‘ভ্রুমধ্যসাগর’ পাণ্ডুলিপি থেকে স্বনির্বাচিত ১০ কবিতা | নাঈম ফিরোজ


  • অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪-এ কবি নাঈম ফিরোজ-এর প্রকাশিতব্য চতুর্থ কবিতাগ্রন্থ ভ্রুমধ্যসাগর পাণ্ডুলিপি থেকে কবি-নির্বাচিত ১০টি কবিতা পাঠকের জন্য রাখা হলো। বইটির প্রকাশক উড়কি।


গোলাপ থাকে না কাঁটা থাকে


গোলাপ থেকে অজস্র পাখি ঝরছে কাঁটায়

যেন তুমি ঘুমুতে গিয়েছো তোমার হাতে
যেভাবে ডানার ক্লান্তি
গোলাপ থেকে অজস্র কাঁটায় ঝরে—

ফ্রাউ,

ঘুম নেই বলে—
পুরনো দিন দিয়ে গেলে
দেখালে বোতামের আঁধারেও বেঁচে থাকে কেউবা।

অতুল করের দেখা আঙুল পেলো কী না
এই যাত্রা তার হিসেব নিলো না

গোলাপ থেকে অজস্র গান ঝরছে কাঁটায়

যেন তুমি শুকিয়ে গিয়েছো তোমার হাতে
যেভাবে গীতলতার রঙ
গোলাপ থেকে অজস্র কাঁটায় ঝরে—

ফ্রাউ,

সুর নেই বলে—
পুরনো ব্যথা দিয়ে গেলে
দেখালে পত্রমিতালির স্মৃতি নিয়েও বেঁচে থাকে কেউবা।


সোনালী ঘোড়ার শহর


এইসব ভিজে ওঠা মেলট্রেন
গতিহীন রেলওয়ে—

সিগারেটরঙ কুয়াশায় উড়ে উড়ে ছোটে

বেমালা পানকৌড়ি—
শাপলাবীজ ঠোঁটে নিয়ে আসে

আহা!

জেরক্স রৌদ্রশালবনে—
প্রশ্নাতীত লেখপাতা ফেলে রেখে..

নগরের মানে শ্বেতপাথর নয়
ধাতব পাত ও অনেক ঝিনুকে

এদিকে বিদীর্ণ ভেস্পার গতি কাঁধে নিয়ে
হোমা পাখির ছায়া অধীরে লুকিয়ে নামে

বেমালা সরালিরা—
শালুক ঠোঁটে করে নিয়ে এসে

এক ও অযুত আমিগ্রাম ভেবে
ব্যান্ডেজে মুড়ে দিচ্ছে সোনালী ঘোড়ার শহর


এক মহান নারসিসিস্ট এর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি


অসুবিধা হলে
হে মহান নারসিসিস্ট, কাঁদো তুমি
সকালতক, তোমার অস্তগত স্মৃতির এপিটাফ ধরে
লীডসের সবুজাভ সভ্যতার রাতে
এখানে লীডসে কোনো ভূমিকম্প নেই বলে
এইখানে অনিদ্র কাঁদছে একটা তারার ছেলেবেলা
অধীত জানালার স্বচ্ছতা মেখে ঘুমিয়ে থাকো বালিশ।

আমি পাহাড়তলি হয়ে এডেন উপত্যকায় তোমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় উপচানো
কাকভোর মাখিয়ে নিচ্ছি চোখের পাতায়।

অথচ তোমাকে প্রিয়তম, আমি মিলিনিয়াম পার্ক নির্মাণসালেই দা দিয়ে ফালি ফালি করে কবিতায় কবর রচে দিয়েছিলাম।

দূরদেশ, টিভিযন্ত্র বন্ধ, তবু বুকের মেট্রোওয়েভে নিষুতি রাতের একটানা গান শোনায় সবুজসভ্যতা, ওকে,
তুমি, আমি ও আমরা মিলেই একজন
এ শীতালু অন্ধতায়
আমরাই একে অন্যের হত্যাকারীকে ভালোবাসি আজ।


চতুর্দশপদী অ-কবিতা


ভূমিতল থেকে অংকুর দু’চোখ মেলে নিমীলনে

অপেক্ষা পুড়িয়ে, নির্মোহ বায়ুলীন— আলো উর্মিলে

অববাহিকায় সভ্যতার, রক্ত-শিলা ফুঁড়ে— উপলে

অতোটা শক্তি-সঞ্চার কে করে বীজশিশুর মনে?

রশ্মিবিদ্ধঃ সূর্য অরুণিমা পদচিহ্ন-ভাষা জেনে

মর্মমাধুরীতে সে— সবুজ প্রাণের খোলস খোলে।

এরা রক্তদ্রোণ— কী লোহিতাভ ধ্যানে, মেঘকৌশলে

জাদু— হৃদস্পন্দনের দিশা আনে প্রাণ-অক্সিজেনে!

 

আগুনে-মেশিনে যত রূপান্তর— মিহি আসবাব

মহীরুহ মেনে নিলো, অবয়ব মেটামর্ফোসিসে

কী মনীষা মানুষের;  সুখ-উপযোগের সন্ধানে।

কাল ও ভূগোলের মানচিত্রে— প্রতিবর্গ  হিসাব

নির্ণয়ে ভুল করে হে ভবিষ্যৎ— ভুগবে সিরোসিসে!

কৃতজ্ঞ করো মানুষ— থেকে যাও, বৃক্ষ-অন্তঃপ্রাণে।


অর্জুন


মালবেরিরা মুলজান নদীর পাড়ে—

দেখো থোকায় থোকায় ফেটে ফেটে যাচ্ছে

—মেষচোখী রোদে

লজ্জার সাইকেলে হিম এই শহরে

ব্যায়ামের শব্দে
যারা মাংসল বেজে যেতে যেতে একদিন

গাণ্ডিবে মেখে নিয়েছিলো মুমুর্ষা

হুংকারের হুলিয়া ঝুলিয়ে জানিয়েছিলো—

‘সামনে বিপজ্জনক বাঁক’!

রক্তদ্রোনের দিন আজো

ক্লিশে সব স্মৃতিকরপোরেশন

ম্লান মালবেরিদের বন,

আততায়ী হেরে গেলে—

সেসব বেরিদের বর্ণ আজ মনে নেই।


নীল বিকালের আকরিকে


চল্লিশ মিনিট পরে—
বাড়াবো পা
হাতের আভায় তাই ভাটা পড়ে যাচ্ছে।

এই সেই
পদেপদে-গুপ্ত-বিপণন-ইচ্ছা-জাগানো-অন্তিম শহর।

এইখানে আমাদের তাড়াচ্ছে চোখভয় ও শীতলতাপ।

নীল বিকালের আকরিকের ভিড়ে—
পশ্চিমদেশের লোহার ঘড়ির দিকেই
তোমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া যাক।

ওখানে আমার
কোনো না কোন সন্তের সাথে—
রাতভর গল্প করার সু্যোগ হবে।

যেখানে ঘাসের গাড়ি
চুপ হয় বাসের পিছু পিছু—

ইয়র্ক, ইংল্যান্ড
৩০ জানুয়ারি | ২০১৭

 

প্রমুখ চুমুর হবু স্বপ্নের পর


নক্ষত্র থিতু হয়ে, হয়ে যায় অজস্র জিপসিফুল
নিয়ে শৌর্যকংকাল, শহীদের ভ্রূণ
পাপের পাঁপড়ি থেকে খসে পড়ে যাই
অতন্দ্র তুর পাহাড়ে অতীন্দ্রিয় মেসিয়াহ যেন
মার্সেই নদীর কল্লোলময় লোককথা শুনি আমি।
মুহ্যমান যখন এক প্রবল মাকাল পাতাল
বানিয়ে নিচ্ছে ব্রিটিশবেহুলার ক্লোন
অনুবীক্ষণ-এর নিচে শৌর্যকঙ্কাল
ঘাড়ে কুমিরের ক্লান্তি ও
বিষাক্ত ভেন্ট্রিলোকুইজমের নাজাতের আঘাত
উবে যাচ্ছে যখন প্রিয় মানুষের ইতঃস্তত চোখ চিবুক ঠোঁট হাসি প্রমুখ চুমুর স্বপ্ন

