মাহমুদ পাঠের তরিকা | মোস্তফা হামেদী

সাধারণের পাঠে ও আড্ডায় আল মাহমুদ যতটা আছে, চর্চার জায়গায় ততটা নেই। আল মাহমুদের সাহিত্য-চিন্তা তার পরবর্তী দশকগুলোতে কতটা অনুসৃত হয়েছে বা কাব্যচর্চায় কতটা প্রভাবসঞ্চারী হয়েছে, সেটা বিবেচনা করলেই এর সত্যতা টের পাওয়া যাবে।


আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে লিখতে বসে আমার কেবলি মনে পড়ছে স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেনের কথা। বাংলা ভাষার মর্মের সন্ধানে তার মতো অমন দরদ দিয়ে আগে বা পরে আর ভেবেছে কে! ফলে তাকে হাজির-নাজির করে আলাপ পাড়াটা কাজের দিক থেকে জুৎসই মনে হচ্ছে। কেননা কবিতা বিচারের কিংবা কবিতাভাষার রূপ বোঝার ক্ষেত্রে যে ‘চিন্তা পদ্ধতি’ তিনি আবিষ্কার করেছেন, বিস্মৃতিপ্রবণ ও আত্মঘাতী বাঙালির কাছে তার মূল্য অকিঞ্চিৎকর হলেও, এই অধমের কাছে তা যেন খনি থেকে আহরিত হীরামণিমাণিক্যস্বরূপ। মৈমনসিংহ গীতিকার ভুমিকায় তিনি বয়ান করতেছেন এইভাবে,

“বঙ্গসাহিত্য পৌরাণিক উপাখ্যানগুলিতে সংস্কৃত শব্দের সোনালী চুমকি দেওয়া বেনারশী চেলী পরিয়া ঝলমল করিতেছে-কিন্তু পাড়াগাঁয়ের এই সকল সরল কথা, যাহাতে সংস্কৃতের একটুকুও ধার করা শোভা নাই, যাহা নিজ রূপে অপূর্ব্ব সুন্দর,-তাহার নমুনা আমরা কোথায় পাইতাম! নানা দিক দিয়া এই সকল পল্লীগাথায় খাঁটি বাঙালী জীবনের অফুরন্ত সুধা, অচিন্তিতপূর্ব্ব মাধুর্য্য ঝরিয়া পড়িতেছে। ইহা স্বর্গ হইতে আহৃত অমৃতভাণ্ড নহে, ইহা আমাদের দেশের আমগাছের মৌচাক, এজন্য এই খাঁটি মধুর আস্বাদ আমাদের নিকট এত ভালো লাগিয়াছে। চন্দ্রকুমার বঙ্গসাহিত্যের নিজ ভাঁড়ার ঘরের সন্ধান দিয়াছেন,-উহা হোটেলের মসলা-দেওয়া মুখরোচক বিলাসখাদ্য সম্ভার  নহে, উহা আমাদের পল্লী-অন্নপূর্ণার শ্রীকরকমলের দান-জীবনদায়ী অন্নব্যঞ্জন।”

মহাত্মনের এই বাক্যগুচ্ছের মধ্যে কয়েকটা শব্দ বা বাক্যাংশ – ‘ধার করা শোভা’,‘খাঁটি বাঙালী জীবনের অফুরন্ত সুধা’, ‘নিজ ভাঁড়ার ঘর’,‘জীবনদায়ী অন্নব্যঞ্জন’ আমার কানে সুর লহরীর মতো বেজে উঠছে, আর মস্তিষ্ককে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। ফলে পাঠকের বিরক্তিকে পরোয়া না করেই এই লম্বা উদ্ধৃতি টানলাম। পরে সময়ে সময়ে তাঁর শরণাপন্ন হবো। আপাতত মাহমুদে ফেরা যাক।

