হাবা
কোথাও যাব না বলে স্থির বসে আছি
একা একা, গঞ্জনার তীরে
বসে বসে পেছনের প্রতিও তাকাই
দূর থেকে ঘাড় নাড়ে বেগানা হিজল
তবু মনে হয়, তার পাশে, আড়ঠারে
সর্প পাখি কীটেরাও মন্দভাবে ডাকে
যেন আর যাবই না আমি
বেতের জঙ্গলখানি সাফ করে দিয়ে
পেছনের ঘুরপথও দশমুখে ডাকে
জরাজীর্ণ প্রত্নপুথি নিয়ে
যাব, না ফিরব তার কিছুই জানি না
বসে আছি নিমস্রোত গঞ্জনার তীরে
প্রবাস
একলা প্রবাসে আছে, ঘরে কবে ফিরবে ধীবর?
এপারে করচ গাছ, অড়হর, সবাই একাকী;
বাকিরাও চুপচাপ, পথপাশে জননী ও জায়া
ফিরবে হিঙ্গুল রাতে, যদি পায় গোধূলির বর?
শিকারি ঘনিষ্ঠ হলে টের পায় তিত্না ও পুঁটি;
জাল ফেলা হয়ে গেলে, নিরুপায় মাছেদের ভিড়;
তবু তো সবাই সেই স্বর-অন্ধ, কিছুই শোনে না :
কোথায় মাৎস্যন্যায়, কোন স্থানে ধীবরের ত্রুটি।
জলদাসী খরাগ্রস্ত, ঘূর্ণিবাত্যা, হৃদয় বেহাল
নাগর-গঞ্জিত দেখে সধবাও হেলে-দুলে হাসে;
গুঞ্জরন, বিলপারে, কথা ওঠে ধীবরপাড়ায় :
ধীবর ফিরলে ঘরে, ফের সে কি হাতে নেবে জাল?
ঘুঘুকাল
অঘ্রানে, খলার পাশে এসে ভাবি :
‘এ মাটি উড়ছে কেন, আর তার গায়ে
কেন লেগে আছে রাজ-চঙ্গলের দাগ?’
এই খোলা প্রান্তরেও নারীরত্ন চুপে মরে যায়
ভাবতেই অবাক আমি—যার নাম সাধুকান্ত,
সুষ্ঠু পৃথিবীর কাছে সেও দেখি বলে-কয়ে ঘুঘু
কেউ দিয়ে যায় বীজ, উয়ানির আগেই এসে,
অন্যজন, বারবার, খেয়ে যায় ধান
অকালসখা
এই তো থেমেছে ছুরি, তুমি গলা বের করে আনো
এইবার সিনা থেকে নামবে সিমার
সাধের আমন ধানে ভরে আছে ক্ষেত
দুজন দাঁড়াব আজ মিহিঘ্রাণ ধানের খলায়
দশদিকে উড়ুক নিশান।
আমরা জেনেছি আগে, কাকপক্ষী তাড়াবার নামে
কত শত গুমখুনি ডুবে গেছে আঁধুয়া ডহরে।
অহেতুক ভয় পাও তুমি, কী সব মানত নিয়ে
হররোজ বসে থাকো শাপরান মাজারের পাশে!
