“সবুজ ক্ষেতের কাছে ঋণী হতে চাওয়া চোখ
একদিন দেখল—
শহরের শরীরে সায়ানাইড মিশে গেছে!”
– শ্বেতা শতাব্দী এষ। একজন ভ্রমণরত কবি! (আমি ভ্রমণরত কবি বলেই ডাকবো। বোধ করি, বারবার নামের উচ্চারণে শব্দ বিভ্রাট হতে পারে।) পৃথিবীর সমস্ত আয়োজনে যিনি ঢেকে রাখেন নিজস্ব চোখ, আমরা সে চোখ দূর থেকে দেখি না। তবু শব্দে, বাক্যে, ভাবে যে লিরিক তিনি নিরন্তর লিখে চলছেন, সে লিরিক বেঁচে থাকার কথা বলে। কখনো আবার হাহাকারে বিপর্যস্ত একটি অবয়বের সন্ধান করে দেয়। যে অবয়ব তিনি প্রতিনিয়তই সৃষ্টি করছেন, ধ্বংস করছেন। অথচ বিপর্যস্ত অবয়বটিকে স্মরণে ঠিকই খুঁজে চলেন, হয়তো এটাই আবহমান। একজন প্রোটাগনিস্ট, যে পৃথিবীর সমস্ত ভারসাম্যহীনতাকে নিজ চক্ষে ধারণ করে। এবং স্থিতি ধরে রেখে আমাদের দেখায়- কেমন করে ভারসাম্যহীনতায় বেঁচে থাকতে হয়। সেই স্থিতি ঠিকই বেঁচে থাকে, তারপর আরও কিছুকাল বিপর্যস্ত মুখায়বের জন্য অপেক্ষা করে একদিন থেমে যেতে হবে। একটা শক্তিশালী চরিত্রকে দিনের পর দিন ভাঙা-গড়া নিয়মের ভিড়ে টিকিয়ে রাখার এই যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা, মূলত এখানেই সান্ত্বনা জমা হয়।
কখনো হতাশ হলে পরে নিজস্ব লিরিকে তিনি বুঝিয়ে দেন, যেন আমরা প্রকৃতির কাছে দ্বারস্থ হওয়া শিখে নিই। যেন অনিশ্চিত যাত্রায় জীবনের রঙ অতি সহজেই চেনা যায়, তবু মানুষের আদিম দুর্বলতা এবং দ্বারস্থ হওয়া প্রকৃতি ভিন্ন কথা বলে যায়। দূর থেকে এইসব ভিন্নতার একটাই মৌলিক রঙ থাকে, আদতে ভিন্নতার প্রশ্নতো তখনই আসবে, যখন ভ্রমণরত কবিকে তার স্বরূপে চেনা যায়। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষের সংস্পর্শে এসে যতটুকু আলো চেনা যায়, দূর থেকে তাকে একটি রঙেই চেনা যায়। দূরের দূরত্ব প্রবল বলেইতো কৌতুহলী চোখ সান্ত্বনাস্বরূপ বেঁচে থাকে, অন্তত নিখাদ অবলম্বন এমনই হয়ে থাকে। ভ্রমণরত কবির কবিতায় যে অনিশ্চিত যাত্রা দেখতে পাই, ভ্রমণরত কবিও তেমনি এক যাত্রায় অন্তলীন হতে চলেছেন। বস্তুত মানুষ মাত্রই যাত্রা, বিদায়, অন্তলীন এইসমস্ত শব্দেরই অলিখিত মিশ্রণ। যে মিশ্রণের নিয়তি বলে কিছু নেই, কেবলই আছে আকস্মিক আকর্ষণ। এমন অজস্র আকর্ষণের সংকেতস্বরূপ খুঁজে পাই, ‘সেই মনোরোম মনোটোনাস!’ কবিতাটি মুহূর্তের ছোঁড়া সেরা উপহার, যা তিনি নিজস্ব ধ্যানের ভিতরে থেকে আমাদের বুঝিয়েছেন। কবিতাটির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে,
“এই যে বৃষ্টির গান, ইলেক্ট্রিক তারে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে, সেই গানে ভালো না থাকা ধুয়ে যায় একটু একটু করে
___এই মনোরম মনোটোনাসে এরকম ভাবি,
এই ঘরে, এই অন্ধকারে”।