তখন
না শব্দে না স্বপ্নে
শহীদেরভ্রূণ উড়ছে
এখানে ওখানে
আমিও ফিরে যাই ভ্রান্তির মানচিত্রের বুল্ভারদে
দুনিয়ার শানদার গ্যালারির পরান্মুখ দেয়ালে দেয়ালে
বেশুমার সেমিটিক শিশুদের অশ্রুলীন সুরমাচোখে
যেন জোর করে করে মানবাধিকার জপতে জপতে
লেগে যাই এই আমিও, ম্লান অম্লানতায়।

নফল ছুটে গেলে কাঁদো নকল মান্যবর
তোমাদের কেতা, মখমল, অমল অসার
হেরেমে হিঁচড়ে নিয়ে পৃথিবীরে আর
তিনভাগ নীলজল তার
মুখের লালায় চোখ ভিজাও বাহার
প্রমুখ চুমুর হবু স্বপ্নের পর

যে পৃথিবীর রায়ট-ই-ভূগোলবিদ্যা গ্রন্থে পাতায় পাতায়
আলেপ্পো, নাজাফের পর প্যালেস্টাইনে থির থেঁতলে আছে মায়ের লাশ
পাশে শিশুসব অল কোয়াএট !
অল কোয়াএট অন দ্য ওয়ার্লডস ‘ফা*ড আপ’ ফ্রন্ট!


গানপ্রতিম সোনালি অন্ধকারে


ফিমেল এক দোয়েল
এখানে বসেছিলো জবুথবু—

একটা নীল গ্রানাইটে —
আত্মহননের জন্য অপেক্ষমাণ
আর ভীষণ আহত!

— দহে সে
রহে সে
সহে সে

(শি)সে ডোবে যার— প্ররোচনা, প্রেম, পাপ
প্রেমিকপ্রবর রাজহাঁসেদের মলিন ডাক

রা নেই তার
রি রি নেই তার
খুনে রিরংসাঘুম ছড়িয়ে পড়ছে— তার চোখে, ডানায়

একরাশ সোনালি হরিণ বসে আছে
আগেই যেখানে,
গানপ্রতিম অন্ধকারে

(শি)সে অস্তাচলের আলোয় হরিণ গোনে
শিসে ডোবে যার— প্ররোচনা, প্রেম, পাপ

অগ্রাহ্য এক ঘোরে ডাকছে বসে

ফিমেল এক দোয়েল—
সুগায়ক আর শাশ্বত পালকের, ছোট


এক একটা গুড ডায়নোসরের গান


অ্যান্ড্রোমিডায় যাওয়ার পথে আমার কান্না জমছে।
চাঁদকে ঘুমিয়ে যেতে দেখি আমি রোজ ভোরে
আমার পিতার চোখের জলে।

বস্তুত অতলান্তিকে ভাটি নেই, ভাটিয়াল কোনো।

সব মায়া পরান্মুখ হারিয়ে গেছে!

গ্রীনহাউজের বন্দিনীর উবে যাচ্ছে জলচোখ।

অভ্রপুস্পও এনডোরস করে দেয়…
এই না শাশ্বত উড়াল!

রাইমাধবের দিন, ক্রমাগত সিতাংশু হতে থাকো।

সুবিনীত সাক্ষরতার নিচে আমার পিতার পোড়ে আত্মা।

আমি কাহাতক আর্চডিউকের একাকীত্ব মুছে ফেলি
আর ডাইনোসরগোষ্ঠীর মনের বাও খুঁজে পাই!