যেখানে বসেছে আগে সখি দিলারাম,
কখনো সরলা আর শানুরের মন্দোদরী মাই
এখন থেমেছে ছুরি, তির তুলে নাও
কোনো দিন জঙ্গপথে থামে না অর্জুন
আত্মগত
ধলুয়ার মাঠে এসে এ-গজল করেছি রচনা
এই লাল গোধূলিবেলায়
আজ যার গরুবারি ছিল, অস্ত যাওয়ার আগে
সে-রাখাল চলে যাচ্ছে লম্বা গোঠ নিয়ে
তোমার হৃদয়ে ওই মাঠহর্ষ বর্ষিত হোক
তোমাকে অবাক করে দিয়ে ডেকে ডেকে
চলে যাচ্ছে দীর্ঘ হংসসারি
যেভাবে এসেছে হাওয়া সেভাবেই ফিরে চলে যায়
দুর্গত গাছেরাও মৃদুমন্দ দোলে
তোমার মননে তার পত্রহর্ষ বর্ষিত হোক
দূরে দূরে, তবু শা-রগের পাশে চোখ খোলা যার,
তার কাছে এইকথা পৌঁছে দিতে বসে আছি আমি :
আমার গজল যেন আর্তনাদ করে না কখনো
আগুন
আগুনের পাশে বসে মনে মনে বহুদূরে ফিরে যাচ্ছি আমি
মূলত বসে আছি আগুনের পাশে,
বহু রূপে বহু ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে আগুন আগুন
পাশে এসে আর কোনোদিন বসব না, মনে মনে এইসব ভাবি
তবু ঠিক আগুনেরই পাশে প্রতিদিন বসে থাকি আগুনপাগল
মোস্তাক আহমাদ দীন
জন্ম ১৯৭৪ সালে, সুনামগঞ্জ জেলায়। গ্রামের লোকায়ত পরিবেশে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। গ্রামসংলগ্ল ভবের বাজার, ফকির সৈয়দ শাহনূর-সৈয়দ আসহর আলী,-শাহ মজিরউদ্দিন আহমদের জন্ম-স্মৃতিবিজড়িত সৈয়দপুর, ফকির আছিম শাহের জগন্নাথপুর আর রাধামাধব দত্ত-রাধারমণ দত্তের কেশবপুর গ্রাম একসময় ছিল বাউল-ফকিরদের আশ্রয়স্থল। পড়োশিগ্রাম ইসহাকপুরও সেই প্রভাবের বাইরে ছিল না। মামা ছিলেন লোকসাহিত্যিক, মাও খাতায় লিখে রাখতেন পল্লিবাংলার পইপ্রবাদ, শ্লোক ও মহাজনদের গান। নিভৃতে গাইতেন সৈয়দ শাহনূও, আর রাধারমণ দত্তের গান। হয়ত এইসব প্রভাবেই মোস্তাক আহমাদ দীনের জীবনের প্রথম প্রকাশিত বই দুটিই ছিল সম্পাদনাগ্রন্থ— নাম : ‘পরার জমিন’ (রচয়িতা : মকদ্দস আলম উদাসী, ১৯৯৯) এবং ‘নিবাচিত গান’ (রচয়িতা : আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধরী, ১৯৯৯)। এরপর, বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পাদনায় বেরিয়েছে ফকিরি তত্ত্বের আদিগ্রন্থ ‘ফকির বিলাশ’, ফকির শাহ মজিরউদ্দিন আহমদের নাগরী লিপিতে রচিত ফকিরি তত্ত্বগ্রন্থ ‘ভেদ জহুর’, বেরিয়েছে সে অঞ্চলের আরও কয়েক জন বাউল-ফকিরের গানের সংগ্রহ এবং লোকসংস্কৃতিবিষয়ক আরও দুটি গ্রন্থ ‘আটকুঠুরি’ ও ‘মাটির রসে ভেজা গান’। লেকাসংস্কৃতিবিষয়ে এইসব অবদানের জন্য পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির লোকসংস্কৃতি পদক ২০২০।
২০০১ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সমাদৃত হয়। চতুর্থ বই ‘ভিখিরিও রাজস্থানে যায়’ (২০১২)-এর জন্য পেয়েছেন ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার’, এছাড়াও কবিতায় সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘লোক সাহিত্য পুরস্কার’, ‘চিহ্ন পুরস্কার’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘ঐহিক সম্মাননাসহ আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার।
কবিতা ছাড়াও সৃজনশীল সাহিত্য ও বাঙালি চিন্তকদের মননচিন্তা বিষয়ে নিয়মিত গদ্য লিখে চলেছেন মোস্তাক আহমাদ দীন। এ বিষয়ের তাঁর ৩টি বই : ‘কবিতাযাপন’, ‘কবিতা পড়ার পরে’ ও ‘মননচিন্তা ও বিবেচনা’। মননচিন্তা বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য চিহ্নায়ক কাজ ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত ‘কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. তপোধীর ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে রচিত এই অভিসন্দর্ভের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ তাঁকে ২০০৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। বইটি ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