পড়তে যেয়ে এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হলে পরে আকর্ষণ শব্দটি নিয়েও ভাবতে হয়, এখানে আকর্ষণ বলতে যা বুঝায়, হয়তো তা পড়ার পরই হৃদয়ঙ্গম হতে পারে। ভালো না থাকা কিংবা ভালো থাকা, এসবই মূলত সেইসব অলিখিত মিশ্রণের অংশবিশেষ। যদি প্রশ্ন আসে বারবার কেনো প্রেক্ষাপট বদলে একজন ভ্রমণরত কবির কবিতা নিয়ে লিখা হলো, তবে অনুসন্ধানী চোখেদের জ্ঞাতার্থে বলা যেতেই পারে, একজন ভ্রমণরত কবির জন্ম বারবার হয়, একেকটি কবিতায় তিনি আলাদা বিশ্বাস কিংবা বিস্ময়ে আমাদের চোখে ধরা দেন। সুতরাং প্রেক্ষাপট যদি বারবার বদলেও যায়, একজন ভ্রমণরত কবিকে চিনে নিতে কষ্ট হবে না নিশ্চয়ই! এই যে কবিতার ভিতর দিয়ে ভাবাবেগ বদলে যাচ্ছে, প্রসঙ্গ বদলে যাচ্ছে, এর কোনো কিছুই কৃত্তিম নয়। কেননা ভ্রমণরত কবি তো স্থির নয়! যাইহোক আমি তো কনফেশনাল স্টেটমেন্ট লিখতে বসি নি, ভ্রমণরত কবির কবিতায় অনিয়ন্ত্রিত সংযোগ স্থাপন করতেই এসেছি। তাহলে এবার ‘সাজকক্ষে’ ফেরা যাক! ‘সাজকক্ষে’র ভিতর থেকে দুটি লাইন উল্লেখ করা যেতে পারে,
“এখানে যুদ্ধ কার সাথে কার,
যুদ্ধভূমির ভৌগোলিক সীমা অথবা লক্ষণরেখা কোনো কিছুই নির্ধারিত নয়”।
দুটি লাইন খুব সাধারণভাবেই বোধের উপর আঘাত হানে, কেননা নিত্যদিনের এই আঘাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলেই লাইন দুটি সাধারণ কিংবা স্বাভাবিকভাবে ধরা দেয়। তবে আমি বলবো; লাইন দুটিতে, যুদ্ধের অনুকূলে বেঁচে থেকে নিরন্তর পথ চলার এক মোহাচ্ছন্ন সুর খুঁজে পাওয়া যায়। যে সুর এক করুণ মানবকে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে আসে। বস্তুত করুণ মানবের মাঝেই আমরা মুহূর্তবিশেষে আবহমান হতে চলেছি। এই যেমন,
“বেঁচে থেকে থেকে, আয়তক্ষেত্রে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সৌম্য ভাবে__
হেরে গেলাম”!
অন্তত ‘সাজকক্ষে’ ফিরে এলে বোধের এমন আশ্চর্য প্রতিফলন আমাদের ভাবায়, যেহেতু ‘যুদ্ধটা সমভাবে চলমান’! আমাদের নিঃসঙ্গ মুহূর্তের উজ্জ্বল অথচ ভিন্ন চোখে দেখলে ধূসর এক ভ্রমণের নাম, ‘সাজকক্ষে’। যে কক্ষে প্রতিটি মানুষই একা, আর এই অনিবার্য। যদিও সময়ের পালে সুর কখনো কখনো ভিন্ন পথের সন্ধান করে দেয়। নিজস্ব কক্ষের ভিতরে আমাদের কোনো দায় থাকে না, হয়তো থাকেও। যেহেতু কক্ষে আবর্ত প্রতিটি মুখ নিঃসঙ্গ, এবং নিজ কক্ষে আবর্তমান। এই আবর্ত হওয়াকেই বিচ্ছিন্ন মানুষেরা অর্থাৎ আমরাই একমাত্র দায় ধরে নিয়েছি। কখনো মুহূর্তের বিপরীতে চলে গেলে হৃদয়ে হতাশা জাগে, আমরা তখন সমস্ত দায় প্রকৃতিতে মিশিয়ে দিতে চাই। আমাদের এ ইচ্ছে হুট করে জয়ী হওয়া কোনো মুহূর্তের ফলাফল নয়, এই ইচ্ছে অবশিষ্ট রাতের জন্য এক সুখগাথা, কিংবা সান্ত্বনা। লক্ষণীয় হলো ‘সাজকক্ষে’ও ভ্রমণরত কবি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, যেন আমরা প্রকৃতির কাছে দ্বারস্থ হওয়া শিখে নিই। ‘সাজকক্ষে’ ঘুরে ঘুরে এবার ভ্রমণের সুরে অন্য কোথাও যাওয়া যাক। তবে এর শেষ তিনটি লাইন উল্লেখ না করে পারছি না, হয়তো তীব্র আকর্ষণই কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে। ‘সাজকক্ষে’র বিদায়ী চিহ্ন তবে উচ্চারণ করা যাক,
“পৃথিবীর সমস্ত ট্র্যাজিক নাটকে সৌম্য শুধু এক করুণ মানব।
যুদ্ধবিজিত ক্ষত, ভাঙা রথ পড়ে রয় মঞ্চের পাশে__
সাজকক্ষে সে কখনো মুখোশ পড়ে না”!
একজন সৌন্দর্যপিপাসু পাঠক হিসেবে সৌন্দর্য নিয়ে আমার কিছু বলার ছিল। কিন্তু লিখতে যেয়ে এ পর্যায়ে এসে কেনো সৌন্দর্য নিয়ে কিছু বলবো! নিশ্চয়ই বিগত লাইনগুলিতে সৌন্দর্যের কোনো ছায়া পড়ে নি, যে কারণে অসচেতন মন এবার সৌন্দর্যে প্রবেশ করতে চাইছে। তবে সান্ত্বনা এই যে, একজন ভ্রমণরত কবি নিজস্ব সত্ত্বায় লীন হয়ে থাকে বলেই সৌন্দর্য সেখানে নির্লিপ্ত থাকে, অথবা হতে পারে সে নিজেই ঢেকে রাখে তার রূপ। আর যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় তা হলো, আমাদের নির্মিত সম্পর্ক সমাচার। কখনো সম্পর্কে সুন্দর খোঁজা হলে দেখা যায়, বিপরীতমুখী সুর আমাদের অন্য কোথাও নিয়ে যায়। এই অন্য কোথাও বলতেই বিভ্রান্তি নামক শব্দটির জন্ম হয়। যে জন্মের বর্ণনা শুরু থেকে এখন অবধি কেবল প্রলম্বিতই হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সুপ্ত ইচ্ছের ভাষা কঠিন হলে পরে যা কিছু দূরের এবং বিপরীতে যা থাকে, তাই জীবন। নিসন্দেহে সুখময় জীবন! এমন আবহমান বিশ্বাসেই প্রলম্বিত হতে হয়। যে কারণে ‘বিপরীত দুরবিনে দেখি’, মূলত আমরা সবাই দেখি। তাই সহজকে ভালোবেসে বলা যেতেই পারে, যা দেখি, তাই সুখ। আবার কখনো কখনো সুখ বলতেই আক্ষেপকে বুঝি। দেখার এমন দ্বৈত অনুবাদ আমাদের শিরা, উপশিরায় মিশে আছে। যে কারণে একজন ভ্রমণরত কবিকে নিয়ে লিখতে যেয়ে কেবলই বিচ্যুতি এসে অন্য পথ দেখায়, অর্থাৎ বিপরীতমুখী! তাই দেখি, ‘বিপরীত দুরবিনে দেখি’,
“সময় সেলাই করে এমন এক সুচশিল্পী
পৃথিবীর অক্ষাংশে যাবতীয় অতীতের সমাধি তুলেছে।
এখন হাতঘড়ি উল্টালে আলোকবর্ষ পথ
টুপটাপ ঝরে পড়ে দূরত্ব, শূন্যভূগোল___
এরকম দৃশ্যরা কোনো কোনো জানালায় ভেসে উঠে
আবছা পাহাড় যেন আলগোছে ভরে যায়
শাদা শাদা অজস্র মুহূর্তফুল!
এইমাত্র যারা চোখ ছুঁয়ে আছে”
বেঁচে থাকা প্রতিটি মুহূর্তই ভ্রমণের ভিন্ন নাম। কিন্তু জীবনালেখ্যে সব মুহূর্তই কি স্থান পায়, কিংবা আমরা কি মনে রাখি! ভ্রমণের ভিতর দিয়ে বয়ে গেলে স্রোতমুখী দ্বন্দ্ব আমাদের থামাতে বাধ্য করে, আর যখনই বিরতির পালা শুরু হয়, নিজ চক্ষে আমরা তখন প্রতিফলন দেখি, কিংবা ক্ষরণ দেখি। তাই এখানেই বিশেষ অবিশেষ এর দ্বন্দ্ব কিছুটা ভোগাতে পারে। যদিও এই ভোগ আদিম, এখানে আমাদের কি হাত! যে কারণে ভ্রমণরত কবিকে নিয়ে সেইসব বিরতির পালা লিখা হলো। সহজ করে বলতে গেলে যা বলা যায়, তা হলো, বিশেষ বিরতি। এমনই এক বিশেষ বিরতিতে আমরা দেখি, ‘বিপরীত দুরবিনে দেখি’, যেখানে আমাদের দেখা ধ্রুব বলে মনে হয়। এবং সত্যিই এই কবিতাটিকে আমার স্থির মনে হয়। কেননা যখনই এর গভীরে চলে যাই, মনে হয় যেন এইমাত্র ভ্রমণরত কবিকে চেনা গেলো। চেনা হয়ে গেলে একটা দীর্ঘ যাত্রার প্রয়োজন হয়। বস্তত ভ্রমণরত জীবন তো যাত্রাতেই লীন হবে, আর এটাই নিয়ম। বিশেষ বিরতি শেষ হয়ে গেলে দৈন্য হৃদয় ‘ভাববিদ্যুৎ’ এ চমকিত হয়। আজন্ম কৌতুহলটিকে বুঝতে পেরে চমকিত হওয়া, বোধ করি মন্দ হবে না! ‘ভাববিদ্যুৎ’ এ চমকিত হয়ে এবার দীর্ঘ যাত্রায় মিশে যাবো। তার আগে ‘ভাববিদ্যুৎ’ থেকে একটি লাইন উল্লেখ করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস, লাইনটি লিখা হলে পরে ভ্রমণরত কবিকে নিয়ে লেখা বিগত বিভ্রান্তির একটা ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে।
“এক বিকেল স্তব্ধতার কাছে বলা হয়ে যায় অনেক কথা, তোমার অশ্রুত”!