কাঁদো ডায়নো কাঁদো!
তোমাদের হিমেল বিলুপ্তির দিনে আমার রক্ত ঝরে ভাই।

ডানা মেলে চাই
রোদছাওয়া অমল সূর্যশব।


টাকাবন মোর


উন্মীল দিন— উর্মিল মন, এক হবিয়িস্টের মন— বড় বেশি উথলায়— উবারে চড়ছে সে— ধানমন্ডি উনিশ থিকা— বেশি দূর কই তুমি— তবু তার দিল আনচান, পকেট করে ভাঙচুর

টাকাবোন মোর— কও তুমি কত দূর?

বৃষ্টিডানার পাখীরা তোমাতে বেঁচে— নাকি তুমি বেচো ওদের— জোড়ায় জোড়ায়— এই রোযায়

মিসেস মুনিয়ার চোখের রজতশুভ্র জল তুমি
আমলে নাও না কেন— মহাত্মা টাকাবন মোড়?

টিয়ায় কান্দে, খরগোশ, বিলাইয়ে করে রোনাজারি
সারমেয়ী দেয় সান্ত্বনাবাণী

আমি জানি— জানি আমি
উত্তল নীলের ক্ষেতের পর হাতিরপুলের আগে
তোমার চেয়ে কেউ নয় নামী আর দামী

ফ্যানসিয়ার পিজিওনখোর—
রঙিলা মাছেদের শরীর বেচে
কী হচ্ছে আকাশে মুক্তা সেঁচে

জিয়ল মাছের বন
কয় পাখী দূর তোমার লোকেশন থিকা
কারওয়ান বাজারে গিয়া বলে কে লাল মাছ দাও— দাও না গ্লাস ফিশ— ওয়াও, বলে বোয়াল

খোদ ঢাকা বলে আরেকটা গাও— সবই ফাও— গাও ম্যান, ওয়ান মোর!

আমি ভাবি— যাইয়া তোমায় বলি—

ওগো— বৈধ চিড়িয়ার মোকাম

আমার জন্য আমদানি কইরা নতুন কী জাত আনিলা ম্যানিলা থিকা, নরমঠুঁটি মুনিয়া বা মোমজ ঠোঁটের ম্যানিকিন—

গিয়া দেখি কিছুই নাই— কী একটা অবস্থা আজ তোমার,
বলো, এলা— কী আমার কাম?

আলুলায়িত আমি
উন্মাদ এক ফিঞ্চ-এনথুসিয়াস্ট— উন্মার্গগামী
যাব পুরান ঢাকায় ঐতিহ্য খেতে, তা না, খুঁজে চলি কোথায়— মাকাল ফলের মোকাম

কেন আমি সব রেখে ছুটেফুটে এলাম
কী হলো আমার—

টাকাবনে এসে শুনি অতলান্ত মর্সিয়া

হায় আমি এ কোথায় এলাম—
হেরি অগণন—
পিঞ্জিরায় বেটা ফিশ দাপড়ায়
পঙ্খীরাজের খোঁজে উড়ে যায় এন্তার একোয়ারিয়াম!


নাঈম ফিরোজ

জন্ম ডিসেম্বর ২৬, ১৯৮৩, ঢাকার ধানমন্ডিতে।

প্রকাশিত বই

• গ্রীনহাউজের বন্দিনী (কবিতা, ২০০৮, ভোরের শিশির)
• উবে যাও জলচোখ (কবিতা, ২০১৬, মূর্ধণ্য)
• পৃথিবীর শেষ কয়েকছত্র মেঘপত্র (কবিতা, ২০১৭, তিউড়ি)
• ভ্রুমধ্যসাগর(কবিতা, ২০২৪, উড়কি)

সংকলন, অনুবাদ ও সম্পাদনা

The Poetics of Green Delta [International Anthology of Poetry from Bangladesh Era(1971-2017), by Bangla Academy UK. Published from London, 2017]


 

শেয়ার