নৈশ ডাকঘর
নৈশ ডাকঘরে পড়ে আছে
তোমার বাদামি খাম
লিখে জানিয়েছো,
কিভাবে হাত না পুড়ে
ব্যতি চালের মাড় গালতে হয়
খোসাসমেত রান্না চড়াতে হয়
ঠিকঠাক ভিটামিন রক্ষায়
কিভাবে চিৎকার গিলে ফেলে
সবচেয়ে সুন্দর হাসির ছবি দিতে পারছো না
পাছে লোকে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ভাবে,
তুমি দারুণ সুখে আছো!
সংসার করতে কত ছল চাতুরি
তোমার করতে হয় জানতে ইচ্ছে করে
রাত এলে পরে তুমি ঢেকে যাচ্ছো
শরীরের ভিতর।
মন—
তাকে কবে কে
কখন শেষ স্পর্শ করেছে বা
আদৌ করেছে কিনা
মনে পড়ে না!
রিফিউজি
আমার বাবা প্রায়সময় বলেন,
“তোর কচ্ছপটা বড় হয়ে যাচ্ছে। খিদে পেলে দ্যাখ কেমন পাথর খেয়ে ফেলছে! এক্যুরিয়ামটাও ছোট হয়ে গেছে। এবার এটাকে বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আয়।”
ভয় হয় যদি বায়েজিদ বোস্তামীর বড় কচ্ছপগুলো ওকে গিলে খেয়ে ফেলে! অবশ্য আমি ঠিক নিশ্চিত নই- কচ্ছপ কচ্ছপের মাংস খায় কিনা! যেমন আমি জানতাম না, মানুষ মানুষকে কীভাবে ধীরেধীরে খেয়ে ফেলে। আবার এই আশঙ্কাটা উড়িয়ে দিয়ে ভাবি, এমনও হতে পারে আমার কচ্ছপটাকে মাজারের কচ্ছপেরা সাদরে গ্রহণ করলো না, এমনভাবে তাকে দেখলো যেন এক সন্দেহজনক প্রাণী ঢুকে পড়েছে তাঁদের সীমানায়। তারপর সে হয়ত বন্ধুহীন- আত্মীয়হীন একা একা সারা পুকুরময় ঘুরে বেড়াবে যেন কোন শরণার্থী শিশু…
(যা কিছু থাকে গোপন)
আমরা গোপনে কথা বলতে বলতে একদিন ভালোবেসে ফেলি। আমরা ভাবি ভালোবাসলে তো বিয়েটাও করে ফেলা জরুরি। তুমুল প্রেমের টানে আমরা পালিয়ে যাই। বিয়ে, ঘর সংসার, বাচ্চা বিয়োনো সবই ঠিকঠাক চলে। আমরা একদিন একটা দ্বীপে বেড়াতে যাই— আমরা দুজন, বাচ্চাদের মাথায় ফুল ব্যান্ড আর ফ্রক পরিয়ে। বাচ্চারা সমুদ্র দেখে পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে ঢেউয়ের দিকে। তুমি আমি সুখী সুখী মুখ করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আর ভীষণ সঙ্গোপনে এই অসহ্য সুখকে গিলে ফেলি। চোখ তুলে দেখি আমাদের বন্ধুরা এগিয়ে আসছে। আমাদের গোপন জীবন ধরা পড়ে যাবে এক্ষুনি! আমি এগিয়ে যাই তার দিকে। সে হাত বাড়িয়ে টেনে নেয় আমাকে। তুমি অন্যদিকে তাকে বাহুলগ্ন করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসো। হাসির ফুলঝুরি। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কি সুন্দর ছোট সবুজ চারাগাছের মতো তাদের দেখায়! এবারের মতো আমাদের গোপন বেঁচে গেলো দেখে আমি তোমার বউয়ের নাকফুলের প্রশংসায় এবং তুমি আর সে দাঁড়িয়ে দেখে যাও বাচ্চাদের এইসব খেলা খেলে যাওয়া।
আমিও তোমাদের দেখি ঈশ্বরের মতো, দর্শক হয়ে।
কামড়
তোমার কানের লতিতে ইন্দ্রাণীর দাঁতের দাগ লেগেছিল। ইন্দ্রাণীর বাচ্চার নাচের ভিডিওতে হাততালি দেওয়ার সময় ঝকঝকে দাঁত বের করে ও হেসে উঠতেই আমার আড়চোখ তোমার কানের লতিতে অদৃশ্য সেই দাঁতের কুটকুট দেখতে পাচ্ছিল।
গড়পড়তা
আমার বাবা ভীষণ আটপৌরে মানুষ
আমার বাবা ভীষণ ভীতু
ছেলে মদ খেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরলে
মেয়ের সংসার ভেঙে যাওয়ার
অজুহাত খুঁজে না পেলে
অফিসে কারো হিসাবে গরমিল হলে
(যদি বাবাকে দায়ী করে!)
ভয়ে বাবা জড়োসড়ো,
“লোকে কি বলবে!”
বাবা তাই চুপ থাকেন
পাশের বাসার পুরুষটির গ্লাস ভাঙা
বা নারীটির চিৎকার চেঁচামেচিতে
বাচ্চাদের কান্নার রোল, মারপিটের শব্দে
বাবা দরজা জানলা সব খিল মেরে
বাকিসব শব্দের আসার পথ বন্ধ করে দেন
তিনি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না
যদি লোকে জিজ্ঞেস করে,
“কীভাবে মেয়েটি মারা গেলো টের পেয়েছিলেন?
রোজ কি তাঁদের ঝগড়া, কথা কাটাকাটি হতো?
বর কি প্রতিদিন মারতো?
কোন আওয়াজ? কোন শব্দ?”
বাবা জানেন শুধু লোকের ভয়ে
সব শব্দের আসা-যাওয়াটুকু আটকে দিতে
ঝামেলা এড়াতে, ঝামেলায় জড়াতে।
শাফিনূর শাফিন
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।
প্রকাশিত বই:
প্রথম কাব্যগ্রন্থ “নিঃসঙ্গম”, অনুবাদগ্রন্থ ” গন্দমফুল” (কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের ম্যাক্সিমের বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ) এবং চার্লস ডিকেন্সের “আ ক্রিসমাস ক্যারল” (ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ)। প্রাচ্য রিভিউ নামে একটি ইংরেজি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদক।