হোশাং/হোশাঙ্গ মার্চেন্ট মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া ভারতের বিখ্যাত কবি। এই কবি সেদেশে প্রকাশ্যে সমকামিতার অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া প্রথম কবি। ওনার লেখা গীতিগদ্যধর্মী আত্মজৈবনিক বই ‘দ্য ম্যান হু উড বি কুইন’ সম্প্রতি বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি ‘যে রানি হবে জানি এক আত্মপুরাণ’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন সৌরভ রায়, যা প্রকাশ করেছে তৃতীয় পরিসর। বইটির অনুবাদকের ভূমিকা রইলো শিরিষের ডালপালার পাঠদের জন্যে…
লক–ডাউন ছিল এক বিচিত্র গর্ভাবস্থা। ভাগ্যবন্ত আমরা ‘স্টে হোম স্টে সেফ‘ থাকতে পেরে, আতঙ্ক আর আলস্যের যুগ্মবীজে গর্ভবান হলাম। পুরনো ভ্রূণ এক এক কোষ করে মরছিলো আর তার স্থানে ফুটে উঠছিলো ভয়াল ‘নিউ নর্মাল‘। এই বাংলা অনুবাদের গর্ভাধানও সেই সময় নাগাদ।
আন্তর্জালে আমাদের পরিচয় হবার পরে … এক দমে ‘The Man Who Would be Queen : Autobiographical Fictions’ (Penguin India 2011, 2018)পড়ে ফেলার পরে … আর আমার বাংলা অনুবাদের প্রথম নমুনায় ‘তৃতীয় বিশেষজ্ঞ‘-এর অনুমোদন পাওয়ার পরে পরেই… লেখক সবুজ পতাকা দোলালেন।
অস্বাভাবিক সহজ সাবলীলতায় এ কাজ শুরু হয়েছিলো। হোশাঙ্গের প্রথম আত্মজীবনীকে তাঁর বাংলায় অনুবাদ করার আগ্রহ, আর সেই রাণীকাহিনীকে আমার বাংলায় পড়ার আগ্রহের মিলন – যেন দু‘য়ে–দু‘য়ে চার হবার জন্যই অপেক্ষা করছিলো।
কিন্তু এই ‘অস্বাভাবিক সহজ‘-এর গোড়া কোথায় ? বলা ভারি কঠিন। বর্ষাধিক সময় পেরিয়ে ফিরে দেখা সত্ত্বেও। পরিস্থিতি,আগ্রহ,রসদ সবকিছুর রাজযোটক হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু চেষ্টা করা যাক এই সহজতাকে আরেকটু তলিয়ে জানার। কারণ ‘”হোশাঙ্গ মার্চেন্ট, এখন বাংলাতেও উপলব্ধ” এই বস্তুটি ঠিক কোন ধাতুতে গড়া তা বোঝার জন্য এটা জরুরি ।
লেখক–প্রদত্ত কোন লাগসই উক্তি এখানে আমাদের কাজে আসবে না। এই ভূমিকা লেখার আগে বাংলা অনুবাদে তাঁর আগ্রহের কারণ জিজ্ঞেস করলাম। হাজির–জবাব হোশাঙ্গের বাণী এলো “আত্মজীবনীতে কখনও লেখকের মুখবন্ধ থাকতে পারে না।” তার পরে তিনি জানালেন, “অনুবাদকের ভূমিকায় লেখকের কথা কওয়া শোভা পায় না।” অতএব লেখকের বাংলায় অনূদিত হ‘বার ইচ্ছাকে অনুবাদের ভারও আমার। সেই ইচ্ছা থেকেই আপনার হাতে ধরা এই বইটির জন্ম কিনা, তাই এ ভার আমায় নিতেই হ‘বে।
হোশাঙ্গ মার্চেন্ট অনূদিত হয়েছেন হিন্দিতে (কিছু নিজেই করেছেন), এবং তেলুগু, মালয়ালম, ক্রোয়েশিয়ান, ব্রাজিলিয় পর্তুগিজ, জার্মান, ইটালিয়ান আর এস্পেরান্তোতে। কিন্তু এই বাংলা অনুবাদটির আগে, আশ্চর্যের কথা, তাঁর মাত্র গুটি কয়েক কবিতা অনুবাদ হয়েছে বাংলায়। হোশাঙ্গ মার্চেন্টের ৭৫ বছরের জীবনে (জন্ম ১৯৪৭), তাঁর নামাঙ্কিত ৫০টি ছাপা বই আর ৩৮টি ই–বই প্রকাশ হয়েছে (কবিতা, গদ্য, সমালোচনা, সম্পাদিত বই, অনুবাদ, সাক্ষাতকার)। আরও আশ্চয্যি এই যে, ৯০–এর দশকে (তার পরের দশকেও কিছু) তাঁর বেশীর ভাগ বইয়ের প্রকাশ ক্যালকাটা থেকেই (তখনও এ শহরের নাম কলকাতা হয়নি)। সাহিত্যমন্ডলে ব্যাপকভাবে পঠিত, অনূদিত, প্রচলিত, সমালোচিত, ঘৃণিত আর সম্মানিত – বাংলাপ্রেমী হোশাঙ্গ মার্চেন্ট বাংলা আর বাঙালিতে বহু আগে থেকেই মাখো–মাখো হয়ে আছেন, কিন্তু বাংলায় অনূদিত হননি তবুও।
বাংলায় প্রকাশিত হতে কেন ‘পথে হ’ল দেরি’ সে প্রশ্ন করলে লেখক এড়িয়ে যান, মার্সেল প্রুস্ত-প্রশ্নমালা (Proustian Questionnaire) গোছের জবাব দিতে থাকেন। সে সব শুনতে বেশ মজার আর ছাপার জন্য লাগসই, কিন্তু তা উত্তর হিসেবে কাজের নয়। একবছর ধরে এই বঙ্গানুবাদের জন্য যথোপযুক্ত প্রকাশক পাবার জন্য হয়রানি হয়তো সেই প্রশ্নের এক নীরব উত্তর। বাংলা আর ইংরিজি ভাষাপ্রকাশনা জগতের মাঝের ধারালো পুঁজি-অসাম্য এমন এক করাত – যা যেতে (ইংরিজি থেকে বাংলায় অনুবাদের ‘অবতরণ’ কালে, যেখানে মুল ইংরেজি রচনাকে হতেই হবে এক ‘ভিনদেশি রত্ন’ ) আর আসতে (বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের ‘উত্তরণ’ কালে, যেখানে মূল বাংলা রচনাকে হ’তেই হবে এক ‘ছাইয়ের গাদায় হিরে’)দু- দিকেই কাটে, যেন শাঁখের করাত। ভারতের সব আধুনিক ভাষার মধ্যে বাংলা সবচেয়ে ইংরিজি-ঘেঁষা , তাই বলে সে তো আর খোদ ইংরিজি নয়!
‘পথে হ’ল দেরি’ প্রশ্নের আরও উত্তর পেলাম, অনুবাদের পথ চলতে চলতে এগিয়ে আসা নানান বাধা থেকে, যদিও আংশিকভাবে। এই আত্মকথার আখর প্রেম, কাম আর রতিতে মুখর। সেই মুখরতার সুর স্বাভাবিক, খুবই নির্দিষ্ট, ছুঁৎমার্গ ও ন্যাকামিবিহীন। অনুবাদ করতে গিয়ে বুঝলাম এ ব্যাপারে প্রমিত বাংলা শব্দভান্ডার কত দীন আর তার অঙ্গে অঙ্গে নাগপাশের মত কত আঁট করে জড়ানো ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ। তাই এই বেনীআসহকলা প্রেম-কাম-রতিকে অনুবাদ করার জন্য আমার হাতে থাকে লাল পেন্সিল আর নীল পেন্সিল – সংস্কৃতগন্ধী বাংলা বা মুখচালু বাংলা – তাও শহুরে কলকাতার মুখচালু বাংলা। কারণ গ্রামের মুখচালু, দেহের-বাজনা-বাজা বাংলা ‘ভদ্রলোক’ পাঠকের অনায়ত্তই শুধু নয়, অবোধ্যও।
তারপর ছিল কবিতারা। এই বইয়ে গদ্যের কূলে কূলে কবিতারা মাঝে মাঝেই ফুটে ওঠে – লেখক-কবির নিজের কবিতা, উদ্ধৃতি, অন্য ভাষার কবিতার ইংরাজি অনুবাদ – শাস্ত্র থেকে (শাস্ত্র হামেশাই কবিতা), সংকলন বা প্রেমিকের লেখা চিঠি থেকে; ভারতীয়, ইউরোপীয় আর মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা থেকে। বছর-ভ’রের এই অনুবাদকাজে শুধু একটি জিনিস নিয়েই লেখক-কবি উদ্বিগ্ন ছিলেন – কবিতাগুলোর অনুবাদ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। গদ্য বোধকরি সাজোয়ান, সে নিজের দেখভাল নিজেই করতে পারে।
আমার অনুবাদ–শ্রমে এই ছিলো দু‘টি দুরুহ আনন্দ– কামকান্ডের অনুবাদ এবং গদ্য–পদ্যের ঘাটে ঘাটে নিত্য আপ–ডাউন। আর এই সাবলীল যাত্রার সহজ সুখ ছিলো, লেখকের স্বচ্ছ আর বেলোয়ারি–রঙা গদ্যের অনুবাদ।
