মৃত্যুর দুয়ারে রবীন্দ্রনাথ ।। আবদুল্লাহ আল-হারুন

ইউরোপে মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ সময়ে সঙ্গ দেওয়ার সংগঠন হজপিস। হজপিস একটা আন্দোলনও। লেখককে প্রথম বাঙালি হজপিসকর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। শতাধিক মৃত্যুসঙ্গের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ‘মৃত্যু’ হয়ে উঠেছে যার প্রিয় বিষয়। অনুবাদকর্মের পাশাপাশি তিনি মৃত্যু বিষয়ক লেখালিখি করে থাকেন। ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন’ এবং ‘মৃত্যু: একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা’র পর চলতি বইমেলায় ‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার মৃত্যুবিষয়ক চতুর্থ বই ‘মৃত্যুসঙ্গীর দিনলিপি’। বইটি মূলত লেখকের উল্লেখযোগ্য ছ’টি মৃত্যুসঙ্গের ধারাবয়ান। যেকোন ভাষায় এটি হয়তো প্রথম মৃত্যুসঙ্গের বই। ‘মৃত্যুর দুয়ারে রবীন্দ্রনাথ’ লেখাটি পাঠের মধ্য দিয়ে বইটির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী হবে আশা করা যায়। যেখানে জার্মানপ্রবাসী লেখক পরিচয় করিয়ে দেবেন তার বন্ধু রাফির সঙ্গে, যিনি মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথের মুখচ্ছবিতে যিশুর জন্মান্তর দেখেছিলেন। তো হয়ে যাক মৃত্যুসঙ্গী আবদুল্লাহ আল- হারুনের মৃত্যু কিংবা জীবনপাঠ…


বই: মৃত্যুসঙ্গীর দিনলিপি
প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রচ্ছদশিল্পী: ধ্রুব এষ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৭


প্রিয় আবু, আমি বুঝেছি মর্ত্যরে বন্ধনক্ষয় বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয় এই তো পরিত্রাণ, এই তো মহানির্বাণ। ঈশ্বরপুত্র যিশুর শূলে জীবনদানের এই তো শুভ পরিণতি। স্বয়ং তোমাদের টেগোরই আমাদের, সবার ও সারা বিশ্বের যিশু। টেগোর আর যিশু একই। দুজনেরই মুখমণ্ডল স্বর্গীয়, দুজনের রূপই পরিত্রাতার। আমার এই কথা তুমি তোমাদের দেশবাসীদের বলবে। ধর্মে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে কোনো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষ এক। ওই দেখো টেবিলে টেগোর আর যিশুর ছবি। কোনো তফাত দেখছো কি?


মৃত্যুর দুয়ারে রবীন্দ্রনাথ

এ জীবনে বহু রকম নেশার মুখোমুখি হয়েছি। কেউ দীর্ঘদিন আচ্ছন্ন রেখেছে, কেউ স্বল্প সময়েই প্রস্থান করেছে। গোঁফ গজানোর আগে থেকে প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো তরুণীর প্রেমে পড়তাম। তখন প্রতি মাসেই সুচিত্রা-উত্তমের ছবি আসত। পুরনো কাগজ বেঁচে, বাজারের পয়সা মেরে (এমনকি মাঝেমাঝে উপায়ন্তর না পেয়ে পড়ার বইও পুরনো বইয়ের দোকানে বেঁচে দিতাম) ওদের মাতাল সব রোম্যান্টিক ছবি, ম্যাটিনি শোতে দেখতাম। কোনো কোনোটা তো চারপাঁচবার দেখেও আশ মিটত না! ছবি দেখার পরই নিজেকে উত্তম কুমার মনে হতো, পাশের বাড়ির কিশোরীকে মনে হতো সুচিত্রা! চিঠি লিখে ধরা পড়ে, অভিভাবকের চেলা কাঠের পিটুনি খেয়েছি। পিঠেপিঠি বড় ভাইয়ের সঙ্গে একই মেয়ের প্রেমে পড়ে এক মহা কেলেঙ্কারি হয়ে গিয়েছিল। যাক, ওসব কথা এখানে অবান্তর।

১৫ বছর বয়সে শুরু করা ধূমপানের অভ্যেস, জার্মানে এসে ১৯৯২ সালে, সঙ্গিনীর ৫০তম জন্মদিনে (উপহার হিসেবে) ছেড়ে দিয়ে তাকে পরম আশ্চর্য করে দিয়েছিলাম। আজও ধূম্রহীন জীবন, ২০০২ এ মদ্যপানের চির অবসান! যে নেশা দু’টির সাহচর্যে জ্ঞান হবার পর থেকে আজ অবধি, ঘুমানোর সময় বাদ দিয়ে আমার জীবনযাপন। বইপড়া ও চা পান। আমি নিশ্চিত এরা উভয়েই আমার আমৃত্যু সঙ্গী। একবার ধর্ম নিয়ে আলোচনার সময় আমার সঙ্গিনীকে মুসলমানদের মৃত্যুর পর কবরে মুনকির-নকির দুই ফেরেশতার জিজ্ঞাসাবাদের গল্প বলেছিলাম। ও আমাকে বলল, কিন্তু তুমি তো প্রথমে ওদের বলবে, আগে চায়ের ও আজকের একটা দৈনিক পত্রিকার ব্যবস্থা করুন। তারপর কথাবার্তা হবে! আমার মনে হয়, এ হতেও পারে! কোনো নতুন শহরে বাসাবদল করে গেলে আমি প্রথমে খোঁজ নেই পাবলিক লাইব্রেরিটা কোথায়, বইয়ের দোকান আছে কিনা।

১৯৮৪-তে বাঙালিদের সাথে যৌথ বসবাস ছেড়ে দিয়ে, ভাইল ইম শোনবুখ নামে একটা ছোট্ট শহরে, সঙ্গিনীর সাথে ১৯৭৭-এ জন্মভূমিতে ছেড়ে আসা ঘরসংসারের পুনরুত্থান ঘটল। পার্থক্য এই, বাঙালি বধূর বদলে সাদা চামড়ার মেম সাহেব, মাতৃভাষায় মিষ্টি প্রেমালাপের বদলে কঠিন ও দাঁতভাঙা জার্মানে ভাববিনিময় (ভাষান্তরের ভুল বোঝাবুঝি ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার)। তবে প্রেমের ভিত্তিটি মজবুত থাকায় (সে সময়) কোনো অঘটন ঘটেনি। জনবসতি মাত্র ৮ হাজার এই শহরে, যে দিকেই হাঁটুন ২০/২৫ মিনিট পরেই বন-জঙ্গল। পটে আঁকা ছবি বোধহয় একেই বলে। আমার সৌভাগ্য পাবলিক লাইব্রেরি আমাদের বাসা থেকে মাত্র চার মিনিটের হাঁটা পথ। শহরটি খুবই ছোট, মিউনিসিপ্যালিটির তেমন আয় নেই। বেতন দিয়ে লাইব্রেরিয়ান রাখা এসব ছোট শহরের আয়ত্তের বাইরে। মিসেস রাফায়েলা এই শহরের অনারারি লাইব্রেরিয়ান। তার বয়স তখন ৮৪ বছর। ২০ বছর আগে পেনশন নিয়েছেন। পেশায় ছিলেন অফিস সেক্রেটারি (আমাদের দেশীয় ধারায় কেরানি বলা চলে)। স্থানীয় একটি ফার্মে ১৯ বছর বয়সে সেই যে কাজ শুরু করেছিলেন, ওখানেই ৪৫ বছর টানা একই কাজ করে অবসর নিয়েছেন তিনি। শেষ পাঁচ বছর বড় কর্তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি ছিলেন।

বাসাবদলের পরদিন কেনাকাটার জন্য সঙ্গিনীকে সাথে নিয়ে মধ্যশহর স্টাডমিটে যাওয়ার পথে বহু আকাঙ্ক্ষিত পাবলিক লাইব্রেরিটির দেখা পেলাম। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল, সপ্তাহে মাত্র তিন দিন খোলা থাকে জেনে। মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার ও শনিবার— তাও বিকেল ৩টা থেকে ৬টা! এ ছাড়া শুধু ছোটদের জন্য শনিবার সকালবেলা ৮টা থেকে ১১টা। পরদিন মিসেস রাফায়েলার সাথে পরিচয়ের যে শুভ সূচনা হলো, মাসখানেকের মধ্যেই আমরা তুমিতে নেমে এলাম। আমার সে সময়, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার শেষ পর্যায় চলছে। আইনানুযায়ী চাকরির অনুমতি নেই। সামান্য সরকারি সাহায্য পাই। সঙ্গিনী ভালো চাকরি করেন, কোনো অসুবিধা হয় না। তখন আমাদের প্রেমের মাত্র দু’বছর। আমাকে খুশি করতে তিনি নিয়মিত আমার জন্য বই, গানের ক্যাসেট কেনেন। এমনকি ৩০ কিলোমিটার দূরের শহর স্টুটগার্ট (তার চাকরিস্থল) থেকে আমি না বললেও, ওখানকার ইন্ডিয়ান স্টোর থেকে হিন্দি ছবির ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে আসেন। ওই সময়কার সামগ্রিক অবস্থায় আমার জন্য প্রযোজ্য একটি সর্বনাম প্রায়ই আমার মনে হতো। যদিও শব্দটি অস্বস্তিকর‘ঘরজামাই’ (অবশ্য শ্বশুরবাড়িতে নয়!)। শুধু জার্মান শেখার একটা দৈনন্দিন দায় ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। সুতরাং সপ্তাহে তিন দিন, প্রায় তিন ঘণ্টাই আমি মিসেস রাফায়েলার লাইব্রেরিতে নিয়মিত ও স্থায়ী পাঠক। অনেকদিনই আমি খোলার সময়ের আগেই এসে লাইব্রেরির সামনে অপেক্ষা করতাম। সন্ধ্যায় ঝাপ বন্ধ করা অবধি রাফায়েলার সাথে কথা বলতাম, পত্রপত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখতাম, নতুন আসা বইয়ের গন্ধ শুঁকতাম বা এটা-সেটা করে তাকে সাহায্য করতাম। উনি খুব খুশি হতেন। আমার সঙ্গিনী এই নিয়মিত গ্রন্থাগারে দীর্ঘ সময় অবস্থান নিয়ে কোনো অনুযোগই করতেন না। প্রথমত, ৮৪ বছরের রাফায়েলার মধ্যে উনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার কিছু দেখতেন না। পরে বলেছেন আমার ভালোবাসায় তার কোনোদিনই কোনো অবিশ্বাস ছিল না। দ্বিতীয়ত, রাফায়েলার সাথে কথা বলে আমার জার্মান শেখাটা চালু থাকবে। রাফায়েলার ইংরেজি জ্ঞান, ইয়েস নো ভেরি গুডেই সীমাবদ্ধ ছিল। ও মাঝেমাঝেই আমার কাছে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে ইংরেজি শেখার উদ্যোগ নিত, কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলত। আমি ওই সময় জার্মান বাচ্চাদের বই গোগ্রাসে পড়তাম। বেশির ভাগ রূপকথা আর সোজাসাপ্টা ছবি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ইতিহাস, ভূগোল। শ’দেড়েক ইংরেজি বই একটা শেলফে ছিল। আমি সব তিন মাসেই পড়ে ফেলেছিলাম। সীমিত অর্থের মধ্যেও রাফায়েলা মাঝেমাঝে আমার পড়ার জন্য দু-একটি ইংরেজি বই কেনার জন্য কর্তৃপক্ষকে বলতেন। এটাতে আবার আমার সঙ্গিনীর মহা আপত্তি ছিল। তার ধারণা ইংরেজি পড়লে, জার্মান শেখা ব্যাহত হবে! কথাটা কিছু ঠিকও। দুই ঈশ্বরের পূজা একসাথে হয় না!


