আমরা যা কিছু দেখি, তার সবটুকুই মন ধারণ করে রাখে না। দিনশেষে তাই ওইসব দৃশ্যের কাছে ফিরে যেতে মন সায় দেয় না, যেখানে তৃষ্ণা তার বিপুল শেকড় ডালপালা মেলে ধরে না। একটা গান শোনা বা একটা কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা আসলে কেমন? একজন পাঠক বা একজন শ্রোতা ওই ঘটনা বা ঘটনাংশের সাথে নিজের অভজ্ঞতা মিলিয়ে দেখতে চায়। হয়ত কখনও সে ওই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে অথবা সে ওই ঘটনার মুখোমুখি হতে চায়।
সম্প্রতি মাসুদার রহমানের কিছু কবিতা পড়া হল। সত্যি বলতে আমি আগে তাঁর কবিতা পড়িনি। এই কয়েকটি কবিতা আমাকে একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। আমি যেখানে আমার কল্পনাকে এই ক্লেদ, হতাশা, ক্লান্তির জীবন থেকে ছুটি দিয়ে ভিন্ন একটা জগৎ দিতে চেয়েছি, এই কবি আমার উল্টো পথে হেঁটেছেন। আমি বলছি না তাঁর কবিতায় কল্পনার স্থান নাই, তবে জীবন এইখানে কিছুটা বেশি রুঢ়। অভিজ্ঞতা তাঁর কল্পনার মাধুরিকে টেনে অতি বাস্তবের পথে নামিয়েছে।
“আমি আর সিলভিয়া মিলে
মাছ-আড়তের পাশে বাড়িভাড়া নিয়ে আছি
শস্তায় মাছ কিনি; সহজ আমিষ খাই
আশপাশে অনেক বরফকল। আমরা প্রস্তুত আছি
আমাদের সম্পর্কের
কখনও পচন এলে; শস্তা বরফ কিনে পচন ঠেকাব”
(লিভটুগেদার)
এইখানে চিরাচরিত একটা প্রেমের আখ্যানকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে গেছেন কবি! একজোড়া দম্পতি, যারা ভালোবেসে সংসার পেতেছে, মাছের আড়তের পাশে, যারা শস্তায় মাছ কেনে, সহজ আমিষ খায়, তারা এই সহজ সম্পর্কের উপর শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রাখতে পারে না। আমরা শেষ লাইনে এসে বুঝে যাই, আসলে কেন ওই দম্পতি মাছের আড়তের পাশে সংসার পেতেছিল। তবে কি সংসার, এই সম্পর্ক এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের নাম?
“ঘুমের মধ্যে কথা বলছে বউ
ঘুরেফিরে বলছে ওর ছেড়ে আসা প্রেমিকের নাম
বলুক না
সে না হয় ঘুমের মধ্যে
আমি তো কেবল ওর জেগে থাকাটুকু
নিয়ে সুখি হতে চেয়েছি”
(দাম্পত্য)
দাম্পত্য কবিতায় আমরা এক ভিন্নতর পরিস্থির মুখোমুখি হই। এখানে দেখি এক প্রেমিকা তাঁর ছেড়ে আসা প্রেমিকের কথা বলছে। অথচ কেউ একজন তাঁর জেগে থাকাটুকু নিয়েই সুখি হতে চেয়েছে কেবল।
দুটো মানুষ যখন মুখোমুখি বসে, এবং ভাবের আদান-প্রদান না করে একটা সংকটময় পরিস্থিতি পেরিয়ে যেতে চায়, তবে কেমন হয় তাদের ভাবনারাশি! এখানে কী সাহায্য করে আসলে? এখানে সংস্কৃতি একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। দুটো মানুষ একই সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠলেও পরিস্থিতির মোকাবেলায় তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে পারে। “বাবা” কবিতায় আমারা দেখি—
“জঙ্গলের পাশে বাড়ি। বাবা হারিয়ে গেছেন
জঙ্গলে
ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে মায়ের মুখভারি সংসার
স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি
ড্রয়িং খাতায় পেন্সিলে ছবি আঁকে জঙ্গলের
এখনও স্কুলে না যাওয়া মেয়েটি
ইরেজার ঘষে ঘষে জঙ্গল ফিকে করে-
দেখে, সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন বাবা”
এখানে দেখি, এক স্কুল পড়ুয়া ছেলে যে জঙ্গলের ছবি এঁকে বাবার স্মৃতিকে ধরে রাখতে চাইছে, আর স্কুলে না যাওয়া মেয়েটি সেই জঙ্গলের ছবি ঘষে ফিকে করে বাবার ফিরে আসার পথ তৈরি করে দিচ্ছে। ভালোবাসা সম্ভবত এমনই হয়, যেখানে আবেগ যুক্তির শৃঙ্খলকে ভেঙে দেয়। এক নতুন দৃশ্যের জন্ম দেয়।
আমরা মাসুদার রহমানের কবিতায় এক চিরপুরাতন অসুখের কথা শুনি—
“লাফিয়ে নামছে অজস্র আলোর বল এবং ছড়িয়ে যাচ্ছে
নানা দিকে
যার দু’একটি এসে ঢুকলো আমার চোখের ভিতরে
অসুখে পেরুনো শৈশব একটি সামান্য ফুটবলও যেভাবে পাইনি”
(সকালের সংবাদ)
কুকুর কবিতায় আমরা এক রহস্যের মুখোমুখি হই। যেখানে একটা বিশ্বস্ত কুকুর তাঁর প্রভুর জুতো মুখে নিয়ে বসে আছে। যে জানে অথচ সে এই রহস্যের ভেদ করছে না! কেন? সে কি তবে জেনে গেছে, মানুষ দূরে যুদ্ধের মাঠে শিরস্ত্রাণ খুলে; কোমরের বেল্ট বাঁধা রিভলভার খুলে রক্তাত্ত করছে নিজেকে!
