মৃতের মাতৃমঙ্গল ।। মুনিরা চৌধুরী

মৃতের মাতৃমঙ্গল

__________________________মুনিরা চৌধুরী

 

দু’চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল

পৃথিবীর প্রাচীন কবরে

হায়! এ-আনন্দধারায় আমিও জেনে যাই- বর্ষা এসেছে, তাজা জলে ডুব দেবে কঠিন কাছিম…

 

পাতিহাড়ে পড়ে বৃষ্টির ফুল, চকিত হরিণ ভয় নেই তোমার

আদি বর্ষায় জল আর গহীন জঙ্গলে আমরা ছিলাম আদি ভাই বোন…

 

সর্বদা মানুষ থাকি না তাই

অর্ধেক চাতক, চাতকিনী…

 

প্রতিঅঙ্গে বৃষ্টির গজল মাখি আমি আর মৃত ঠাকুর মা (সঙ্গে তাঁর ধর্মান্তরিত প্রেমিক)

 

হায় বর্ষা! জীবিত আর মৃতের

অনন্ত মাতৃমঙ্গল…

 

 

২.

পৃথিবীর জানালায় ভর দিয়ে দেখছি

গাছের পাতাগুলো কাঁপছে, পাতার আড়ালে স্বর্গের ফল ঝুলে আছে

নদীতে নেমে-যাওয়া সেই রাস্তাটায় ঝিরঝির হাওয়ার মুখ ভেসে ভেসে ডুবে যায়…

অনেকটা ডুবন্ত মানুষের চোখে দ্রুত সরে যাচ্ছে জলের প্রবাহ

 

এভাবেই

রোকমচিন্তাহীন, ভাবেই এক জীবন…

 

আবছা গোধূলির আলো ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কেউ প্রথম বাতিটি জ্বালিয়ে দিলো

সে আলো জ্বলজ্বল করছে আয়নায়

যেন মহারাত্রির অপেক্ষায় একটি জোনাকিপোকা।

 

 

৩.

এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুত চমকায়

খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে

বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।
ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…
কতিপয় মানুষ পাখির শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়
পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে
আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি

ধর্মবিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মত পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে I

 

 

৪ .

ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম

এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু…

 

বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট

ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়

টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে

ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।

বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক

বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল…

আর আমি হতে চাই সেইজন

যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।

 

 

৫ .

সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার অপন করেছো

নিজের মতো করে

নিজের ভেতরে…

রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড

এলোমেলো চাঁদের মাংস আর

আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।

 

কে তুমি মহাকাল, ১৯১৭…

বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে চাওয়া নিম্মচাপ আজ বড়ই প্রবল…

কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে…

সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসেনি

প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে

 

 

৬ .

স্বপ্নেরও হাত আছে, চোখ আছে, ঠোঁট আছে…

দু’বছর আগের সেই শিউলি-ফোটা ভোরেরও অবয়ব ছিল

আজ গোপন পাঁজর খুলে দেখলাম

আমার জীবনের সেই একটা মাত্র ভোরের মুখখানা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে…

 

আমি সঙ্গপনে ঠাকুর মা’র পিতলের কৌটা থেকে শরৎকাল বের করে নিয়ে আসি

স্বর্গের শিশির দিয়ে ধুয়ে দেই ভোরের দুইচোখ, মথুরা বৃন্দাবনের ঘুমসমগ্র।

 

 

৭ .

আজ এই পূর্ণিমার রাতে

পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে গলিত কফিনের ভেতর

কাগজের পরতে নড়ে উঠছে জিরাফের মাথা, গোপন রক্তপ্রবাহ

প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা সাদা কাগজের মুখ মিলিয়ে যাচ্ছে গহীন কুয়াশায়।

 

স্থির দাঁড়িয়ে থাকি

গ্রহণ করি কুয়াশার কামড়…

 

একসময় সূর্য উঠে

কষ্টিপাথরের গন্ধ ফেটে পড়ে গর্ভবতী মায়ের জঠরে

জবাই-হওয়া শব্দের গলা বেয়ে সাদা রক্ত ঝরছে তো ঝরছে…

অবশিষ্ট তারা ফাঁসির জন্য ছটফট করে।

 

শব্দের ফাঁসি দেবো বলে

কাগজ কলমের বদলে বিস্মৃতির মেহেকানন্দা নদী নিয়ে আসি

শব্দের বদলে ঝুলে পড়ে ঈশ্বরের গলা।

 

 

৮.

