মাজুল হাসানের গল্প : ভেদরেখার ওপারে ।। এমরান কবির

গল্পকার হিসেবে যখন কোনো কবি আবির্ভূত হন তখন যেকোনো সমালোচক তার গল্প বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবিসত্তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। এবং প্রায়শঃ লক্ষ করা যায় কবির লেখা গল্পে কবিসত্তার প্রভাব থাকেই। পড়তে গিয়ে মনে হয় ‘ও এখানে এরকম। আসলে উনি কবি তো। ’

কিন্তু কবি মাজুল হাসানের গল্প পড়তে গিয়ে কখনোই মনে হয়নি তিনি আসলে কবি। তিনি সচেতনভাবে তার কবিসত্তাকে গল্পসত্তা থেকে আলাদা করতে পেরেছেন। তাতে কী হয়েছে! তাতে গল্পগুলো কাব্যভারাক্রান্ত হয়নি। কাব্যভারাক্রান্ত হলে কী হয়? এটা কি দোষের? ঠিক দোষের নয়। কিন্তু এই প্রবণতা প্রায়শই গল্প তার গল্পের জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি করে। মাজুল হাসান গল্পকার হিসেব বোধকরি সচেতনভাবেই তার কবিসত্তাকে গল্পে টেনে আনেন নি।

কবিতা দিয়ে তিনি তার শিল্পযাত্রা শুরু করলেও সমান্তরালভাবে চালিয়ে গেছেন গল্প চর্চা। প্রকাশিত গ্রন্থের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রথমে তার গল্পের বই-ই বের হয়েছে। ২০০৯ সালে তার প্রথম গ্রন্থ বের হয় টিয়ামন্ত্র। দ্বিতীয় গ্রন্থটি কবিতার। বাতাসের বাইনোকুলার বের হয় ২০১০ সালে। তারপর একটু বিরতি। ২০১৪ সালে বের হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্য মালিনী মধুকক্ষিকাগণ। ২০১৬ সালে বের হয় ইশারা ভাষার জলমুক। এর মাঝে ২০১২ সালে বের হয় গল্পগ্রন্থ নাগর ও নাগলিঙ্গম। কাব্য ও গল্পগ্রন্থেই তিনি নিজেকে নিমগ্ন রাখেন নি। কাজ করেছেন অনুবাদ নিয়েও। অনুবাদ করেছেন রাসেল এডসনের কবিতা টানাগদ্যের গডফাদার (২০১৬)। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ বাবুই। যে কাগজটি প্রথম দশকের লেখকদের দারুণ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।

বাংলা ছোটগল্প-কথার প্রবাহ বাঙালির জীবন নদীতে যে ঢেউ তোলে তা শুধু কুলছোঁয়াই নয় একই সাথে কুলপ্লাবীও। বাংলা ছোটগল্পে আক্ষরিক অর্থেই দৃশ্যমান হয় জীবনবোধ, বিচূর্ণ হয় প্রচলিত ধ্যান, বিস্তৃত হয় মানবিকতার সূত্রসমূহ। এগুলোর লব্ধি ফলাফল নিয়ে যায় জীবন সংক্রান্ত সকল তাৎপর্যের ধারাপাতে। এই ধারাপাত ধারাবিবরণী নয়।

মাজুল হাসানের টিয়ামন্ত্র পড়তে গিয়ে এই কথাগুলোই মনে হলো বারবার। মনে হলো, আমাদের সম্মানিত পূর্বতনদের ভিত্তি ও অবদানের বেদীপীঠে দাঁড়িয়ে আমরা থমকে যাই নি। বরং চলিঞ্চু হয়েছি। রসায়িত হয়েছি, অনুকৃত হয়েছি, অনুসৃত হয়েছি, বর্জিত হয়েছি, নিরীক্ষিত হয়েছি। আর চলমান রেখেছি ধারা। এই ধারা নিছক মৌহূর্তিক ভাবাবেগের নর্তন-কুর্দন নয়। সংকটের সংবেদনা।

কী সেই সংবেদনা? এই সংবেদনার কোনো সংজ্ঞা নেই। এই সংবেদনার কোনো সংজ্ঞা হয় না। এর কোনো মাপকাঠিও নেই। তবে ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রান্ত অন্য ভূ-খণ্ড, সেই ভূ-খণ্ডের মানুষ … এভাবে পরিব্যপ্ত ব্যক্তির বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত রূপরস ও সংকটের উপলব্ধির ক্ষেত্রে কোথায় যেন এক সূক্ষ্ন সেতু রয়েছে। মাজুল হাসান একটি বিশেষ অঞ্চলের কতিপয় মানুষের ব্যক্তি-উপলব্ধিকে সংশ্লেষ করতে গিয়ে ওই পরিব্যপ্তির মহাজালে নিয়ে গেছেন সমূহ সংকটকে। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্নটির উত্তর তালাশ করতে গেলে ঢুকতে হবে ‘টিয়ামন্ত্রে’র এগারোটি মন্ত্রে।

প্রথম মন্ত্রটির নাম লেঞ্জা। একজন ট্রাক ড্রাইভারের গল্প। যে তার হেল্পারের কাছে মহাপুরুষ। তার চলন, বলন সবকিছুই অন্যরকম। চলতি পথে তাদের কথোপকথন আর ফ্লাশব্যাক থেকেই উঠে আসে এই দুটি জীবন আর তাদের জীবনের সাথে আরো জড়িয়ে পড়া কয়েকটি জীবনের ঘনিষ্ঠ চিত্র। তাদের সংকট ও দর্শন। কুকুর দেখলেই ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে তার দিকে তেড়ে যায়। কেন? এই রহস্যের ভেদ করতেই পেরেশান তার হেল্পার। অনেক কাটাকুটির পরও বিষয়টা ক্লিয়ার হয় না হেল্পারের কাছে। জানা যায় ছোটভাইয়ের সাথে ড্রাইভারের বউয়ের অনৈতিক সম্পর্কের কথা। ভালোবাসার নিরঙ্কুশতার কাছে এ বিষয়টি যে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য তা ড্রাইভারের কাছেও অগ্রগণ্য। বিষম পীড়াদায়ক। এই পীড়া-ই তাকে দিনে দিনে করে তুলেছে অন্যরকম। ধীরে ধীরে তা জানা যায়। তবুও মাঝে মাঝে ভালোবাসাকে ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে তার। তাইতো সেলফোনে স্ত্রী আহ্বান করলে প্রেমের দুর্নিবার টানে কার্ফু অতিক্রম করে ছুটে চলে সে । কিন্তু ধরা পড়ে যায়। শাস্তি হয়। বেয়নেটের গুঁতো খেতে হয়। সারারাত নিলডাউনের পর যখন ছাড়া পায় তখন আর বাড়ি তথা স্ত্রী তথা শেষ গন্তব্যের কাছে তার ফিরতে ইচ্ছে করে না। হেল্পার অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে। বস এতো প্যাঁদানি খেলো আবার বউয়ের কাছে যাবে না!
‘বস, ভাবী তুমার লাইগা ওয়েট কইরা বইসা থাকবো।
না রে, আসলে কিছুই বদলায় না কখনো।’

এই যে শ্লেষ, খেদোক্তি আর হতাশা , এখান থেকেই উঠে আসে আমাদের ব্যক্তিক সংকটের চালচিত্র যা ব্যক্তির ব্যক্তিগত সীমানা অতিক্রম করে রাষ্ট্র, এমনকি রাষ্ট্রের বাইরেও নিয়ে যায়।

পরের গল্পটি ‘নেইলকাটার’। আগের গল্পে একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ব্যক্তিক সংকটের মধ্যে রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক সংকটের একটা মানচিত্র অঙ্কন করা হয়েছিল। এই গল্পে উঠে এসেছে তা একজন আধুনিক মানুষের মধ্য থেকে। গল্প দুটির মধ্যে কোথায় যেন সেতু-সম্ভব যোগাযোগ রয়েছে। এই গল্পে উঠে এসেছে একজন আধুনিক মানুষের সংকট। যে একটি বেসরকারি টিভিতে চাকরি করে। অর্থাৎ কর্পোরেট পণ্য। সে আধুনিক। মিডিয়াতে চাকরি করে। কিন্তু বারবার সে ফিরে যায় তার শৈশবে। সে প্রতিনিয়ত দেখে তার নোখ বড় হয়ে যাচ্ছে কুকুরের মতো। কিন্তু সেই বর্ধিত নোখ সে কাটতে পারছে না। ব্যক্তির ভণ্ডামি, কর্পোরেট দুনিয়ার কর্পোরেসি, হারানো শৈশবে ফিরে গিয়ে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি.. .সবকিছু মিলিয়ে সে যখন নিজের মুখোমুখি হয়, ভড়কে যায়। এটাই কী হবার কথা ছিলো! নোখ বড় হয়ে যাওয়া আর তা নিয়ে তার চিন্তিত চিত্ত আমাদের সামনে দুটি বড় জিনিসের প্রতীক হয়ে থাকবে অনেকদিন। এক সে এক কর্পোরেট যুগের ক্রীতদাস, দ্বিতীয়ত এখান থেকে সে পলায়ন্মুখ সহজাত ব্যক্তি। অফিসিয়ালি যাকে আমরা প্রতিবাদী বলতে পছন্দ করি।

