কৌমুদী অন্ধকার
প্রতীক্ষার সময়কাল বহুদিনের। যমদূত আসবে বলে নিশুতিরাতে জলের উপর বসে থাকি পা ঝুলিয়ে। গতিময়তা খেলা করে যাপিত জীবনে, যেখানে বিভ্রান্তরত আত্মশুদ্ধি মূর্ছিত। জীবন্তলাশ হয়ে জোড়াপায়ে হেঁটে চলে উদ্বায়ু মস্তিষ্কের দেহ। ইনিয়ে-বিনিয়ে উপকেশে আবৃত দগ্ধ দোপাটি হীরাফুল, সুখফুল, নাকফুল! অনুপ্রাণিত ছন্দ সুর তোলে গুনগুন করে, স্নেহের অতলে মিশে যায় তনু অবিনাশী গান হয়ে। ভাঙে ঢেউ ভাঙে, মিলিয়ে যায় সমুদ্রের নোনা জল হয়ে। ক্রমাগত নূপুরের ক্রন্দনধ্বনি সেও এসে থামে সুপ্ত নীড়ে। অব্যক্ত প্রহর বিস্তৃত হয় শীতলতার পথ ধরে। অন্তঃপুরের জানলার পাশ জুড়ে ঝুলছে ক্রোটন, হাওয়ায় দুলিয়ে মন। জাগ্রত সত্য-মিথ্যে অজানাই থেকেছে। গোপন সান্নিধ্যে পাতাবাহার জেনেছে এরাই হীরাফুল!
আলোকসুন্দরী নম্রপাতায় পালক খোঁজে। অলঙ্কারের বাক্সে হাতড়ে বেড়ায় বিছাহার, শঙ্খের বালা, নাকছাবি। আপন যত্নে কৈশোরের সুঁইসুতোর ফোঁটায় পদ্মরাগমণির পাশা দুলোয়। ক্লান্তির চোখে কাজল এঁকে নিয়ে স্নিগ্ধতা ছোঁয়। কাচের চুড়ির আলনা থেকে সিঁদুররাঙা চুড়ি নামায়। হাতে জড়িয়ে, রিনঝিন রিনঝিন খেলার ছলে মোহিত হয়ে হঠাৎ উচ্চারিত হয়- উফ! নিঃশব্দে কৌমুদী অন্ধকারে প্রবেশ করে দ্যুতি ছড়ায়। ছায়ামানবী আয়নায় তাকিয়ে, আলোকসুন্দরীও তাকিয়ে। খুব চেনা চেনা লাগে। দৃশ্য ভেসে আসে চুড়ির হাটের। ছায়ামানবী, হুবহু সেই মুখ, সৌখিন খাসদানা ছিল যার কোলের ওপর। এক খিলি পান চিবোতে চিবোতে চুড়িওয়ালি নিজের বাহুতে মেপে বেছে বেছে চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে বহুযত্নে। পর্যায়ক্রমে মাপ দিতে দিতে হুট করে চুড়ির ভাঙা অংশে আঁচ লেগে কেটে গেলো হাত। ক্ষতস্থান জুড়ে বয়ে গেলো লাল বর্ণের স্রোত, শঙ্খের বালায়। নতুন চুড়ির শাদা মোড়কে মাখামাখি করলো সিঁদুর লাল। আমি ‘ইস্’ শব্দ তুলে বলে ফেললাম, ‘খুব রক্ত ঝরছে। কিছু দিয়ে চেপে ধরুন ওখানটায়, রক্ত পড়া বন্ধ হবে।‘ মুখে হাসি টেনে চুড়িওয়ালি পানের পিক ফেলে বলে ওঠে, ‘নষ্ট রক্ত। বাহির হইয়া যাক। কিছু হইবো না!’
আপোষ না মেনে বেঁচে থাকার নিয়তিতে, জাগ্রতিক ব্যর্থতার বিপরীতে খেলুড়ে হয়ে ওঠে কেউ কেউ। তারপর কোন শব্দ মাথায় খেলে না। সিঁদুর রঙের চুড়ি হাতে, হেঁটে চলি কোলাহলের একপ্রান্ত ধরে। মেঘ দোলানো চুলের মাতাল ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায়, ছায়ামানবী জড়িয়েছে গুলবাহার, আঁচলের খুঁটে থেকে বের করে এক খিলি পান। ইশারা করে, আলোকসুন্দরীর কোমল হাতের ক্ষতে। টকটকে সিঁদুর লাল মাখামাখি খাচ্ছে! চিকচিক করে উজ্বল দ্যুতি ছড়াচ্ছে ছায়ামানবীর নাকফুল। তীব্র অনুভূতি ক্রুর হয় ক্রমশ, নষ্ট রক্ত স্রোতে ভেসে শিরা- উপশিরায় গোঙানির শব্দ তোলে। জলের তলে বাতাস ফুরোয়। উন্মগ্ন মাছের ঝাঁক পেখম মেলে, উপুড় হয়ে চোখের দিকে তাকাই। প্রতিবিম্বে যমদূতের মুখ ভেসে আসে। অস্পষ্ট আলো ফিক করে হাসে। মাছের ঝাঁক কেঁপে কেঁপে ওঠে। শাদা শাদা মেঘ জমে জলের উপর, হিম হিম রক্ত বাষ্পীভূত হয়। মাছেরা শ্যাওলা হয়ে ভাসে…