হাতে এসে পৌঁছালো ব্রায়ান অ্যাডাম্স ও মারমেইড বিষ্যুদবার। লেখক হাসনাত শোয়েব। এই লেখকের লেখা বইয়ের পাতায় এই প্রথম পড়লাম। কবির সঙ্গে চেনা পরিচয় বলতে সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইন ম্যাগাজিন মাধ্যম থেকে।
প্রথম ঝলকেই লেখাগুলির আলাদা পাঠ্যগুণের কথা মনে পড়ে যায়, একটার পর একটা চমক আসে। লেখাগুলি এগিয়ে যায় একটা এলগোরিদমের মতো, তারপর একটা বিনির্মাণের মোড় আসে। সেখানে থেকে এই যাত্রা এগোলো না পিছোলো বোঝা যায় না, কিন্তু রাস্তা অনুসরণ করলে বোঝা যায় সড়ক তো ঐ আছে, আশেপাশের বাড়িঘরগুলো পালটে গেছে। নিজের রিপ্লিকা নিয়ে যেমন ম্যাডাম তুসো নিজের মিউজিয়াম বানিয়ে মমির আত্মজীবনীতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছেন। আসলে সময়কে আটকে রাখতে চায় সমস্ত যাদুঘর।
কিছু নাটকীয়তা তো রাখতেই হয়, যে কোন কলা বা কৌশলে যা প্রতিভাত হয়, তার জন্য দীর্ঘদিনের অনুশীলন থাকে, এই বইটির প্রচ্ছদভাবনা থেকে প্রতিটা লেখা এক একটা স্তর উত্তীর্ণ করে যায়, নিজের অক্ষের চারিপাশে ঘুরে কবি হাসনাত শোয়েব অদ্ভুত বৃত্ত তৈরি করেন যা আসলে দেখতে আয়তাকার অথবা রম্বস, এক আবসার্ডিটি থেকে এক বিন্দুর মিলন মেলা, বাবা, কনক, বাড়ি, মা, স্কুল, বেড়ে ওঠা প্রতিদিন নতুনভাবে আসে, নিজেই ঘুরে-ফিরে বিভিন্ন চরিত্রে অনুভব করেন, কথোপকথন করেন, লিপিবদ্ধ করেন প্রতিটা যাপনের পল অনুক্ষণ ও তার পর্যবেক্ষণ। প্রতিটা লেখাই চমকে দেয়, নতুন মেটাফর আসে, নাটক আসে, কাহিনীর বৃত্তটি গড়ে ওঠার আগেই তা ডিফিউজ হয়ে যায় । কখনো ধরেন, কখনো ছাড়েন, এক খেলার মত। “আমি তোর কথায় চার ভাগের পৌনে তিন ভাগই বুঝি না / কথা আসলে এক ধরনের যৌনতা যার আসলে কোন কিছুই ঠিক বলে বোঝানো যায় না”।
একটা কবিতা “কাঠবাদামের কান্না”। যেখানে লেখক নিজকের আবিষ্কারের কথা বলছেন, কান্নার কথা বলছেন। দারুণ চিত্রকল্প, অ্যাবসট্রাক্টটো আছেই, দুমড়ানো এলগো, ক্লিন ভাষা প্রয়োগ, পারফেক্ট ন্যারেটিভ । অদ্ভুত এই জিনিস। অনেক কিছুকে নিঃশেষ করে আবার নিজের কাঠামোতেই আরেক অচেনা চরিত্র স্থাপিত হয়, যে কোন অবতারকে যেন নিজস্ব কথা বলিয়ে নেয়। কাউকে কোন জ্ঞান দেবার থাকে না, নিজের ভাবনা ও কল্পনার বিস্তারে রিপ্লিকেট হতে থাকে ‘আমি’, নিজের ভিতরেই আবিষ্কার হয় চেতনা, সাহস, মানুষকে মানুষ বলে চিনে নিতে চায় কবি।
“বিষাদের আলসেশিয়ান”-ও ভালো লেগেছে। নিজেকে হারানো আর খুঁজে ফেরা, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর লেখা। মানুষ তার পরিণতির কথা ভাবে, বিশ্বস্ততার কথা ভাবে, উত্তরাধিকারের প্রশ্নে জড়িয়ে থাকতে চায়, সম্পর্কের তালগোল পাকিয়ে যায়, নিউরনে মোচড় আসে, আলসেশিয়ান তাকিয়ে থাকে, পারপ্লেক্সড।পাঠকের কোথাও আজ যাবার থাকে না।
“অন্ধ ব্লুজ” লেখাটিও বেশ টাফ ন্যারেটিভ, মনে হয় কোন বিদেশী কবিতা পড়ছি, কোন পাবলো নেরুদা। এমন চিত্রকল্প আসে, না জানা কথা, না জানা চিরুনী, সিম্ফোনি, আর্মেনিয়ান হাওয়াই গিটারের কথা। সব ভাষা ডিকোড করা যায় না, করা দরকারও পড়ে না, কতটুকুইবা আজ আমরা মেয়েদের অর্গাজম নিয়ে জেনেছি?
