অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৫-এ বৈভব থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ও গল্পকার কাজল শাহনেওয়াজ-এর বায়ো-গদ্যগ্রন্থ দিঘলী। মনজুরুল আহসান ওলী ও বেনজামিন রিয়াজীর চিত্রকর্ম অবলম্বনে প্রচ্ছদ করেছন বিধান সাহা, ইলাস্ট্রেশনে রাজীব দত্ত। ২৫৬ পৃষ্ঠার এই বইটির মূল্য ৯৬০ টাকা। পাওয়া যাবে ঢাকা বইমেলায়, বৈভবে (স্টল ৫৭৫-৫৭৬)।
দিঘলী সম্পর্কে লেখক জানান:
বইটার সময়কাল ১৯৬১-১৯৭৫ সন
আমাদের আব্বা ছিলেন প্রথম প্রজন্মের ভেটারিনারী ডাক্তার। এখন বলে ভেট। শিক্ষিত ভেটরা তখন অচেনা, নিজেদের চেনাতে তাঁদের অনেক ফাইট করতে হয়েছে। স্বল্পশিক্ষার মানুষ নিজেরাই সদা অবহেলিত, পশুপাখি নিয়ে ভাবনার সুযোগ কই? তাদের আবার চিকিৎসা!
অবলা প্রাণীর সাথে থেকে আব্বা হয়ে উঠেছিলেন মানবিকতায় সেরা। আমরা ছোট বেলাতেই বাসায় থাকা প্রাণীদের পোষা নয়, পরিবারের অংশ ভাবি। রুগি হয়ে আসা আহত কুকুরটা তিন পায়ে হাটতে পেরে শে কৃতজ্ঞতায় আমাদের মাতৃস্থানীয় হয়ে উঠেছিল। শিশু ভাইদের দেখে রাখত সাপ ইন্দুর থেকে। একবাটের ছাগি আমাদের সাথে খেলত বান্ধবির মত। কোরবানির জন্য আনা খাসি নাম তার মধু, আমারে ডাকা শুরু করল ‘মিয়া ভাই’।
আব্বা যেন আমাদের পাগলা বন্ধু আর মিষ্টি বড় ভাই। তাঁকে দেখে শিখি জগতের নিয়মরহস্য।
দিঘলী থেকে (টেক্সট):
‘হাইব্বা কই?’
‘শিকল দিয়া উঠানে বাইন্ধা রাখছি।’
‘ভালো করছো… এইবার যাও, তার জন্য ভুনা খিচুড়ি লইয়া যাও।’
‘হেয় অহন কিছুই খাইব না। হেয় নাকি পরীস্থানের খানা খাইছে। ফলপাকুড় খাইছে। হ্যার সাথেও নাকি আছে!’
‘তুমি দেখছো?’
‘আমি যখন তারে পাই, তার হাতের মুঠা বন্ধ ছেল। যে পোলাডা নৌকা বাইয়া আনছে, অরে নাকি সে পরীস্থানের ফল খাওয়াইছে। খুব নাকি সোয়াদ!’
‘এহন অরেও কও পরীগো লগে ইয়ার্কি করতে। যত্তসব!’
‘কী কইলেন স্যার?’
‘তোমার মাথা আর অর মুণ্ডু।’
ওই বাড়িতে যাইতে হয় সেই রাস্তা দিয়া, যেখানে সাইনবোর্ডে লেখা ‘ইউরিয়া টিএসপি পটাশ’। ভূতপ্রেতের আড্ডাখানা। কিন্তু পরীস্থান-ফেরত কাউরে দেখতে হইবোই হইব। আব্বারে বলতে সাহস পাই না। তারচেয়ে আইয়ুব আলীরে বলি, ছোটটাকে বলি।
মা বলেন, ‘খবরদার, কাছে যাবি না। দূর থেকে দেইখা আইসা পড়বি। ঠিকাছে?’
আব্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট আইয়ুব আলীরে ডাইকা মা বললেন, ‘আইয়ুব সাব, ওগো নিয়া ঘুইরা আসেন তো। বেশি দেরি কইরেন না।’
‘ঠিকাছে ভাবি সাব, দেরি হইবে না।’
আমরা দুইজন পথে আইয়ুব চাচারে জ্বালাইতে থাকি। ভদ্রলোক অতি নীরিহ ও তাবেদার টাইপের। ওনারে যাই করি না কেন, কোনো অসুবিধা নাই। আব্বার কাছে নালিশ হইব না।
জ্বালাইতে-জ্বালাইতে আমি বলি, ‘কাকা, আপনে রাগ করতাছেন? আপনের যে দুর্বল শইল।’
‘কী বললা, শইল? এইটা কেমন কথা বলো তো! তোমরা হইলা ডাক্তার সাহেবের সন্তান। তোমরা এরকম গ্রাম্যকথা বলবা ক্যান? শুদ্ধ করে বলবা। আমি অনেকদিন ভাবছি। কথাটা আজ বলেই ফেললাম। কিছু মনে করো নাই তো?’
‘না-না, কী যে কন!’
‘আবার…’
‘আচ্ছা ঠিকাছে, আর বলব না।’
আমি রাজি হলাম। কিন্তু ছোটটা রাজি হৈল না। ও বলে, ‘আমি পারলেও বলমু না। আমি মার মতো কথা কমু। দেখেন না মায় কেমনে কয়।’
‘কিন্তু তোমার আব্বা তো শুদ্ধ কথা বলেন।’
‘ঐটা তো আপনাগো লগে। বাসায় ঠিকই দ্যাশের ভাষা।’
‘তাইলে তো ঠিক আছে। বাসায় বিক্রমপুরের ভাষায় কথা বলবা। আর বাইরে ভদ্র ভাষা।’
‘না, আমি কমু না। আমার কি ঠ্যাকা পড়ছে?’
ছোটভাই কোনোভাবেই রাজি হলো না।
আমি জানি, ও এইসব অজুহাত দিচ্ছে কেন। ও লজ্জা পায় গুছায়া কথা বলতে। বাইরে যতই দুরন্তপনা করুক না কেন, ভিতরে-ভিতরে ওর মতো দুর্বল মানুষ আর হয় না। একেবারে শুকনা বিড়াল।
ভাবছিলাম হাইব্বার সামনে গেলে, আইয়ুব কাকা যেহেতু সাথে আছে, সাহস থাকবো। কিন্তু ওর অবস্থা দেখে সাহস হারাইয়া ফেললাম। ছোটটারে এমন এক চোখ-রাঙানি দিলো যে, কোনোদিকে না তাকায়ে একলাফে চৌদ্দহাত দূরে গিয়া থামল।
হাইব্বা উঠানের কোণায় একটা জামগাছের সাথে শিকল দিয়া বান্ধা। ওর চারপাশে শ’খানেক বাচ্চাকাচ্চা বুড়াবুড়ি নানা রকম মজা করতেছে। হাইব্বা কাউরে দেখতেছেই না।
কে যেন বলে, ‘হাইব্বা, কই তোর ডিব্বা?’
একজন জিজ্ঞাসে আর সাথে-সাথে অন্যেরা ঝলমল করে হেসে ওঠে। কখনো ছন্দ মেলানো, নিজেরা প্রশ্ন করে আবার নিজেই উত্তর দেয়।
‘ক’ছেন হাইব্বা, পরীরা কি বাচ্চা দেয়, বিয়া করে ভাইগ্যা?’
কাজল শাহনেওয়াজ
কবি ও কথাশিল্পী
জন্ম বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দিঘলি গ্রামে (এখন পদ্মাগর্ভে বিলীন), ১৯৬১ সালের পয়লা জুন। পিতা আবু বকর সিদ্দিক পেশায় ভেটেরেনারী ডাক্তার ছিলেন। মায়ের নাম সুরাইয়া। শৈশব কাটে ফরিদপুরে। তারপর কৈশোর কিশোরগন্জে ও যৌবন ময়মনসিংহে। বর্তমানে ঢাকার ধানমণ্ডিতে একটা এপার্টমেন্টে স্থায়ী বসত।
ময়মনসিংহস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি প্রকৌশলে গ্রাজুয়েশন।
পেশা শুরু করেন সেচ প্রকৌশলী হিসাবে, দুই বছর পরে তথ্য প্রযুক্তিতে। পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেন জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সিস্টেম বিষয়ে। বারো বছর একটা কন্সাল্টিং ফার্মে চাকুরি করার পর আরও বারো বছর কাজ করেছেন সাইবার শক্তি নামে নিজের সফটঅয়্যার প্রতিষ্ঠানে। এক সময় পছন্দ ছিল নতুন নতুন প্রোগ্রামিং ভাষা শেখা ও কোডিং করাতে।
জীবনের উচ্চ ও নীচ, সফল ও অসফল, সামান্য ও অসামান্য – সব কিছুতেই অপরিসীম আকর্ষণ নিয়ে বসবাস করেন। কবিতায় কল্পনা ও গদ্যে বাস্তবতা দিয়ে শুরু করেছিলেন লেখালেখি। বর্তমানে বাংলার ভূমি-ইতিহাস-রাজনীতি প্রধান আগ্রহ।
কাজ করেছেন গ্রাম ও নগর দুই ধরণের জগতেই।
প্রকাশিত বই:
কবিতা
ছাঁট কাগজের মলাট (১৯৮৪), জলমগ্ন পাঠশালা (১৯৮৯), রহস্য খোলার রেঞ্চ (১৯৯২), আমার শ্বাসমূল (২০০৭), কাঠকয়লায় আঁকা তোমাকে আমার (২০০৯), তালগাছ হাতির বাচ্চা (২০১১), একটা পুরুষ পেপে গাছের প্রস্তাব (২০১৫), একটা ব্যাঙনি আমাকে পিঠে চড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে (২০১৯),কবিতাসমগ্র (২০১৮), জলমগ্ন পাঠশালা (২য় সংস্করণ ২০২৩)।
ছোটগল্প
কাছিমগালা (১৯৯৩), গতকাল লাল (২০০৭), কাছিমগালা ও গতকাল লাল (২০১১), গল্পসমগ্র (২০১৮), কাছিমগালা (২য় সংস্করণ ২০২৩)
বায়োগ্রাফি
দিঘলী (২০২৫)
সাক্ষাৎকার
ঘোড়ার প্রেমপত্র (২০২০)
উপন্যাস
শে (২০২১)
সম্পাদনা
বিকল্প কবিতা, যৌথ সম্পাদনা, ১৯৮৯; ফৃ, লিটল ম্যাগাজিন, ১৯৯৫-৯৮; ফৃ গ্রন্থিকা সিরিজ (পাতলা মলাটের এক ফর্মার বই), ১৯৯৮-৯৯, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