নেক্রোপলিস
দ্যাখো, দুনিয়াবি সন্ধ্যা নামিছে দিগন্তের ওই সরল কোণে
তবু আমাদের ছায়ারা কাটা পড়ে যাচ্ছে, আলোর সংক্রমণে
ভোর হলো কী ? আমাদের ?
উদিতে সূর্য বুঝি ঘনঘোর মেলানকোলিয়ায়
ফ্যাকাশে ধূসর সকাল আসিলো ফিরিয়া
এই সব ভোরে বিছানা ছাইড়া উইঠো না।
বিষাদগ্রস্ততার চাদর মুড়ায়ে করিতে দুনিয়াদারি
বাইর হইতে চাও কী ?
পড়াইতে ছাত্র ?
অথবা অফিস? ফাইল, ল্যাপটপ?
মুখোশ তুমি। মানুষ অল্প।
যাও তবে । করো দিকদারী।
রাতে ফিরে মুড়ি দিতে স্যাডনেসের কম্বল।
টানাটানি জীবন তোমার।
অনেক ছলাকলা জানা ব্যর্থতা,তোমারে আটকাইলো কিসে ?
মান্থলি পে চেক।
তোমারে টান দ্যায় দৈনিক বাজারের ফর্দ। হিসাব।
বায়বীয় সংসারের খুঁটিনাটি।
তোমার পায়ের কাছে প্রভুভক্ত কুকুর হইয়া
বইসা থাকা সুইসাইড সাইলেন্স
তোমারে টাইনা নিয়া যায় গোরস্থান।
বুকের শেষ শ্বাসটুকু , শেষ আশটুকু
টাইনা নিয়া খোলস তুমি। মহাশ্মশান।
কাকেদের মাতম, ডানার ফড়ফড়ানি
তোমারই হৃদয়গত কলরব
শ্মশান তুমি, নদী না…
এই বেলা অতলান্তে ডুইবা যাও।
দ্য লৌন এক্সপ্রেস
ধরো এইরকম
কইতে চাইতেছি তোমারে কথা
আকাশে বেদনার লু
চান্দের গায়ে বাড়ি খাইতেছে
দীর্ঘশ্বাসের দমক
ফালি ফালি কাটা পড়া জোসনারা
তড়পিতেছে আসমানে
টুকরো টুকরো তাহারা ঝরে পড়তেছে
পথে
প্রান্তরে
বাদাবনে
একাকী ছাদে
বৃষ্টিতে
চিলেকোঠায়
এখন
এইখানে
এই ইস্টিশানে
যেখানে এখন ফাঁকা
শূন্যতার মতো দাঁড়ি টাইনা ছুটতেছে শেষ ট্রেন
ঝমঝম ঝমঝম…
ট্রেন; তুমি কার বুকে বাজতেছো হাহাকার?
ঘনায়মান ঘূর্ণিতে কেবলই থরথর
কাঁপতেছে মাটি
যেন বা হৃদয়
বাজায়ে সুতীব্র হুইসেল
শালবনের ভিতর দিয়া ওইদিকে যাইও না
এই ঘনঘোর আন্ধারে
ওদিকে এখন কোন ইস্টিশান নাই।
মহীনের ঘোড়াগুলি ঢুকে গেছে আরব্য রজনীর পাতায়
পৃথিবীর সব গল্প পুরে নিয়ে ঝোলায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ওই চলে যায়!
বাঁশি তার বাজেনি এবার
তবু সুরের মুর্চ্ছনায় হারিয়েছে তার পিছু পিছু
ট্রেন;
কান্না করুণ ট্রেন
তুমি এখন থামবা কোথায়?
মিলি
আমার ছোটবেলার বন্ধু ডলি, ডলি নামটি তার না পছন্দ বইলা অল্প বয়সেই সে নাম পাল্টায়া লাইজু হইয়া যায়।
ডলি ভালো নাচতে পারতো। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুর ‘পর স্কুলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের যে অনুষ্ঠানটি চলতো, তাতে সে মোটামুটি গলায় গাইতো। এরকম এক বৃহস্পতিবার, সে গাইতেছিলো, খ্যাচা পানিইইই…খ্যাচা পানিইইই…।আমার মাথার মধ্যে জাইগা ওঠা প্রশ্ন জিগাইলো, হোয়াট ইজ খ্যাচা পানি? আমি হিন্দি বুঝি না, তাই বইলা খ্যাচা পানিরে ভুল বইলা ডিকটেট করতে পারি।
দুইজনে দুই টাকার দুইটা চিটাগাং বিস্কুট খাইতে খাইতে হাঁটতেছিলাম রাস্তায়। বাড়ি ফেরার পথটি ধরে। আমি আর মিলি। এইক্ষণে চিটাগাং-এর সাথে কোন প্রকার সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও মুসলিম বেকারির বিস্কুটটি কেনো চিটাগাং নাম নিলো, সেই প্রশ্ন বিবেচনায় না আইনা, বিস্কুটে কামড় দিয়া মিলি কইলো, ‘ডলি ভুল গাইছে।’