তৃতীয় গল্প নথাল। আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা কতিপয় চিত্র। আমরা সকলেই জানি নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান দেয়া হয়। কিন্তু এটা যে বিভিন্নভাবে মিসইউজ হয় তারই গল্প এটি। আনন্দের বিষয় হলো এই মিসইউজ-এর মধ্য থেকেই উঠে এসেছ আমাদের কতিপয় চিত্র। স্কুলের ছাত্রী না হয়েও ছাত্রী সাজার চেষ্টা, শিক্ষকদের সহযোগিতায় উপবৃত্তির টাকা তোলার চেষ্টা, আবার প্রাপ্ত টাকার উপর শিক্ষকের সতর্ক দৃষ্টি.. . ইত্যাদির মধ্য থেকেই উঠে এসেছে আমাদের সংকট ও অসততার চিত্র।

পরের গল্পটার নাম ‘দেবতা বিষয়ক জটিলতা’। গল্পের শুরুটা এরকম, ‘ বলা হচ্ছে না, কিন্তু ঠিকই ভাবছি মনে মনে– যদি তনু আত্মহত্যা করতো আর ছেড়ে যেতো চিরকুট– ‘অচিনের কারণেই… দেখলাম, পারলাম না বোঝাতে; তাই চলে গেলাম’; তবে অচিন, মাানে এই আমি যে কষ্ট পেতাম না তা নয়। তবু মনে হচ্ছে তেমনটা হলে ভালই হতো। জটিলতা! জটিলতা তৈরি করছে দেবতারা, মানে দেবরা অথবা তনু নিজেই। মাঝে মাঝে তনুকে মনে হয় শৈল্য চিকিৎসক। দোষ নিও না, নিও না। ক্ষম, ক্ষম অপরাধ.. দয়াল, ক্ষম অপরাধ। অদ্ভুত তার রোগী দেখার ধরন। দুদিন পুজো না দিলেই মন খারাপ করে। আর তৃতীয় দিন তার বেদিতে চলে আসে ভিন্ন পূজারি। নতুন কাটাছেঁড়ায় মন দেয় তনু। ঠিক করি আর নয়, ঢের হয়েছে। তবু একটা কাগজের প্লেন পাঠাই। তারপরই ডাক আসে, অথবা আসে তার আগেই.. ঠিক মনে করতে পারি না।

এই যে বলছি আমার নাম অচিন, এটাও জেনেছি তনুর কাছ থেকেই।’ প্রতিটা বাক্য আপাত সংযোগ-সম্বন্ধহীন। সিকোয়েন্স ছাড়া এই বাহ্যিকতা আপাত দৃষ্টিতে গোলমেলে মনে হতে পারে। এমনকি তার নাম নিয়েও সংশয়ী হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই আপাত গোলমেলে, সিকোয়েন্সহীন, সংশয়ী বিবরণীও যে একটি চমৎকার গল্প হয়ে উঠতে পারে তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি।

বান্ধবী বা বান্ধবীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্ষত-বিক্ষত অচিন। আসলে যতটা অচিন ও তার বান্ধবী ক্ষত-বিক্ষত তার চেয়ে বেশি ক্ষত-বিক্ষত সম্পর্ক নামীয় সত্তাটি নিজেই। আর তাদের সংকট, সন্দেহ আর সংশয়ের মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে আধুনিক নাগরিক জীবনের ব্যক্তিক সংকটের নির্লজ্জ চিত্র। আসলে কী হতে যাচ্ছে, কী হবার কথা ছিল, এভাবে হচ্ছে কেন, কীভাবে হওয়া উচিৎ ছিল এসবের সাথে ব্যক্তি ও তার পারিপার্শ্বিকতার দ্বন্দ্ব সংঘাত উঠে এসেছে এই গল্পে। এখানে রয়েছে সন্দেহের পর সন্দেহ। যা জন্ম দেয় বিভ্রমের পর বিভ্রম। ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় ঘোর। পাঠক এক মহাঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। এই ঘোর একসময় পাত্র-পাত্রীর সংশয়ী চিত্তের সাথে সহাবস্থান গ্রহণ করে। ফলে আপাত বিমূর্তরূপের ঘোর-জগত থেকে উঠে এসে পাঠক এক সময় তাদের মূর্তরূপ দেবার চেষ্টা করে। এখানেও জটিলতা তৈরি হয়। কারণ লেখক যেখানে সন্দেহ ও সংশয়ের মিশেলে পরাবাস্তব জীবনের চিত্র আঁকতে প্রয়াসী হচ্ছেন পাঠক তখন মূর্ততার ছবি আাঁকতে সচেষ্ট হচ্ছে। এটা ছাড়া পাঠকের কোনো উপায়ও থাকে না। কারণ এখানে যা কিছু পরাবাস্তব-স্পর্শী পাঠকের কাছে তা-ই আধুনিক নাগরিক মানুষের জীবন-যন্ত্রণা। এই সংকটের সহাবস্থানে পাঠকও যেন খাপ খেয়ে যায়।

আরেকটি চমৎকার গল্প ‘লালচিয়া ফুল ও ওসমান গনির কালকেউটা’। ওসমান বলে বেড়াতো, ‘ সে আসবে।’ এই ‘সে’ হচ্ছে তার নাতি। কখন আসবে? ওসমান বলে,‘ আসবে, শালবাগানে লালচিয়া ফুল ফুটলেই। তখন একটা সাদা রাস্তা তৈয়ার হবে হুসনা থেকে কালিগঞ্জের দিকে। আর যুবক তার আসল দাদার কবরে ফণা তুলে ছায়া বিছিয়ে দেয়া একটা বাস্ত কাল-কেউটা দেখতে পাবে।’ এভাবেই গল্পের শুরু, অগ্রগতি, বিকাশ ও পরিসমাপ্তি। কিন্তু এই কয়েকটি কথার মধ্যেই নিহিত আছে পুরো গল্পের নিউক্লিয়াস। এখানে আপাত সংযোগকারী শব্দগুলো ছাড়া প্রায় প্রতিটি শব্দই বিভিন্ন ধরনের প্রতীকের প্রতিনিধি। নাতি, শালবাগানের লালচিয়া ফুল, শাদা রাস্তা, দাদার কবর, বাস্তু-শাপ এগুলো। আমাদের মনে পড়ে যায় প্রাক ইসলামিক যুগে নবীজীর আগমনের পূর্বে এধরনের প্রত্যাশা নিয়ে থাকতে আরবের মানুষেরা। আর এতযুগ পরে আমাদেও এই দেশের কোনো একগ্রামে এক বৃদ্ধ ওসমান ওই সম্ভাবনার সূত্র দেখতে পাচ্ছে। তার আবার তার নাতীর মধ্যে। মূলতঃ হতাশ আর বঞ্চিত মানুষের আশার একটা আলো চাই। এই আলোর প্রত্যাশা এলাকার মানুষ ওসমান গণির মধ্যে দেখতে পায়। সে আশা দেখায়। অন্যরাও আশাবাদী হয় সংশয় নিয়েই। তারা বিশ্বাস করে আবার সন্দেহও করে। এই সন্দেহর পেছনে থাকে তাদের বিশ্বাসের কামনা। সন্দেহ করে যেন বিশ্বাসটা পাকাপোক্ত হয়। তারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বৃদ্ধ ওসমানকে। বৃদ্ধ ওসমান উত্তর দিতে থাকে একের পর এক। সবগুলোই আশার কথা। আশাহীন, বৈচিত্রহীন গ্রামবাসী তা বিশ্বাস করতে চায়। কেউ কেউ আশাবাদী হয়। কেউ ব্যঙ্গ করে। কারণ তারা এগুলোর মধ্যে কোনা কিছু খুঁজে পায় না। এগুলোর মধ্যেই তাদের জীবন বাহিত হতে থাকে। একইরকম ভাবে।