জানো আবু, টেগোর যদি আমাদের এখানে হিটলারের সমসাময়িক হয়ে জন্ম নিতেন, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতোই না, লাখ লাখ নিষ্পাপ প্রাণের অকাল মৃত্যু হতো না। ওর গান যারা গাইত, শুনত, তারা মানুষ মারার জন্য কোনোদিনই অস্ত্র হাতে নিতে পারত না।


রাফির (রাফায়েলার সংক্ষিপ্ত রূপ, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ওকে এ নামেই ডাকত, ততদিনে আমরা সে পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, আমি হয়ে গেছি আবু) কাছে শুনেছি, আমিই নাকি এ লাইব্রেরির প্রথম নন-ইউরোপিয়ান মেম্বার। এ শহরে দুটি শ্রীলঙ্কান তামিল ও একটি শিখ পরিবার ছাড়া আমিই ওই সময় নাগাত শেষ এশিয়ান নমুনা। সঙ্গত কারণেই তামিল বা সিংজিরা কেউ লাইব্রেরিতে পদার্পণ করতেন না। দীর্ঘদিন জার্মানে থেকেও এদের স্থানীয় ভাষায় বই পড়ার মতো জার্মান জ্ঞান আহরণ খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল। মূলত উৎসাহ ও পরিবেশের অভাব এবং (তাদের মতে) এর নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়তা! আমার ঘাড়ে সঙ্গিনীর অষ্টপ্রহর চাপ ও অহর্নিশি দৃষ্টি না থাকলে আজ আমার ঘরে হাজারখানেক জার্মান বইয়ের সংগ্রহ তো দূরের কথা, সামগ্রী বিক্রয়ের বিজ্ঞাপনের কাগজও থাকত কিনা সন্দেহ। আইনস্টাইন বলেছেন, যে বিস্মিত হয় না, সে স্বাভাবিক মানুষ নয়। তার আত্মজীবনীতে পড়েছি, একবার কিশোর বয়সে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে তিনি আলোর গতিকে হারিয়ে দেবার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই পারছেন না! আলো সর্বদা তার সামনেই থাকছে। ঘুম থেকে উঠে তিনি বিস্ময়ের সাথে ভাবলেন, স্বপ্নে তো কত অসম্ভব সম্ভব হয় তাহলে তিনি কেন আলোকে হারাতে পারলেন না? ১৯০৫ এ তার বিশ্ববিখ্যাত রিলেটিভিটি থিয়োরির মূল প্রমাণটি ‘আলোর গতি সর্বদা, সর্ব পরিস্থিতিতে ও মহাশূন্যের সর্বত্র যে সমান (কনস্ট্যান্ট)’ সেটা নাকি এই বিস্ময় থেকেই তার চিন্তায় এসেছিল। প্রথম যেদিন রাফির বাসায় গেলাম, এমনি একটা বিরাট বিস্ময়ের সামনাসামনি হলাম। ও শহরের বাইরে জঙ্গলের গা ঘেঁষে, (ওর বাসাটিই শেষ, তারপরই বন) একটা ভাড়াটে বাড়িতে থাকত। নিজেদের বাড়ি যেটা শহরের মধ্যে স্বামীর সাথে মিলে করেছিল, ওটাতে ওর একমাত্র সন্তান কন্যা সান্ড্রা তার স্বামী হেলমুটকে নিয়ে থাকে। ওই বাড়িতেই নিচের তলায় ওদের একটা রেডিমেড পোশাকের দোকান। এটি রাফির মৃত স্বামী পাউল গ্রোভারের পৈত্রিক দোকান। রাফির কাছে শুনেছি, এ দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়েই ওদের আলাপ পরিচয়। দু’বছরের মাথায় ১৯২৫ এ তারা বিয়ে করেন। রাফি মৃতবৎসা, দুবার সন্তান পেটে আসে কিন্তু দুজনেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। ডাক্তাররা যখন আর কোনো আশা দিতে পারলেন না, ১৯৩২-এ দু’বছরের সান্ড্রাকে এক অনাথাশ্রম থেকে দত্তক নেন। ১৯৪৩-এ হিটলারের নির্দেশে পাউল রুশ ফ্রন্টে ৪৫ বছর বয়সে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন। সে থেকে রাফি সান্ড্রাকে মানুষ করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আবার বিয়ে করার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই তার হয়নি।

২১ বছর বয়সে সান্ড্রা বিয়ে করে হেলমুটকে। দুজনেই গোড়া থেকে আজ নাগাদ একসাথে ওদের পারিবারিক পোশাকের দোকানে কাজ করে। সান্ড্রার পড়াশোনায় তেমন উৎসাহ ছিল না। পোশাক বেচাকেনায় তার গভীর আগ্রহ দেখে রাফি ওকে একটা ক্রয়-বিক্রয় তথা ডিজাইনের বিশেষ স্কুলে তিন বছরের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। ওখানেই একই কোর্সে হেলমুটের সাথে ওর পরিচয়, প্রেম ও ট্রেনিং শেষে বিবাহ। রাফি ওদের বিয়ের পর নববিবাহিত দম্পতিকে একাত্ম হবার সুযোগ দেয়া ও স্বাধীন মতো থাকার জন্য নিজের দোকানসহ বাড়িটি সান্ড্রাকে লিখে দেন। নিজের জন্য এখনকার বাসাটি ভাড়া নেন। সান্ড্রা ও হেলমুট দোকানটি অনেক সম্প্রসারিত করেছে, নতুন ডিজাইনের কাপড়-চোপড় বানিয়ে ওরা অত্র এলাকায় বেশ বিখ্যাত। ৮০/১০০ কিলোমিটার দূর থেকেও ক্রেতারা আসেন। কিন্তু সন্তানভাগ্য ওদের রাফির মতোই। দুর্ভাগ্য হেলমুটের, পিতা হবার ক্ষমতা থেকে বিধাতা তাকে বঞ্চিত করেছেন। সান্ড্রারও একটা চাপা ব্যথা আছে। নিজে দত্তক সন্তান— তাই বোধহয় নিজের জন্য দত্তক সন্তান নিতে তার আপত্তি! রাফি ও হেলমুট উভয়েই বহুবার বলে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সান্ড্রার এখন আফ্রিকার তানজানিয়া ও উগান্ডায় মোট ৩টি দত্তক সন্তান, যারা সবাই যার যার বাবা-মার সাথে থাকে। প্রতিটি সন্তানকে সান্ড্রা মাথাপিছু মাসে ১০০ ইউরো করে পাঠায়। বছরে দুবছরে ওরা দুজনেই আফ্রিকায় যায় ওদের দেখতে। ওদের বয়স ১৫,১৭ ও ২০ বছর। সবাই স্কুলে যায়। ২০ বছরের ছেলেটি সামনের বছর টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হবে। সবাই কয়েকবার জার্মান ঘুরে গেছে। সান্ড্রার ইচ্ছা অন্তত একজনকে জার্মানে নিয়ে আসবে। দোকান ও এখানকার বাড়ি তো একজনকে (ওদের মৃত্যুর পর) দেখাশোনা করতে হবে! কাকে আনবে তা সে জানে না এখনও। আমার সাথেও সে ওদের সবার ফটো দেখিয়ে ও বৃত্তান্ত শুনিয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছে। আমি কিছুই বলিনি, সবাইকে আমার কাছে সমান মনে হয়েছে। শুধু বলেছি, যাকেই আনা হোক ওর নিজস্ব বাবা-মার মতামতের গুরুত্ব যেন দেয়া হয়।

এবার রাফির বাসায় আমার প্রথম দিনের বিস্ময়ের কথাটা বলি। ও প্রথমেই ওর স্টাডি রুমে নিয়ে গেল। ঢুকে ও কিছু বলবার আগেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না! পড়ার টেবিলের বাঁ দিকে একটা সুদৃশ্য ও খুবই দামি কাঠের সেলফে রবীন্দ্রনাথের রচনা সমগ্র, জার্মান ভাষায়! মোট ২৫ খণ্ড। এর আগে এক জার্মান শিক্ষকের বাসায় বেড়াতে গিয়ে তার কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ধর্ম’ নামের প্রবন্ধ পুস্তকটির জার্মান অনুবাদ দেখেছিলাম। সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী জার্মানে আছে, এ চোখে না দেখলে কোনোদিন বিশ্বাস করতাম না। ১৯৫৫ সালে হামবুর্গের এক প্রকাশনা সংস্থা প্রথম ১০ খণ্ডের একটি সংক্ষিপ্ত রচনাবলী বের করেন। পরবর্তী সংস্করণগুলোতে দুটি-তিনটি করে বাড়িয়ে ২০ বছরে পাবলিশার মোট ২৫ খণ্ড করতে সক্ষম হন। ১৯৬১ সালে কবিগুরুর ১০০তম জন্মবার্ষিকীতে জার্মান টেলিভিশনে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান দেখে রাফি ওর গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে যান। রিটায়ার করার পর (রাফির ভাষায়) ওর প্রেমে পড়েন। যখনি পাবলিশার নতুন সংস্করণ বের করত, রাফি হাতেরটা বদলে বর্ধিত সংস্করণটি কিনতেন। এখানে প্রায় সব পাবলিশারই যারা রচনাবলী প্রকাশ করেন পুরনোটা ফেরত নিয়ে সুলভ মূল্যে নতুন সংস্করণ কেনার সুযোগ দেন। উল্লেখ্য ওর সাথে লাইব্র্রেরিতে প্রথম সাক্ষাতের দিনেই আমি বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গে কবিগুরুর কথা বলেছিলাম এবং সেদিনই নাকি রাফি আমাকে ওর বাসায় নিয়ে এসে বিস্মিত করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হওয়া ধরতে গেলে নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার, তদুপরি আমি রবীন্দ্রসংগীতের অন্ধভক্ত। প্রায় সারাক্ষণ শুনি। আজকাল এমপিথ্রির কল্যাণে বারবার সিডি বদলাতে হয় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা লাগিয়ে দিলে, রাতে ঘুমোতে যাবার পরও বাজতে থাকে!