“সমুদ্রপাড়ের বালিতে একজোড়া রাবারের জুতো
সামনে নিয়ে বসে আছে একটি কুকুর
জুতোজোড়া কার? কুকুরটি জানে… কাউকে বলে না
দূর সমুদ্রের দিকে সে কেবল তাকিয়ে রয়েছে
কে তার মুনিব?
লোকটি কী স্নানে নেমে ডুবে গেছে সাগরের টানে!
কিংবা দূর বন্দর থেকে সমুদ্র জাহাজে করে আসছেন সিন্দাবাদ
কুকুরটি সব জানে, কাউকে বলে না”
এই কবিতা আমাদের একই সাথে বিশ্বাস আর বিশ্বাসহীনতার গল্প শোনায়। আমরা দেখি তাই, দিন শেষে সন্ধ্যার কাছে ছোট আপেল বাগান রেখে ঘরে যায় চাষি। ঘর এক প্রকাণ্ড আয়না, আয়নাটি সারারাত আপেল হয়ে উঠবার গল্প বলে!
আর বাস্তবতা যেখানে এতোটা বৈমাত্রেয়, সেখানে শান্ত কোন সুরের দেখা পাওয়া কল্পনার অতীত। তবু আমরা দেখি, দুপুরের বারান্দা হতে নেমে এক মেঘের ভেতর রেডিওস্টেশন; দুপুরটি গান হয়ে বাজছে।
“আমার কোথাও যাওয়া কেন যে হয় না !
অপেক্ষা দীঘিটির ঘাট হয়ে, কংক্রিট হয়ে পড়ে আছে
ঘাটে স্নানের পর রূপসী ফড়িং তার ডানা দুটো ফেলে গেছে, কুড়িয়ে নিয়ে আমি পকেটে রেখেছি
আমার ফড়িংজন্মে ডানা দুটো উড়বার কাজে লাগতে পারে”
আমরা মাসুদার রহমানের কবিতায় এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হই, আমরা টের পাই, অনেক বৃষ্টির পর উঠোনের হাঁসেরা; তারা কোথায় যেন ভেসে গেছে ! শ্রাবণ পুকুরমাঠ থৈ থৈ; ভরা সন্ধ্যের মুখে জল আর কাদা; আমরা ছাতা ও হেরিকেন হাতে কি যেন খুঁজতে চলেছি !
হাঁসের পিছনে হেঁটে কখনও কেটেছে কোন কবির জীবন ?
কবিতা পড়তে গিয়ে, আমার মনে হয়েছে তিন ধরনের কবিতাই আমি পড়ে চলেছি। এক শ্রেণির কবিতা থাকে উদ্ভট শব্দ আর বাক্যের সংমিশ্রণ। এগুলো পড়লে মেজাজ খারাপ হয়, নিজের লেখাগুলো পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আরেক শ্রেণির কবিতা থাকে, যেগুলো উত্তম সৃষ্টি, কোন বন্ধন তৈরি না করলেও খুব গোপনে একটা ছাপ সে রেখে যায়। আরেক শ্রেণির কবিতা আছে যা শুধু উত্তম তাই নয়, সে ভাবনাকে একটা ধাক্কা দেয়, নতুন কোন ভাবনার জন্ম দেয়। মাসুদার রহমানের কবিতা আমার কাছে উত্তম সৃষ্টি, আমার সাথে সে কোন বন্ধন তৈরি করেনি, তবে সে আমাকে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। আমি কি আবার পড়বো এই কবিতা? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। তাতে কিছু যায় আসে না, কেননা মাসুদার রহমানের কবিতা এক চিরন্তন সত্য হয়ে উঠতে পেরেছে, সুতরাং পাঠকের তাঁর কাছে আসতেই হবে একদিন।