পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন — “মীনগন্ধের তারা ।। হাসান রোবায়েত”

                                            বসন্তের বাইরে লেখা গান

 

এই যে নিজের বই নিয়ে লিখতে বসেছি, সে কি নিজের সঙ্গেই এক ধরনের প্রতারণা নয়! ভাবছি, যা কিছু লেখা হয়ে গেছে সেসব নিয়ে কেবল অন্যের কথাই শুনতে পারি আমি। ইনিয়ে-বিনিয়ে নানান ভান-ভবিষ্যৎ করে আমিও লিখে দিতে পারি কয়েক পৃষ্ঠা—কিন্তু সেটা হবে—না আপাত সত্য বলা, না নিজের সামনে দাঁড়ানো। ঝরে পড়া পাতাও কি তার ঝরার ভঙ্গিমা তুলে ধরতে পারে বনের কাছে! কেবল তার সমগ্র শুকনোতা নিয়ে বিবর্ণ ও মলিন হয়ে দেখতে পারে—পথিকেরা কিভাবে মাড়িয়ে যাচ্ছে তাকে! আর তার মর্মরশব্দের কিছু স্মৃতি নিয়ে যখন কেউ ঘরে ফেরে সেটুকুকেই ভেবে নেয় সফলতা। কবিতাও এমন। যদি কোনো পাঠক কোনোদিন এইসব কবিতার সামান্য লাইনও নিজের মতো করে তার কণ্ঠে তুলে নেয়, তবেই হয়তো আনন্দ হয় কবির। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।

তখন খুব ছোট। টিভিতে বেলি কেডস, জাম্প কেডসের বিজ্ঞাপন হতো। আমিও খুব চাইতাম আব্বু অন্তত ঈদে আমাকে ওই জুতা কিনে দিক। কয়েকবার পায়ের মাপও নিয়েছিল। কিন্তু কোনো ঈদেই সে জুতা পড়া হয়নি আমার। আমি হয়তো সেজন্যই লেখায় বারবার জুতার কথা বলি। সেদিনের ছোট-ছোট সুতাগুলো যেন আমার চারপাশে উড়তে থাকে। লাল নীল কালো। কবিতাকেও মনে হয় শৈশবে আব্বুর নেওয়া পায়ের মাপ। এর সুর এতো সাবলীল হতে হয় যে একটু এদিক-ওদিক হলেই কিছুতেই আর খাপ খাবে না। আমার মগজে কি অবধারিতভাবে গেঁথে গেছে ভাষার মাপজোখ! এই জন্যই কি আমিও চাই নতুন জুতার মতো চকচক করুক ভাষা! লেখালিখির একদম শুরুর দিনগুলো থেকেই ভাষার নতুনত্ব আমাকে ভাবিয়েছে, ভাবায় এখনো।

ছেলেবেলায় একবার আমাদের বাড়ির পাশের এক কবরে প্রস্রাব করেছিলাম। তখন বাড়ি বাড়ি বেদেনীরা আসতো। মাকে, ওই ঘটনার পরেই একজন বেদেনী বলেছিল, আমার জীবনে নাকি ফাঁড়া আছে। মা বিশ্বাস করেনি। তবুও কারো কারো কথায় সেদিন মা একটু টলে গিয়েছিল মনে হয়। শুরু হলো ফাঁড়া কাটানোর আচার। আমার পিঠে হাত রেখে কী কী সব পড়ছিল বেদেনী মেয়েটা! কিছুই বুঝিনি সেদিন। কিন্তু পষ্ট মনে পড়ছে সবাই কেমন আবেশে ঢুলছিল। কেউ কি মন্ত্রের কথাগুলোর মানে বুঝেছিল—! নাহ। লেখার কৌশল হিসাবে আমিও গ্রহণ করতে চেয়েছি বেদেনীদের ওই আবেশ করবার ক্রিয়াটি। মনে হয়, ছোটকালের এই সামান্য ঘটনা আমাকে লিখতে সাহায্য করে প্রতিদিন। আমিও বিশ্বাস করতে শিখেছি সমস্ত অর্থ ও নিরর্থকতার বাইরেও কবিতার ভাষা হবে মায়ার আকর।

এই তো সেদিন। তখন মাদ্রাসায় পড়ি। প্রতি বৃহস্পতিবার আব্বু আমাকে বাড়ি নিয়ে যেত। বুধবার রাতে ঘুম হতো না। যে আমাকে টেনেও ঘুম থেকে তোলা যেত না, সেই আমিই ফজরের আজান শুনতে পেতাম। মাদ্রাসার বহু দূরের একটা মসজিদে আগেই আজান হতো। বিস্তীর্ণ কলমির জলাশয় পার হয়ে সেই সুর আসতো আমার কানে। কেন যেন মনে হতো আজানের ওই সুর কলমির আধো বেগনি ফুলের কলসীকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হালকা রঙের আভা ছড়িয়ে ফিরে আসছে আমার কাছে। সবাই ঘুম। শুধু আমিই জেগে জেগে শুনতে পেতাম তার রঙ। সেদিনের ক্লাস শেষ হতেই আমার অস্থিরতা বেড়ে যেত। কখন আব্বু আসবে! অপেক্ষা করতে পারতাম না। মাদ্রাসার গেটের কাছেই একটা বকুল গাছ ছিল। তার ডালে বসে বসে আব্বুর আসার পথে তাকিয়ে থাকতাম। এক সময় দেখা যেত আব্বু আসছে। বকুলের ডাল আর আব্বুর দূরত্বের ওই পথটুকুই আদতে আমার কবিতা।

কত কিছুই তো পড়া হলো না! টেবিলে, শেল্ফে, বিছানায় কত বই-ই তো থক থক করতো এক সময়। দু-চার পাতা উল্টিয়ে সেসব কবেই রেখে দেওয়া হলো কাঠগন্ধের পাশে। যেন আরো অনেক দিন পর অন্য গ্রন্থের দিকে তাকালে সেসবও চোখে পড়বে। এইসব অবিশ্বাস আর আত্মতা নিয়েই আমার দিন কাটে। সেদিনের রঙ কেমন, আমি ভুলেও জানতে পারি না। এই যে না পড়তে পারার হাহাকার আমাকে আর যন্ত্রণা দেয় না। ভাবায়, পৃথিবীর কোনো প্রান্তের মানুষ হয়তো নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের ধারে বসে, যে রেণু সূর্যাস্ত দেখছে আনমনে, কিভাবে অনুভব করেছিল তাকে সেসব লিখে যাচ্ছে—কে লিখতে পারে সেসব! আমি আসলে খুব একটা পড়তে চাইনি বোধ’য়!

বাইরে, তিন রাস্তার মোড়ে যিনি জুতা সেলাই করছেন কট সুতা দিয়ে, তাকে আমার ভীষণ চেনা লাগে। আমি হয়তো অনেক বই পড়তে পারবো না কিন্তু ওই লোকটির থেকে একদিনও দূরে থাকতে চাই না! ধরমপুরে এক ভিখারি টাট্টু ঘোড়া নিয়ে সপ্তাহের দুইটা নির্দিষ্ট দিনে সওয়াল করতে আসতেন। আমি তো কতই তার জন্য অপেক্ষা করেছি! উনি আসলেই কমলালেবুর কোয়ার মতো চকোলেট বের করে দিতেন, শোনাতেন বাড়ির পাশেই থাকা দুইটা ভাই-কবরের গল্প। সেসব কি লেখা হয়েছিল পৃথিবীর কোনো গ্রন্থে! জানি না! ওকড়ার মাঠ, মোনামুনির জঙ্গল, সুবিল, মাধুডাঙা এসবই আমার পড়া বইয়ের পাতা! আমি আসলে দেখতে চাই, ছুঁতে চাই! তল্লা বাঁশ চুরি করতে গিয়ে যে পিঁপড়ার কামড় খেয়েছিলাম আবার খেতে চাই সেসব!

অনেক বই-ই হয়তো পড়া হবে না। কিন্তু এক মুহূর্তও আমি আমার গাছ, বৃদ্ধ ভেড়া আর রঙধনু গায়ে মাখা ইস্পাতের জানালা ভুলতে চাই না। এরাই তো আমাকে জানিয়েছিল—

‘চিরকাল বসন্তের বাইরেও কিছু ফুল ফোটে’  

আমি কেবল বৈমাত্রেয় ভাষায় ধরতে চেয়েছি আমারই এই সব দেখা।



                       ‘মীনগন্ধের তারা’ পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা

 

হলুদ পাখির ডাক   

১.

তোমাকে নিকটে পেয়ে বুঝি—

বহু আগেই জিপসিরা ঢুকে গেছে বনে

যেভাবে পানি, খানিক ভরসা ছিল মহিষের

প্রতিটি উনুন থেকে যেটুকু গেরস্থালি

পড়ে থাকে ভাঙা রশ্মির কাছে—

 

হাতপাখা স্তব্ধ আজ—

এখনো জুঁইয়ের ঘ্রাণ ভেসে আছে টিলার উপর—

 

২.

তোমাকে ডেকেছে কালভার্ট

কী ভীষণ মধ্যাহ্নের রোদে—এই সব ফিরে আসা—

যেন এক সাইকেল অনায়াসে পার হয় পথ—

ও পারে সাতবিল বহু দিন দেখে নি কইয়ের ঝাঁক—

 

ফরজে ও সুন্নতে অথবা মুয়াক্কাদায়

দ্যাখো কতশত গোধূলির ধ্বনি

এখনো বলছে ফাঁড়া কেটে যাক মানত-শোধে

 

 

উড্ডীন, তুমি এক গতি—ফলের সংঘর্ষে পাও প্রাণ

উড্ডীন, তুমি এক গতি—ফলের সংঘর্ষে পাও প্রাণ

 

হারানো তোমার লোভে, আমি ঊন

একান্ত নির্গুণ

‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ ছুড়েছি অজস্র বার

 

বস্তুত চলে যায় দিন, মেহেদি পাতার পাশে—  

 

৩.

তোমার চলে যাওয়া ফিরে ফিরে দেখে নিই—

সূর্যানুগামী কোনো ঢেউ

পানির উপর দিয়ে বয়ে যায়—

নীরব শূন্যস্থানে এখনো ঝরছে কেয়া ফুল

দুপুরের ঘরগুলো পাখিদের খুঁটে খাওয়া দানা

কিভাবে ছড়িয়ে দেয় আঙিনায়!

 

তোমার আসার ছলে

অনেক জন্মান্তর শিস ফুঁকে ডুবে যায় রোদে— 

 

গবাদিপশুর দড়ি কাটি—

যেন বিস্তীর্ণ ভূকম্পনে ওরাও পেতে পারে নিষ্কর বাদামের খেত

গোধূলির নিঃসঙ্গতা ঘেঁষে যে বাছুর দাঁড়িয়েছে একা

হয়তো মায়ের বাঁট শুকিয়েছে বাতোন রোগে

কিভাবে ডাকছে সে-ও ভাতের মাড়ের দিকে একা!

 

প্রতিটা দাবার চাল কতটা নিঃসঙ্গ এইখানে!

তুমি চলে গেছো ঘুঘুভরা নক্ষত্রের দিকে—

 

আবার লটকন ফলার আগেই ফিরে এসো— 

 

৪.

যাবার আগে অন্তত নিমগাছটির কথা ভেবো!

ওই পাতা তোমাকে দিয়েছে বাউল,

গ্রীষ্মের কড়িকাঠ—

দীর্ঘ ঋতুর নিচে অজস্র বাস্তুসাপ কিভাবে লুকায় ছায়া!

 

শূন্য পথের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত উড়ছে শিমুল—

 

৫.

মানুষ ট্রেনের অপেক্ষায় কেবল হারিয়ে ফেলে জংশন

 

৬.

কত দিন রৌদ্রধাতবের নিচে হেঁটে যাও

অথচ কোথাও তুমি নেই

এই সব না থাকার ছল কাঠের পরিবেশ ভেঙে

ঋষভ থেকে ধৈবত তারপর ঊর্ধ্বের অনন্ত শামায়— 

 

হিম শঙ্খেরা, কতটা নতজানু হয়ে তোমাকে চেয়েছে জলে—

প্রতিটি গানের পাশে

ধূলিপথ গেয়ে গেছে তারা—

 

৭.

যা কিছু বলার ছিল, ভাবি—

 

মুদিদোকানির কথা, উদ্বিগ্ন সাইকেল হাতে যে পুরুষ চলে গেল

কূট দুপুরের কাছে

কেন যে ডাকঘর পুরনো কাঠের নিচে

গুনে যায় অপ্রাপ্ত চিঠি!

যেন শ্বাশ্বত চলে যাওয়া বলে অনন্তর কিছু নেই—!

 

৮.

মানুষের মুখের দিকে তাকালে তোমারও মনে হয়

আত্মহত্যার পাশে

ছাতিমের নিজস্ব কোনো বন নেই—

 

গাছের নিবেদন-কালে

কে আর ছায়াকে ভেবে নেয় সন্তান!

হিংসার মর্ম ঘেঁষে প্রতিদিন কিছু পাতা ঝরে যায়

 

৯.

বকুলের ভুল হলে সারাদিন থমথম করে পথ

 

১০.

যাবার পরেও যে লেবুগাছটির দিকে চেয়ে ছিলে

তার শিরাভর্তি ঢেউ তোমাকে ডেকেছে হাওয়ায়

 

কেন নদীতীর আজানু তরঙ্গে

আমাকে জানায় নাচ—! 

একাকী পত্রঝড় থেমে গেছে ধাতুমন্ত্রের দিকে—!

 

একটি সুরের পাশে উড়ে যায় ডাহুকের ছাঁচ

 

১১.

তোমাদের কড়িকাঠ থেকে অনর্থক ভেসে গেল দিন

ভাবি, কোনো চিঠি এল কিনা! চারদিকে পড়ে থাকে

নিখিল ডাহুক!

 

অপরাহ্ণের ভাঙা নিমগাছে হলুদ পাখির ডাক,

রয়েছে কোথাও 

পাখি সে—ভ্রমণকালের তমসায় হারিয়েছে বনতল

ধুলার বিরহ তাকে নিয়ে গেছে দূরে—

 

১২.

মানুষের কান্নার পাশে একটি ডাহুক উড়ে যায় নিভৃতে

শেয়ার