এরপর থেকে আমাদের আলাপ বা কথাবার্তার মূল বিষয়বস্তু হলো বিশ্বকবি। লাইব্রেরিতে, ওর বাসায়, আমাদের বাসায় যখনি আমাদের দেখা হতো, যেমন ‘কৃষ্ণ বিনা গীত নাই,’ আমরা কাটা রেকর্ডের মতো শুধুই রবিচর্চায় ডুবে যেতাম। আমার সঙ্গিনী মাঝেমাঝে খুবই বিরক্ত হতেন। ওর সাথে যখনি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাইতাম, ও বলত — দোহাই, এ কথা রাফির জন্য তুলে রাখো। এক শহরে দুই রবি পাগলই যথেষ্ট, আমি তিন নম্বর হতে মোটেও রাজি নই। আমি যদি বলতাম, আগামীকাল আবহাওয়া কেমন হবে মনে হয়? ও বলতো- রাতে রবিবাবুকে তো স্বপ্নে দেখবেই, ওনাকেই জিজ্ঞেস করো!

১৯৮৬’র শুরুতে আমার রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর হলো। সাথে সাথেই প্রতিদিন জার্মান ভাষা শেখার স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হলো। নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গিনী খুব খুশি। কাঁধ থেকে রবীন্দ্রভূত নেমে গেল অবশেষে। তার একটা আশঙ্কা হয়েছিল (পরে ওর কাছে শুনেছি), আমি বোধহয় শিগগিরই রাফির সাথে শান্তিনিকেতন হিজরত করব। কারণ রাফি প্রায়ই বলত, সুযোগ পেলেই সে বাকি জীবনটা ওখানে গিয়ে কাটাবে। এ বাসনা শোনানোর সময় ও নাকি আমার দিকে সর্বহারার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। যেন নিরবে বলতে চাইত — গুরুদেবের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতনই আমাদের আসল গন্তব্য!

১৯৮৯ সালে রাফির অনারারি লাইব্রেরিয়ানশিপের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিও কাছে’ গানটি, সঙ্গিনীর সাহায্যে জার্মানে অনুবাদ করে এবং পাঠ করে প্রচুর হাততালি পেলাম। বলা বাহুল্য সবচাইতে খুশি হয়েছিল রাফি। ওর বয়স তখন ৮৯, কিন্তু আমি গানটি পড়ার সময় দেখলাম ও কিশোরীর মতো উচ্ছ্বল হয়ে হাসছে। সুধী পাঠককে বলার দরকার নেই যে এ সময়ে সঙ্গিনীর মুখে বেশ বিরক্তির ভাব দেখলাম! আমি ‘নিজের ঘর বাঁচাও’ নীতি অনুসরণ করে বললাম— আমি মার্গারেটের সক্রিয় সাহায্যে গানটি জার্মানে অনুবাদ করেছি রাফির ২৫ বছরের অমূল্য অবদানকে সামান্য স্বীকৃতি জানাতে। তবে এটি উৎসর্গ করছি পরমপ্রিয় মার্গারেটকে, এই আশায় যে সর্বদা সে যেন আমাকে তার পাশে বসতে দেয়। মুহূর্তে মেঘ কেটে গেল এবং ওর সুন্দরতম হাসিটি আমায় উপহার দিল।

রাফি বেশ মোটাসোটা কারণ খাদ্যগ্রহণে তার রুচিটি ছিল প্রথম শ্রেণীর। দৈহিক ওজন প্রায় কুস্তিগীরদের মতো। কথা বলতে হাঁফিয়ে যেত। বাচ্চাদের মতো সর্বদা চকলেট খেত। লাইব্রেরিতে ড্রয়ারে সবসময় চকলেট রাখত। বৈকালিক কফির সাথে এক পাউন্ডের কেক অর্ধেকটা খেয়েও অতৃপ্ত থাকত, যেহেতু লোকলজ্জার ভয়ে সে পুরোটা খেতে পারছে না! একা সে যে পুরোটাই খায়, তাতে কোনো সন্দেহই ছিল না। নড়াচড়ায় ছিল তার মহা আপত্তি। খাওয়া, পড়াশোনা আর ঘুম— এই তিনটি ছিল তার নৈমিত্তিক জীবনযাপন। ওকে দাওয়াত করলে, মার্গারেট আমাদের দুজনের জন্য যতটা তার প্রায় দ্বিগুণ আয়োজন করত। কেক বানাত দুটো, তা না হলে আমাদের ভাগ্যে জুটত না! ভোজনের পর আলাপ-সালাপের সময় কফির সাথে সে যেন ভুলেই সামনে রাখা কেক খেয়েই চলত। এ সবই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আদর্শ পূর্ব শর্তাবলী। রিটায়ারের বছরই ওর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। একমাত্র ট্যাবলেট খাওয়া বাদে ডাক্তারদের কোনো নির্দেশই ও মানত না। প্রয়োজনের অধিক যখন-তখন খাওয়া যে এক ধরনের নেশা, তা প্রথম রাফির নিরবচ্ছিন্ন ভক্ষণেচ্ছা থেকেই জানতে পারলাম। পরে ১৯৯৩-তে আমি নিজেই যখন এ রোগে আক্রান্ত হলাম, ভোজনসংক্রান্ত জ্ঞান আরও বাড়ল। পশ্চিমা জগতের অবিশ্বাস্য প্রাচুর্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত আর্থিক সচ্ছলতাই এ রোগের ভয়াবহ প্রসারতার মূল কারণ।

এ রোগটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে অনিবার্যভাবে শারীরিক কলকব্জার বিকৃতি ঘটে। এ কারণেই ’৯১ সালে ট্যাবলেট ছেড়ে ইনসুলিন নেয়া শুরু হলো রাফির। ’৯০ সালেই বার্ধক্যের চাপে ও লাইব্রেরির কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। আমি সময় পেলে লাইব্রেরিতে মাসে এক আধবার যেতাম। ও কাজটি ছেড়ে দেবার পর খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হতো না আর। এ বাড়ি ও বাড়ি মাঝেমধ্যে নিমন্ত্রণের আদান-প্রদান হতো। স্বাভাবিকভাবেই ওর রোগের আরও অবনতি হলো। ’৯৩-’৯৫ এ কয়েকবার ও হাসপাতালে ছিল। আমরা যেতাম দেখতে। মোটা শরীরটাই ছিল শুধু, সেই প্রাণোচ্ছ্বলতা, হাসি ঠাট্টা, রবীন্দ্রচর্চার অবকাশ আর হতো না। ’৯৫-’৯৬ আমি সুদূর উত্তর জার্মানে কাজ নিয়ে বছর দেড়েক ছিলাম। মার্গারেটের টেলিফোনে শুধু ওর রোগের অবনতির খবরই পেতাম। আমি দু-তিন মাসে একবার এ শহরে এলে ওকে দেখতে যেতাম। মাত্র কিছুক্ষণ থেকেই মন খারাপ করে ফিরে আসতাম। একবার ওর অনুরোধে কবিগুরুর শেষের কবিতার ওর খুব প্রিয় কিছু অংশ জার্মানে পড়ে শুনিয়েছি। একটা দীর্ঘ বেকারত্বের সময় ১৯৯৭ সালে আমি হজপিসের কোর্স করি। এই সময়টা রাফি ১৫০ কিলোমিটার দূরে হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির একটা স্পেশাল ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিল। কোর্স করার সময় আমি দুবার ওর সাথে দেখা করতে ওই শহরে গিয়েছি। আমি হজপিস কোর্স করছি শুনে ও খুব খুশি হয়েছিল। একবার রসিকতা করে বলল, আমাকে ওকে শেষ সঙ্গ দেবার সুযোগ দেবার জন্যই নাকি ও ওর মৃত্যুর বিলম্ব ঘটাচ্ছে। আমিও পাল্টা রস দিয়ে বললাম, আমার কোর্স শেষ হওয়া অবধি সে যদি এ ধরাধাম ত্যাগ না করে আমি তাকে শেষ সঙ্গ দেবার সুবর্ণ সুযোগটি অবশ্যই আনন্দের সাথে গ্রহণ করব। আমি আরও বলেছিলাম, আমি মনে করি না, যেখানে হেলমুট ও সান্ড্রা আছে সেখানে তোমার শেষযাত্রার সময় অতিরিক্ত কারো প্রয়োজন হবে। রাফি বলল, তোমার যদি সে সময় কোনো কাজ না থাকে, আমি অবশ্যই তোমাকে ডেকে পাঠাব আমাকে পাহারা দিতে। এ ধরনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আমার এদেশে বহুবার হয়েছে। কেউ কিছু হাসি-ঠাট্টা করে বলেছে, পরে তাই একটা বিরাট সত্য হয়ে আমাকে বিস্ময়ের পাহাড়ে তুলে দিয়েছে। রাফির কথাও সত্যি ছিল।