হোশাঙ্গ মার্চেন্ট গুজরাতি, হিন্দি (এবং অবশ্যই ইংরিজি) পড়তে, লিখতে আর বলতে পারেন। মারাঠি, ফার্সি আর উর্দু বলতে পারেন। ফরাসি পড়তে আর লিখতে পারেন। তাই তাঁর সমসাময়িক আরেক ‘Midnight’s Child’ সলমন রুশদি–র মত তিনিও ‘Translated Men’-এর দলে। কিন্তু খুবই আলাদা অর্থে। হোশাঙ্গের homeland, কোনোভাবেই রুশদির ‘Imaginary Homeland’ নয়। তাঁর কথায়: “আমি আগা শাহীদ আলির মত আমেরিকান কবি নই। ও বলত, আমি একজন আমেরিকান কবি, যে কাশ্মীর নিয়ে লেখে। আমি একজন ভারতীয় কবি, যে ইংরিজিতে লেখে। কিন্তু আমি খুব কম বয়সে লেখা শিখেছি আর প্রকাশিত হয়েছি আমেরিকায় (পার্দু ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময়), আমার গদ্য তাই আমেরিকান কথ্য ইংরিজিতে বেরোয়।” তাঁর কবিতার ব্যাপারে অবশ্য এ কথা খাটে না। এই লেখক–কবির কবিতা তাঁর গদ্যের অন্তরে সদাই নিহিত – কখনো অননূদিত কখনো অনুবাদাতীত, আর সবসময় এক ঝলকে তাকে কবিতা ব‘লে চেনাও যায় না। এই বইয়ের বম্বে বিষয়ক অংশে (শুরুর দিকে আর শেষে) পার্সি আর গুজরাতির ঝংকার; তেহরান আর ইশফাহান অধ্যায় তাঁর পড়া–শোনা ফার্সি ভাষার পেলবতায় টলটল করছে । ‘জেরুজালেম (১৯৮৩ – ৮৪)’ দু‘টি আরবিসুবাসিত ইংরিজি কবিতায় রাঙানো। হোশাঙ্গের ‘Burak’ আর ‘Fairuz Sings ‘Lebanon” দু‘টি কবিতাই সম্পূর্ণরূপে উদ্ধৃত এখানে ।
কিন্তু লেখক যবে যবে যেথায় যেথায় গেছেন, ঠিক সেই সেই ভাষার ঝঙ্কার তাঁর ঐ ঐ জায়গার লেখায় উঠেছে, এ কথা বলা জবরদস্তি গোছের আন্তর্জাতিকতা। আর অনুবাদক হিসাবে এরকম ছকবন্দি কথা কওয়া সত্যের অপলাপও বটে।
লেখকদের স্মৃতি, তাঁর নিজের জীবন নিয়ে বিশেষতঃ, কখনোই এরকম খাপে–মাপে কাজ করেনা। তা ঘুরপথে হাঁটে, উছলে পড়ে, কখনও বা বেমালুম উধাও হয়ে যায়, পরক্ষণেই আবার পিছন থেকে কাঁধে আলতো টোকা মারে।
হোশাঙ্গের গভীর বিশ্বাস যে রতি, আধ্যাত্মবোধ আর সাহিত্যরচনা – সবকিছুর মূলে আছে কামনা। তাঁর এই বই এনেস নিনকে উদ্ধৃত করে ব‘লে : “রতিমার্গ ধরেও সন্ত হওয়া যায়।” তাঁর মতে, কাম আর রতি নিয়ে লেখাও তিন (খুঁটিয়ে গুনলে আরও বেশি) ধাপের অনুবাদ–কাজ – সেই রতিক্রিয়া, তাকে স্মরণ করা এবং তারপর তাকে লিখে ফেলা। স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে কামনার রথে চড়ে, আর সেই রথের রশির টান আগুপিছু– সময়ের আগুয়ান ধারাপাতকে তা মানে না। তাঁর ভালোবাসার শহর যখন ১২ই মার্চ ১৯৯৩–তে একের পর এক বোমের ঘায়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তা থেকে উৎসারিত হ‘ল এক কবিতা ‘Bombay, 12 March 1993’। খুব সচেতনভাবে তা সিরিয়ান কবি নিজার কাব্বানির ‘বিলকিস‘ কবিতার পুনর্কথন। সেই কবিতা উৎসারিত হয়েছিল নিজারের স্ত্রী বোমার আঘাতে নিহত হবার পরে। বম্বের সেই কবিতা এ বইয়ের কোথাও নেই – কিন্তু তার দীর্ঘ ছায়া আছে বম্বে নিয়ে লেখা এ বইয়ের প্রতিটি আখরে। তাঁর দয়িত বম্বের সাথে সম্পর্ককে গভীরভাবে, চিরকালের মত বদলে দিয়েছিলো এই ঘটনা–কবিতা। তাঁর কামনা, লেখনী আর বম্বের স্মৃতিকেও।
এই পদ্য-গদ্যের কাটাকুটি ছায়াপাত ভাষাতত্ত্বের পণ্ডিতি লব্জে – ‘ভাষারা জানা আর অজানা ভাবে একে অপরের মধ্যে হানা দিচ্ছে’ কিংবা ‘কবিতা আর গানেরা তৈরি করছে ঔপন্যাসিক এক বহুস্বর’ ব’লে সালটে দেওয়া যায়। হোশাঙ্গ মার্চেন্ট প্রাক্তন মেধাজীবী ও প্রাক্তন অধ্যাপক হ’লেও তাঁর আত্মকথার পদ্য-গদ্যর মধ্যে রয়েছে বহু দিগন্ত। এই সব পণ্ডিতি চুম্বকের সহজ খাঁচায় তাদের ধরা যায় না। ‘আমি আগে জীবনতত্ব বেছে নিয়ে তারপর বাঁচি না।’ ২০০৯-এ লিখেছিলেন তিনি। তাঁর লেখার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
ঊডি অ্যালেন একটি ছদ্ম-ডকু ছবি বানিয়েছিলেন ১৯৮৩-তে, নাম জেলিগ(Zelig)। এই ব্যঙ্গছবিতে অ্যালেন লিওনার্ড জেলিগের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। তিনি একজন মনুষ্যাকার “বহুরূপী গিরগিটি”।দশকের পর দশক ধরে সারা পৃথিবীর নানা স্থানে স্থানে ইতিহাসের নানা তুঙ্গমূহুর্তে গতায়াত তাঁর। তিনি যাঁর পাশেই থাকেন, নিজের চেহারা বদলে যেন তাঁর মতই “হয়ে যেতে পারেন” – শুধু চামড়ার রং বা মুখের আকার বদলে নয়, শরীরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ নতুন করে নিয়ে, এমনকি মুহুর্তের মধ্যে নতুন অজানা ভাষায় কথা ব’লে। তাঁর এই অশেষ আজব কীর্তি নিয়ে মুখর খবরের কাগজের হেডলাইন, মনস্তাত্বিক গবেষণা আর নিত্যনতুন নাচের হুজুগ।
লিওনার্ড জেলিগের ‘আত্মকথা’ আসলে পরিপার্শ্বের নানা সঙ্কেত বুঝে নিয়ে প্রতিকুল আবহাওয়ায় আরেকটু ভালো করে বেঁচে থাকা – বেশ করে মানিয়ে নেওয়ার এক জীবনকাহিনী। কিন্তু অ্যালেনের ফিল্মের আখরের মানিয়ে-নেওয়া queerness হোশাঙ্গ মার্চেন্টের আত্মকথার মানছি-না-মানব-না queerness এর বিকৃত-বিম্ব যেন। আর এই প্রতিবিম্ব পারদের যে পরতের জন্য সম্ভব হয়ে ওঠে, তা হ’ল তাঁর ভাষাশৈলীর সেই রাজপথ যা সব পাঠকের জন্যই হাট করে খোলা – সে পাঠক কুইয়ার হ’ন বা নাই হ’ন।
‘The Man Who Would be Queen : Autobiographical Fictions’ গভীর ভাবে কুইয়ার। তার কারণ শুধু লেখকের যৌন অভিমুখিতা নয়। লেখকের সমকামিতা গত কয়েক দশক ধরে তাঁর জীবনের ধাপে ধাপে, দুঃখে, আনন্দে আর লেখার ছত্রে ছত্রে উন্মুক্ত, গ্লানিহীন। তাই এই বই যে ভাবে কুইয়ার, সেই ভাব দুর্বোধ্যতার বোঝা থেকে বিমুক্ত, প্রকাশভীরুতা আর সমকামিতাজনিত আত্মসংশয় তাতে অনুপস্থিত। এই বই তাই দারুণভাবে পাঠকের জন্য সুখভোগ্য, সহজলেহ্য আর সর্বজনপেয় – যদি সেই পাঠক হ‘ন সংবেদনশীল। যে মানুষের জীবনের আয়না এই বই সে মানুষটি নিজেকে বিষমকামী মানুষদের থেকে আলাদা এক উন্নততর বা অবনত–তর কোনও প্রজাতিভুক্ত ব‘লে মনে করেন না।
এত এত তথ্যসূত্র, এত মুশকিল, নানা ভাষা, উদ্ধৃতি আর পন্ডিতির উল্লেখে পাঠকের মনে হ‘তেই পারে – এ বই বই নয়, এক গ্রন্থ। হোশাঙ্গের সৌম্য মুখচ্ছবি হতে লম্বিত রাবীন্দ্রিক শুভ্রশ্মশ্রুর মত অগাধ ভাবে গুরুভার সাহিত্যিক।
কিন্তু হোশাঙ্গের ঐ সাদা দাড়ির পর্দার পেছনে আরও অনেক হোশাঙ্গ মিলে আসর জমিয়ে বসে – মাতা হোশাঙ্গ, রাণী হোশাঙ্গ, স্নেহময় হোশাঙ্গ, দুষ্টু সরস্বতী হোশাঙ্গ…তাঁদের মৃদু কম্প্রতা, অতল গভীরতা আর হাড়–জ্বালানো বেয়াড়াপনা পাঠকের পাতে একই সাথে যা–চাই–তাই আর যাচ্ছেতাই বেড়ে দেয়।
একইসাথে সাদা আর কালো এই queerness যেন রামধনুর সাতটি রংকে সমানভাবে শোষে আর ঠিকরে দেয়। যে পাঠক শুধু হোশাঙ্গের সমকামের ধ্বজাউত্তোলন আর প্রতিভার বিচ্ছুরণ আশা করে পড়বেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে কিছু ভুলভুলাইয়া। যে পাঠক শুধু টক–ঝাল চাটনি মাখা বেআইনী সেক্সের ভেলপুরি খেতে চাইবেন, তাঁদের লোলুপ মুখের সামনে আয়না ধরবেন লেখক। যাঁরা বিগত অতীতের ভারতীয় সমকামী জীবনের নীল নকশা খুঁজতে আসবেন, তাঁরা পাবেন অনেক অভারতীয়, অতিআধুনিক পাঠ।
