যেখানে ঝরাপাতা নিজের শব্দে বন
৬.
চক-স্লেট আর শিশুশিক্ষার পাট চুকিয়ে ভেতরে ভেতরে কখন যে স্কুলের ভর্তির দিন এলো বুঝতেই পারি নি। স্কুলের কথা শুনলেই ভয় পেতাম। সেটা কি এত দিনের মুক্তি ছোট হয়ে যাবে বলে! সকালের ছোট বই গুটিয়ে পরনে গামছা বেঁধে পুবের ধানখেত পেছনে ফেলে আর সুবিলে যাওয়া হবে না বলে! অথচ তখনো কাছেই সুবিল, তার ছোট নদীর রূপ নিয়ে অনন্ত কাশবনে শান্ত বয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কোনো কোনো দিন আব্বু আর আমি মাছ ধরতে যেতাম এই নদীতেই। আমার হালে খলি আর আব্বুর হাতে তৌরা জাল। প্রচুর অ্যাকাশিয়ার পাতা পড়ে থাকে পানিতে। জাল টানলে মাছের সাথে সাথে পাতাও আসে প্রচুর। কর্তি মাছ, পাতাসি মাছ, কৈ । সুবিল ধরে হাঁটতে হাঁটতে অজানা কত গাঁয়ে চলে যেতাম। সেসব গাঁয়ের পথে আর যেতে পারবো! শুনতাম, সকাল থেকে বিকাল অব্দি স্কুল। সম্ভবত সেটাও কারণ ছিল না ভয়ের। স্কুলে ভর্তি হবার কথা ভাবলেই আমার মনে হতো প্রকাণ্ড কোনো মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে অনবরত ঘুরানো হবে আমাকে। এভাবে ঘুরাতে ঘুরাতে এক সময় ভর্তি হয়ে যাবো আমি। তাই ভর্তির কথা শুনলেই পালিয়ে যেতাম। বেশ কয়েক দিন পালিয়েছি এমন।
সেদিন আর পালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। আমাকে আর ভাইকে একসাথে গোসল করিয়ে মাথায় তেল দিয়ে সিঁথি করে চুল আচড়ে দিল মা। তারপর খেতে বসালো। খাওয়া শেষ করে মুঞ্জু চাচাকে বললো আমাদেরকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে।
মা আর মুঞ্জু চাচার কাছেই পড়তে বসতাম আমরা। অনেক ভালো পড়াতো চাচা। রাগ ছিল খুব। পড়া না পারলে গণহারে মার খেতাম। ইংলিশ প্যান্ট পড়তাম তখন। চাচা রানের উপর থাপড় মারতো। যে পড়া হতো না আমি আগ বাড়িয়ে চাচাকে ওই পড়াই ধরতে বলতাম। চাচা ধরতো না। তখন যে পড়াটা আমার হয়েছে সেটা ধরতো। রচনা মুখস্থ করতে জান বের হয়ে যেতো। একবার রচনা মুখস্থ ধরলো চাচা। একটা প্যারা পারি তো আরেকটা পারি না। জানতাম চাচা মারবে। এবং চড়টা পড়বে রানের উপরেই। রাইটার কলম ব্যবহার করতাম, নিব ছিল লম্বা। আমি রানের উপর কলমের নিবটা উঁচু করে ধরে রাখলাম। কিছুক্ষণ পরেই চাচা থাপ্পর মারতেই কলমের নিবটা তালুতে ঢুকে গেল। চাচা উহ্ শব্দ করে কঁকিয়ে উঠলো। কড় কড় চোখে আমার দিকে তাকালো। বুঝতে পেরেছিল বোধ’য়। ভয়ে আমার আত্মারাম কাঁপছে। কিন্তু কিছুই বলে নি সেদিন। আমাকে তো ভালোবাসতো মুঞ্জু চাচা। আইনুল চাচা, হান্নান চাচা আমাদের বাড়িতে এলে নাবিস্কো চকলেট নিয়ে আসতো। তারা সবাই তখন বেকার। চাচিও আসতো। তখনো বিয়ে হয় নি চাচার সঙ্গে। চাচির সঙ্গে তার এক ভাগ্নীও থাকতো। চাচির বান্ধবী ছিল সে। কী সুন্দর দেখতে। আমি তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। চাচি এলে কল কল করতো বাড়ি। মার সঙ্গে খুব ভাব ছিল চাচির। আমি দুষ্টামি করে তখনই চাচি ডাকতাম তাকে। আমার চাচি ছিল ছিপছিপে সুন্দর। অত সুন্দর আমি দেখি নি তখনো।