জুনের মাঝামাঝি হজপিস কোর্স শেষ হলো। ঘটা করে মিউনিসিপ্যাল হলে এক বিশেষ সন্ধ্যায় জেলা প্রধানের হাত থেকে আমরা ১৭ জন কর্মী সার্টিফিকেট পেলাম। দর্শকরা একটা বিষয়ে মহা আশ্চর্য! ১৬ জনই জার্মান মহিলা, শুধু আমি একজন পরুষ, তাও আবার বাদামি রঙের অপাঙ্ক্তেয় এশিয়ান। পৃথিবীর দরিদ্রতম একটি দেশ থেকে এসেছি। প্রায় সবাই এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন। কোর্সের পরিচালিকা, তুবিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিওলজি বিভাগের অধ্যাপিকা মিসেস সুলজ, তার বক্তৃতায় আমাকে নিয়ে ৩-৪ মিনিট গুণগান করলেন। সংক্ষেপে তা হলো, তিনি এযাবৎ যে ১১টি হজপিস কোর্স জার্মানের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালনা করে দুই শতাধিক কর্মীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়েছেন, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে মি. আবদুল্লাহ একজন অন্যতম প্রতিভাবান ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তার কোনো সন্দেহই নেই যে আমি একজন স্পিরিচুয়াল পার্সন। আমার অমল সান্নিধ্যে যে অসংখ্য মৃত্যুপথযাত্রী তাদের শেষযাত্রায় মৃত্যুভয় অতিক্রম করে আনন্দের সাথে মৃত্যুলোকে গমন করবেন, তাতে তিনি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত। বক্তৃতাটি শুনে আমার সঙ্গিনী মহাখুশি। সর্বসমক্ষে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের যে ঝড় তুললেন জোর করেও তা আর থামাতে পারি না! এত খুশি হতে ওকে কমই দেখেছি। জেলাপ্রধানও বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আমার যেকোনো কাজে তার কোনো কিছু করার থাকলে, আমি যেন অবশ্যই কোনোরকম দ্বিধা না করে তাকে স্মরণ করি, এ কথাটি সর্বসমক্ষে জোরেশোরে ঘোষণা করলেন। আমার তো পোয়াবারো! বেকার, চাকরি খুঁজছি। ঘরে এসে সঙ্গিনীকে সাহেবকে ধরে একটা চাকরির কথা বলতেই সমস্ত প্রেম ঝেড়ে ফেলে ও আমায় প্রায় মারতে আসে আর কি! তার কথা, চাকরি হবে তোমার যোগ্যতায়, কারো তদবিরে নয়। কথাটা এদেশে খুবই প্রযোজ্য। এখানেও যে উমেদারি নেই তা নয়, তবে তা উঁচু মহলে, কোটি কোটি টাকার যেখানে খেলা।

একজন দুজন করে আমাদের নব্য সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কর্মীরা শেষ যাত্রায় সঙ্গী হলেন। জুলির কাছে তার অভিজ্ঞতা শুনে আমি মহা উত্তেজিত হয়ে গেলাম, আমার পালা কবে আসবে। প্রতিটি শহরের হজপিস গ্রুপের একজন কো-অর্ডিনেটর আছেন। তার টেলিফোন নম্বর পত্রপত্রিকায়, মিউনিসিপ্যালিটিতে দেয়া আছে, যাদের কর্মীর প্রয়োজন হয়, তারা তার সাথে যোগাযোগ করেন। আমাদের গ্রুপের কো-অর্ডিনেটর ব্রিগিটে এই সময় একবার আমাকে একজন ৭৮ বছর বয়সি রুশ-জার্মান বৃদ্ধার সঙ্গ দেবার প্রস্তাব করলেন। সঙ্গিনী আপত্তি করে বললো, ওদের জার্মান বোঝা তোমার সাধ্যের বাইরে। মানসিকভাবে আদি জার্মানরা খুবই জটিল ও সংকীর্ণ মনের। আমার প্রথম অভিজ্ঞতা যাতে নৈরাশ্যজনক না হয়, সেজন্য আমাকে খুব সাবধান হতে হবে, প্রথম সঙ্গটির ব্যাপারে। ব্রিগিটেও এ ব্যাপারে একমত। যথারীতি আবার চাকরির দরখাস্ত লেখায় মনপ্রাণ ঢেলে দিলাম।

জুলাইয়ের এক অপরাহ্ণে, ব্রিগিটের টেলিফোন এলো। চারদিন আগে সান্ড্রা ওর মাকে হাইডেলবার্গ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ওর আন্তরিক ইচ্ছা, নিজ গৃহে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার। ওদের বাড়িতে (যেখানে সান্ড্রার দোকান) ওর পুরনো শোবার ঘরে রাফি ওর শেষ সময়ের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। রাফি সান্ড্রাকে টেলিফোন করে খোঁজ নিতে বলেছে, আবু কোথায়। আমি যদি কাজ না পেয়ে থাকি তাহলে সান্ড্রা ও হেলমুটকে রাতে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করতে পারি কিনা। হেলমুট-সান্ড্রা দিনে রাতে মার পাশে থাকে। কিন্তু এতে দোকানের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। আমি যদি রাতে রাফির শয্যায় ওকে দেখাশোনা করি, ওরা দুজনে দিনে পালা করে দোকান ও মাকে দেখতে পারে। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। কোর্সের সময় আমাদের বলা হয়েছিল, প্রথম একটা-দুটো সঙ্গ যদি আমরা আগে থেকে পরিচিত কাউকে দিতে পারি তাহলে পরবর্তী সময়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াটার জন্মগত ভয়টা কেটে গিয়ে মৃত্যুশয্যার পাশে অবস্থান অভ্যাসের মধ্যে এসে যাবে। রাফি আমাকে এ সুযোগটা করে দিল। আমি ব্রিগিটের সাথে কথা বলে সান্ড্রাকে টেলিফোন করলাম। আমার সম্মতিতে ও মহাখুশি। বলল— মাকে এখনি বলে আমাকে আবার টেলিফোন করবে। আধঘণ্টা পরেই ওর টেলিফোন এলো। রাফি আগাম তার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। আমি যেন আসার সময় টেগোরের গানের বাংলা বইটা সাথে আনি (গীতবিতান)! কিন্তু রাফির কাছে তো জার্মান ভাষায় অনুদিত গীতাঞ্জলি আছে। ও শেষ সময়ে বাংলা শুনতে চাচ্ছে কেন? আমি তো আর গাইতে পারব না, আবৃত্তিও আসে না, পড়ে শোনাতে পারি শুধু।


 ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে! এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে?’ গানটি (গীতবিতান, পূজা ৬১৫)। শুনে অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। তারপর আবেগ মেশানো গলায় বলল, আমি আজও জানি না, টেগোর কবি না প্রফেট? এত কঠিন ব্যাপারটি কত সহজে ব্যাখ্যা করলেন, তাও গানে।


প্রথম রাত

‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!’

বিকেলে কাজ শেষে মার্গারেট ফিরে এলে ওকে সব বললাম। ও ম্লান হেসে আমায় শুভেচ্ছা জানাল, আমার প্রথম সঙ্গ দেবার সুযোগ আসাতে। মনে হলো না যে খুব একটা খুশি হয়েছে। ও আর দশজনের মতোই মৃত্যুকে ভয় পায়, এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলে। আমি জানি ও মন থেকে চায় না যে আমি গভীর রাতে একাকী মৃত্যুর মুখোমুখি হই। তেমন কথাবার্তা আর হলো না, একটা অজানা শঙ্কা আর উদ্বেগ আমাদের দু’জনকেই বার্তালাপ থেকে বিরত রাখল। রাতের খাওয়া সেরে, কাপড় পরে গীতবিতানটি যখন হাতে নিলাম, মার্গারেট মৃদু হাসির সাথে যেন একটু বিদ্রুপভরা চোখে তাকাল। যেন বলতে চাইল, মৃত্যুর মুহূর্তেও রবীন্দ্রনাথ? অবশ্য কিছু বলল না। আমার অনেক মানা সত্ত্বেও ও রাত নয়টার দিকে আমাকে গাড়িতে করে পৌঁছে দিল। সারা রাস্তা কোনো কথা হলো না। দরজা খুলে নামার সময় আমার বাঁ হাতটি শক্ত করে ধরে বলল, যদি কিছু হয়, যদি ভয় পাও, প্রতিজ্ঞা করো, আমাকে সাথে সাথে টেলিফোন করবে। সত্যিই ও ভীষণ ভয় পাচ্ছে। আমি পরিবেশটা হালকা করার জন্য বললাম, রাফি আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ও ভূত হয়ে কি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে? আর ঘরে তো সান্ড্রা ও হেলমুট আছেই। মনে হলো খুব একটা আশ্বস্ত হলো না। ও গাড়ি ফিরিয়ে চলে গেল। যতক্ষণ সম্ভব হলো, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে দেখে আমারও বুকটা খচ খচ করে উঠল!

