ভাষার ভেদ
ব্যক্তিগত সুনামি বলতে কিছু নাই
ছিল না কোনোকালে
ব্যক্তিগত উক্তি ছিল না
ব্যক্তিত্বপিপাসু ব্যক্তি ছিল না
ব্যক্তিগত সংঘাত ছিল না
যুক্তি—বলয়ে আবর্তিত হ’তে—হ’তে
আমি কী করে গাইব অব্যক্তের গান?
এমনকি যা অযৌক্তিকও না
যুক্তির বাইরে অযৌক্তিকতার আড়ালে
আমার কণ্ঠ রোধ করে যে বাষ্প;
ভাষা, তুমি আমাকে দাও সেই অপূর্ব ধ্বনিসমষ্টি
ভাষা, তুমি আমাকে রোপণ করো সেই বর্ণমালা মাঠে
দোহাই তোমার আমার কণ্ঠ রোধ করে যে বাষ্প
তুমি তাকে প্রকাশ করো।
সুনামির যে—ঢেউয়ে আমি কলেমা পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি
তুমি সেই ঢেউয়ের বর্ণনা দাও
তুমি বিশ্লেষণ করো
তোমার যা ইচ্ছা, নৃতাত্ত্বিক অথবা দার্শনিক
যে কোনো কোনায় বসে লিখে দাও চাঁদের যোগ ছাড়া
এ কেমন জোয়ার?
না! অধিবিদ্যা নাম দিয়ো না!
ভাষা, তুমি তোমার গরিমায় ফাঁস করে দাও
উপরের দিক্ থেকে তোমার নজর কেন নামে না?
হে মহামান্য ভাষা, ওহি পাঠাও এই অবুঝ বান্দার কাছে
নীচে অন্ধকারাছন্ন ভূমিতে না—তাকালে ভূমিকে অনুভব না—করলে
তুমি কেমন করে জানবে সুনামি ব্যক্তিগত নাকি সমষ্টির?
হে তৃতীয় বিশ্বের কালো ভাষা,
তুমি কোন দিকে যাও? আলোর দিকে?
সাদার দিকে, উপরে?
তোমার মহিমা শুনতে পাই, অথচ
তুমি বিভক্ত! তুমি দুই প্রকার! একই সঙ্গে মহাপরশ্রীকাতর
তোমার দুই রঙ! একই সঙ্গে তুমি সবলা আর অবলা
একই বিশ্বের এক ঈশ্বর, এ কেমন প্রকারভেদে আসো তুমি?
একে অন্যকে দমিয়ে ঠকিয়ে দয়া—প্রার্থনায় এগিয়ে যাচ্ছ
নাকি পিছিয়ে যাও? যার পরে আর রাস্তা নাই, সেই রাস্তায় কেন হাঁটো?
থেমে যাও। থেমে যাও এই ধ্বংসের বাক্য নিয়ে
থামিয়ে দাও এই ধ্বংসের প্রলাপ!
মুছে দাও ভাষা তোমার সকল চিত্রকলা
সাহিত্যের প্রতিটা অক্ষরকে দাও কেটে
ধসিয়ে দাও তোমার পাহাড়সমান অহংকার
যা উড়ে যাচ্ছে ভূমির অনেক উপর দিয়ে।
তুমি ব্যক্তিকে উক্তি দিয়ে ব্যক্তিগত করো
তোমার ওহি আমার কাছ থেকে ছিনতাই করে সমষ্টি।
ভাষা,
এ—সুনামি তোমার বাইরের
এ—সুনামি তোমার অনেক অনেক নীচে বইবে
তুমি নিকাশ করো, তুমি যুক্তি দাও
অধিবিদ্যা বলে গালি দাও
বর্ণচোরা তোমার পরোয়া করি না
এ সুনামিতে আমি লা ইলাহা… প’ড়ে মরতে চাই।
জোড়াজন্ম
যেখানে প্রকাশ পায়নি মানুষের মুখ
যেখানে স্পর্শের অনুভূতি শুধু অমূল্য নিঃশ্বাস—প্রশ্বাস
তেমনই অবর্ণনীয় মাতৃগর্ভ যাপন
আমাকে অনুনয় করছে, অন্ধকার আকাশে তারার হরফে।
জন্ম হতেই দেখলাম আমি আলাদা।
আমার প্রকাশ আলাদা, আমাকে সময় দিলো না সময়
দ্বৈত নিঃশ্বাস আলাদা, দ্বৈত শরীর আলাদা
আমাকে সময় দিলো না সময়
আমি আর আমি না, আমি তুমি হয়ে
তুমি আমি হয়ে, তুমি আর আমি না
তোতলানো হলো না এই জন্মের পরে
আমি শব্দের ভিতর ভূমিষ্ঠ হয়েছি
তিরতির—পায়ে হাঁটা হলো না
আমি দৃঢ়তার ছবক নিয়ে এসেছি
সময় আমাকে সময় দিলো না
রক্ত ঝরল গলগলিয়ে
নাভি কেটে বরইপাতার সেক দিলো না মাসি
আমি নিজের রক্তপানেই বেঁচে উঠি
মাতৃহীন এ—জন্মে তড়পানো মানে প্রথম কান্না
একামত মানে বিস্মৃত প্রেমের বাণী
আমাদের প্রথম কাপড় হলো দিনের আলো
ঝকঝকে দিনের সমাজবদ্ধ আলো
দগদগে জন্মদাগের উন্মেষে জন্ম—যন্ত্রণা একীভূত হয়
জন্ম থেকে দূরে স’রে—স’রে আলাদা থেকে আলাদা হয়ে
জীবের শুধু মনে থাকে জন্মদাগ।
দিনের আলোয় দগদগে আর নজরকাড়া।
বরফ-জনম
আমরা দু’জন আজ এক প্রাণ আমাদের এই বরফ-জনমে
আমাদের এই পরিমিত মনে জন্মায় দ্বিধা নানান প্রকার,
আমাদের এই সহবাস কেন, মিলন না কেন! কেন দাঁতে দাঁত!
এ বরফ-যুগে সুন্দর করে ঘষা-মাজা-সাজা ছেলেমেয়েগুলো,
কেন খোঁজে বলো প্রেম-মাধুর্য? এই হিমযুগে প্রেম! প্রেম কেন!
হায় কী তোহফা পেলাম আমরা! বিশ্ব উষ্ণ তাই প্রেম হিম।
আমি ছিলাম যে বিনাশী আগুন, পুড়িয়েছিলাম তোমার বরফ
তুমি গলেছিলে, কিন্তু তোমার বরফায়নের দামামায় আমি
গলিয়েছি যত, পুড়িয়েছি যত, তারচেয়ে বেশি তাপ খুঁইয়েছি
তারচেয়ে বেশি বরফ হয়েছি, ঝরে ঝরে গেছি মেঘজাত শিলা!
আমার ধারণা তার নিচে কোনো তরল ছিল না, তোমার বরফ
ফঙ্গবেনে না, গললো না তাই প্লুত হলই না চারপাশ শেষে।
কুপিয়েছি আমি গর্ত খুঁড়েছি পানি পাই নাই, চৈত্র ছিল না।
ঘুটঘুটে কালো তার মাঝে আমি ছুটেছি চাকর, পেয়েছিলাম কী?
সিমেন্ট বালির মিশেল শাপলা। পেয়েছিলাম কী? পঙ্গু দোয়েল।
আমি ঘুঁটে খুঁজি, অথচ গরুই পাওয়া গেল না হে! জ্বালাব বৃক্ষ
বন আর বন! কাটো আরো কাটো! ইটভাঁটা জ্বালি আমাদের মনে,
যেহেতু আগুন জ্বলতেই হবে, পুড়তেই হবে পোড়াতেই হবে।
আমি চাইতাম রোষানল গতি, চারপাশে আমি তা দেখেছিলাম,
কী করে ছুটছে সকল বিদেশ, ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে, আমি চাইতাম
সেই গতি হোক আমার আপন, সেই গতি পেতে পেখম খুলেছি,
আমি না বুঝেই মাছরাঙা-নীল মুছেছি যতনে; গতির সঙ্গী
রক মিউজিক আমি কানে-তালা বধির হয়েছি মূক হয়ে গেছি।
কেরাঞ্চি-আঁকা মিউজিয়ামের দেয়ালে দেয়ালে, বাইরে শকট।
কী ক্ষতি হতো হে! যদি থাকতাম লেপটে ঊষায়, যদি থাকতাম
তোমার খামারে; আমাদের ক্ষেতে ফলনে ফসলে যবের হাসিতে!
ধানের ক্ষেতের অল্প পানিতে মাছ হয়ে যদি ভাসতাম! তাতে
কী অভাব ছিল? বৃষ্টি হতো না? গাছের পাতা কি দুলত না প্রিয়?
পুকুর শুকালে তার শাদ্বলে শুয়ে থাকতাম জড়াজড়ি করে,
বৃষ্টি ঝরত… আহা যদি হতো! এমন সবুজ! এমন জনম!
ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেল আমার আগুন; হিমবাহ হল, কেননা জামানা
আমার জন্য উপায় রাখেনি, সোনাদানা-মোহ আমাকে ছাড়েনি।
আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাই, দুই হিমগিরি, দূরে আরো দূরে…
ধীরে ধীরে সেই হাবল-সূত্রে, হেন দাবদাহে বরফের এই
সংসার যেন সিল-চিৎকার, তারা-ভরা রাতে দুই মেরুবাসী।
সবুজ ঘরেতে খালি ঘাম নয়- রাশি রাশি হিম জমে আজকাল।
হাশর
মানুষের দেহে ছিল যত দাগ নুনের প্রকার
ছিল যত রেণু রক্তের ফোঁটা, পোকার আহার
মানুষের মনে ছিল যত কথা, ছিল যত রঙ
ছিল যত ধার ইর্ষার কূপ আত্মঅহং।
হৃদয়েতে ছিল, ছিল যতগুলো গল্পের ঘর
সরু সরু রগ, আর তার মাঝে গচ্ছিত সুর
ইতিহাস লেখা ছিল মানুষের সাদা কপালেতে।
কপালেতে ছিল ইতিহাস লেখা, না-দেখা কালিতে।
যত সাদা ভোর; কত শত কালো রাত নেমেছিল;
মানুষের জানা সে-শূন্য হ’তে তারা ঝরেছিল
উঠেছিল যত ব্যথা বেদনার সূর্য আকাশে
নিভে ছিল চাঁদ কত কতবার আলোর আবেশে।
চোখের ভিতরে চোখ মুদেছিল কত কত চোখ
মরে গিয়েছিল কত সহস্র সহস্র লোক
কেউ তো থাকেনি, থাকেনি তো কেউ বায়ু সাগরে
মাটি চেপেছিল মাটির উপরে মাটির ভিতরে
ভাসান
আলো-আঁধারে হারানো দেশ ভাসে
তার মৃদু মুদিত দুই চোখে
ইলিশের ঘ্রাণে কলাইয়ের ক্ষেতে
আবার সে যেন জাগে
একই গানে সুর মেলানো জাগা কারা যেন
অবাস্তব সব আশে
চেয়ে দেখি, সমস্ত মানবসভ্যতা এক হয়ে যেন
ঘুমায় আমার পাশে
কেউ না থাকুক তবু কেউ তো দেখে
কেউ না রাখুক তবু কেউ তো রাখে
প্রতিরাতে আয়াতুল কুরসি পড়ে যেন কেউ
তার ওই গলন্ত মুখে
রওশন আরা মুক্তা
মূলত কবি। চিন্তা করতে ভালোবাসেন, চিন্তার পথে কোথাও থেমে যেতে চান না। বুলি সর্বস্ব মানবিক পৃথিবী না, নির্বাক প্রেমের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন।
তাঁর জন্ম ১৯৮৮ এপ্রিলের ১২ তারিখ।
রওশন আরার মুক্তার এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইগুলো – অপ্রাপ্তবয়স্কা (আদর্শ, ২০১৩), এলদোরাদো (ঐতিহ্য, ২০১৬), কেন দোলনচাঁপা (শ্রাবণ প্রকাশণী, ২০১৮), পিতরি প্রীতিমাপন্নে (আদর্শ, ২০২২)। গল্পগ্রন্থ: টরে-টক্কা (অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৮), গল্পগ্রন্থ: ঘুঘু (বৈভব, ২০১৯), গল্পগ্রন্থ: ঘুঘু (পুনঃপ্রকাশ- বৈতরণী, ২০১৯)।