গ্রামটা ধীরে ধীরে যেন অধিবস্তব হয়ে ওঠে। চরিত্রগুলো চেনা হয়েও যেন অন্যরকম। কিন্তু কোথাও কোনা লালচিয়া ফুল দেখা যায় না। ধীরে ধীরে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে। আশার পরিবর্তে তারা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ওঠে। পাটোয়ারীর শাপ শাপ বলে চিৎকার ও নগ্ন দৌড়ের মধ্য দিয়ে তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। গ্রামের লোকজন এগুলো দেখে। উপভোগ করে। বিচলিত হয়। আশাবাদী হয়। এদিকে ‘জমিলা তার ফুলতে থাকা পেটে হাত বুলায়।’ অর্থাৎ জীবনপ্রবাহে কোনা পরিবর্তন ছাড়ায় আসতে থাকে পরবর্তী প্রজন্ম।

আলু-পটল-ঝিঙ্গা-তরই অথবা গালি সংহিতা’ গল্পটি পড়লে যে কোনো পাঠক মুহূর্তেই ফিরে যাবেন তাদের পরাবাস্তবতা মাখানো হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দুপুরগুলোতে। ‘রাজনর্তক,’ ইমেলদা-ইসমত আরার জুতো,’ ‘টিয়ামন্ত্র,’ গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় সংশ্লিষ্ট।

তাহলে মাজুল হাসানের প্রধান কৃতিত্ব কী? সংকটের চিত্র ও জীবন ঘূর্ণনের জটিল আবহ নির্মাতা হিসেবে? হতে পারে। তাঁর কৃতিত্ব আরো অনেক কিছু হতে পারে। কিন্তু যে কথাটি উচ্চ স্বরে বলতে ইচ্ছে করছে সেটা হচ্ছে তার গল্পের সাথে একাত্ম হতে পারার ক্ষমতায়। একাত্ম হবার ক্ষেত্রে কয়েকটি সত্তার উপস্থিতি বিরাজ করে। এক গল্প নিজেই। দুই এর চরিত্ররা। তিন গল্পকার নিজেই। চার পরিবেশ। পাঁচ পরিস্থিতি। ছয়.. সাত… এই সত্তাগুলোর মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেই সেই সফলতার সূত্র নিহিত। একটি সুতোয় বাঁধা না হলে এটা অসম্ভব। সুতোটি হচ্ছে ভাষা। মাজুল হাসান এ ক্ষেত্রে ইর্ষণীয় সফল। কারণ প্রতিটি গল্পেই লেখকের নিজস্ব ভাষা, কথকের ভাষা আর গল্পের আবহ উপযোগী নিজস্ব ভাষা– সব মিলিয়ে এমন এক ভাষার জন্ম দিচ্ছে যা গল্পের বক্তব্যের সাথে মিথস্ক্রিয়া করছে অপূর্বভাবে। এতে আবার কোনো পক্ষের আবেদনকেও ব্যহত করছে না। কথন ও প্রয়াসের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নেই কোনো অহেতুক ভাষার কচকচানি। নেই কসরত। আছে অপূর্ব রসবোধ। আর বিচিত্র রকমের উপমার খেলা। যাতে নিশ্চিত হয় মাজুল হাসান জীবনকে জীবনের ওপার থেকে নয় জীবনের ভেতর থেকেই দেখেছেন। আঁকতে চেয়েছেন জীবনের সার্বভৌমত্যকে।

তার অধিকাংশ চরিত্রই বিচূর্ণ। তাদের আত্মা বিচূর্ণ। তাদের আত্মউপলব্ধিও বিচূর্ণ। মাজুল হাসানের বক্ত্যব্যে ঋজুতায় আর ব্যক্তিত্বে তা ফুটে উঠেছে যথার্থ।

অক্ষর দিয়ে সাজানো আমাদের বিকল্প প্রতিবিম্বের কাছে আমরা কী চাই। কাহিনি? ধারাবিবরণী? সংকটের চিত্র? সমাধানের সূত্র? গুজব? ভাষার মারপ্যাচ? সরল গরল কথামালা? আধো বাস্তবতার আলেখ্য? কী? কী চাই? এই সিরিজ প্রশ্নের শেষ নেই। এই অন্তহীন প্রশ্নমালার শেষ বিন্দুর পরে যে মহাশূন্যতা বিরাজ করে সেখান থেকেও উঠে আসে জীবনের আলো। এই আলো বহুবর্ণিল। মাজুল হাসান এই বহুবর্ণিল আলোকে মন্ত্রষ্মাৎ করতে চেয়েছেন। পেরেছেনও।

শেয়ার