রাফির ইচ্ছানুযায়ী ও যে ঘরে শৈশবে থাকত, সে ঘরে ওর শেষ শয্যা পাতা হয়েছে। চারদিকের দেয়ালে, রাফির মৃত বাবা-মা, বোন, স্বামী পাউলের ছবি টানানো হয়েছে। বিছানার পায়ের দিকে একটা ছোট টেবিলে রবীন্দ্রনাথের বিরাট তৈলচিত্রটি রাখা, যা অনেক আগে একটা ভিউকার্ড থেকে রাফি জনৈক শিল্পী দিয়ে বেশ টাকা খরচ করে আঁকিয়ে নিয়েছিল। ছবিটিতে কবিগুরুর একটা কবিতার ছয় লাইন জার্মান অনুবাদ রয়েছে। ওর দেহের স্থূলতা একটু কমেছে। ৩৫ বছর ডাক্তারের কড়া নির্দেশে, পরিমিত আহার, ডায়েট কন্ট্রোল, ব্যায়ামাদির কোনোটাই তোয়াক্কা না করে রাফি তার দেহের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বাড়িয়ে চলছিল। দু’বছর আগে দুটি কিডনিই কর্মক্ষমতা হারানোর পর অনিবার্যভাবে দেহের সামগ্রিক অবনতি ঘটতে থাকে। প্রথম বছর সপ্তাহে দু’দিন হাসপাতালে ডাইলোশন করতে যেতে হতো, তারপর চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলার পর ঘরে এসে নার্সরা করে দিত। হাইডেলবার্গ যাতায়াতও অ্যাম্বুলেন্সে করতে হয়েছে। এখন বিছানা থেকে কারো সাহায্য ছাড়া উঠতে পারে না। শিশুকে খাওয়ানোর মতো সান্ড্রা চামচে করে তরল খাবার খাইয়ে দেয়। আমাকে দেখে ও খুশি হয়েছে বুঝলাম ওর আকর্ণ হাসি দেখে। শুভ সন্ধ্যা, প্রিয় আবু, কেমন আছ? গলাটা আগের মতোই ভরাট ও পরিষ্কার। এবার দেখাও দেখি হজপিসের কোর্সে কি শিখলে। পরীক্ষা নেবার জন্য আমি তৈরি। বলেই প্রাণখোলা হাসি। পরে সান্ড্রা বলেছে, হাইডেলবার্গ থেকে এসে ওই প্রথমবার শব্দ করে হেসেছে রাফি। সান্ড্রাও আমাকে দেখে খুশি, এবার ঘুমুতে যেতে পারবে। স্যুপ (বার্লি), প্লেট, বাটি, চামচ, মাইক্রোওয়েভ এসব দেখিয়ে বলল, মা আজ সারাদিন কিছু খায়নি। দেখো তো পরে একসময় স্যুপটা গরম করে খাওয়াতে পারো কিনা। শুভ রাত্রি উভয়কে, মা বেশি আড্ডা দিও না, ঘুমানোর চেষ্টা করো বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল সান্ড্রা। এসে গেল সেই মুহূর্ত, যার মুখোমুখি হবার জন্য ৯০ ঘণ্টার কোর্সে নিজেকে তৈরি করেছি! একটু নার্ভাসও যে হইনি তা নয়, তবে রক্ষা এই, রাফি আমার পুরনো বন্ধু।

তোমার বাইবেলটা সাথে এনেছ তো? গীতবিতান আমার খুব প্রিয় এবং ঘরে বেশিরভাগ সময় আমার আশেপাশে থাকে বলে মার্গারেট একে আমার বাইবেল আখ্যা দিয়েছিল। রাফি সেটা জানত। তোমার একটা প্রিয় গান বেছে আমায় বাংলা ও জার্মানে শোনাও প্লিজ। মিনতির সুরে বলল রাফি। আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম, সময় ও পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখে দুই ভাষাতেই শোনালাম— ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে! এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে?’ গানটি (গীতবিতান, পূজা ৬১৫)। শুনে অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকল। তারপর আবেগ মেশানো গলায় বলল, আমি আজও জানি না, টেগোর কবি না প্রফেট? এত কঠিন ব্যাপারটি কত সহজে ব্যাখ্যা করলেন, তাও গানে। আমার দুর্ভাগ্য, আমার ৪১ বছর বয়স নাগাদ উনি বেঁচে ছিলেন, দুবার জার্মানে এসেছেন আর আমার ওকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি! রাফি গর্ব করে বলত, তার জন্ম বছরই (১৯০০) নতুন শতাব্দীর শুরু। রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ এ প্রথমবার ডর্টমুন্ডের ডিউকের আতিথ্যে এসে তার প্রাসাদে তিন সপ্তাহ ছিলেন এবং ডিউক তার সম্মানার্থে টেগোরসপ্তাহের আয়োজন করেছিলেন। ফ্রাঙ্কফুর্টের জার্মান-বাংলাদেশ সোসাইটি ওইখানে প্রতিবছর রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালন করেন। এসব কথা রাফি আমাকে আগেও বলেছে। একটু পানি দাও, গলাটা শুকিয়ে আসছে- রাফি বললো। তাকে কথা বলা বন্ধ করতে চাই না। যে কয়েক দিন এখনও ঈশ্বর বাঁচিয়ে রাখেন, খেয়ে সময় নষ্ট না করে তোমার কাছে টেগোরের কথা শুনব। রাফি ক্যাথলিক, ধর্মে অগাধ ভক্তি তার। সময় সুযোগ পেলে আমাকেও ওর দলে টানার চেষ্টা করত। হজপিস কোর্সেও আমাদের বলা হয়েছে, মৃত্যু যার দোরগোড়ায়, তাকে জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাওয়াতে নেই। এ সময় শরীরের শুধুমাত্র অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোই কাজ করে। যেমন রক্ত চলাচল ও শ্বাস-প্রশ্বাস। মস্তিষ্ক সচল থাকার জন্য এ দুটি অপরিহার্য। হজম বিভাগটি এর মধ্যে পড়ে না। বিদ্যুৎ চলে গেলে যেমন ক্ষুদ্র ডায়নামো দিয়ে অতি জরুরি কাজকর্মগুলো করা হয়ে থাকে তেমনি এ দুটি ন্যূনতম জীবন প্রক্রিয়া শরীরের সঞ্চিত শক্তি দিয়ে চালিত হয়ে থাকে। শেষ কয়েক দিনে ডাক্তাররাও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ওষুধপত্রও বন্ধ করে দেন। শুধু নিয়মিত পানি খাওয়াতে হবে, এটি অপরিহার্য। পানির আরেক নাম সত্যিই জীবন। অথচ আমাদের দেশে আত্মীয়স্বজনরা স্নেহের নামে মরার আগে খাঁড়ার ঘা দেবার মতো, শেষ খাওয়ার ইচ্ছা পূরণের নামে, মৃত্যুপথযাত্রীকে পেট ভরে খাওয়ানোর চেষ্টা করে তার শারীরিক যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে তোলেন।

জেগে গল্প করার আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও দুর্বল হয়ে পড়ায় রাত বারোটার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ল রাফি। ঘুমানোর আগে অবশ্য পথের শেষ কোথায় গানটি আর একবার পড়ে শোনাতে হয়েছিল আমাকে। রাতে ও তিনবার উঠেছিল পানি খাবার জন্য। আমি ওর অবস্থা দেখে সারারাত জেগেই ছিলাম। সকাল ৬টায় হেলমুট এলো। রাফি তখনও ঘুমিয়ে। সামান্য কথাবার্তা বলে আমি বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় এসে চাবি ঢুকানোর আগেই দরজা খুলে গেল। মার্গারেট রাস্তার দিকের জানালা দিয়ে আমায় আসতে দেখেছে। মানে অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে আমার প্রতিক্ষায় ছিল ও। মার্গারেটের উস্কোখুস্কো চুল, দুই চোখই ফোলা। রাতে কী ও কেঁদেছে নাকি ভালো ঘুম হয়নি? জিজ্ঞেস করার আগেই শাসনের সুরে বলল, কোনো কথা নয়। সারারাত জেগেছো, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোথা থেকে জবর পিটুনি খেয়ে এলে। নাশতা তৈরি, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে শুয়ে পড়। তথাস্তু বলে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।

 

দ্বিতীয় রাত

‘অশ্রু নদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে’

আজ কিছুতেই আর মার্গারেটকে গাড়ি দিয়ে আমাকে পৌঁছানোর সুযোগ দিলাম না। গ্রীষ্মকাল, ফুরফুরে হাওয়া, রাত নটায়ও গোধূলির আবছা আলো-আঁধারির খেলা। আমরা দুজনেই হাঁটাহাঁটি করতে খুব ভালোবাসি। বললাম— তুমিও তো সারাদিন কাজ করে এসেছো। ষাট কিলোমিটার যাওয়া-আসা। বিশ্রাম আমার চাইতে তোমার বেশি দরকার। আমি তো সারাদিনই ঘুমিয়েছি। হেঁটে গেলে দীর্ঘ নিদ্রার শ্রান্তিটা কাটবে। আজ ওর উদ্বেগ কিছুটা কম মনে হলো। গত রাতে রাফির পাশে সারারাত জেগে বহাল তবিয়তেই ফিরেছি। একটুকুও ভয় পাইনি। কোনো ভূতের আক্রমণও হয়নি। সাবধানে থাকার কথা বলে ও অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমায় বিদায় দিল।

আজ রাফিকে বড় অস্থির মনে হলো। আমি শুভ সন্ধ্যা জানালাম, ও কিছু বলল না। এ ধরনের শীতলতা রাফির কাছে কখনও পাইনি। সান্ড্রাকেও বেশ বিরক্ত মনে হলো। হেলমুটকে রেখে ও আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। বলল, মা আজ সারাদিন জ্বালিয়েছে! এটা খাব, ওটা খাব, খাবার আনার পর মিথ্যা করে বলেছে, এটা তো আমি চাইনি। এক্ষুনি আবুকে খবর দিয়ে নিয়ে আসো। ও ছাড়া আমার প্রয়োজন তোমরা কেউ বোঝ না। আমায় বসিয়ে দাও, বসালে পরে বলে— আমি হাঁটব। হাঁটাতে গেলে রাগ করে বলে, আমি কি হাঁটতে পারি তোমরা কি আমায় এখনি মেরে ফেলতে চাও? ইত্যাদি। আবু, আজ কি তুমি মাকে সামলাতে পারবে? তুমি না হয় আজ বাসায় ফিরে যাও, কাল রাতে এসো। আমরা আজ দুজনেই রাত জাগব, কাল দোকান বন্ধ রাখব। বুঝলাম আজ হজপিস কর্মী হিসেবে আমার অগ্নিপরীক্ষা। বললাম, কোনো চিন্তা কোরো না, আমার কাছে টেগোরের গানের বই আছে। ওটা দিয়েই রাফিকে শান্ত রাখতে পারব। তোমরা বিশ্রাম নাও, কাল শনিবার ব্যবসার জন্য ভাল দিন, দোকান বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। বহু ক্রেতা এসে ফিরে যাবে।

তুমি দেশে ফিরে যাও না কেন? রাফির প্রথম কথাতেই আক্রমণ। আমি বললাম, তুমি তো ভালো করেই জানো, কেন দেশে ফিরে যাই না।তোমার কত বড় সৌভাগ্য, তুমি টেগোরের দেশের লোক। একই জাতি তোমরা, তার ভাষায় কথা বলো, তার সব লেখা বোঝো। তোমাদের দেশে গিয়ে মরাও অনেক ভালো। এ দেশে টাকা ছাড়া কী আছে? জানো, আজ সান্ড্রা কী বলেছে? আমি নাকি ইচ্ছা করেই মরতে লেট করছি। ওদের ব্যবসায় এতে বহু লোকসান হচ্ছে। এবার বুঝলাম ওর এত রাগ কেন আজ!