“কী বিষাদ! কী বিষাদ!” কবিতায় আত্মহত্যার কথা আসে। তরুণ প্রজন্মের কবিরা আত্মহত্যার কথা বলছে মানে একটা ফ্রাস্ট্রেশন লেভেল তো আছে মনে হলো। তথাকথিত বাঙালি সমাজ কবিতা বলতে যা বোঝে, বাজার সেই রাস্তায় ফেরী হয় না, এই কবিতাও তাদের মাথার উপর দিয়ে যাবে। বোধগম্য হবে না, বিক্রিবাট্টাও কম হবে, ইনটেলিজেন্ট পাঠক তাই সংখ্যালঘু হবে। কবিদের মধ্যেও সেই বিষাদ। কী আর হবে। বব মার্লের কনসার্টও ভরবে না আজ, আত্মহত্যার জন্য যে পারফেক্ট স্টেজ বেছে নেবে যে কোন সৃষ্টিশীল যুবক। ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে।
আরো কিছু আমার ভালো লাগে “চিঠি আর আসেনি”, “বুলগেরিয়ার রাজধানীর নাম হয় সোফিয়া লোরেন”, “ব্রায়ান অ্যাডাম্স ও মারমেইড বিষ্যুদবার”,”বিষন্ন বিমানের দ্রাঘিমা”…আরো অনেক, অনেক।
হাসনাতের প্রতিটা কবিতা নিয়ে আলাদা আলাদা ফিলিং হয়, একবারে পড়া যায়, অনেককিছুই লেখা যায়, আমারই বরং সীমিত কবিতা জ্ঞান বলা যায় তাই সেই ধৃষ্টতা না করাই ভালো। কিন্তু পাঠক হিসাবে আমার যে অনুভূতি, সেটা তো প্রকাশই করা যায়। কবিতার চরিত্র, কবিতার কন্টেক্সটে ঢোকা যায়, আর অভিমন্যুর মতই পথ হারাতে হয়। অর্থাৎ টেকনিক্যালি বলা যায় এইগুলো ক্লোজড কবিতা নয়, বেশ প্রবেশযোগ্যতা রয়েছে। আর যেহেতু ভাঙ্গা ভাঙ্গা এলগোর উপস্থিতি রয়েছে, সম্পূর্ণ আবসার্ডও নয়, বরং আমার মনে হয়েছে ন্যারেটিভ নিয়ে একটা অবচেতনার আশ্রয় নিয়েছে যা ইন্টারটেক্সটে গিয়ে পাঠকের মনে একটা নাটকীয়তা আনে, এক একটা সত্যের ডিসকভারী হয়, সত্য চিত্রপটে এসে নিজেকে ডিফিউজ করে। সেটা একটা বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেয় পাঠককে।
আমি বেশি কিছু জানি না এই কবি সম্পর্কে। আমি দিল্লি থাকি, এক ডায়াস্পোরিক দুনিয়া। আর এই কবি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাসিন্দা । দূর দেশ থেকে তার বাংলা কবিতা এই পড়ছি , এটাই যোগাযোগের আশ্চর্য সবুজ সিগ্ন্যাল, আর যেখানে ভৌগলিক দূরত্ব ধুসর হয়ে আসে ।