মাহমুদের প্রথম কাব্য বেরোয় ১৯৬৩ সালে। পূর্বাপর আধুনিক কবিতার ভাবপরিমণ্ডলের মধ্যেই তার কাব্যযাত্রার শুরু। চল্লিশের স্বাতন্ত্র্যবাদী কবিতা কিংবা মার্কসীয় ভাবধারার কবিতা আধুনিক কবিতার পরিস্রবণের সুফল ভোগ করলেও, অন্তর্গত স্বভাবে তা বিপুলভাবে রাজনেতিক ও সামাজিক নানা অঙ্গীকারকে ধারণ করেছে। পাশাপাশি ভাষার সাধারণ প্রবণতা স্বীকার না করেই জবরদস্তি করার উদাহরণও সেখানে ঢের। ফলে ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে যখন পরিস্থিতির বদল ঘটে, তিরিশি নন্দন ফের শক্তিমত্তা নিয়ে হাজির হয়, ষাটে গিয়ে সেটা বিচিত্র ভাবধারা সহযোগে আরও দৃঢ় হয়। সেই পশ্চিমা ভাবাদর্শের জয়জয়কারের যুগে আল মাহমুদ এক অদ্ভূত সজ্ঞায় অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে কেবলা রোখ করেছেন পুবে। ইউরোপধর্মের সাথে তার এই নাফরমানি বাংলা কবিতাকে স্বভূমে বসতি গাঁড়ার সুযোগ দান করেছে। দীনেশচন্দ্রের ভাষায় ‘ধার করা শোভা’র থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি তাকিয়েছেন ‘নিজ ভাঁড়ার ঘরে’। ফলে মাহমুদ বাঙালি কবি, পাঠক ও চিন্তকদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণাদায়ী নাম।

আমার উদ্দেশ্য মাহমুদের স্তবগান গাওয়া নয়, কিংবা নয় তার নাম সংকীর্তন করা। স্রেফ কাজের জায়গা থেকেই এই লেখার অবতারণা। কী লিখবো, কেন লিখবো, কী পড়বো, কীভাবে পড়বো- এইসব প্রশ্নের সুরাহা পেতেই খুলে বসেছি মাহমুদের মোহাফেজখানা।

কবিতাকে সময় ও ইতিহাসের সূত্রে বেঁধে পাঠ করাটা জরুরি বিবেচনা আমার কাছে। কেননা কোনো আবেগমাত্রই কার্যকারণ বিবর্জিত নয়। আর কবিতা তো আরও উচ্চাঙ্গের ব্যাপার-স্যাপার। ব্যক্তির ভাবাবেগের সাথে ভাষা ও জাতিসত্তার ইতিহাস, সমসাময়িক নানা ঢেউ ও ঢং, প্রভাব ও প্রলোভন, মত ও মতবাদ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কবিতার শরীর গড়ে তোলে। ফলে কবির রুচিকে প্রশ্ন ও সন্দেহের মধ্যে রেখে আগানো ভলো। রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে করেই গড়ে উঠেছে তিরিশ। কিন্তু তিরিশকে আকুল করে গ্রহণ করার যে প্রবণতা পঞ্চাশ পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত হয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী, সেটা কেবল তিরিশি আধুনিকতার সক্ষমতা নয়, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি জাতির স্বাধীন সত্তা বিকশিত না হওয়ারও লক্ষণ। এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত। ইউরোপকে নতুন করে ফিরিয়ে এনে ঔপনিবেশিকতার পুনর্জীবন দান করে ও সুপ্ত ইংরেজিপনাকে চাগিয়ে তুলে তারা মুক্তির অর্থকে ব্যঞ্জনা দিতে চেয়েছে। তাদের সেই পশ্চাৎধাবনে সহায়ক হয়েছে আধুনিক কবিতা। সেই প্রেক্ষিতের খাপে আল মাহমুদকে পুরে নেওয়া বেশ কষ্টকর হয়েছে বটেই। এই কারণে আমরা দেখতে পাই, সাধারণের পাঠে ও আড্ডায় আল মাহমুদ যতটা আছে, চর্চার জায়গায় ততটা নেই। আল মাহমুদের সাহিত্য-চিন্তা তার পরবর্তী দশকগুলোতে কতটা অনুসৃত হয়েছে বা কাব্যচর্চায় কতটা প্রভাবসঞ্চারী হয়েছে, সেটা বিবেচনা করলেই এর সত্যতা টের পাওয়া যাবে। ফলে বলা যায়, আল মাহমুদ নিয়ে আলাপ বা আদিখ্যেতা ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে নি। এর কারণ হচ্ছে, বাঙালির ঐতিহাসিক হীনম্মন্যতা, ব্রিটিশ উপনিবেশের বাসিন্দা থাকার ফলে প্রাপ্ত এক ধরনের বোধ, যা তার যাবতীয় স্বাদেশীকতাকে ঊন ভাবতে শিখিয়েছে।

