‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ প্রকাশের চার বছর পর প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’ – বাঙ্ময় প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। ফেব্রুয়ারির বইমেলা থেকেই পাঠকের কাছে পৌঁছাবে বইটি। চট্টগ্রামে বসবাস করা, অনেকটাই নিভৃতচারী কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর বইটি প্রকাশের আগে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়াসে এই আয়োজন। পড়ার আমন্ত্রণ, হে কবিতাপাঠক!
জীবন, বিষন্ন রোদের ডানা
১.
মগজের কোষে কোষে সেসব নিঃশব্দ শিকার খেলা করে
যারা চলে গ্যাছে স্মৃতিময় ভোর হাতে করে নিয়ে দূরে
দীর্ঘবাহু ছড়িয়ে আছে যে তুমি ধরতে পারো আঙুলবন
বেদনার হাত থেকে বেঁচে যাবে ছুঁয়ে সারসের ডানারোদ
৫.
পরস্পর হেঁটে চলে গ্যাছি, ভেতরে ছায়ার শরীর শুধুই
অকারণ কথা বলেছে বিষ প্রহরের সাথে, বিষন্ন রোগ
দৃশ্য ধুয়েমুছে গ্যাছে বৃষ্টি আর সেসব স্মৃতিময় শরীর
হাড়ের ভেতর এখনও শ্যাঁওলার গন্ধ লেগে আছে যেন
৩১.
কিছু নেই, কেউ ছিলো না কোনোকালে-থাকে শুধু কালের কণ্ঠ
আমাকে রক্ষা করো, নিয়ে যাও এই মৃত্যুনীল আতঙ্ক থেকে
যেখানে খেলা করে খেয়ালি পাখির দল, বিস্তৃত নদী বয়-
আমাকে গ্রহণ করো হে বিষন্ন সৌরভভরা চিরহরিৎ
বন্ধুরা হারিয়ে গেলে
(তুই, তুমি , আপনি-যারা হারিয়ে গ্যাছে, যাবে,যাচ্ছে)
বন্ধুরা হারিয়ে গেলে, শীতরাতে জ্যাকেটের স্মৃতি মনে পড়ে
হারিয়ে গেলে সম্ভাব্য বন্ধুদের কাছে যেতে ভয় করে শুধু
ঠাণ্ডা খাবারের মতো স্মৃতির ভেতর খেলা করে যায়-মৃত্যু
হারিয়ে গেলে বন্ধুরা হয়ে যায় নাম এক, বিষন্ন বায়স
প্রাচীণ ফলাকা যেন, দৃশ্যের অতিলৌকিক বেদনার নাম
আশ্চর্য ফুল কখনো, কখনো দূরন্ত ট্রেন-সংঘর্ষে জীর্ণ
তবু সবিনয়ে বলি, এ’ভোরলগ্ন কথার ভার একা লাগে
কখনো মৃত্যুর কাছে নেমে এলে অর্ধশত সকাল ও রাত
বলিরেখা মুছে দিতে এসো-বলো আমি সৈয়দ সাখাওয়াৎ
না, কবিতা লিখছি না!
এইসব ম্যাটাফোর, যেন প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকা
সকল বিদায়ী কথা , মেঘবালিকার গান উড়ে যাচ্ছে
পাতায় পাতায় লেখা হয় বার্তা, প্রেক্ষাগৃহে-নিরুপায়
তোমাদেরই গায়িকা, নায়িকা-নায়কগণ দাঁড়িয়েছে-
লাইনবন্দী মিছিলে-ওখানে পাতারা ওড়ে-তালুবন্দী!
এই যে অনাকাঙ্ক্ষিত সুখপ্রাপ্তি, উদগ্রীব জনগোষ্ঠী-
তোমাদের রসপাত ঘটে, মৃত্যুর মিছিলে-রক্তপাতে
সফল অনুঘটকে লিখে যাচ্ছো বেদনার মহাভান
সকল কৌতুহলের অপমৃত্যু হলে, তুমি ও মদিরা
সকলের অগোচরে চলে যাও স্নানকক্ষে-শান্ত, স্থির!