আমার ডায়রিতে একটুও জায়গা নেই

ব্লেড দিয়ে কাটা-রাত আর নার্ভ থেকে ঝরা-রক্ত চারদিকে।

কিছু রক্ত আবার পুড়ছে। কাটা-মাংস হতে শূকরের আর্তচিৎকার ভাসমান…

ছিলে-তোলা চাঁদের খোসা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে…

 

ডায়রিতে আছে হরিণের মাথা, কাক ও পেন্সিল, আমার প্রেমিকের কলিজা ও পাতিহাড়

মৃত ঈশ্বরের কবর ও চিতা পাশাপাশি

 

আজ একপাল মৃত পাখি উড়ে এসেছে ব্যাবিলন থেকে, আরও একবার আত্মাহুতি দেবে বলে।

 

আমি ডায়রির ভেতর লুকিয়ে পড়েছি

ছায়া ও শব্দের ছাইদানীর ভেতর ছাই হচ্ছি, ছাই।

 

 

৯.

আমি জেগে থাকি

কাটা-হাতখানা অন্য-হাতে নিয়ে সারারাত জাগি

অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা

 

হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে… ঘুম লাগে

 

এইসব মুনিরা ঘুমের ঘোরে কোথাও কোনো জানালা নেই; সই সই নয় দরজার বাতাস…

 

 

১০.

ছায়া ছায়া, অন্ধকারে ডুবে হাওয়া, মুখ দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই

ছায়ার ভেতর মিশে যাওয়া দু’টি আবছা ছায়ামূর্তি

একই রকম অথচ কত আলাদা

একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর…

আর

অন্যটি সামান্য ঝুঁকে, আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টায় হাঁপাচ্ছে…

 

মাঝে-মধ্যে থেমে থেমে নি:শ্বাস নেয়ার চেষ্টা

তারপর আবার আরো ঝুঁকে টেনে টেনে চলে তার বোঝাখানি

হতচকিত হয়ে দেখতে পেলো কী সামান্য পথই না পের হয়েছে!

 

ছায়া ডুবে গেলে

ঘরের ভেতরে ঘর আর চোখের ভেতরে চোখ ঘুমিয়ে পড়ে

হয়তো জোনাকী পোকার ভেতর পৃথিবীর অবশিষ্ট আলো জেগে আছে!

 

 

১১.

পাতার পরত বেয়ে বেয়ে ঝরে-পড়া ঝর্ণার আওয়াজ

হাড় হতে হাড়ের ভেতরে…

গাছের বুক হতে পাখিদের বুক বেয়ে ধাবমান, বৃষ্টির বিলাপ।

বিক্ষুদ্ধ

বাতাসের গান…

 

বাতাসের হাত-পা-আঙুল আমাদের কাঁচের জানালায় ডুবে ডুবে যায়

গ্রীষ্মের এই গহীন সন্ধ্যায়

 

অগ্নিকালো আকাশের নিচে দীর্ঘ দাঁড়াই

আমি আর আমার ছোটবোন আত্নহত্যা

 

এখন কি পরিস্কার হলো তোমাদের আয়নার কুয়াশার আবরণ!

 

 

১২.

চোখ জোড়া যেনো ঘুমের মধ্যে গলে যায়…

উঁচু উঁচু বিশাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চালাই

নৌকায় আমার মৃত ঠাকুরমা আর মহাশূন্যের একটি পিঙ্কি বিড়াল

 

চোখবিহীন ঘুমের সর্বত্র শুধু ঘুম

কপালের দু’পাশে সাগরের ঢেউয়ের মতই নাড়ি টিপটিপ করে

মনে হয় দুই খন্ড ভাবনার সমুদ্র

 

এরপর কি হলো?

না, এর আগে কি হয়েছিলো?

অবশ্য আগে-পরে বলে কিছু নেই

যাত্রা সবসময়ই বর্তমানের

নৌকা, মৃত ঠাকুরমা আর পিঙ্কি সবকিছুই বর্তমান মুহূর্তের অস্তিত্বশীল

সবকিছুই স্থিরীকৃত

স্থির আবার চলমান

ঘুমের বিপুল ননীর মধ্যে সবকিছু দোলে…

 

মুখে চোখ নেই, চোখের তারা নেই

আছে কেবল সর্বব্যাপী ঘুম

দুই চোখের পাতা জুড়ে ঘুমের প্রপাত I

 



Munira
                                                                মুনিরা চৌধুরী

জন্ম : ৬ জানুয়ারী ১৯৭৬, গ্লস্টারশায়ার, যুক্তরাজ্য। মৃত্যু: ১৭ নভেম্বর ২০১৮, কার্ডিফ, ওয়েলস। প্রকাশিত ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ: কাম ক্লোস টো মাই আই পেন্সিল। প্রকাশিত বাংলা কাব্যগ্রন্থ: ১) নয় দরজার বাতাস ২) মেহেকানন্দা কাব্য। পেশা : বাংলা একাডেমি ইউ কে’র পরিচালক। পাশাপাশি কাজ করছেন এনএইচএস-এর সঙ্গে।


 

শেয়ার