আবু, মরতে আমার এত ভয় হয় কেন? মনে হয় কত কিছু করতে পারলাম না। কত কিছু করার বাকি। সান্ড্রার ছেলেটা আফ্রিকা থেকে এখানে এসে সব ব্যবসাপাতি বুঝে নিতে পারে কিনা, তা না জেনে মরেও শান্তি পাবো না। আর তিনটা বছর বাঁচতে পারলেই তো বিংশ শতাব্দীটাও দেখে যেতে পারতাম! মানবজনমের এই এক মহা সমস্যা। এক জীবনে কোনো সময়ই তার সব সাধনা পূরণ হয় না! কত কিছু করার আছে এখনও, কত অপূর্ণ আশা বাসনা, কত কর্তব্য বাকি! সবাই আমাকে অনুনয় বিনয় করে বলেছে, তুমি তো প্রাচ্যের লোক। কত রকম জাদুবিদ্যায় তোমাদের জন্মগত অধিকার, আমাকে যেভাবেই হোক একটা বছর, না হয় ছ’টি মাসের আয়ুর একটা ব্যবস্থা করে দাও না। নাতনির বিয়েটা দেখে যেতে চাই। বিশ্বকাপ ফুটবলটা অন্তত দেখে যাবার একটা পথ বের করো। আমার এত টাকা অ্যাকাউন্টে, যা চাও দেবো, বাকি জীবন আর তোমার কাজ করে খেতে হবে না।

তোমার বাইবেলে (গীতবিতান) মৃত্যুভয় দূর করার কোনো গান আছে কী? রাফি জিজ্ঞেস করল।

আমি দু ভাষায় ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে, ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে’ (গীতবিতান, পূজা ৫৬৬) গানটি পড়ে শোনালাম। শুনে ও বহুক্ষণ থম ধরে রইল। হঠাৎ বলে উঠল— জানো আবু, টেগোর যদি আমাদের এখানে হিটলারের সমসাময়িক হয়ে জন্ম নিতেন, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতোই না, লাখ লাখ নিষ্পাপ প্রাণের অকাল মৃত্যু হতো না। ওর গান যারা গাইত, শুনত, তারা মানুষ মারার জন্য কোনোদিনই অস্ত্র হাতে নিতে পারত না।

 

বাকি রাতটা ও শান্ত হয়ে ঘুমাল। রবীন্দ্রসংগীতে কোনো জাদু আছে নাকি?

 

তৃতীয় রাত

‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে’

আজ সন্ধ্যায় সিটি হলে মার্গারেটের পার্টি মিটিং ছিল। রাত ন’টায় একাই বেরিয়ে পড়লাম। মনে মৃদু ব্যথা। দুদিনই ও বিদায় দিয়েছে, আজ নেই। ওর উদ্বেগে কষ্ট পাই, আবার নিজ কানে যে আজ ওর আশঙ্কার ও সাবধানে থাকার কথা শুনতে পেলাম না, তাতেও যেন স্বস্তি পাচ্ছি না!

আজ রাফির মুড খুব ভালো দেখলাম। সান্ড্রা বলল, সকালে হাসপাতাল থেকে নার্স এসে ডায়ালেসিস করে দিয়ে গেছে। তাই মা আজ শান্ত। পেট ভরে আজ স্যুপও খেয়েছে। রাফি বলল, ঠিক মা এখন লক্ষ্মী মেয়ে, আজ তো শনিবার, কাল দোকান বন্ধ। হেলমুটকে নিয়ে তুমি বাইরে খেতে যাও। আমার বিশেষ কথা বলার আছে আবুর সাথে। আমরা নিভৃতে কথা বলতে চাই। সান্ড্রা রসিকতা করে বলল, আবুকে আবার প্রেম নিবেদন করো না, তাহলে মার্গারেটকে বলে দেব। বলে মায়ের তিরস্কার শোনার আগেই দৌড়ে বাইরে চলে গেল। রাফি হাইডেলবার্গ থেকে আসার পর সান্ড্রা নিশ্চয় অবসর পায়নি দোকানদারি আর মায়ের সেবা করে। আজ সন্ধ্যাটি হেলমুটকে নিয়ে বাইরে এনজয় করবে। যাবার আগে টেলিফোনটি এ ঘরে দিয়ে গেল।

জানো আবু, কাল রাতে বাবা-মা, বোন সবাই এসেছিল আমার কাছে স্বপ্নে। সবার সাথে প্রাণখুলে কথা বলেছি, সবাই খুশি, শিগগিরই আমরা একত্র হচ্ছি। পাউল (ওর মৃত স্বামী) এলো একটু পরে। কিন্তু মুখটা খুব বিষণ্ন। আমার সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, তাকালোই না! আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ পাউল? আর দেরি নেই, এসে পড়লাম বলে তোমার কাছে। শুনে মনে হলো না, ও খুশি হলো। বড় কষ্ট পেলাম। কিছুক্ষণ পরেই কিছু না বলেই যেমন এসেছিল, তেমনি নীরবে চলে গেল। কেন বলো তো? বললাম, সমস্যাই বটে!

টেলিফোন বেজে উঠল। মার্গারেট করেছে। মাফ চাইল, মিটিংয়ে দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য। আমার কণ্ঠ শোনার আগ্রহে ফোন করেছে। এক কথায় আমার জমে থাকা ব্যথা উবে গেল। যথারীতি সাবধানে থাকার কথা বলে, জানতে চাইল রাফিকে ছোট্ট শুভেচ্ছা জানাতে পারে কি না? চোখের ইশারায় রাফিকে ইঙ্গিত করতেই ও টেলিফোনটি ওকে দিতে বলল। সংক্ষিপ্ত আলাপ। রাফি মাফ চেয়ে বলল, আমার জন্যই তোমাকে আবুর বিরহ সহ্য করতে হচ্ছে! এজন্য তো আমি’ই দায়ী। জোর গলায় বলল, আর মাত্র দু-একদিন, তারপরই আবুর ছুটি।

আবার গতরাতের স্বপ্নে পাউলের রহস্যময় আচরণের কথা উঠতে আমি বললাম— টেগোর তার একটি গানে এ সিচুয়েশনটির চিত্তগ্রাহী ও সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ও উৎসুক হয়ে বলল, আর দেরি কেন আবু, পড়ে শোনাও। আমি যথারীতি দু ভাষায়, ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে’ (গীতবিতান প্রকৃতি ১৩৩) শোনালাম। বাক্যরোধ হয়ে গেল ওর। সব কষ্ট, ব্যথা-বেদনা যেন জাদুমন্ত্রে উধাও হয়ে গেল। এ কথা সে কথায় এক সময় সে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, যিশু যদি তার শূলে চড়ানো হত্যাকারীদের ক্ষমা করার জন্য ঈশ্বরকে এই বলে অনুুরোধ করেন— ‘ওরা কী করেছে, তা নিজেরাই জানে না’। তাহলে মানুষ কেন তার প্রিয়জনের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা করে না, যে অপরাধ সে স্বীকার করে সদা ক্ষমাপ্রার্থনা করে? বেশ একটু জটিল ধাঁধা হয়ে গেল নাকি, তুমি কি বলতে চাচ্ছ? আমি বললাম। খানিকটা ইতস্তত করে, লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে যেন বেশ কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিল ও। পাউল যখন যুদ্ধে ছিল, তখন আমি এক বছর আমার তৎকালীন বসের শয্যাসঙ্গিনী ছিলাম। এজন্যই কাল রাতে ও আমার সাথে কথা বলেনি, যদিও আমি সবসময় ঈশ্বর ও পাউলের কাছে এজন্য ক্ষমা চাই।

কথাটা বলে রাফি আর শ্বাস নিতে পারে না, চোখ উল্টে আসছে, সারা শরীর সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফাঁক করে চেষ্টা করছে কী যেন বলবে, জিহ্বা চোয়ালের ওপর নিচে ছুঁয়ে যাচ্ছে, কোনো কথাই বেরুচ্ছে না। এই কি শেষ সময়? টেলিফোন আঁকড়ে ধরে এমার্জেন্সিতে খবর দিলাম। এক হাতে উত্তেজিত রাফির শরীর শক্ত করে ধরে ওর বুকে ম্যাসেজ করতে থাকলাম (কোর্সে শেখা) যাতে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত না হয়। বারকয়েক মুখে মুখ দিয়ে ওর প্রশ্বাস চালু করার প্রচেষ্টা নিলাম। মনে একটাই দুশ্চিন্তা, মেয়ে জামাই আমার হাতে মায়ের সেবার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাইরে গেছে আর আমি ওর পুরনো ক্ষতটি এক রবীন্দ্রসংগীতের খোঁচায় উস্কে দিয়েছি। পরিণামে শেষ মুহূর্তে কি একমাত্র স্বজন, কন্যা সান্ড্রা রাফির শয্যাপাশে থাকতে পারবে না? সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে এমার্জেন্সি ডাক্তার এসে গেলেন। দ্রুত অক্সিজেন সংযোগ, রগে বিশেষ ইনজেকশন ইত্যাদির মাধ্যমে আধঘণ্টার মধ্যেই স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে থাকল রাফি। আমি জানতাম কোন রেস্টুরেন্টে সান্ড্রা খেতে গেছে, টেলিফোন করতেই ১০ মিনিটের মধ্যে এসে গেল ওরা। ওদের সাথে রাফি স্বাভাবিকভাবে আলাপ-সালাপ করল। ঘটনার কোনো ইঙ্গিতই দিল না। ডাক্তারও বলল, এ অবস্থায় হঠাৎ এমন কলাপস হতেই পারে। রাফি কৃতজ্ঞতার সাথে বলল, এ যাত্রায় আবু পাশে থাকার জন্যই ঈশ্বর এ রাতটির জীবন তাকে উপহার দিয়েছেন। ডাক্তার মৃদু ঘুমের ওষুধ দেওয়াতে, রাফির চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে এলো। এক ফাঁকে আমাকে বলল— আজ রাতের মূল ব্যাপারটি যেন কোনোদিনই হেলমুট ও সান্ড্রা জানতে না পারে। আমি সায় দিলাম। সকালে ও যখন ঘুমাচ্ছে, ঘরে সান্ড্রা আসার পর আমি বাসায় ফিরে এলাম।