চাচার সঙ্গে আমি আর ভাই স্কুলের দিকে যাচ্ছি। অতদূর অব্দি পথ এর আগে যাই নি কখনো। আমবাগানের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা। ভয়ে ধিপ ধিপ করছে বুক। আজ যখন সেই বালকের দিকে তাকাই, মনে হয় একা মাঠের মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে ছেলেটি মুঠ করা আঙুলের ফাঁকে ছোট্ট শামুক বাজিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও। দূরে, সাবানের ফ্যাক্টরি। চিমনিতে আবহমানতার ধোঁয়া। নিষ্পত্র গাছের নিচে একটি বাছুর তার ছায়ার দিকে তাকিয়ে চুষে নিচ্ছে দুধের রোদ। এইসব দেখতে দেখতে ছেলেটি চলে যাচ্ছে পুবের ধরমপুর, আলুখেত ছাড়িয়ে সূর্যাস্তে সাজানো ক্রন্দসীর দিকে। যেন ওই দিকেই অপেক্ষা করছে কোনো সৌগত তার ধানগন্ধের পাশে। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পাই না আমি। অনেক হাঁটতে হয়েছিল সেদিন স্কুলে যেতে। সব রাস্তাই দীর্ঘ ছিল তখন। কারোর আশায় তাকিয়ে থাকার মতো দীর্ঘতা ভর করতো সব রাস্তায়। মনে মনে ভাবছিলাম, বৃষ্টি আসুক, ঝড় উঠুক। তাহলে বাড়ি ফিরে যাবো। সেসবের কোনো লক্ষণই ছিল না সেদিন। ঝরঝরে গদ্যের মতো দিন।
এক সময় ঠিকই পৌঁছে গেলাম। স্কুল-প্রাঙ্গনে ঢুকতে কোনো বালাই-ই নেই দরজার। গরু-ছাগলও ঢুকতে পারে অনায়াসে। নাক বরাবর পাকা করা তিনটা কি চারটা ঘর। টিনশেড বিল্ডিং। হাতের ডানে বহু পুরাতন ঘর। টিনগুলো ঝাঁঝরা হয়েছে সেই কতদিন আগে। দেখার কেউ নেই তাদের। অভিভাবকহীন ঔদার্যে দিন কাটছে। এবড়ো থেবড়ো বারান্দায় মোটা মোটা চৌকো পিলার। শ্যাওলার সখ্যে আপ্লুত। থাকা না থাকার মাঝখানে ঝুলে আছে পলেস্তরা। একটা খাল—নালাই বলা ভালো। স্কুলের বাঁ দিয়ে সোজা ধরমপুর বাজারের দিকে চলে গেছে। পাশেই রাস্তা। ইটের জিগজ্যাগ। তারপরেই বিশাল আমবাগান। স্কুলমাঠের এক ধারে খালের পাশে একটা জিগার গাছ, একটা গামারের বড় গাছ। টুপটাপ গোটা পড়ছে। গাছের নিচেই সন্দেশঅলা বসে। কালো-শাদা সন্দেশ পাওয়া যায়। দুধমালাই, নারকেল মালাই আর পাইপ-আইস্ক্রিম নিয়ে বসে কয়েকজন। স্কুলের পেছনে সুদীর্ঘ বাঁশবন। বায়ে ঘরবাড়ি। ধরমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল এমনই।
চাচা হেড স্যারের রুমে নিয়ে গেলো আমাকে আর ভাইকে। একটা স্টিলের আলমারি দেখে ভয় পেতে শুরু করলাম আমি। এই তো সেই যন্ত্র যেখানে ঢুকানো হবে আমাকে তারপরেই শুরু হবে ঘূর্ণন। বারবার এদিক ওদিক তাকাতে থাকি। এই হয়তো কেউ এসে আমাকে জোর করে ঢুকাবে। অদ্ভুত এক আতঙ্ক! মাকে কয়েকবার বলেছিলাম। মা শুধু হাসতো আর বলতো—’তাই আবার ক্যাংকা কথা! ওংকা মেশিন নাই বাবা। স্যারেরা পোশনো করবি তুই খালি উত্তুর দিবু। ব্যস ভর্তি করে নিবি তোক’। আসার সময়ও মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে যেন ঠিকঠাক পারি। কিন্তু এই রুমেই তো ভর্তির মেশিন দেখছি আমি। মাকে অবিশ্বাস হয় আমার। এর মধ্যে হেড স্যার আমাকে প্রশ্ন করতে থাকেন, পটপট উত্তর দিতে থাকি। অথচ আমার সমস্ত মনোযোগ তখন স্টিলআলমারিরূপী মেশিনের দিকে। হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে কে যেন আলমারিটা খুলে ফেলে, আমি চমকে উঠি। কিছুই ঘটে না। এক সময় ভর্তি করে নেয় আমাকে আর ভাইকে। বড় ওয়ানে। কয়েকটা বই দেয়। কী সুন্দর বই! বই পেয়ে আনন্দ হয় খুব। চাচা আমাকে আর ভাইকে সোজা বাড়িতে যেতে বলে কোথায় যেন চলে যায়। সারাটা রাস্তা আমি শুধু বইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে ধরমপুর বাজারের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। ওই রাস্তাটা চেনা ছিল না আমার, ভাই চিনতো। সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। একটা দোকান থেকে পলিথিন ব্যাগ চেয়ে নিয়ে বইগুলো ঢুকিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখি। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরি সেদিন।
পঞ্চম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন