যুগন্ধরের ব্রত | আল ইমরান সিদ্দিকী


পঞ্চাশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে গিয়ে সত্তর ও আশির শুরুতে বাংলা কবিতা যে-বেহাল দশায় পৌঁছেছিল, সেটা আমরা ঠিক আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সাধারণ পাঠক আজও পড়তে বা শখ করে লিখতে চেষ্টা করলে ঠিক সত্তরের কবিদের মতো করেই লিখে।


 

কালো বিদ্যুৎ চমকায়, আহা, শোঁ-শোঁ কালো হাওয়া ধমকায়, ভাই,
কালো সূর্যটা জ্বেলে কালো রোদ প্রাণ জড়ে মোর শঙ্কায়, ভাই।
আমি কোন্ দিকে কোন্ বোন-ঝিকে ডাকব, বাড়ায়ে অন্ধের হাত!
ভালো কালো রাত, কালো আখেরাত, কালো ধারাপাত কর্ আঁধিয়ার;
সকল কালোর সেরা কালো তুই,- আয়, আমি শুই- শব-এ-বরাত!
গ্র্যানিট-কঠিন এ-কফিন মম আজ হোক তমোপহ হাতিয়ার!
কালোতে কালোতে কাটাকাটি হবে, লাঠালাঠি হবে লঙ্কায়, ভাই,
রগ-রঙ-চটা কালো সূর্যটা নীল হ’য়ে যাবে শঙ্কায়, ভাই!

(ম্যাকাবার)

 

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতাকে ঘিরে আমার বিশেষ মুগ্ধতা রয়েছে, এবং আপাতত দ্বিতীয় বারের মতো আমি চেষ্টা করছি, তাকে নিয়ে কিছু লেখা যায় কিনা। তাঁর কবিতাকর্মের  যে ব্যাপ্তি এবং ব্যাপ্তি ও বিচিত্রতায় যে আভিজাত্য লালন করে ‘সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতা’, তা নিয়ে কিছু বলাটা সহজ নয়, আদতে কোনোভাবেই সহজ নয় এই সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ।

পঞ্চাশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে গিয়ে সত্তর ও আশির শুরুতে বাংলা কবিতা যে-বেহাল দশায় পৌঁছেছিল, সেটা আমরা ঠিক আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সাধারণ পাঠক আজও পড়তে বা শখ করে লিখতে চেষ্টা করলে ঠিক সত্তরের কবিদের মতো করেই লিখে। যা এখনও অনেকের কাছে ক্লান্তিকর মনে হয় না, তা তৎকালে যাদের কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়েছে, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

সুকবির চোখে সবকিছু সবার আগে ধরা পড়ে, একঘেয়েমির জায়গাগুলি তারা যেমন ধরতে পারেন, তেমনি একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার রাস্তা বানাতেও তারা পারঙ্গম। আশির দশকে কবিতার বাঁক-বদল করতে যারা আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের যুবরাজ হলেন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। বিবৃতি, ছন্দশৈথিল্য ইত্যাদির বিপরীতে তিনিই যতটা লড়েছেন, তার সমসাময়িক আর কারো লড়াই এতটা শ্রমমুখর, এতটা সাহসিকতার হয়ে উঠতে পারেনি। ফলতঃ এও মনে হতে পারে, লড়াই তিনি একাই করেছেন। আসলে এখনও করছেন; ঐ যে বললাম আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

সাহিত্যে ‘থমকে থাকা’ আছে, ‘এগিয়ে যাওয়া’ আছে কিন্তু ‘পিছনে যাওয়া’ বলে কিছু নেই। আবার সাহিত্যে আমরা যুগন্ধর কবির কথা সচরাচর বললেও যুগন্ধর পাঠক-সমালোচকের প্রসঙ্গ কখনও আনি না! যুগ বদলায় যুগন্ধর কবি ও পাঠক-সমালোচকের সম্মিলনে। সবাই মিল্টন বা মধুসূদনের পাঠক হয়ে উঠতে পারে না, পারে না সুব্রত অগাস্টিন গোমেজরও পাঠক হতে। যা হোক, পূর্ববর্তী কবিদের বাচালতা, ছন্দশৈথিল্য, উপরিতলসর্বস্ব কবিতা হটাতে গিয়ে অনেক পেছন থেকে নিজের রসদ সংগ্রহ করার ভিতর দিয়ে সুব্রত গোমেজ বাংলাদেশের কবিতাকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন; নিজ ভাষার ভাণ্ডারে চর্যাপদ থেকে মধুসূদন অব্দি হাতড়িয়েছেন। আপন যুগ, আপন সময়ের সাথে এসবের সম্মিলন ঘটিয়েছেন অনন্য দক্ষতায়।