 

চতুর্থ রাত

আজ রবিবার। আসার সময় সান্ড্রা বলেছিল, আজ দোকান বন্ধ। রাতে আর তোমার আসার প্রয়োজন নেই। ওরা স্বামী-স্ত্রী মিলে আজ দিনে রাতে পালা করে মাকে দেখবে। মুচকি হেসে আরও বলল, তিন রাত মার্গারেট তোমাকে মিস করেছে, এ রাতটা ওর পাওনা। কিছুটা সত্য। এত দীর্ঘ সময় আমরা বিচ্ছিন্ন থাকিনি।

বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর দেখলাম মার্গারেট ওর একটা ভীষণ সুন্দর পোশাক পরে গুন গুন করে গান গাইছে ও কাপড় ইস্ত্রি করছে। ভীষণ ভালো মুডে আছে! সকালেই ওকে বলেছিলাম আজ রাতে আমাকে যেতে হবে না। বলল, গোসল করে তৈরি হয়ে নাও বাইরে যাব, ডিনার আজ বাইরে। আমরা সাধারণত বাইরে খাই না। মার্গারেটের ভীষণ শখ ঘরেই রান্না করার। আমিও ঘরকুনো মানুষ, চেনা টেবিলে বসে খেতেই আমার মহাসুখ। মার্গারেট যখন বাইরে খাবার কথা বলে, তার দুটি অর্থ— ও আমার ওপর প্রচণ্ড খুশি এবং ঘরে যেহেতু আমার পছন্দমতো কোনো খাবার নেই, বাইরে গিয়ে ফেভারিট কিছু খাওয়াবে।

কয়েক ঘণ্টা বনে হাঁটার পর, দুজনে রেস্টুরেন্টের বারান্দায় (এখন সামার, সন্ধ্যা ৭টায় ভর রোদ) বসে খাবার অর্ডার দিয়ে যুত হয়ে বসলাম। মনে মনে গুন গুন করছি— ‘আজকে শুধু একান্তে আসীন, চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিন, আজকে জীবন-সমর্পণের গান গাবো নিরব অবসরে।’

অনেকক্ষণ আমার দিকে একটানা তাকিয়ে থেকে আচমকা ও বলল, কেন জানি মনে হচ্ছে, এ তিন দিনেই তুমি আমার অচেনা হয়ে গেছ, অনেক দূরে চলে গেছ, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাস? আমার উত্তর দেবার আগেই বলল, না না তোমার বলতে হবে না। মাফ করো প্রিয়তম, আমি নির্বুদ্ধিতার বশে এ প্রশ্ন করেছি তোমাকে। এ প্রশ্নের উত্তর আমি অনেক আগে থেকেই জানি। আমি বিশ্বাস করি, শুধু আমাকে ভালোবাসার জন্যই তুমি আট হাজার কিলোমিটার দূরে তোমার প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে জার্মানে এসেছ। ওয়েটার সালাদের প্লেট সার্ভ করে গেল, প্রেমের বন্যায় ভেসে আমরা মহানন্দে খাওয়ায় ডুবে গেলাম।

 


ওর মূল ভয়ের কথাটি ও পরে আমাকে বলেছে। পরলোকে রাফি, রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে বের করার জন্য হয়তো মরার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে! আমি হেসে উঠেছিলাম ওর কথা শুনে। জার্মানের এক মহিলার মুখে আমার দেশের আতঙ্কিত এক অশিক্ষিতা তরুণী বধূর মতো সংলাপ শুনব, এ আশা কোনোদিন করিনি।


পঞ্চম ও শেষ রাত

‘সম্মুখে শান্তি পারাবার ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’

গত রাতে অনেক দেরি করে শোওয়া হয়েছে। কিন্তু যত রাতেই ঘুমুতে যাক, পরদিন সকালে মার্গারেট কাজে যেতে কখনও দেরি করে না, ছুটি নেওয়া তো দূরের কথা। সকালে ৭টায় ঠিকই কাজে চলে গেছে। আমি ঘুম থেকে দশটার দিকে উঠলাম। রান্নাঘরের দেয়ালে একটা নোটিশ বোর্ড আছে, ওতে আমরা একজন আরেকজনের অনুপস্থিতিতে চিরকুট লিখে পিন দিয়ে আটকিয়ে রাখি। একটা বেশ বড় স্লিপ আজ টানানো। লেখা আছে, ফ্রিজে আজ দুপুরে আমার খাওয়ার জন্য কোন খাবারটি রাখা আছে। মাইক্রোওয়েভে তা কতক্ষণ গরম করতে হবে। নাশতার রুটি, জেলি কোথায় ইত্যাদি। বই পড়ে বা টেলিভিশন দেখে যেন সারাদিন ঘরে বসে না থাকি। অপরাহ্ণে অন্তত দু’ঘণ্টার জন্য বাইরে যাওয়া চাই এবং তা অবশ্যই ধোওয়া কাপড় পরে। ওর কড়া নিয়ম, মোজা দু’দিনের, শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি তিন দিনের বেশি পরা চলবে না। আজ যখন গায়ের গেঞ্জি ১০/১২ দিন পরে দুর্গন্ধের ঠেলায় ধোওয়ার আলসেমিতে ডাস্টবিনে ফেলে দেই, মাসের পর মাস এক প্যান্ট পরে থাকি। শার্ট বদলাতে ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে যায়, মোজার কথা নাই বা বললাম। তখন এই সব স্বপ্নের দিনের কথা ভাবি। এখন আর কেউ ঘরে স্লিপ টানিয়ে রাখে না। কেউ বলে না, ও শার্ট তিন দিন ধরে পরছো কেনো, তা না করে ধোওয়া একটা এক্ষুনি পরে নাও, নাহলে তোমার কপালে আজ ভীষণ দুঃখ আছে।

রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘামে সারা গা ভিজে গেছে। একটা ভয়ানক কিছু অবশ্যই দেখেছি, এখন আর মনে নেই। পাশের বাড়ির তরুণী তিন দিন আগে সদ্যজাত কন্যা নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। নতুন মা, বাচ্চা সামলাতে পারেন না, শিশু সারাদিনই কাঁদে। তরুণীর মাতাও সারাদিন কাজ করেন। বিকেলে এসে নাতনিকে তার দীর্ঘ মাতৃজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে নাইয়ে ধুইয়ে শান্ত করেন ও মেয়েকে সন্তান পালনের পাঠ দেন। সারাদিন নবজাতিকা যেভাবে একটানা কেঁদেই চলে, মনে হয় এ শিক্ষা তাকে অনেকদিন নিতে হবে। কিন্তু আজ যেন শিশুর কান্নাটি আরও করুণ, বুকে এসে বিঁধছে! ছেলেবেলায় নানাবাড়ি বেড়াতে গেলে, রাতে অনেকক্ষণ কুকুর কাঁদলে নানী বলতেন— এ রাতে এখন কেউ না কেউ কোথাও মারা যাচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে আমার নিজের বুকে হাত চেপে দেখতাম, হৃদপিণ্ড চলছে কিনা, আশ্বস্ত হয়ে পাশে শোওয়া ছোট বোনটির বুকে হাত দিয়ে বুঝতে চাইতাম, ও মারা যাচ্ছে নাতো? আজ দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই বিজন প্রবাসে শিশুটির একটানা হৃদয়বিদ্ধ করা ভয়াবহ ক্রন্দনে নানীর কথা মনে হলো। বিদ্যুৎ চমকের মতো হঠাৎ মনে হলো, আজ রাতই কি রাফির শেষ রাত?

আজ যাওয়ার আগে দিনের বেলা যে ভাবনা মনে এসেছিল মার্গারেটকে বলতেই ওর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি তখন নিজেকে মনে মনে তিরস্কার করেছি, কেন বলতে গেলাম? বলল, ও আমার সাথে যাবে। কাল কাজে ছুটি নেবে। আমাকে আজ ও কিছুতেই একা যেতে দেবে না। অনেক কষ্টে ওকে নিবৃত্ত করলাম। কথা দিলাম, কিছু একটা হলে যত রাতই হোক, ওকে টেলিফোন করব। ওর মূল ভয়ের কথাটি ও পরে আমাকে বলেছে। পরলোকে রাফি, রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে বের করার জন্য হয়তো মরার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে! আমি হেসে উঠেছিলাম ওর কথা শুনে। জার্মানের এক মহিলার মুখে আমার দেশের আতঙ্কিত এক অশিক্ষিতা তরুণী বধূর মতো সংলাপ শুনব, এ আশা কোনোদিন করিনি। পরে ভেবে দেখেছি, প্রেম সব দেশেই এক, এ সবাইকে সত্যিই অন্ধ ও অবুঝ করে দেয়! বিকেল থেকে রাফিকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। আমাকে দেখে সান্ড্রার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সারাদিন জ্ঞান হলেই রাফি জিজ্ঞেস করেছে, আবু এসেছে কি? আমি বললাম আমাকে টেলিফোন করলেই তো আমি চলে আসতাম। না না, তুমি তো সারা রাতই জেগে থাকবে। দিনে তোমার বিশ্রামের অবশ্যই দরকার আছে। রাফির স্থূল পেটটি ছাড়া ওর দেহের আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এসময় স্থানীয় পাদ্রি এসে গেলেন। মৃৃত্যুর আগে ক্যাথলিক রীতি অনুযায়ী রাফিকে তেল দিয়ে শুদ্ধ করবেন। এসব দেখে আমার হাসি এসে যায়। আমি বসার ঘরে গিয়ে মার্গারেটকে ফোন করলাম। আমার কাছে যখন শুনল, পাদ্রির পেট না রাফির পেট বেশি মোটা, নির্ণয় করা কঠিন। মৃদু হেসে তিরস্কার করল, রাফিকে নিয়ে এ সময় এসব কথা ভালো নয়। আমি মাফ চেয়ে বললাম, ওই পাদ্রি আর ওর তেল দেওয়া-অনুষ্ঠান দেখেই আমি আমার সম্বিত হারিয়ে ফেলেছি। মার্গারেট যদিও ক্যাথলিক বাবা-মার সন্তান, আমার মতোই ও কোনো ধর্ম মানতো না।