আর যাঁরা এক ঝলমলে ‘গে আইকন‘ খুঁজতে আসবেন, তাঁরা সেই প্রতিমার খড়ের পা আর রঙের ফাটলও দেখতে পাবেন। লেখক নিজেই ডেকে ডেকে দেখাবেন।
লিওনার্ড জেলিগের মেনে–নেওয়া–মানিয়ে–নেওয়া–র বিপ্রতীপে রেখেছিলাম হোশাঙ্গ মার্চেন্টের মানছি–না–মানবো–নাকে। কিন্তু সেই মানছি–না–মানবো–নাকে বিষমকামী সমাজ–সংস্কারের কাঠামোর সাথে সাথে লড়াই–আপোষ করতে করতেই বাঁচতে হয়। ২০১৮–তে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যখন ৩৭৭ ধারা নাকচ করে, দ্য হিন্দু কাগজ থেকে সেরিশ নানিসেট্টি হোশাঙ্গের একটি সাক্ষাৎকার নেন। তাতে পাই এই এক ঘটনা: “কলেজে পড়াতে যাওয়ার পথে হায়দ্রাবাদের অরোরা কলেজের ছেলেরা আমায় ঢিল ছুঁড়ত। ক‘দিন সহ্য করে আমিও ওদের পালটা ঢিল মারতে শুরু করলাম। এক দিন নিজেই নিজেকে বললাম : কি করছিস হোশাঙ্গ? তুই না প্রফেসর? এর‘ম পাগলের মত করবি? ঢিল ছোঁড়া বন্ধ করলাম। ওদের মধ্যে একটা ছেলে অরোরা কলেজ ছেড়ে পরে আমার ছাত্র হয়েছিল।”
এই বইটি অনুবাদ করার সময় Reading Mirages: The Unexpurgated Diary of Anaïs Nin, 1939–1947 (Swallow Press, 2015)পড়ছিলাম, কিন্তু সেটা সচেতন ভাবে নয়, পাকে চক্রে অনেক আগেই পড়া শুরু করেছিলাম। কাকতালবশে এই বই যে বছর শেষ, হোশাঙ্গের জন্মসালও সেই বছর। নিন একই সাথে হোশাঙ্গের আদর্শ, পি এইচ ডি-র বিষয় এবং মা গোঁসাই (যদিও হোশাঙ্গ পরে ধীরে ধীরে নিন-আরাধনা থেকে বেরিয়ে নিজের পথ খুঁজে নেন)। নিনের আত্মকথার আয়নায় হোশাঙ্গের রাণীকাহিণী আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমার পড়ন্ত কিশোর বয়সে আমি অখন্ড মনোযোগে ‘Katha Prize Stories’-এর খণ্ডগুলো পড়তাম (সব মিলিয়ে পনেরো খন্ড)। প্রতি বছর নানা ভারতীয় ভাষার সাহিত্য পত্রিকা থেকে সেরা গল্প বেছে ইংরাজিতে অনুবাদ। এক সময় সারা ভারতের প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্যের স্বর হিসাবে ইংরিজি ভাষায় ভারতীয় লেখকদের লেখার থেকে (যথা হোশাঙ্গ) এই ইংরিজি অনুবাদগুলিকে (সরকারি সাহিত্য আকাদেমির পত্রিকা Indian Literature-ও ছাপা হ’ত এই ধারার অনুবাদ) অনেক বেশি খাঁটি ভারতীয় মানা হ’ত। কিন্তু ঐ তর্কে না ঢুকেও বলা যায়, সর্বভারতীয় সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে সেই ইংরিজিরই ডাক পড়তো আর এখনো তাই পড়ে। এই জগদ্দল বাস্তব আসলে এক আজব বিকৃতি – সারা ভারতের মাত্র ২% মানুষ ইংরিজি সাহিত্য পড়ে – তা মূল থেকেই হোক কিংবা অনুবাদ থেকে। ‘সর্বভারতীয় সাহিত্য’ জিনিসটিও বেশ ধোঁয়াটে, গড়াপেটা একটা ব্যাপার। যদি আমরা গত কয়েক দশকে বাংলা থেকে ইংরিজিতে অনূদিত বইয়ের ইতিহাসের সাথে ইংরিজি থেকে বাংলায় অনূদিত বইয়ের ইতিহাস তুলনা করে দেখি – তা হ’লে এই আজব ধাঁধাঁ আরও ঘনিয়ে ওঠে। ভারতে, বাংলাদেশে আর পৃথিবীতে সম্ভাব্য বাংলা অনুবাদ পাঠকের সংখ্যা আর সম্ভাব্য ইংরিজি অনুবাদ পাঠকের সংখ্যার তুলনামূলক হিসাব দিয়ে পুরো ছবি বোঝা যায় না। বাংলা অনুবাদপ্রকাশকের বন্টনক্ষমতা আর ইংরাজি অনুবাদপ্রকাশকের বন্টনক্ষমতায়ও আসমান-জমিন ফারাক। কিন্তু যাঁরা বাংলা জানেন না, তাঁরাই শুধু বাংলা থেকে ইংরাজি অনুবাদ পড়েন, আর যাঁরা ইংরাজি পড়তে পারেন না, তাঁরাই শুধু বঙ্গানুবাদ পড়েন, এই অতিসরল হিসেবগুলোও বেশ গোলমেলে। তাই একটি সমকামী মানুষের বহুপঠিত আত্মকথা যখন বাংলায় অনুবাদ হয়, সেই বইয়ের সাধারণ পাঠকসংখ্যা কি বাড়ে? নাকি শুধু তার কুইয়ার পাঠকসংখ্যা বাড়ে? যাঁরা মূল ইংরিজি পড়তে পারেন না শুধুই তাঁরা, নাকি যাঁদের নানা কারণে ২০১১ সালে প্রকাশিত ইংরিজি বইটি পড়ার সময় হয়নি শুধু তাঁরা? নাকি যাঁরা দু’টি ভাষাতেই সমান চোস্ত-দুরস্ত কিন্তু বাংলা পড়ে বেশি সুখ পান তাঁরাই শুধু পড়বেন এটি? এসবের থেকেও জরুরি প্রশ্ন হ’ল আনকোরা নতুন পাঠকরা এই বইটি পড়বেন কিনা। যতই হোক, বইটি তো আনকোরা। নতুন ভাষায়, নতুন করে গড়া, আনকোরা আত্মকথা।
‘”হোশাঙ্গ মার্চেন্ট, এখন বাংলাতেও উপলব্ধ” এই বাক্যবন্ধ শুরুতে যখন ব্যবহার করেছি – তাতে ছিল খানিক ব্যঙ্গ, খানিক ইংরাজি–বাংলা অনুবাদের রাজনীতির প্রতি কটাক্ষ আর অনেকটা সততা।
যখন একটি মানুষের জীবন, একটি সমকামী জীবন, যে জীবন বাঁচা হয়েছে ইংরিজিতে (গুজরাতি, হিন্দি , ফার্সি, উর্দু আর ফরাসিতে, কিন্তু বাংলায় নয়), সে জীবন যদি অনুবাদ হয় বাংলাতে তা কি এক বাংলা সমকামী আত্মকথা হয়ে ওঠে?
বাংলায় এখনো অবধি লেখা সমকামী পুরুষদের আত্মকথা খুব আলগোছে খুঁজলেও বেশ অনেকই পাওয়া যায় (এমনকি সেই সময় থেকেও যখন সমলিঙ্গপ্রেমকে ‘সমকাম’ বা ‘কুইয়ার’ আখ্যা দেওয়া হ’ত না।) কিন্তু অতিসাম্প্রতিক কয়েকটা বই বাদ দিলে, আর ক’টা বইয়ের কথা সহজে জানা যায়, কেনা যায় আর পড়া যায়? যদি সেগুলো লাইব্রেরী আর আর্কাইভে থেকেও থাকে, তা হ’লে কতজন বিষমকামী পাঠক সেগুলো পড়তে চান আর কজন সমকামী পাঠক জানেন যে পড়তে চাইলে কোথায় যেতে হ’বে? আমার কাছে এর উত্তর নেই কিন্তু আমি জানতে চাই।
আমাদের যুগের LGBTQIA+ পলিটিক্স (যা সমকামী অধ্যাপক অ্যাশলে টেলিসের মতে LGBHQIA+, H for Hijra, not Transgender)মতে হরফ ধরে ধরে ভাগে ভাগে টুকরো টুকরো পরিচয়ের রাজনীতি করাটাই দস্তুর। আমাদের প্রত্যেকের যৌন অভিমুখিতা অনুযায়ী আমাদের জীবন এবং যাপন নাকি এতটাই আলাদা যে আমাদের ঠিক পাশের হরফের লিঙ্গরাজনীতিকের জীবনযাপনের সাথে তার আকাশ-পাতাল তফাৎ। জিপিএস লাগানো অ্যাপে আমরা একইসাথে খুচরো সেক্স আর জীবনসঙ্গী খুঁজতে খুঁজতে আমাদের ‘নিজেদের মত’ খোঁজার বাই আরও বেড়ে গেছে – ‘লাইক’ এর খোঁজে ‘লাইক’ – মান্যসমকামের চক্কর। আজকের কুইয়ার কনটেন্টের ভারতীয় বাজার অনেক খোলামেলা হ’লেও – সেখানে বাংলা আর বাঙালিত্বের উপস্থিতি এখনো নামমাত্র।
আমরা ভুলে যাই যে আমরা ‘অপর’-এর আয়নায় নিজেদেরকে নিজে চিনতে শিখি, ভালোবাসতে শিখি। এক কুইয়ারের তার কুইয়ার-‘অপরের’ থেকে এই শেখা আরও কঠিন, আরও জরুরি। আত্মকথার ‘আত্ম’-র সাথে আমরা নিজেকে মেলাতে পারছি, না ‘কথা’-র সাথে – মেলাতে পারছি কি পারছি না সেটাই কি বড় কথা নয়?
