যেখানে ঝরাপাতা নিজের শব্দে বন | হাসান রোবায়েত | পর্ব ৫

যেখানে ঝরাপাতা নিজের শব্দে বন

 

তখন শীতকাল। খুব সকালে উঠতাম আমরা। খোলায় নাড়ার আগুন জ্বেলে তাপ পোহাতাম। বেশিক্ষণ থাকা যেতো না। মা বাড়ির ভেতর থেকে মুহুর্মুহু ডাক পারতো। অগত্যা যেতেই হতো ঘরে। আব্বু বাড়িতে থাকলে মার সব কথাই শুনতাম। টেবিলের উপর থেকে শিশুশিক্ষা বই নিয়ে বারান্দায় পড়তে বসতাম আমি আর ভাই। বেতের কাঠায় মুড়ি আর গুড় নিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতাম। নানান রঙের কবিতা। জোরে জোরে পড়তাম। পড়তে পড়তে এক সময় নেশা লেগে যেতো। 

 

পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল।

কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।।  

রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। 

 

এই পর্যন্ত পড়তে বেশ লাগতো আমার। বাড়ির লাল-পেয়ারার গাছে, আমবাগানের ডালে, সামনের পুকুরে যেতে বাঁশের আড়ায় সন্ধ্যার সময় কত পাখি ডাকতো। বেশি আসতো গাঙশালিক। ওদের বাসা ছিল গাছের ফোঁকরে। কাঠঠোকরা পাখিগুলো সারা মাস কিট-কিট-কিট-কিট করে ডাকতো আর ঠুকরে ঠুকরে খোড়ল বানাতো গাছ। সেখানেই গাঙশালিকের বাসা। মীর আলম আর আমি সারাদিন এসব বাসা খুঁজে বেড়তাম। [মীর আলম আমার বন্ধু। আমাদের বাড়ির পেছনেই ওদের বাড়ি। ওর বোন স্বপ্না আপা আমাকে আদর করতো খুব। চাল ভাজলে মিষ্টি কুমড়ার বিচি ভাজলে স্বপ্না আপা ডেকে ডেকে খাওয়াতো। মার সঙ্গে ভাব ছিল ওর।]  আর সাপের ভয়ে ভয়ে পাঁচ আঙুল সুঁচালো করে ঢুকিয়ে দিতাম খোড়লে। ভেতরে কী গরম! মা পাখিরা থাকলে ইচ্ছামতোন ঠুকরে দিত। সেই আঘাত সাপের ছোবল ভেবে দ্রুত বার করতাম হাত। টিয়া পাখিও আসতো। মীর আলম বলতো টিয়ারা নাকি লাল মরিচ খায়। আমি তো কতদিনই মার ডালা থেকে লাল মরিচ নিয়ে ডাবের গাছে বসা টিয়াটির দিকে তাকিয়ে লাল মরিচ নিয়ে যেতে বলতাম। কখনোই আসে নি তারা। সবচেয়ে ভালো লাগতো টুনটুনি পাখির বাসা। টুনটুনি টুন টুনালো/ সাত রাণীর নাক কাটালো। মাকে ফিরে ফিরে বলতাম, ‘মা ওই কিস্তেডা কন না!’ মা বলতো, ‘কোনডা’। আমি বলতাম, ‘উ যে—হামার ঘরোত যা আছে রাজার ঘরোত তাই আছে।’ মা তখন শুয়ে দুই হাঁটু ভাঁজ করে আমাকে পায়ের পাতার উপর বসিয়ে দোলা দিতে দিতে বলতো কিভাবে টুনটুনি পাখিটা রাজপ্রাসাদের ছাদে শুকাতে দেওয়া টাকা ঠোঁটে করে নিজের বাসায় নিয়ে যায় আর জানালায় বসে মন্ত্রী-আমাত্যদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে ‘রাজার ঘরে যা আছে আমার ঘরেও তা আছে’। রাজা রেগে গিয়ে একে একে সাত রাণীর নাক কেটে দেয়। এসব শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম আমি। পরদিন আবার পড়া শেষ করেই মীর আলমের সাথে চলে যেতাম টুনটুনির খোঁজে। একবার তল্লা বাঁশের ঝোঁপে এক জোড়া টুনটুনির বাসা খুঁজে পেলাম। খোশকার দুইটা পাতা একসাথে সেলাই করা। ভেতরে দুইটা বাচ্চা। আমাকে দেখেই একটা টুনি ফুড়ুৎ। ভেতর থেকে বাচ্চা দুইটা নিয়ে সোজা আমাদের গোয়াল ঘরে। খড় পেঁচিয়ে নতুন বাসা করে দিলাম। কিন্তু কিছুতেই থাকে না ওরা। নানান রকম বুদ্ধি করছি। কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। মা আমাদের ফিসফাস টের পেয়ে গোয়াল ঘরে এসে বাচ্চাগুলোকে দেখেই বলতে লাগলো—’যা এই মুহূর্তে থুয়ে আয়’। আমি তো যাবো না। মা বললো—’বাচ্চা দুডের মা মন্নি দিবি। পাখিরা মন্নি দিলে পড়া হয় না। যা যা তাড়াতাড়ি থুয়ে আয়।’ কিছুতেই আমাদের মন চায় না ওদের রেখে আসতে। কিন্তু যদি মন্নি লাগে সেই ভয়ে রেখে আসলাম। পরের দিন আবার দেখতে গেলাম। এমন করে প্রতিদিনই যাই। একদিন দেখি বাসাটা আর নেই সেখানে। পাতা দুটোর বোঁটা ছিঁড়ে কে যেন নিয়ে গেছে। হয়তো আমাদেরকে লক্ষ্য করে অন্য কেউ দেখেছিল বাসাটা। মন খারাপ হয় আমার। তারপর অনেক দিন পর্যন্ত দুপুরে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে দেখতাম, একটা বাঁশপাতারি সাপ খোশকার গাছ বেয়ে বেয়ে তার চিকন জিহবা লকলক করে এগিয়ে দিচ্ছে বাচ্চা দুটোর দিকে। খুব চিৎকার করছে মা পাখিটা। সেই পাখিটার ডাক কতদিন শিমফুলের পাশে ফুটেছিল আমর্ম সবুজ হয়ে। 

 

তখন কবিতার কোনো মানে ছিল না। কেবল পড়ার আনন্দ আর পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তি জুড়ে বিছিয়ে থাকতো কল্পনার ঢেউ। আমার শিশুশিক্ষা আর নামতা পড়ার সময় ছিল রাখাল ছেলের, বিলভরা কচুরিপানা আর কাঠগোল পাতার সাথে হেমন্তের ছাঁচ। যেখানে সারাক্ষণ পাতায়-পাতায় পড়ে নিশির শিশির।


পর্ব ৪ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার