‘প্রেম আমার প্রেম’ উপমহাদেশের প্রখ্যাত গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর লেখা একমাত্র উপন্যাস। উপন্যাসটির প্রকৃত নাম ‘বেগায়রে ওনওয়ানকে’ (নামহীন)। এটি মান্টোর জীবনের শেষ দিককার রচনা। এই উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু আর লেখক মান্টোর শেকড় একই—কাশ্মীর উপত্যকা। বইটি তিনি কেবল নেহরুকে উৎসর্গই করেননি, বইয়ের ভূমিকায় তাঁর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেন মান্টো। এই চিঠি একটা সময় ও কালের এবং কিছু ঘটনার ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে। তাই এই চিঠির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। প্রেম আমার প্রেম উপন্যাসটি আখতার-উন-নবী’র অনুবাদে বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশ হয় ১৯৮০ সালে। এ সময়ের পাঠকদের জন্যে নেহরুকে লেখা মান্টোর ঐতিহাসিক চিঠিটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
— রুহুল মাহফুজ জয়
সম্পাদক, শিরিষের ডালপালা
পণ্ডিত, আসসালামু আলাইকুম—
এটা আমার প্রথম পত্র, যেটা আপনার দরবারে প্রেরণ করছি। আপনি মাশাল্লাহ্ আমেরিকানদের কাছে খুবই সুপুরুষ বলে পরিগণিত। কিন্তু আমি মনে করি, আমার গঠনাকৃতিও খুব একটা মন্দ না। যদি আমেরিকা যাই, তাহলে আমাকেও হয়ত সেই সৌন্দর্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি হচ্ছেন বিশাল হিন্দুস্তানের প্রধানমন্ত্রী আর আমি পাকিস্তানের একজন শ্রেষ্ঠ গল্পকার। দু’টোর মধ্যে অনেক ব্যবধান। অবশ্য একটা ব্যাপারে আমাদের দু’জনের মধ্যে মিল আছে, আপনিও কাশ্মিরী, আমিও কাশ্মিরী। আপনি নেহরু, আমি মান্টো। কাশ্মিরী হবার আরেক মানে সৌন্দর্য এবং সৌন্দর্য মানে, যা এখনো আমি দেখিনি।
অনেকদিন থেকে আমি আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করে আসছি। (হয়ত জীবনে একদিন দেখা হয়েও যেতে পারে) আমার গুরুজনরা তো আপনার গুরুজনদের সাথে প্রায়শঃ দেখা-সাক্ষাৎ, ওঠা-বসা করতেন। কিন্তু এখানে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করার তেমন কোনো সুযোগই করা যায়নি।
এটা কত বড়ো ট্র্যাজেডি যে, আমি আপনাকে দেখিনি পর্যন্ত। অবশ্য কণ্ঠস্বর শুনেছি রেডিওতে, তাও একবার।
আমি যে বলেছি অনেকদিন থেকে আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করে আসছি, তার কারণ, সম্পর্কে আপনি কাশ্মিরী বলে। কিন্তু এখন ভাবছি, তার কি প্রয়োজন! কোনো না কোনো রাস্তায়, কিংবা কোনো চৌমাথায় এক কাশ্মিরীর সাথে অপর কাশ্মিরীর দেখা হয়েই যায়।
আপনি কোনো এক নহরের (নালা) পাশে জন্মগ্রহণ করে নেহরু হয়েছেন। কিন্তু এখনো ভেবে পাই না আমি, মান্টো কী করে হয়ে গেলাম আমি। আপনি তো যাহোক লক্ষবার কাশ্মীর দেখেছেন হয়ত, কিন্তু আমার স্রেফ বাঁহাল পর্যন্ত যাবার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার কাশ্মিরী বন্ধু-বান্ধবরা, যারা কাশ্মিরী ভাষা জানে, তারা আমাকে জানায়, মান্টোর অর্থ হচ্ছে ‘মানুট’ অর্থাৎ দেড়-সেরী পাথর। আপনি নিশ্চয়ই কাশ্মিরী ভাষা জানেন। যদি এই পত্রের উত্তর প্রদানের কষ্টটুকু স্বীকার করেন, তাহলে অবশ্যই ‘মান্টো’ নামের সার্থকতা জানাবেন।
আমি যদি সত্যিই দেড় সের হই, তাহলে আপনার সাথে আমার কোনো তুলনাই হয় না। আপনি পুরো নহর আর আমি স্রেফ দেড়-সেরী। সুতরাং আপনার সাথে আমার কি কোনো সংঘর্ষ হতে পারে? কিন্তু আমরা দু’জনেই এমন এক জোড়া বন্দুক, যা কাশ্মিরীদের ব্যাপারে বিখ্যাত প্রবাদমতে ‘রৌদ্রে ঠুস করে’।
