ফিলিস্তিন নিয়ে কিছু লিখতে গেলে ঝামেলাটা যা হয়, তা হচ্ছে, লেখা আগানো যায় না। ভাবা যায় না কী লেখা উচিত, কী লিখব। আমার কিছু লিখতে হলে, আমি সেই ব্যাপারটা থেকে নিজের আবেগ সরিয়ে নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। যাতে লেখাতে আবেগ না থাকে। এই জন্যে কখনও আমি আমার মাকে নিয়ে লিখতে পারি নাই। ফিলিস্তিন নিয়ে লিখতে গিয়েও একই সমস্যায় পড়ছি। যদিও আমার মায়ের আবেগ আর এই আবেগ এক না। একটা মানবতার অন্যটা কেবলই নৃশংসতার। যেই নৃশংসতা নিয়ে ভাবতে গেলেও কুঁকড়ে যেতে হয় বারবার। কেবল সত্তর দিনে প্রায় আঠার হাজার মানুষকে খুন করার গল্প এইটা। এর মধ্যে দশ হাজারের বেশি শিশুই। এরকম সত্তর দিনের ভয়াবহ গল্প রক্তে রক্তে রচিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। ফিলিস্তিনকে নিয়ে কী লিখব আমি, রক্তাভ ক্ষত ছাড়া!
ফিলিস্তিন নিয়ে লিখতে গেলে আসলে একগাদা জিনিস মাথায় আসে; কষ্ট, সাহস, সয়ে নেওয়া, দাঁত চেপে লড়াই করা এসবই। এ বছর সাত অক্টোবরের পর থেকেই ফিলিস্তিনের যে কয়টা ভিডিও সামনে এসেছে, এসবই দেখেছি শুধু।
গাজার একটা ভিডিওতে, অনেকজন ডাক্তার বৃষ্টির মধ্যে জানাজা পড়লেন, হয়ত নিজেদের কোন সহকর্মীরই বা আর কারোর। পড়েই আবার কাজে দৌড় দিচ্ছেন কাঁদতে কাঁদতে। এরই মধ্যে একজন উপরের দিকে তাকায়ে কী জানি বিড়বিড় করলেন। হয়ত খোদারে বললেন কিছু, হয়ত ভাবলেন, খোদা যে কী ভেবে চুপ করে আছেন এখনও!
অন্য ভিডিওতে একটা মসজিদ, দাঁড়িয়ে জ্বলজ্যান্ত, দুম করে একটা বোমায় নাই হয়ে গেল। অন্যটায়, বেশ কিছু মানুষ পানি খেতে জমায়েত হয়েছেন, নিরস্ত্র, সেখানে দুম করে একটা বোম পড়ল, উড়ে গেল বেশকিছু মানুষ—ফিলিস্তিনে মরে যাচ্ছে মানুষ। মানুষের দাদা-নানা, নানি-দাদি বাবা, মা, ভাই, বোন, খালা, খালু, চাচা, চাচি, কাজিন সব। একটা বোমা পড়ে, বেঁচে যাওয়া কেউ চোখ খুলে দেখে তার আত্মীয়র মধ্যে হয়ত বেশ কয়জন মারা পড়েছে।
আরেকটা ভিডিওতে দেখলাম, এক মেয়ে হাসপাতালের মাটিতে শুয়ে শুয়ে বিলাপ করছে, “ওরা আমার বোন, মাকে মেরে ফেলছে। ওদের ছাড়া আমি থাকব কেমন করে। আমি তো বাঁচতে পারব না ওদের ছাড়া।” কেউ একজন হয়ত বলছিল, ধৈর্য ধরো, ওরা তো শহীদ হয়েছে। মেয়েটা তখন বলল, “জানি তো শহীদ হইছে। কিন্তু আমি আর কত ধৈর্য ধরব। ইয়া আল্লাহ। ওরা আমার দাদা দাদীকে মারছে, খালা ফুপুকে মারছে। আজকে মা আর বোনকেও মারল। আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না।”
একটা দাদার ভিডিও বেশ পসার পেয়েছিল ইন্টারনেটে, “নাতনি মরে গেছে, দাদা নাতির বুঁজে থাকা চোখ খুলে সেখানে চুমু খেলেন, তারপর বেশ কয়বার বুকে চেপে ধরলেন নাতনিকে। তারপর কিছু দোয়া পড়ে কাফন পরাবার জন্যে এগিয়ে দিলেন, সে সময় বলছিলেন, “এটা আমার আত্মার আত্মা”।
এই মানুষগুলোর বিশ্বাস; তাতে জমে থাকা, জীবনকে সামনে থেকে মোকাবেলা করার যে দম, সেটা দেখলেই কেমন কান্না পায়, অসহায় লাগে সবকিছু। এরা দমে যায় না, এটা সবচে আচানক ব্যাপার। এরা আশা করে, আশায় থাকে একদিন বদলাবে সব। এই কষ্টগুলো সয়ে নেয় হাসিমুখে।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছিল, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে একটা মেয়ে রুটি বেলছে, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে শান্তির হাসিটা সে দিয়েছে। পুরো ধংসস্তুপটাকে ওই একটা হাসির জন্যে ফুলের মত লাগছিল। ফিলিস্তিনের বাচ্চাদের দেখি, বোমা পড়ার মধ্যে একটু সময় পেলে খেলে। দৌড়ায়। স্বপ্ন দেখে, একটা স্বাধীন জমিনের, যেই জমিন তাদের, যেখানে কোনো লুটেরা এসে গুলি চালাবে না নিরস্ত্র মানুষের ওপর। যেখানে তাদের জলপাই গাছ দেবে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী তেল। যেই মাটিতে তারা বুনতে পারবে মানুষের ক্ষত ঢাকবার ব্যান্ডেজ।
এম বেরির একটা কবিতার কথা মনে হলো। কবিতাটা সুন্দর, বাংলা করলে এমন হয় :
সকাল সকাল একটা জিনিস জানলাম
ইংরেজি gauze শব্দটা আসছে নাকি আরবি শব্দ গাজ্জা থেকে
ভালো বুননে তাদের পসার শত শত বছর ধরে, তাই
তারপর মনে হলো
আমাদের কত শত ক্ষত
রেহাই পেলো
তাদের জন্য
বদলে, তাদের কত শত ক্ষত
ফিরায়ে দিলাম
আমরা
ফিলিস্তিন নিয়ে লেখা যায় না আসলে। এত এত শিশুর আর্তনাদ চোখের সামনে সিনেমার মতো চলতে থাকে যে, থেমে যেতে হয়।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ
লেখক, গবেষক