সে কি পঞ্চকাঠের ঘোড়া
সারাজাত সৌম
ওই যে— কালো কচ্ছপটি ধীর, কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে যেন সে একাই আপন মনে হাঁটতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অথচ তার চারপাশে কতো কিছুই না দ্রুত বদলে যাচ্ছে বা যায়ও! সেদিকে তার মোটেও ভ্রুক্ষেপ নেই। কেনইবা থাকবে। সে তো তার একান্ত আনন্দ-বেদনা নিয়েই সাজিয়ে রেখেছে তার সমস্ত বোধের জীবন। যেন আমি তারই ছায়ার ভেতর অন্য এক ছায়া হয়ে আছি। নিজের বলতে আদতে কিছুই নেই— সকলই সকলের ছায়ামাত্র। কেবল মনের দিকটাকেই বড় বেশি আপন মনে হয়েছে নিজের কাছে আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে যে, সেও তো নিজ দেহ থেকে বেরিয়ে যায় যোজন যোজন দূর! যেন বাতাসে উড়ে যাওয়া সেই হলুদ পাতাটির মতো মর্মর সে বেদনা। আমি যার গান শুনছি হাওয়ায় চড়ে কিংবা বালির সাথে মিশে গিয়ে তাকে সান্তনা দিচ্ছি সেইসব বেদনার জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি। আসলে আমি কি লিখছি সেটা বড় বিষয় নয়, জীবনের কাছে বরং আমি কি দেখছি বা ভাবছি সেটাই হলো বিষয়। অথচ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেন আমি নিজেই নিজের কাছে এক অদ্ভুত রকমের প্রাণী— সব ভুল প্ররোচনায় ভেসে যাচ্ছি আজ অকূল জলের গভীরে! তবু এই পথে যেতে যেতে অন্তত যদি কেউ ডুব দিয়ে তুলে নেয় আমার আদল, একটি জলজ ফুল— মাছেদের মতো আলো কিংবা এক টুকরো পাথরের পাশে বসে যদি কেউ কোনো এক পাগলের মুখের ভাষার ভেতর দিয়ে বলতে থাকে আমার এই মানুষের ভাষা— তবে তাই হোক। আসলে এই বইটি নিয়ে এ ছাড়া আর আমার তেমন কোনো দোর্দণ্ড প্রতাপ আপাত দৃষ্টিতে হয়তো নেই, তবে যেটুকু আছে তা কেবল তার ভেতরের নানান রকম মানুষের নানা দৃশ্যের অনুসঙ্গ, স্মৃতি-বিস্মৃতি আর সেইসব হারানো মুখের আভা। যারা পৃথিবীতে ভালো থাকে— মন্দ থাকে। এমনকি তার বাইরেও চলে যায় কেউ কেউ অন্তহীন মায়ায় পড়ে— এ যেন জীবনেরই আরেক নিজেস্ব খেয়াল…
ভাবছি— পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ অথচ তারচেয়েও বেশি পড়ে আছে আমাদের জন্য বিশদ শূন্যস্থান! ছুঁয়ে থাকা— না থাকার মতো সুখ-অসুখ এমনকি দুঃখের মতো এক একটি সান্তারা দুলে ওঠা বাড়িটির পাশে। যেখানে পাখিদের ঝগড়ার মতো কতো কতো সকাল যেন আলোর ভেতর তারা নিজেরাই এক একটি আলোক পাথর! এখানে আমার শৈশব যান্ত্রিক— ভায়োলেন্স থেকে পালাতে চেয়েছি বারবার। হয়তো এখনো পালাতে চাই অনেক কিছু থেকেই কিন্তু কোথায় যেন আটকা পরি বারবার, হয়তো মানুষের মুখের কাছে— যে ছায়ায় থেকে উড়ে আসে অবিরাম শিশু আর ফুলের মতো আঘ্রাণ! কিন্তু মানুষ— তার এই যে অপরিমেয় ব্যবহার, আমাকে খুব বেশি যে মুগ্ধ করেছে এমন বলতে পারি না। কিন্তু দূরেও যে ঠেলে দিয়েছে সবাই এমনও তো না। তাই হয়তো এই দূর বা কাছে— আর অদেখাকে ভালোবাসতে পারি আমি