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ যেমন সব ধরণের বাংলা ছন্দে লিখেছেন, তেমনি ছন্দের ভিতরকার বৈচিত্র‌্যকে তিনি ঈর্ষণীয় দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যদি তাঁর কবিতা থেকে কথাগুলিকে ফেলে দেই, তাহলে কী থাকবে?  যা থাকবে তাকে বলবো, ‘ধ্বনিকাঠামো’। দুর্দান্ত সব স্ট্রাকচার। রং, চুন, বালি খসে যাওয়া দালানের মতো বা নির্মাণাধীন এক দালানের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে, যাতে শুধু  রং মারা বাকী ,বাকী থাকবে দরজা-জানালা লাগলোর কাজ; দাঁড়িয়ে আছে তার সুরেলা স্বরূপ নিয়ে। পুরো মহাবিশ্বই এরকম। শেপ আর পেটার্নের খেলা; তাতে যুক্ত হয় রং, জ্যোতি আর গতি —জেগে ওঠে আশ্চর্য সঙ্গীত। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ তেমন সঙ্গীতই সৃষ্টি করেছেন। অনায়াসে তিনি লিখে ফেলেন:

রাত : তকরার- একবার যদি পড়শি আমায় ছুঁতো!
গলন্ত-লোহা-বহা যমুনায় খেয়া দেয় নিশি-কানু;
শরীর পালায় শরীরীকে ফেলে; সময়ের চেয়ে দ্রত,
একটা মানুষ হবে ব’লে, ছোটে এক-ট্রেন শুক্রাণু!

উৎকণ্ঠার ন্যায় নিঃসীম পদ্মার বিস্ফার,
শাহ্ মখদুম দুম দুম হয় হার্ডিন্জ্ ব্রিজ পার।

 

বাংলাদেশের কবিতায় সংস্কৃত ছন্দের চর্চাটাও তিনিই শুরু করেছিলেন তার বিখ্যাত ‘নাগপঞ্চমী’ দিয়ে, তোটক ছন্দের পাঁচ রকম বিন্যাস এনে। পাশাপাশি তিনি মন্দাক্রান্তা, প্রহর্ষিনী, শার্দূলবিক্রীড়িত, বসন্ততিলকসহ আরও বেশকিছু সংস্কৃত ছন্দে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন। আমি বিশ্বাস করি গত অর্ধ শতাব্দিতে আর কোনো কবি বাংলাদেশের কবিতাকে এতটা সমৃদ্ধ করেনি।

তাঁর কবিতার যে-দিকটা আমাকে বিশেষভাবে ভাবায়, তা হলো তার সম্মিলন ঘটানোর ক্ষমতা। পূর্ব-পশ্চিমের হাজারও মিথ-পুরাণ, ঘটনা-দুর্ঘটনা, তত্ত্ব-তথ্য, নব্য মিথে তাঁর কবিতা ভরপুর; বিপুল কলরবে গড়া এক বিশাল জগৎ! কয়েক শত বছরের বাংলা কবিতায় এত বেশি আয়োজন, এত বেশি সম্মিলন আর কোনো কবির কবিতায় দেখা যায়নি। দুই হাতে কবিতা লিখেছেন বিগত কয়েক দশক ধরে; তিনি এমন একজন কবি, যিনি তাঁর সঞ্চয় ও অপচয়, উভয়ের সহাবস্থান দ্বারা মহিমান্বিত।

বড় কবি মাত্রই তাঁর আপন ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্ব করেন। আবার একই সাথে বৈশ্বিক চেতনার অধিকারী হন, কিছুই তার দৃষ্টির বাইরে অবস্থান করে না। এই এক ভূখণ্ড বাংলাদেশ, কত কবি একে কতভাবে তুলে ধরলেন! রবীন্দ্রনাথ, জসীম উদ্‌দীন থেকে শুরু করে জীবনানন্দ, আল মাহমুদ হয়ে আরও অনেক কবি। আপন ভূখণ্ডকে  তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের প্রয়াসকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। এক জনের আঁকা ভূখণ্ড অপর জনের মতো নয় —সুব্রত অগাস্টিন গোমেজও তেমনই। তাঁর নিশি-কানু গলন্ত-লোহা-বহা যমুনায় খেয়া দেয়, তাঁর ঊষার শিশির চোয়ানো-ওয়াইন-হেন গ’লে পড়ে, তাঁর দুপুর ঘনায় চোয়ানো-ওয়াইন-হেন, তাঁর নামাজ কাজা করা উড়ন্ত দগ্ধ তোতার জেনিথে ওজন ফুটো হয়ে গেল। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক সম্মিলনের ভিতর দিয়ে নিজ ভূখণ্ডকে তুলে ধরা, এটাই তাঁর কাজ।

কিন্তু তিনি কি এই কাজটাই করতে চেয়েছেন?  মনে হয় না। তাঁর ইচ্ছা মূলত মেসাকার করে ফেলা। কিসের সাথে কিসের সংমিশ্রণ যে তিনি ঘটাননি, সেটা ভেবে হয়রান হতে হয়! ধর্মীয় আবহ, মিথ, কালচারের সাথে অপর ধর্মের মিথ-কালচারের সংমিশ্রণ, ভূগোলের সাথে ভূগোলের, প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে পুঁথির ভাষার, লোকসঙ্গীতের ভাষার, বৈদিক মন্ত্রের ভাষার, চর্যাপদের ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষার ও প্রাচ্যের লেখ্য-কথ্য ভাষার বহু শব্দের সাথে বহু শব্দের প্রাণসঞ্চারী সংযোগ ঘটিয়েছেন বাক্য থেকে বাক্যে, কবিতা থেকে কবিতায়। তা না হলে কীভাবে তিনি বেদনামিশ্রিত ঠাট্টা উপহার দিয়ে বলতে পারেন:

রক্ত কাঁদে শৈলক্রুশে, টাইটান
স্বপ্নপুরোবর্তী, তুমি আইতান?

 

এই তার ভিতর জেগে উঠছে ধর্ষকাম, তো এই মর্ষকাম। এই তিনি সংহারক, তো এই তিনি ত্রাণকর্তা। এই বলছেন , ‘ক্ষমো, তপ্ত অন্ধকার, মাতৃগর্ভ মম, ক্ষমো, নিশা, ক্ষমো, সাথি, নীরন্ধ্র নির্বেদ’,  তো এই বলছেন, ‘ অক্কে-নক্কে মারো সাঁই, তক্কে-তক্কে থাকো, ছেন্দা খোঁজো সান্ধাবারে লোহার বাসরে’।

তাঁর কবিতা নিয়ে আরও অনেক বলার আছে আমাদের। তাঁর কাজের ব্যাপ্তি এত বেশি যে স্বল্প পরিসরে বলাটা অসম্ভব। তাঁর কবিতায় যে বাস্তবতা ধরা পড়ে, তাঁর কবিতায় যে চিত্রকল্প-উপমা-উৎপ্রেক্ষার দেখা মেলে, সেসব নিয়ে বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন আছে। ২০১৬ ‘লোক’ পত্রিকার তরফ  থেকে যখন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতা নিয়ে আমাকে লিখতে বলা হলো, তখন হাজারও ঝামেলায় সেটি করা যায়নি ঠিকঠাক। তদুপরি কয়েকটি টাইপোর কারণে বক্তব্য বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আজ যখন ‘শিরিষের ডালপালা’র পক্ষ থেকে লেখা চাওয়া হলো, তখন পুরনো লেখাটি বের করে ধুলো ঝাড়া ও দুয়েকটি ছোটখাটো সংশোধন করা হলো,  কিন্তু তার বেশি আর কিছুই করা হলো না।  এই কবিকে নিয়ে খুব বড় পরিসর কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। এই লেখাটি সেই কাজের একটি খসড়া ভূমিকা আকারে থেকে গেল আজও।


 আল ইমরান সিদ্দিকী
জন্ম: ০২ অক্টোবর, ১৯৮৩ ইং, নীলফামারি। বর্তমান নিবাস: নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
পেশা: ফিন্যান্সিয়াল এনালিস্ট।

প্রকাশিত কবিতার বই: কাঠঠোকরার ঘরদোর(২০১৫, চৈতন্য), ধুপছায়াকাল (২০১৮, মেঘ), গোধূলির প্যানোরামা (২০২০, বৈভব), অচির অরোরা (২০২৩, বাতিঘর)।
সম্পাদনা: ওয়েবম্যাগ ‘নকটার্ন’ (যৌথ)।
যোগাযোগ: imran831002@gmail.com, +16096061184

শেয়ার