বাংলাদেশের মূলধারার শিল্প পরিমণ্ডলে সাহিত্য বা কবিতার সাথে জনজীবনের যেন সতীনের সম্পর্ক। ব্যক্তির জীবন-যাপন, সংস্কৃতি, বসন-ব্যসন, জীবন প্রণালীর সাথে কবিতার চলন বিপরীতমুখী। এখানকার সাহিত্যের সত্যের সাথে ব্যক্তির জীবন সত্যের মিল থাকে না। কেননা যে দৃষ্টি সৃষ্টিতে কার্যকর থাকে, সেটা বাস্তব পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষে গড়ে না ওঠে, পাঠের দুনিয়া থেকে গড়ে ওঠে। যে পাঠের দুনিয়া আবার গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিক আচ্ছন্নতার জায়গা থেকে। আল মাহমুদের স্বশিক্ষা এই ফাঁক ও ফাঁকির জায়গাটিকে গুঁজে দিতে সক্ষম হয়েছে। তার কাজ অন্তত এই জায়গায় অহেতু পরানুকরণের গ্লানি থেকে মুক্তির আনন্দটুকু দেয়।


তার কবিতার গোড়া অন্নদামঙ্গল, গীতিকা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হয়ে চর্যাপদ পর্যন্ত প্রোথিত। চর্যাপদের ভাষাভঙ্গিমার সাথে সংযোগ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সুর, গীতিকার সরলতা ও  অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘যাবনীমিশাল’ ভাষার সাথে পুববাংলার সহজিয়া ভাবধারা মিলেমিশে গড়ে তুলেছে আল মাহমুদের ভাষা ও কাব্যের অন্তর্জগৎ।


‘ইউরোপীয় আধুনিকতা’ বাংলাদেশে এক ভিন্ন ধরনের মৌলবাদিতার জন্ম দিয়েছে, যেখানে আধুনিককালের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে গিয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগ নামক বিভাজন সৃষ্টি করে বাঙালির পাঠের ও সৃষ্টির পরিসরকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগকে একরৈখিক-ধর্মাশ্রয়ী-পয়ারপ্রধান ইত্যাদি নানা রঙের তেরপলে ঢেকে পাঠকের দৃষ্টিসীমানা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু লায়েক ব্যক্তি এসবে ভুলবেন কেন! সেই কালো পর্দা সরিয়ে সরিয়ে তিনি দেখবেন কী আছে এর ভিতর। আল মাহমুদকে এই ফ্রন্টেও লড়াইরত দেখি। তার কবিতার গোড়া অন্নদামঙ্গল, গীতিকা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হয়ে চর্যাপদ পর্যন্ত প্রোথিত। চর্যাপদের ভাষাভঙ্গিমার সাথে সংযোগ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সুর, গীতিকার সরলতা ও  অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘যাবনীমিশাল’ ভাষার সাথে পুববাংলার সহজিয়া ভাবধারা মিলেমিশে গড়ে তুলেছে আল মাহমুদের ভাষা ও কাব্যের অন্তর্জগৎ। এ কারণেই তার কবিতা হয়েছে ওজঃগুণসমৃদ্ধ।