আমার মতো করে। বলতে পারি— খুব কি বেশি কিছু চাইছি আমি? এ প্রশ্ন বহুবার বহুভাবে করেছি নিজেকে। কোনো উত্তর পাইনি— হয়তো তার উত্তর আমি খুঁজতেও চাইনি কোনোদিন। শুধু প্রশ্নটাই আমাকে দৌড়াচ্ছে এখনো, এখান থেকে ওখানে আর আমি ছুটছি— যেন একটি হরিণ হঠাৎ করে জলে তার নিজের ছায়া দেখে নিজেই ভয়ে ডুবে যাচ্ছে কুয়াশায়। জীবন সত্যিই অদ্ভুত! বহুবার তাকিয়ে থেকেছি— পল গগ্যাঁ’র সেই ছবিটির দিকে, “…কোথায় আছি এবং কোথায় যাচ্ছি”।
হয়তো এ ঘর শূন্য আর মহাশূন্যস্থানের দিকেই সে প্রসারিত হতে থাকবে চিরদিন। তুমি দৌড়াবে আর পেছন থেকে সরে যেতে থাকবে সেইসব মধুর দৃশ্য আর পথে পথে ছড়ানো-ছিটানো তোমাদের যতো অহং এবং অলংকার। এমনকি চোখের সামনে জড়ো হতে থাকবে আরো এক একটি দৃশ্য নতুন— যা দেখোনি কোনোদিন আর। কবিতা বোধ করি এমনই দৃশ্য-ভাষার-আবেগের-অনুভুতির মতোই বিস্তৃত এক ভিন্ন গ্রহ, যেখানে তুমিই সৈন্য— তুমিই রাজা। যা কিছু মহৎ— মানুষের আড়ালেই পরে থাকে সে। এর নির্ণয় এমনই এক নির্বাণ— যে তাকে দেখেছে একবার সে আর কোথাও দেখিনি তাকে! হয়তো অন্য কোথাও সে ফুটে আছে মধুরিমা— এক অনাত্মীয় মায়ের পেটে অন্ধকারে। মানুষ তো কেবলই আনন্দ চায়। আর আমি চাই মানুষ ভালো থাকুক মানুষের মতো। সেকি যন্ত্র—পরান্মুখ, দেখে দেখে শেখার কাল! যদি আমি আবার শিশু হতাম কিংবা কিছুই না— এর চেয়ে ভালো বোধ করি আর কিছুই হতো না আমার।
পৃথিবীতে এতো কিছু বিরাজমান যে, একজন মানুষ তা একজীবনে দেখেও শেষ করতে পারবে না— পারেও না। তবুও এই না দেখার ভেতর থেকেই যেটুকু শুনতে পাওয়া যায় বা দেখতে পাওয়া যায় তার ইশারাই একমাত্র কবির জীবন। এর বাইরে তার আনন্দ-দুঃখ বলে কিছুই নেই। আমিও এর বাইরে যেতে পারি না! এটাই আমার কাজ। দেখা-অদেখার সীমানায় পৌঁছানোর মতো করে আজ কোথায় যেনো চলে এসেছি আমি, কোথায় যেন চলে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তেই…
তবে কে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার এই ভাষা—আমার দেহ— সেকি পঞ্চকাঠের ঘোড়া! ধুলা উড়িয়ে এই শহর থেকে—গ্রাম থেকে—মানুষের কোলাহল পাশ কাটিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে তার ধ্বনি। সেকি ফের কম্পিত করছে না পৃথিবী আর আমাদের চারপাশের বস্তুসকল। হয়তো কিছু তার আমি দেখি আবার দেখিও না! অথচ এইসব ইশারা নিয়েই ছুটে চলছি। যেন “একাই হাঁটছি পাগল” তার মনকে নিজের মন ভেবেই প্রভাবিত হয়েছি ভীষণ।
কেননা—আমি আমার মন দ্বারাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত।
‘একাই হাঁটছি পাগল’ পাণ্ডুলিপির কবিতা
ব্লু
গভীরে ন্যুড—শান্তি শিশুর মতো হাত-পা ছড়িয়ে থাকে। ফুলের উপর এই নীল— পায়রা উড়ে গিয়ে স্থির সাদা স্কার্ফে। অথচ তুমি ছিলে— না থাকার পরাগ, হঠাৎ রোদের মতোই এক পাগলি থুথু দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়!