পাদ্রি বিদায় নেবার পর, আমি রাফির কাছে এলাম। তেল দেওয়ার কল্যাণেই বোধহয় রাফি বেশ প্রফুল্ল, ওর অক্সিজেন-তাঁবু খুলে দেওয়া হয়েছে। কুশলাদি বিনিময়ের পর ও বলল, আজ তোমাকে মৃত্যুর ওপর, টেগোরের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও অনন্ত প্রভাবী একটা গান খুঁজে বের করে শোনাতে হবে। যেটি শুনে আমি জীবনের এই অপ্রতিরোধ্য ও অনিবার্য সমাপ্তিটি মেনে নিতে পারি। গলার স্বর আগের মতো ভরাট নেই, ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেছে। শুনে মনে হয়, এখানে নয় ও বহু দূরে অন্য কোথাও থেকে কথা বলছে। এ অভিজ্ঞতাটি আমার পরেও হয়েছে, মৃত্যুর আগে কণ্ঠস্বর ক্ষীণ ও দূরের হয়ে যায়। আজ ওর ফরমায়েসি গানটি আমি আগেই শেষ সময়ের জন্য ভেবে রেখেছি। ওকে শোনালাম— ‘সম্মুখে শান্তিপারাবার… ভাসাও তরণী হে কর্ণধার। তুমি হবে চিরসাথী, লও লও হে ক্রোড়পাতি… অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকারা’ (গীতবিতান, আনুষ্ঠানিক সংগীত ১৩)। ওর অনুরোধে কয়েকবার পড়তে হলো, দুটি ভাষাতেই।

প্রিয় আবু, আমি বুঝেছি মর্ত্যরে বন্ধনক্ষয় বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয় এই তো পরিত্রাণ, এই তো মহানির্বাণ। ঈশ্বরপুত্র যিশুর শূলে জীবনদানের এই তো শুভ পরিণতি। স্বয়ং তোমাদের টেগোরই আমাদের, সবার ও সারা বিশ্বের যিশু। টেগোর আর যিশু একই। দুজনেরই মুখমণ্ডল স্বর্গীয়, দুজনের রূপই পরিত্রাতার। আমার এই কথা তুমি তোমাদের দেশবাসীদের বলবে। ধর্মে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে কোনো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষ এক। ওই দেখো টেবিলে টেগোর আর যিশুর ছবি। কোনো তফাত দেখছো কি?

এতক্ষণ দেখিনি। এখন দেখলাম, কবিগুরুর ছবির পাশে আজ যিশুরও একটা ছবি রাখা হয়েছে। রাফির কবিগুরুর তৈলচিত্রটিতে ওনার বয়স ৪০/৪৫ হবে যিনি প্রায় সর্বত্রই তার যে ছবি দেখা যায়, লম্বা জোব্বাধারী, শুভ্র শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ নন। কালো দাড়িতে বলতে গেলে, তাকে দেখতে যিশুখ্রিষ্টের মতোই লাগে। দুজনের এই তুলনা আজ পর্যন্ত আমি শুনিনি। রাফির কথা কি ঠিক? কে জানে। এরপর ঘণ্টাখানেক ও চুপ। গির্জার ঘড়িতে রাত তিনটা বাজার ঘণ্টা শুনতে পেলাম।

একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। না ঘুম না জাগরণ। হঠাৎ শুনি স্পষ্ট বাংলায়— ‘সম্মুখে শান্তিপারাবার…  ভাসাও তরণী হে কর্ণধার। তুমি হবে চিরসাথী, লও লও হে ক্রোড়পতি… অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার॥ মুক্তিদাতা, তোমার ক্ষমা তোমার দয়া হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার। হয় যেন মর্ত্যরে বন্ধনক্ষয়, বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়, পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা অজানার।’

চোখ খুলে মনে হলো স্বপ্ন দেখছি না তো? রাফির মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে মৃত্যুর এই আবাহনী। ঠোঁট নড়ছে না, শুধু একটু ফাঁক হয়ে আছে, জিহ্বা দেখা যাচ্ছে, অচল অনড়। তবে কে আবৃত্তি করছে ওর মুখ দিয়ে? কণ্ঠটি আগের মতোই ভরাট ও উদাত্ত। এতক্ষণে দেখি, হেলমুট ও সান্ড্রাও অবাক হয়ে মায়ের মুখের শব্দরাশি শুনছে। কিছুই বুঝছে না, বাংলা বুঝবে কোথা থেকে? ওরা দুজনেই হাত ধরাধরি করে বিছানার আরেকদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে। কথা শেষ হয়ে এলো, চক্ষু দুটি এযাবৎ কবিগুরুর ও যিশুর ছবির দিকে পলকহীন হয়ে তাকিয়ে ছিল। মনে হলো একবার ও পাশে হেলমুট ও সান্ড্রাকে দেখল, তারপর দৃষ্টি আমার দিকে। হাসির একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা যেন দেখলাম। মনে হলো তার ওই আগের মতো দরাজ গলায় আমাকে বলছে— আমার এই কথা তুমি তোমাদের দেশবাসীকে বলবে। ধর্মে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে কোনো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষ এক।

মাথাটা বাঁ দিকে কাত হয়ে গেল। এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, কী যেন একটা অদৃশ্য অথচ দৃশ্য, নিঃশব্দ-সশব্দে ওর দেহ থেকে বেরিয়ে অবিশ্বাস্য আর অবর্ণনীয় এক মহাবেগে অতল, অসীম আর অশেষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে চলে গেল। একটা গগণবিদারী মহাশব্দ, যা শুধু অনুভব করা যায়, কানে শোনা যায় না! যা প্রস্থান করল, এটাই কি অবিনশ্বর আত্মা? আমি ওর হাত দু’টি ধরে বললাম— রাফি, তুমি একটি অত্যাশ্চর্য মানবিকতাসম্পন্ন মানুষ, যাও তোমার পরিত্রাতা যিশুর কাছে বা তোমার প্রিয় গুরুদেবের কাছে, ভয় পেয়ো না— ‘হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার।’

মৃত্যুর পরে জীবন নিয়ে গবেষণায় বিশ্বখ্যাত ডা. এলিজাবেথ ক্যুবলার রস বলেছেন, এ পৃথিবী থেকে মৃত্যুর দরজায় যে প্রবেশ করছে, তার কাছে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি সব ভেদাভেদ লোপ পায়। সে তখন অনায়াসে সব ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারে। এ পৃথিবীর প্রচলিত নিয়ম, ধারা, রীতিনীতি, সূত্র সবকিছুর ঊর্ধে উঠে যায় সে। তাই কি রাফি মৃত্যুর দরজায় পা দিয়ে অনায়াসে কবিগুরুর গান নির্ভুলভাবে আবৃত্তি করে তার মৃত্যুর পরের জীবনকে বরণ করে নিল? মা’র বুকে মাথা দিয়ে সান্ড্রা অঝোরে কাঁদছে। নিজের জন্মদাতা বাবা-মার পরিচয় সে জানে না। অবিবাহিতা তরুণী মা হয়তো সমাজ সংসারের ভয়ে, জন্ম দিয়ে গির্জার দরজায় রেখে যায়। রাফি আর পাউল দত্তক নেবার আগে দু’বছর অনাথাশ্রমে ছিল সান্ড্রা। ১১ বছর বয়সে দত্তক পিতাও যুদ্ধে গিয়ে মারা যান। সে থেকে রাফিই ওকে বাবা-মার স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছে।

হেলমুট গেল টেলিফোনে পাদ্রি আর ডাক্তারকে খবর দিতে, সৎকারাদীর ব্যবস্থার জন্য। আমি রাফির কপালে একটা চুমু দিয়ে ওর নশ্বর দেহের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমার চেয়ার ছেড়ে ওঠার শব্দে সান্ড্রা উঠে দাঁড়াল, মুখে সদ্য মাতৃহারার নীরব হাহাকার। আমরা আলিঙ্গন করলাম। ও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাল ওর মাকে শেষ সময় পর্যন্ত সঙ্গ দেবার জন্য। বলল— মা তো ল্যাটিন জানত না, তবে কী করে ওই ভাষায়, মরার আগে কী সব বলে গেল। আমাদের দেশে যেমন না বুঝলেই সংস্কৃত, এ দেশে সব অবোধ্য ভাষাই ল্যাটিন। ও বিশ্বাস করবে না তাই আর সত্য কথাটা ওকে বললাম না। এতদিন শুধু মৃত্যু সংবাদই শুনেছি। এই প্রথমবার আমার জীবনে মৃত্যুকে, একটি নিঃশ্বাসের ব্যবধানে, এতটা কাছে থেকে দেখলাম। কিন্তু একটা মৃত্যুতে এ পৃথিবীর কি আসে যায়? রাফিদের বাসা থেকে বেরুলে মোড়ে একটা বিরাট প্রাচীন ওক গাছ। দেখলাম ওর বিশাল দেহ, পাতা, ডালপালা সব আগের মতোই আছে। গ্রীষ্মকাল, এখনই পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের আভাস। শহর এখনও ঘুমিয়ে। একটা দুটো গাড়ি হঠাৎ শব্দ করে চলে যাচ্ছে। এছাড়া সব সুনসান। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বাড়িঘর সব আগের মতোই আছে। কিছুই বদলে যায়নি। কিন্তু আমি কি আগের মতোই আছি? মার্গারেট হয়তো ঠিকই বলেছে আমি ওর থেকে, আগের আমার থেকে বোধহয় বেশ কিছু দূরে সরে গেছি।

হে বিশ্বকবি, দেশে-বিদেশে তো তোমার লাখ লাখ ভক্ত ছড়িয়ে আছে। এ পৃথিবীতে যে ছিল প্রায় শত বছরের কিন্তু অন্তরে যে চিরশিশুর মতো নির্মল ও সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে, যে আজ তোমার দর্শনের আশা নিয়ে তুমি যে লোকে আছ, সেখানে তার অনন্ত যাত্রা শুরু করেছে, তার এই আন্তরিক মনোবাঞ্ছা তুমি পূরণ করো। তোমার ভাষাতেই বলি— ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়, মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।’

 

আবদুল্লাহ আল-হারুন
ফ্রয়েডেনস্টাড, জার্মানী, ডিসেম্বর ২০০৬

শেয়ার