মাফ করবেন, কিছু মনে করবেন না—এই কাল্পনিক প্রবাদটা শোনার পরে কাশ্মিরী হিসাবে ক্রোধে আমারও শরীর জ্বলে গেছে। প্রবাদটি খুব চিত্তাকর্ষক বলেই ওটা আমি ঠাট্টার ছলে নিয়েছি। অথচ আমি আর আপনি, আমরা দু’জনেই ভালো করে জানি যে, আমরা কাশ্মিরীরা আজ পর্যন্ত কোনো ময়দানে পরাজয় বরণ করিনি।
রাজনীতিতে আপনার নাম বড়ো গর্বের সাথে নিতে পারি। কারণ আপনি কথা বলে সঙ্গে সঙ্গে তার বরখেলাপ করতে বড়ো পটু। কুস্তিতে আজ পর্যন্ত আমাদের কাশ্মিরীদের কেউ পরাজিত করতে পারেনি। কাব্যচর্চায় কে আমাদের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পেরেছে? কিন্তু শুনে অবাক হলাম, আপনি আমাদের নদী বন্ধ করে দিচ্ছেন। তা পণ্ডিতজি, আপনি তো স্রেফ নেহরু। দুর্ভাগ্য যে, আমিও স্রেফ দেড়-সেরী পাথর। যদি ত্রিশ-চল্লিশমণী পাথর হতাম, তাহলে নিজেকে সেই নদীতে শুইয়ে দিতাম। যাতে পাথর সরানোর জন্য আপনাকে অন্ততঃ কিছুক্ষণ সময়ের জন্য হলেও ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে পরামর্শ করতে হতো।
পণ্ডিতজি, আপনি অনেক বিখ্যাত লোক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি হিন্দুস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ওদেশের ওপর, যার সাথে আমাদেরও সম্পর্ক জড়িত—আপনারই রাজত্ব, আপনি সবকিছু মাফ করবেন, আপনি এই অধমের (যে কিনা কাশ্মিরী) কোনো কথারই তোয়াক্কা করলেন না।
দেখুন, আমি আপনাকে একটা বড়ো চিত্তাকর্ষক কথা শোনাচ্ছি। আমার পিতা (মরহুম), স্পষ্টতই তিনি কাশ্মিরী, কোনো হাতু’র দেখা পেলেই তাকে ডেকে বাড়ি নিয়ে আসতেন, দেউড়িতে বসিয়ে তাকে নিমক-চা পান করাতেন। সাথে কুলচাও (এক প্রকার খাদ্য) থাকতো। তারপর বড়ো গর্বভরে তাকে বলতেন, আমিও কাশর।
পণ্ডিতজি, আপনিও কাশর। খোদার কসম, প্রাণ দিতে বললে তাও দিতে রাজি আছি। আমি জানি বরং এটাই বুঝি, কাশ্মিরী হিসাবে কাশ্মীরের প্রতি আপনার চুম্বকের মতো প্রেম আছে বলেই কেবল আপনি কাশ্মীরের সাথে জড়িয়ে আছেন। এটা প্রতিটি কাশ্মিরীর মধ্যেই থাকা উচিত, এমনকি যে জীবনেও কাশ্মীর দেখেনি, তার মধ্যেও।
যেমন পত্রের শুরুতেই লিখেছি, আমি স্রেফ বাঁহাল পর্যন্ত গিয়েছি। কুদ, বটু’ত, কসতোয়ার এসব অঞ্চল দেখেছি, কিন্তু সৌন্দর্যের সাথে সাথে ক্ষুধা-দারিদ্রও দেখেছি এসব অঞ্চলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য যদি দূর করতে পারেন, তাহলে কাশ্মীর আপনি নিজের কাছেই রাখুন, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি স্বয়ং কাশ্মিরী হওয়া সত্ত্বেও তা দূর করতে পারবেন না, কারণ আপনার সেই অবকাশই নেই।
আপনি এক কাজ করেন না কেন—আমি আপনার পণ্ডিত ভাই, আমাকে ডেকে নিন না কেন। আমি আপনার বাড়ি গিয়ে প্রথম শালগমের শবদেগ (এক প্রকার ব্যঞ্জন, যা সারারাত ধরে রান্না করা হয়) খাবো, তারপর কাশ্মীরের সমস্ত কাজকর্ম সামলে নেবো। এসব বখ্শী-টখশীরা কেবল পানি বখশিশ দেবারই যোগ্য। নম্বর ওয়ান চারশ বিশ। ওদের খামাখা আপনি নিজের প্রয়োজনে উচ্চপদমর্যাদা বখশিশ দিয়ে রেখেছেন—তা কেন? আমি জানি আপনি রাজনীতিবিদ। আমি তা নই। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, আমি কিছুই বুঝবো না।
দেশ ভাগ হলো। রেড কলফরা যা বোকামি করার করলো। এদিকে আপনি গিয়ে অন্যায়ভাবে জুনাগড় দখল করে নিলেন। যা কোনো কাশ্মিরী একমাত্র কোনো মারাঠার প্রভাবেই করতে পারে; আমার ইঙ্গিত প্যাটেলের প্রতি। (খোদা তাকে মাগফেরাত দান করুন)
হায়দরাবাদের প্রতিও আপনি প্রতিবেশীসুলভ আক্রমণ চালালেন। হাজার হাজার মুসলমানের রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিলেন এবং অবশেষে হায়দরাবাদও দখল করে নিলেন। এটা কি আপনার জন্য বাড়াবাড়ি নয়?