আয়ুর ভেতর
সবকিছু ডুবে থাকে সদানন্দ আয়ুর ভেতর।
ফুলের ভেতর জল, গড়িয়ে চলে গ্যাছে গহীনে
এ’দৃশ্য দ্যাখে ভ্রমর উড়ে গ্যাছে ছায়ায়,অক্রমে
ঘুমন্ত শবের সারি, সেইসব স্মৃতির আধার।
পারদের দোল দ্যাখে, শরীরে গ্রহণের মৌসুম
দৃশ্যের ভেতর তবু যেন দীর্ঘ প্রমাদ, শূণ্যতা
নামের আয়ুজীবন পার করে দাঁড়াই যেখানে-
সেখানে পড়েছে ছায়া- দীর্ঘজীবন পথক্রমের।
সন্ধ্যেবেলা
একটা উটের পিঠে কাটলো সন্ধ্যাবেলা
একটা চড়াই পাখি উড়ালে গান গায়
রাইজলে ডুব দিচ্ছে সন্ধ্যাতারা
সাগর যেন আমূল পাল্টায়
বাদাম দানা ভাঙছে দাঁতের চাপে
শহর যেন ব্যস্ত নাবিকপাড়া
যা কিছু ঝরে গ্যাছে
যা কিছু ঝরে গ্যাছে, তারা কোথায়, কবে ফুটেছিল কে জানে
পথচারী নদীদল, এতকিছু বয়ে নিয়ে গ্যাছে ঢেউয়ের মাথায়
ফসফরাস বুদবুদ কতটুকুইবা দ্যাখেছে, দ্যাখেনি মরা চোখও
শুধু খেয়ালের আলিঙ্গনে কোথাও বুঝি থমকে গ্যাছে একাকী
পাহাড়ের কোল থেকে উড়ে যাওয়া পাতারা মূলত ঝাঁপ দ্যায়
পাহাড়ের কোল থেকে উড়ে যাওয়া পাতারা মূলত ঝাঁপ দ্যায়
যেভাবে হরিণশাবক নিজের ছায়ায় ডুব দ্যায় অথৈ জল ভেবে
পরিযায়ী পাখিদের ডানায় বিকল্প রোদ উড়ে যায় মৌসুম খুঁজে
মৃত্যুর শীতল চোখও ফাঁকি দ্যায়, ঝাঁপিয়ে পড়ার অমোঘ নেশা!
ওইযে দূর পাহাড়ে, রোদের ফাঁকে ফাঁকে ডুব দ্যায় বিলাসী চোখ
নিভন্ত সূর্য যারা বুকে বয়ে নিয়ে যায়, ওরাতো প্রেত-আহাম্মক
বাথান শরীর, বাঁচে ফুল-পাখি-ফল-পাতাদের সাথে যৌথ খামারে
সতর্ক পাহারাদার জানে না, নিখুঁত বুলেটের চেয়ে এ’বড় দরকারি।
নিখুঁত মৃত্যুর হাত, তুমি গুটিয়ে যাও!
আমি শুধু চাই-পাহাড়ের কোল থেকে উড়ে যাওয়া পাতা
ঝাঁপ দিয়ে পড়ুক নিষ্কলুষ জলে…
সূর্যডোবার মানে জানে অন্য আকাশ
আবারো কথা দিয়ে তুমি ডুব দিলে অথৈ জলে
তখনো ডানায় ছিল রৌদ্রের গন্ধ
কিছু জল শিশিরের শব্দের ভেতর ঘুমিয়ে গেল
কবরের নীরবতা ছিল আর ছিল –
রতিক্লান্ত বেদনার ঘুম
এবারো কথা দিয়ে হারিয়ে গেলে
পেছনে মাইলেজ শরীর বলে যায় সেসব নাতিদীর্ঘ
স্মৃতিকথা
হারিয়ে গেলে বুঝি পেয়ে যায় অন্যকেউ
সূর্যডোবার মানে জানে অন্য আকাশ
আঙুলে পাইন রোদ
১.
দোতালায় বিষন্ন দুপুর এসে দাঁড়িয়েছিল, বাইরে বাহারি বৃষ্টি তখনও
হাতঘড়ি একাকী কাঁটার ছল চাতুরি রোদ হাতরে ফিরেছে গান, সমারোহ
২.
নিজেকেও সাথে রাখি, এ’কথা শুনেছে কেউকি কোনোদিন খেয়ালের করপূটে?
ভীতির শতাব্দী ইতিহাস দ্যাখে উড়ে যাচ্ছি মাটি থেকে আকাশে আকাশে নিশ্চুপে
৩.
চোখে চোখে হিমালয়, বালিকার অভিমানী ঠোঁট কাঁপে আঙুলের ভাষা হারিয়ে
সেইথেকে নদী নামে, শরীরের বাথানে বাথানে জলেদের গুল্মগান জড়িয়ে
ক্রমশ
ক্রমশ পৃথক পাহাড় হয়েছি, ক্রমশ পৃথক নদী
কনিষ্ঠ আঙুল যেমন পৃথক, অনামিকা পাশে থেকে
বিছানা-বালিশে মৃদু কোলাহল, আঙুলের প্রতিভাষা
তবুও ফুটেছে বিষাদের সুর, আরো জল নিরবধি
পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে
১.
এই যে মানুষ, মুখ তুলে দ্যাখো-ওইখানে খেলা করে রোদের আঙুল
তথাকথ বেদনার মাছিদের অবিরাম ধ্বণি থেকে বের হয়ে এসো
পোড়াও এ’দুঃখভার ইশকুল। আমি তোমাকে দু’পাত্র কবিতা শোনাবো।
এখানে অবিরাম রোদজ্বলা গাছেদের গায়ে ভেঙে পড়ছে শব্দবিন্দু
খেলা করি-মাছিদের,বনেদের,রোদেদের শব্দকুঞ্জ ঝড় নিয়ে একা
তবুও জানি, প্রবাসী বায়ুর মেঘ এসে ছুঁয়ে যাবে ঠিক প্রতি হেমন্তে।
ফসলতোলা নগ্ন মাঠের উপর সওয়ার হয়ে ঠিক শুরু হবে মেলা
কী আর লাভ বলো, এতো এতো কল্পনার মেঘজমা দুঃখের কথা বলা?
৩.
আমাকে শেখাও গান, ঊষারতি! ফসলের বাগানে বাগানে যোনিমুখ চিনে
আমিও পথ হেঁটেছি তারাদের সাথে। একটা উন্মাদ সন্ধ্যা ছিল সেদিন
আর সাথে ছিলো বানভাসী আসক্তির জ্বলজ্বলে অনুভূতি-উড়ছিলো।
বলো? আর কীইবা চেয়েছিলো-কতটুকুইবা চায় শরীরের ঘামসিক্ত
রোমকূপ। সপ্তর্ষির তারা গুণে গুণে আমি হয়ে গেলাম বিকল্প কালপুরুষ!
স্বীকারোক্তি-১
জন্মকাল থেকে শিখেছি কীভাবে আলাদা হতে হয়
নাভীমূল থেকে জঙ্ঘাস্থি জটিল চুলের মত করে
নিয়মিত স্রাব ও মেহ করছে আলাদা তুমি-আমি
আমাদের কাল, কলের হাওয়া মাথায় করে দোলে।
চুলগুলো ঝরে পড়ছে সতর্ক টানের সাথে সাথে
রক্তস্রাব আর বীর্যের সকল পাহারা ধুয়ে ধুয়ে
কখনোবা মুখ ঢেকেছে বিপুল স্বপ্নের নীল দাগ
ঝরাপাতা বলে ডেকেছে রক্তের তুমুল আর্তনাদ!
তারপর, স্নান শরীরে আলাদা শোকের মৃদু টান
মধ্যযাম পার করছে নগর, সতর্ক হেঁটে যান!
প্রেম মাস্তানা
মানুষটা মারা যাবে বলে একটা নোট লিখে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষটা মরেনি। ধুকে ধুকে কাটিয়ে দিয়েছে ১২টা বছর। কম সময় না। মানুষটা মরে গেলে ১২টা বছর তাকে কম অপেক্ষা করতে হত। মানুষটা বোকা! অপেক্ষার ফাঁপড়ে পড়ে গেল। এখন নোটটা গলায় ঝুলিয়ে সে হেঁটে বেড়ায় শহরের অলিতে-গলিতে। লোকজন পিছু নেয়। হৈ হৈ রৈ রৈ একটা রব তুলে, আর বলে প্রেম মাস্তানা। আহা! লোকটা বোকা!
ইদানিং শহরের ছেলেদের গলায় ঝুলছে ফুটনোট আর মেয়েদের গলায় মাদুলি। চাবিগুচ্ছ ছুঁড়ে দিয়েছে কেউ জলে।
ফুলগুলো কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছিল
ফুলগুলো কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছিল
রাতজাগা পাখিদের ঠোঁটে সেইসব স্মৃতি বেঁচে থাকে
আর কেউ, যাদের ঠোঁটের উপর নিয়ত নিষেধাজ্ঞা
তারা, নিশ্চিন্ত রোদ ছেড়ে কথা বলে না।
ওইযে দূরে নক্ষত্রালোকে দুলে ওঠে
স্মৃতি-বিস্মৃতির নাম না জানা পাখিদল শঙ্কাডানায়
বিস্তীর্ণ পথের ক্লান্তি ওদের চোখে-মুখে পালক ছুঁয়ে
ঐশ্বর্যের রোদগুলো তবুও দুরন্ত।
অন্ধ
মাঠে মাঠে অশান্ত পাখিসব, নুয়ে পড়া ধানগাছ
মৃত মাঠ, গল্পের নামহীন জলস্রোত পাড়ি দিচ্ছে
মাঝে মাঝে ক্রন্দন, স্মৃতিদের বাড়ী থেকে শোনা যায়
এত এত বেদনা ও মাধুর্য্য দ্যাখি, তবু যেন অন্ধ!
সারি সারি মুখ দ্যাখে তোমার মনে পড়ে কী পড়ে না
গান নেই, শুধুই বিরতির আর্তি ফিরে ফিরে আসে
এইসব শব্দেরা ক্লোরোফর্ম, মুহূর্তের জড়ভাব-
এনে দ্যায় শরীরে, শোকাবহ সংগীত বেজে যায়।