পড়ে থাকে শীতল ব্লু—রাগের মতন। সূর্য—তুলি সে এখন সম্ভাবনার। আঁকো—যতো মেঘ—ঘর-বাড়ি আর আমাদের ছোট্ট মায়ের মুখখানি।
যেন গভীরে—আরো গভীরে ন্যুড। তার চেয়েও ভারি এ জীবন—যদি বেঁচে থাকো কোথাও ঈশ্বর—বেঁচে থাকো আমারই চিত্র নিয়ে।
অন্যের স্ত্রীর প্রতি
ষোল বছর বয়স—পাখির সমান। এই যে, আপনি অন্যের স্ত্রী—আমার ভালো লাগে। আপনার গাছের ফুল—পাখিদের মৃদু ডাক, এটা একটা ব্যাথা। যেন মাথার ভেতর পুরো দুনিয়ার চিৎকার।
মেশিনগান…
ডালিমের রক্তে ফুটে থাকা সুন্দর। সকল শাড়ির কুচি থেকে ছড়িয়ে পরা প্যানডোরা! আমি আঙুল দিয়ে এঁকে রাখি আমার ঘর—বিস্তর শরীর, একা একটা রাক্ষসের।
অথচ কোথায় যেন আপনার ঘুম—তেত্রিশে এসে পরীটি জাগে।
আমি উঠছি না—নামছি না। তবু আপেলের শরীর—ছবির মতো লাবণ্য ধরে হাঁটে। ঘুরেফিরে তাকাই। এফোঁড়-ওফোঁড় করা আপনার একান্ত দৃশ্য—এই মনোহর জগতের। অদ্ভুত! আপনার স্বামীটি এখন বুড়ো ঈগল—আকাশ ও মৃত্যুপুরীতে।
জানি—এখনও আপনার চোখের ভেতর ডুবে থাকে সেই সব ষোল বছর বয়সের সমবেদনা…
শীতকাল
চোখের উপর দাঁড়িয়ে থাকে পয়মন্ত দিন—গাভীগ্রাম! গাজরের গ্রীবায় সন্ধ্যা নেমে এলে তুমি চুল ছড়িয়ে দাও আকাশে। আর এক পাগলা নক্ষত্র—চোখ মেরে লুকিয়ে যায় ধ্যানে!
জানোই তো—স্কুল দিনে আমার বড্ডো শীত লাগে। সাদা মোজাদের কুচকাওয়াজ কষ্টকর। অথচ সবুজ কার্ডিগানে যে ফুলগুলি আরবি ভাষায় কথা বলে, তার দিকে তাকিয়ে এবার আমি মরেই যেতে পারি!
হে শীতকাল—আমাকে একটা খরগোশ বানিয়ে দাও। আমি ফুলকপির ওম নিয়ে ঘুমোতে চাই।
চোখ
হিরা কেটে নিচ্ছে সমস্ত দৃশ্য, জল—সমতল। মানুষ—মানুষের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ রাগ—রকেট যাচ্ছে কোথায়?
শরীরে—পোঁদে আতঙ্ক—জ্বলছে হিরা, কেটে নিচ্ছে সমস্ত দৃশ্য। অথচ মানুষ—মানুষের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ ছবি—তুমি যাচ্ছ কোথায়?
শালিখ
শালিখ—রোদের বর্ণচোরা এক। যে জলের উপর ভেসে থাকা মাছেদের শরীরে বিলি কেটে চলে যায় অনন্ত পাগলের ছাঁচে!
অথচ তার বালখিল্য হাসি—চাপা পড়া ফুল—বর্তুল মেঘ—কাজলের ঘোড়া, এঁকে যায় দিন—মোহরের দাগে।
এই টান—সিনান ছেড়ে—যে গেছে উড়ে—সেই সন্ধ্যার ফাঁকে! তার ভাষা উজ্জ্বল—সোনার চেয়ে।