প্রাচীন ইতিহাসের প্রতি আগ্রহবশত অনুবাদ করেছেন উর্দু ভাষায় লিখিত সিলেট-ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘তারিখে জালালি’ (ফারসি ভাষায় প্রথম প্রকাশ : ১৮৬০ খ্রি.), ফারসি ও উর্দু সাহিত্যের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবির শের ও গজল। সম্পাদনা করেছেন (যৌথ) ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, সিলেট এবং জনজাতিবিষয়ক গ্রন্থ ‘বাঙ্গালা ও বাঙ্গালার বাহিরে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক’ (প্রথম প্রকাশ : ১৯১৫ খ্রি.) এবং ছোটোকাগজ ‘বিকাশ’ ও আলোচনাকাগজ ‘মুনাজেরা’।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি মোস্তাক আহমাদ দীন পেশায় একজন শিক্ষক। বর্তমান লিডিং ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। নিচে তাঁর পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থতালিকা উপস্থাপিত হলো :
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ
কথা ও হাড়ের বেদনা, প্রকাশক, পাঠকৃতি, সিলেট, ২০০১।
জল ও ত্রিকালদর্শী, প্রকাশক অর্কিড, সিলেট, ২০০৪।
জল ও শ্রীমতী, প্রকাশক পাঠসূত্র, ঢাকা, ২০০৮।
ভিখিরিও রাজস্থানে যায়, প্রকাশক, বইপত্র, সিলেট, ২০১২।
বানপ্রস্থের আগে, প্রকাশক, চৈতন্য, সিলেট, ২০১৪।
স্ফটিকচূড়ার নিচে, প্রকাশক, বাতিঘর, ঢাকা, ২০২০।
কবিতাসংগ্রহ-১, প্রকাশক, চৈতন্য, সিলেট, ২০২০।
মাটির বইয়ের পাতা, প্রকাশক, পুণ্ড, ঢাকা, ২০২৩।
প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ
কবিতাযাপন প্রকাশক, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, (২০১১); চৈতন্য সংস্করণ, সিলেট ২০১৮।
আটকুঠুরি, প্রকাশক, শস্যপর্ব, সিলেট, ২০১২; চৈতন্য সংস্করণ, সিলেট ২০১৫।
মাটির রসে ভেজা গান, চৈতন্য, সিলেট, ২০১৭।
কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭।
মননচিন্তা বিবেচনা, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৮
কবিতা পড়ার পরে, জলধি, ঢাকা, ২০২৩।।
অনুবাদ
তারিখে জালালি [১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সিলেটের ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ] মূল মবশ্বির আলি চৌধুরী, প্রকাশক, উৎস, ঢাকা, ২০০৩।
সম্পাদিত গ্রন্থ
পরার জমিন, মকদ্দস আলম উদাসী, প্রকাশক, লোকচিহ্ন, সিলেট, ১৯৯৯।
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান, প্রকাশক, লোকচিহ্ন, সিলেট, ১৯৯৯।
অকূল নদীর ঢেউ, শাহ সুন্দর আলী, প্রকাশক, শঙ্খ, সিলেট, ২০০৪।
মাসিং নদীর তীরে, ফকির সমছুল, প্রকাশক, বিকাশ, সিলেট, ২০০৫।
নূরে মারিফত, শাহ ছাবাল আলী, প্রকাশক শাহ তেরাব আলী কামারগাঁও, সুনামগঞ্জ, ২০০৫।
ছহি ফকির বিলাশ অর্থাৎ মারফতি ভেদ, মুন্সী মোহাম্মদ আশ্রফউদ্দিন, প্রকাশক শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১০।
কামালগীতি,কামাল উদ্দিন, শুদ্ধস্বও, ঢাকা, ২০১০।
আশিকের রত্ন সমগ্র, ফকির সমছুল, প্রকাশক শঙ্খ, সিলেট, ২০১২।
এ, জেড, আব্দুল্লাহ রচনাসমগ, কেমুসাস, সিলেট, ২০১৭।
নির্বাচিত গান, মকদ্দস আলম উদাসী, জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ, ২০১৭।
পূর্বাপর, রবীন্দ্রমূল্যায়নগ্রন্থ, শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ, সিলেট, ২০১৯।
শত জলঝর্নার ধ্বনি, শামসুল করিম কয়েস মূল্যায়নগ্রন্থ, ঘাস, সিলেট, ২০২০।
নির্বাচিত কবিতা, দিলওয়ার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০২০।
বাঙ্গালা ও বাঙ্গালার বাহিরে যে সকল দুব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক, ই.
এফ, সি ডালি, চৈতন্য, সিলেট, ২০২১।
ভেদ জহুর [নাগরী লিপিতে লিখিত ফকিরি তত্ত্বগ্রন্থ], শাহ মজিরউদ্দিন আহমদ, চৈতন্য, সিলেট, ২০২৪।
যাওয়ার পথে, ফকির সমছুল, চৈতন্য, সিলেঠ, ২০২৪।
সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা
বিকাশ [১৯৯১-১৯৯৭]
মুনাজেরা [২০০৮ থেকে চলমান]