জন ও ভাষাতত্ত্বের নানা আলামত তালাশ করে নীহাররঞ্জন রায় দেখাচ্ছেন যে, বাঙালিত্বের পরিগঠনে অস্ট্রিকভাষীদের অবস্থান সবচেয়ে প্রাচীন ও দৃঢ়। তারা ছিলেন মূলত কৃষিজীবী। পুব বাংলার জনজীবনের সাথে সম্পৃক্ত বিবিধ কৃষি উপকরণ, প্রাণী ও বস্তুনিচয়ের নামে তার পরিচয় আজও সুলভ। লাঙ্গল, কার্পাস, পট, গণ্ডা, কপোত, ডোঙা, বেগুন, কলা, লাউ, বোয়াল, বাণ, ধনুসহ অস্ট্রিক-অনার্যদের প্রচুর শব্দ, পদরচনা ও ব্যাকরণরীতি বাংলা ভাষার স্থায়ী সম্পদে পরিণত হয়েছে এবং তা বাঙালির কুলঠিকুজির স্মারকরূপে বিরাজমান। গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিজীবী ও অরণ্যাচারী শিকারী স্বভাব নিয়ে গড়ে ওঠা কৌমজীবনই বাঙালির পরিচয়ের শেকড়।

“বস্তুত বাঙলাদেশের ইতিহাসের গভীরে তাকাইয়া যদি বলা যায়, এই কৌমস্মৃতি ও কৌমচেতনা আজও বহমান তাহা হইলে খুব অন্যায় বলা হয় না।” [বাঙালির ইতিহাস: আদিপর্ব: নীহাররঞ্জন রায়]

চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য ও গীতিকার সমাজ এই সত্যকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। আল মাহমুদও তার তুঙ্গস্পর্শী কাজ ‘সোনালি কাবিন’-এ এই কৌমচেতনা দ্বারা প্রবলভাবে তাড়িত হয়েছিলেন।

 

“বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী

জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।”

 [২-সংখ্যক কবিতা: সোনালি কাবিন]

 

কিংবা,

 

“আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?

গলায় গুঞ্জারমালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,”

[৫-সংখ্যক কবিতা: সোনালি কাবিন]

 

এভাবেই মাহমুদ ‘নিজের ভাঁড়ার ঘর’র সাথে হৃদয়ের সংযোগ সাধন করেছেন। শব্দ, সুর ও ছন্দের সে অপূর্ব সংহতি বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারার সাথে আধুনিক কবিতা ও সময়ের বিচ্ছেদ যন্ত্রণাকে যেমন লাঘব করেছে, তেমনি যোগাযোগের সম্ভাব্য পদ্ধতির ইশারাও দিয়ে গিয়েছে। মাহমুদের অনন্যতার এটাও একটা জায়গা। নতুন কোনো কাব্যাদর্শ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই মাহমুদীয় তরিকা প্রাণদায়ীরূপে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

আল মাহমুদের কবিতায় আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার দেখলে অনেকের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। অথচ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও যে আরবি-ফারসি (কামান, খরমুজা, বাকী, মজুর, গুলাল, লেম্বু, অফার প্রভৃতি) শব্দের ব্যবহার রয়েছে, এই তথ্য হয়তো তাদের কাছে পৌঁছায় নাই এখনও। ঔপনিবেশিকতার প্রভাবপুষ্ট তিরিশি আধুনিকতাকে এবং ঢাকাই সাহিত্যে কলকাতার ব্রাক্ষণ্যবাদী সাহিত্য-রাজনীতি, ভাষাভঙ্গি ও নন্দনকে মোকাবেলা করতে গিয়ে মাহমুদ আর্যপ্রভাবমুক্ত পুব বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠী যার সদস্য তিনি নিজেও, তার ব্যবহারিক ভাষা ও বাগবিধিকে কবিতাভাষায় প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। কবিতার নিবিড় ও নির্মোহ পাঠে তার এই লড়াই যে ধর্মরক্ষার লড়াই নয়, পূর্বসিদ্ধান্ত না থাকলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাংলা সাহিত্যের উন্মেষকালের প্রসঙ্গ টেনে ভারতের জওহরলাল নেহেরু মন্ত্রীসভার শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবির গাইতেছেন,