হোশাঙ্গ মার্চেন্ট, শেষমেশ, কুইয়ারনেসের এক অন্য ভাষায়, অন্য এক প্রজন্ম থেকে কথা বলেন। আরেক বিপজ্জনক অনন্যসাধারণ সমকামী উইলিয়াম ই জোনস সম্পর্কে তওসিফ নুর যা লেখেন তা হোশাঙ্গের জন্যেও পুরোপুরি খাটে: “ এক পুরোনো ধাঁচের কুইয়ার জীবনকে পরম আদর্শ হিসাবে ধরে নেওয়া – যেই জীবনসংস্কৃতিরঅংশ এমন রাজনৈতিক বিশ্বাস আর যৌন অভ্যাস, যা ক্রমাগত গতবাঁধা বিষমকামী জীবনকে অস্বস্তিতে ফেলে – তা এক ভাবে নিপীড়নের নেশায় পড়া।” হোশাঙ্গের কোটিপতি–থেকে–কৌপীনধারী শারীরিক আর মানসিক জীবনকান্ড কোনভাবেই সাধারণ নয়। সেই জীবনের তুঙ্গ আর ভঙ্গ সবই আর পাঁচজনের নাগালের বাইরে। সেই জীবনের গু আর গরিমা কোনোটার সোনা–রং–ই গড়পড়তা নয় একেবারেই। তাঁর প্রজন্মের খুব কম মানুষই (এমনকি যাঁরা তাঁর মত সুযোগসুবিধা পেয়েছেন) হোশাঙ্গের মত দেশে দেশে দিশি দিশি বহুধাবিচিত্র জীবন বাঁচতে পেরেছেন – ভ্রমণ, কাজ, প্রেম, সেক্স, লেখা আর অভিজ্ঞতার মাঝে। তাঁর রাজনৈতিক মতামত অনেকেরই মনে ধরবে না। ট্রান্সজেন্ডার রাজনীতি নিয়ে তাঁর ভাবনা অনেকেরই সেকেলে লাগবে। হোশাঙ্গের দৃঢ় বিশ্বাস শুধু লিঙ্গপরিবর্তন সার্জারি আর ছাঁচবাঁধা বৈবাহিক জীবন ট্রান্সজেন্ডার মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্য হ‘তে পারে না। সমপ্রেম–কাম–বিবাহ নিয়ে তাঁর জীবনব্যাপী বিশ্বাস আর চর্যা আমাদের কালের সম্মানিত নবপুঁজিবাদী কুইয়ারদের বিশ্বাসের সাথে মিলবে না। হোশাঙ্গ কোনোদিনই এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, আর এখন তো থোড়াই কেয়ার করেন।
ধারা ৩৭৭-পরবর্তী যুগের ‘woke’ কুইয়ার ভারতীয় আমরা, নিজেদের যতটা প্রতিফলিত হ’তে দেখি কুইয়ার পলিটিক্স, কুইয়ার ইতিহাস আর তত্বে, সাহিত্যে ততটা নয়। কারণ, কল্পিত জীবন বা নিজের জীবন নিয়ে লেখা সাহিত্য শুদ্ধভাবে প্রগতিশীল বা অভিনন্দনমূলক হ’তে পারে না। কারণ সাহিত্যের মিথ-মিথ্যা অস্বস্তিকর ভাবে সত্যজটিল হয়ে ওঠে, আঁতেও লেগে যায় কখনও কখনও। আমাদের আব্দার মত তা ‘দেখো আমরা কত দ্রুত কত প্রগতি পেয়েছি’-র সুখভোগে বা ‘আমরা এখন আগের যুগের থেকে সত্যিই অনেক ভালো আছি’-র স্বাচ্ছন্দ্যবোধে ভরপুর হ’য় না। যার যার জীবন শুধু তার তার মাপেই তৈরি, অন্যদের মাপে তো তার কাপড় কাটা হয়নি।
হোশাঙ্গ আমাদের মনে করিয়ে দেন তাঁর সম্পাদিত Yaraana : Gay Writing from South Asia’ (Penguin 1999) অগ্রণী সাহিত্যসংকলন ইন্ডিয়া টুডে বেস্টসেলার লিস্টে দু‘ নম্বরে ছিলো বম্বে আর দিল্লীতে কয়েক মাস ধরে, কোন প্রচার ছাড়াই (সাধারণ বেস্টসেলার লিস্ট, সমকামসাহিত্যের বেস্টসেলার লিস্ট নয়)। তার গোটা এক বছর বাদে রুথ বনিতা আর সালিম কিদওয়াই–এর ইতিহাস–বদলে–দেওয়া ‘Same-sex love in India : Readings from Literature and History’ বইটি প্রকাশিত হ্য়। তার অর্থ এই নয় ঐতিহাসিক ভাবে ভারতে সমলিঙ্গমূলক সাহিত্যের স্থান সমলিঙ্গমূলক ইতিহাসের আগে। তার মানে এই যে, এই সাহিত্যের পাঠক ছিল এবং আছে। আজকের অনেক বেশি কুইয়ার কালচারাল কনটেন্ট, অনেক বেশি তথাকথিত কুইয়ার প্রতিনিধিত্ব আর আগের থেকে একটু উদার সমলিঙ্গ–বিষয়ক আইনের যুগে, আমাদের ভারতীয় কুইয়ার জীবনে বিরাট কিছু উন্নতি বা কোন পরিবর্তন আসেনি। আমাদের জীবনকে সাহিত্যে প্রতিফলিত দেখার তৃষ্ণাও যে ইন্সটাগ্রাম ‘থার্স্ট ট্র্যাপ‘-এর জোগান বেশি এসে গেছে ব‘লে মিটে গেছে তা মনে হয় না।
উপরোল্লেখিত ২০১৮-র সাক্ষাৎকারে, হোশাঙ্গ বলেন: “৩৭৭ বাতিল করা মানে সবধরণের কামকে আইনের আওতা থেকে বের করে আনা নয়। এর মানে দু’জন সমলিঙ্গের পুর্ণবয়স্ক মানুষ লোকচক্ষুর বাইরে, অন্তরালে সেক্স করতে পারে। এখানে ‘অন্তরালে’ খুব জরুরি কথা। যখন আমি ইরানে ছিলাম, একটা মজার গল্প শুনেছিলাম। প্রার্থনার জায়গায় এক প্রেমিকযুগল ধরা পড়েছে। পুরোহিত তাদের ধমকে লাট করে দিচ্ছে : “কোন লজ্জা নেই, ভগবানের ভয় নেই, ধর্মের ভয় নেই, সভ্যতা নেই, দেশভক্তি নেই।” তরুণযুগল চুপচাপ শুনে গেলো, শেষে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার ধমকানি কি পুরো হয়েছে, সার?” “হ্যাঁ।” “আমাদের সব আছে সার, কিন্তু আড়াল হওয়ার কোনও জায়গা নেই।” এই “নো প্লেসের” গল্পের সাথে সাথে পাঠক ভারতের গে ডেটিং অ্যাপের লাখ লাখ প্রোফাইলে লেখা ‘নো প্লেস’ শব্দবন্ধ নিয়ে ভাবতে পারেন। কিংবা এ যুগের সমকাম আন্দোলনের বহুনন্দিত স্লোগান ‘love is love’ এর মধ্যে বহুজাতিক সংস্থা রিবকের ‘I am what I am’ স্লোগানের অর্থহীনতার ঝঙ্কার খুঁজতে পারেন। নাও পারেন।
আমি এই ‘অনুবাদকের ভূমিকা’ প্রথমে ইংরেজিতে লিখেছিলাম, লেখক যাতে পড়তে পারেন। তারপর বঙ্গানুবাদ করলাম। নিজের অতীত লিখনের বর্তমান অনুবাদকাজ করার একটি অঙ্গ হ’ল আমার করোটির মধ্যে দু’টি স্বরে নিয়ত বাক্যালাপ – লেখকের আর অনুবাদকের। এই বইয়ের অনুবাদক আর প্রথম কুইয়ার পাঠক হবার অভিজ্ঞতাও আমার নিজের কাছে সেরকমই দো-রোখা – প্রতিধ্বনি আর প্রতিবিম্বে ভরপুর। রোমানিয়ান-জার্মান উপন্যাসিক হার্টা মুলারের দেওয়া সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতার উপমার সাথে যেন তার খানিক মিল আছে। যেন একই সাথে এক ‘private property’ মাথায়, আর এক ‘public property’ হাতে ধরে আছি। আমার অনেক সংক্ষিপ্ত, অনেক মামুলি কুইয়ার জীবনের ভূমি হোশাঙ্গের জীবনের মানচিত্রের মধ্যে যেন নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
এই বইটি আপনি যদি মহাজীবনচরিত ভেবে পড়েন কিংবা বেদনাকলঙ্কগাথা ভেবে কিংবা অন্য কিছু ভেবে, আপনার আশাপূরণও হবে, আশাভঙ্গও হবে, আর ‘সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ আসুন, পড়ি।
সৌরভ রায়
গদ্যকার, অনুবাদক