ও নিজে ক্যাসেটে শুনছে গানটা, কেচোবানিইই…। আমার হিন্দি গান শোনার সুযোগ নাই। তাই মিলির কথারে যুক্তিযুক্ত ধইরা নিয়া হাঁটতে থাকা রাস্তায় আগাইতে থাকি। বাড়ি নিকটে আসে।
রাস্তার বামদিকে শ্মশান। সেইখানে বছর বারো বয়সে হুট কইরা বিষ খাইয়া মইরা যাওয়া মিলি, শুইয়া থাকবে কিছুদিন বাদে। যেহেতু অপ্রাপ্তবয়স্ক কুমারী কন্যা, তাই চিতায় না যাইয়া গোলাকৃতি কবরে ঘুমাবে মিলি। সপ্তাহ খানেক বাদে আমরা গুজব শুনবো, নিকট অমাবস্যার রাতে কালীসাধকেরা লাশ হইয়া যাওয়া মিলিরে চুরি কইরা নিয়া গেছে।
আরো বছর আঠারো পর, ইউটিউবে নাইন্টিজ নস্টালজিয়ায় বাজতে থাকা ক্যায়সে বানিইইই…ক্যায়সে বানিইইই… আমারে নিয়া যাবে
খ্যাচা পানিইইই…কেচো বানিইইই…
ডলি…মিলি…
শ্মশানে মিলির কবর…
কবর উপচায়ে বরিষণ ধারা বইয়া যাওয়া দীঘির জলে…।
মিলি, এখন নিথর রাতের ইনসমনিয়া
বাঁইচা থাকা এই আমার
নিদারুণ বাঁইচা থাকার গল্প ল্যাখে।
পোয়েট অফ দ্য ফল
ধরো দারচিনি গন্ধমাখা গল্পের ধোঁয়ায় উইড়া চইলা আসলাম
গ্রাম গ্রাম গন্ধমাখা ছোট্ট শহরে তোমার
তোমার বলতে যেইটারে তুমি
নিজের বইলা দাবী করো
ছোট শহরের ছোট ছোট দালানকোঠা
কদাচিৎ মাথাচাড়া দিয়া ওঠা কয়েকটা দালান
বা গগনচুম্বী স্বপ্ন , কোনটারে দেখতেছো আসলে তুমি?
এই পড়ন্ত সন্ধ্যার সমীকরণে?
মাঠে মারা যাওয়া বাকি সব স্বপ্নরা তোমার
তোমারি নিজস্ব গোরস্থান ফুঁড়ে
যেনো বা ভোজবাজি
ধেয়ে ধেয়ে আসে তারা আমারই দিকে
মৃত স্বপ্নেরা সব তোমারই সাপেক্ষ
নাম না জানা নদীতে নামি
পা ভেজাই
শীতল পানি; এতো পরিষ্কার!
ডুইবা মরার সাধ হয়
উইড়া যাওয়া আলগা বাতাসে
ঝুইলা থাকা এক টুকরো গ্রে সন্ধ্যা থেইকা
নাম কাটায়ে দিও কবিতার
আমাদের এখন গদ্যে লেখা জীবন
তবু ছায়া ছায়া গ্রে-তে আটকায়ে থাকা
বিষণ্ণতার উইন্ডো দিয়া
ডাকতে আসে কে?
বিষাদ? নাকি কবিতা?
জীবন যখন গোরস্থান
কবিতার প্রেতেরা আত্মার অস্থি দিয়া ডাঙগুলি খেলিবে
খেলিতেছে
জানো তো
মইরা যাওয়ার আগেই মইরা যায় যারা
পৃথিবী তাদের কবি বলে মনে রাখে
ল্যামেন্ট
স্যাফ্রন কুড়ানি কিশোরী
অকাল তুষারে তোমার ক্ষেত সাদা হয়ে যাইতেছে
তোমার জাফরান মনে রঙ ঢালতেছে
আশঙ্কার বিষাদ গ্রে
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তরুণী
সহোদরা তোমার
সবুজ পাতায় ছেয়ে আছে বাগান
পাত ভরে উঠতেছে না তবু তার
সাদা ভাতে
সেনোরিটা, কমলালেবু বনে
তুমি যে খুঁজতেছো সাইট্রাসি সুবাস
জানো কী?
মানুষ এক আশ্চর্য গন্দম
ল্যাভেন্ডার গন্ধ লাগাইতে গায়ে
তোমারে গিলে খাবে
তীব্র শীতের হাহাকার
জন্মিবে এক জন্মান্ধ বিষণ্ণতা
যেন বা গান্ধারী
দেখিবে দুনিয়া
মেলিয়া চক্ষু
কেন না পৃথিবীই ধৃতরাষ্ট্র তোমার!
এই স্যাফ্রন কিশোরী,
চা-পাতা তরুণী,
সাইট্রাসি সেনোরিটা,
অথবা তুমি!
তুমুল গান্ধারী
নিঃশ্বাসে তোমার
লিলি অব দ্য ভ্যালি
তবু হেমলকে
চিনে লোকে
কেবল সক্রেটিস
পৃথিবীর দম ফুরোলে ‘পরে
শ্বাস ভরে নিও বিশুদ্ধ বাতাস
যেখানে নক্ষত্র চূর্ণ
পাতিবে গালিচা
সরায়ে হাবিয়ার ছাই
চলো ততদিন
চোখ নাই, কান নাই, জিভ নাই
যেন
সংগোপনে বিষণ্ণতা পিয়ে যাই
শান্তা এফ. আরা
জন্ম যশোরে। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। কবিতা ও গল্প লেখেন।