবা অহেতুকই থেকে যেত। স্কুলের শাদা শার্ট আর নেভি ব্লু প্যান্টের পকেট মেখে যেত কালির দাগে। নিউজপ্রিন্ট কাগজকে বলতাম ভোশকা কাগজ আর ছিল কর্ণফুলি। কাগজের তাও কিনতাম, ২৪ তাওয়ে এক দিস্তা। সূর্যের আলোয় কর্ণফুলি কাগজ পরখ করতাম, মাঝখানে কশিটানা দাগ।
প্রথম প্রথম পরীক্ষায় সব প্রশ্নেরই উত্তর করতাম। মনে আছে, যেদিন স্কুলের প্রথম পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এলাম, মা জিজ্ঞাসা করলো কোন কোন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, আমি বললাম, সবগুলো। মা মন খারাপ করেছিল। অনেক পরে বুঝতে পারি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই।
তখন বোধ’য় ক্লাশ থ্রিতে পড়ি। একজন শিক্ষক রাখা হলো আমাদের জন্য। অদ্ভুত ছিলেন তিনি। খুবই বেখেয়ালি গোছের। গ্রামেই কার বাড়িতে যেন জায়গির থাকতেন। প্রতিদিনই পড়াতে আসতেন বিকালে। আমার একদম ভালো লাগতো না ওই সময়ে পড়তে। পড়া না পারলেই দুই আঙুলে পেটের চামড়া ধরে টান মারতেন। জান বের হয়ে যেতো। কতদিন স্কুলের পথে তার জানালায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেরেছি আমি।
আমরা তখন সিমেন্টের বস্তা দিয়ে বই মলাট করতাম। মলাট করা বই একদম ভালো লাগে না। ওই যে প্রচ্ছদের ছবি, তার তিন কালারের রঙ, তারার গাঁয়ে যে শ্যাওলা জমে তার মতো ঘ্রাণ—সবই উধাও হয়ে যায়। ন্যাড়া মাথা ছেলেদের মতো লাগে বইগুলো। খসখসে আর হৃদয়হীন। সেদিন বিকালে স্যার এসে আমাদের বই মলাট করে দিলেন। পায়ের নিচে বই রেখে সেলাইও করে দিলেন। উনি যখন পায়ের নিচে বই নিয়ে ফোঁড় ঢুকাচ্ছেন আতঙ্কে কাঁপছিলাম আমি। ভুলেও যদি পায়ে কখনো বই লাগতো হাজার বার সালাম করতাম। বই মন্নি দিলে কারো পড়ালেখা হয় না এই ভয়ে। কিন্তু স্যার কী অবলীলায় সেলাই করছেন বই। আমি বললাম—’স্যার, বইগুলা তো আপনেক মন্নি দিবি!’ স্যার হাসতে হাসতে বলেন—’বই কোনোদিন মন্নি দেয়? দেয় না। বইয়ের কি জান আছে? নাই। খালি ধর্মের বই বাদ দিয়ে সবই ইংকে করে সিলেই করা যাবি’। আমার কেমন যেন বিশ্বাস হতে থাকে স্যারের কথা। সেদিনের মলাট করা বই ছিল খুবই সুন্দর। ক্যালেন্ডারে ছিল ইরানি মিনিয়েচার। রূপকথার লেজঝোলা পাখি, সোহরাব আর রুস্তমের ঘোড়া, সারিসারি গোলাপ, মসজিদের কারুকাজ করা কার্পেট। বুকের মধ্যে বই নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। স্বপ্নে লেজঝোলা পাখিটার সাথে কথা হতো আমার। সে আমাকে চন্দ্রপথের গল্প শোনাতো। চেরি আর পাইনবনের মধ্যে উড়ে বেড়ানোর কথা বলতো। মধ্য দুপুরে যখন বাড়ি ফিরতাম সেলুনে কারবালার ঘোড়া দেখে পাখিটার ডাক শুনতে পেতাম। পৃথিবীর এই পথেই কত শিশু অনন্ত গুল্মের পত্রছায়ায় নিজেকে হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছে মাটির ধুলায়। মর্মর ধ্বনির শেষে যে নিস্তব্ধতা বনের শষ্পমূলে ভর করে তার দিকে চেয়েই খুঁজতে বেরিয়েছে জীবন। যেখানে মা ও মায়াবন দুই-ই সঙ্গী হয়েছে তার।