“…বিপ্লবী পূর্ব বাঙলায় বৌদ্ধমানস জনসাধারণের অবচেতনার মধ্যে মজ্জাগত। সেই প্রচ্ছন্ন চিত্তসংগঠন বদলাতে যতখানি সুযোগ এবং যতখানি সুবিধার প্রয়োজন বাঙলার  হিন্দু অভ্যুত্থান তা পায়নি। জয়দেবের গীতগোবিন্দ তাই স্ফুলিঙ্গই রয়ে গেল, দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবার অবকাশ পেল না। সংস্কৃত ভাষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টাও তাই মুসলিম বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার পরাজিত হল, বাঙালির চিত্তও প্রাচীন সংস্কার ও শাস্ত্রশাসনের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল।”

[বাঙলার কাব্য: হুমায়ুন কবির]


বাঙালি জাতিকে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে থাকতে হলে এক অনিবার্য উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। ভাষা হবে সেখানে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র। কেননা জাতিসত্তার ডিএনএ বা নকশা লুকানো থাকে তার  ভাষার ভিতরে। আল মাহমুদের কবিতা ও কাব্যচিন্তা বাঙালিত্বের জীন বহনকারী।


পরে দীর্ঘ মুসলিম শাসনে এ অঞ্চলের জনসংস্কৃতিতে ইসলামি মিথ, ভাবধারা ও জীবনচর্যা প্রভাববিস্তারি হয়েছে। জনমাসকেও বদলে দিয়েছে অনেকখানি। মূলত মাহমুদ এইসব শব্দ ও প্রকরণের আশ্রয়ে হুমায়ুন কবির কথিত ও নিজ অভিজ্ঞতার সূত্রে প্রাপ্ত পুব বাংলার স্বভাবকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেছেন কেবল।

সত্য হচ্ছে, বাঙালি জাতিকে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে থাকতে হলে এক অনিবার্য উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। ভাষা হবে সেখানে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র। কেননা জাতিসত্তার ডিএনএ বা নকশা লুকানো থাকে তার  ভাষার ভিতরে। আল মাহমুদের কবিতা ও কাব্যচিন্তা বাঙালিত্বের জীন বহনকারী। লড়াইয়ের ময়দানে তার শরণ নিয়েই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে হবে। ফলে কাজ হচ্ছে অসূয়া কিংবা ব্যক্তি মাহমুদের যাপন সংক্রান্ত নানা হিসাব নিকাশ দ্বারা তাড়িত না হয়ে তার কাব্যচিন্তার মর্মে প্রবেশ করা। রসদ সংগ্রহের সে এক দারুণ উৎস। আর এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম পথ।       

বাংলা ভাষা ও বাংলা কবিতা নানা বাঁকানদী পার হয়ে হয়ে সামনের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। সেই জলপ্রবাহে মাহমুদ যেন সুখী মাছের মতে ধেই ধেই করে নেচে বেড়াচ্ছেন। যে পথে ফিরতেই হবে সমস্ত পথভ্রষ্ট মীনকে, সেখানে তিনি এক সত্যদ্রষ্টা রাজপুঁটি। পিঠ ভাসিয়ে রোদের শরীরে এঁকে দিচ্ছেন উজ্জ্বল নকশা কোনো। আর সে নকশা ধরে ধরেই আমাদের পৌঁছাতে হবে মঞ্জিলে। কেননা ভূ-প্রকৃতিই এভাবে নির্ধারণ করেছে আমাদের সম্ভাব্য পথরেখা,

“আমরা কোথায় যাবো, কতদূর যেতে পারি আর

ওইতো সামনে নদী, ধানক্ষেত, পেছনে পাহাড়।

বাতাসে নুনের গন্ধ, পাখির পাপড়ি উড়ে যায়

দক্ষিণ আকাশ জুড়ে সিক্তডানা সহস্র জোড়ায়;

তবে কি বৃষ্টির দেশে এসে গেছি আমরা তাহলে

তরঙ্গের মধ্যে শান্ত লোকালয়, খাল বিল জলে।”

[প্রত্যাবর্তন: কালের কলস]       


মোস্তফা হামেদী

কবি, প্রাবন্ধিক

শেয়ার