আপনি ইংরেজি ভাষার একজন নামকরা সাহিত্যিক—আমিও এখানে উর্দুতে গল্প-টল্প লিখি, যে ভাষার নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলতে চাইছেন আপনার হিন্দুস্তান থেকে। পণ্ডিতজি, আপনার বক্তৃতা-বিবৃতি সব আমি মনযোগ দিয়ে পাঠ করি, তা থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, উর্দু আপনার প্রিয় ভাষা। কিন্তু ভারত ভাগ হবার পর রেডিওতে দেওয়া আপনার ভাষণটি আমি শুনেছি। আপনার ইংরেজির ব্যাপারে সবাই স্বীকার করে, কিন্তু আপনি যখন নামমাত্র উর্দুতে ভাষণ দেওয়া শুরু করলেন, তখন মনে হলো যেন কোনো কট্টর মহাসভাওয়ালা আপনার ইংরেজি ভাষণের উর্দু অনুবাদ করেছে, যেটা পাঠ করার সময়ে আপনার মুখের স্বাদ বিকৃত হয়ে যাচ্ছিলো। প্রতিটি বাক্যের ওপর আপনি যেন বমি করছেন।
আমার বোধগম্য হলো না আপনি এমন ভাষণ পাঠ করার জন্য রাজি হলেন কি করে—! এটা তখনকার কথা, যখন ‘রেডকলফ’ ভারতকে ডবল রুটির দু’টি টুকরো করে রেখে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এখনো সেঁকা হয়নি। ও-দিকে আপনি সেঁকছেন, এদিকে আমরা। কিন্তু আমাদের উভয়ের উনুনুনের আগুন আসছে বিদেশ থেকে।
পণ্ডিতজি, আজকাল আপনার ‘বগোগোসের’ (এক প্রকার খাবার) মৌসুম। গোস তো আমি অনেক দেখেছি, কিন্তু ‘বগোগোস’ খাবার জন্য মনটা বড়ো আনচান করছে। এ কি অত্যাচার আপনার, বখশীর হাতে সবকিছু বখশে দিয়েছেন, অথচ সে বখশিশ হিসাবেও আমার জন্য একটু বগোগোস পাঠায় না।
জাহান্নামে যাকে বখশী আর বগোগোস—না, যেখানেই আছে ওরা সুখে থাক। আসলে আমার বক্তব্য হচ্ছে, আপনি আমার বইগুলো পড়েন না কেন! পড়লেও আফসোস, তার প্রশংসা করেন না। যদি না পড়েন, তাহলে তারচেয়েও বেশি আফসোস যে, আপনি একজন সাহিত্যিক।
আপনার বিরুদ্ধে আমার আরো একটা অভিযোগ আছে। আপনি আমাদের নদীর পানি বন্ধ করে দিচ্ছেন। আর আপনার দেখাদেখি আপনার রাজধানীর প্রকাশকরা অনুমতি ছাড়াই আমার বইগুলি চটপট ছেপে বের করে ফেলছে। এটা কোন ধরনের ভদ্রতা! আমি তো ভেবেছিলাম আপনার মন্ত্রীত্বে এরকম হীন কাজ হতেই পারে না! আপনার দিল্লি, লক্ষ্নৌ, জলন্ধরের ক’জন প্রকাশক আমার বই বেআইনী প্রকাশ করে—তা আপনি এক মুহূর্তে জেনে নিতে পারেন।
অশ্লীলতার অভিযোগে আমার ওপর বেশ কয়েকটা মকদ্দমা চলছে। অথচ এটা কত বড়ো বাড়াবাড়ি যে, দিল্লিতে, আপনার নাক বরাবর নীচেই এক প্রকাশক ‘মান্টোর অশ্লীল গল্প’ নাম দিয়ে আমার একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করে চুটিয়ে ব্যবসা করছে।
আমি ‘গনজে ফেরেশতে’ নামে একটা বই লিখলাম। সেই বইটিই আপনার ভারতের এক প্রকাশক ‘পর্দে কি পিছে’ নাম দিয়ে ছাপিয়ে দিলো—এখন বলুন, আমি কী করতে পারি?
আমি এই নতুন বইটি লিখলাম। এই পত্রই তার ভূমিকা যেটি আপনার কাছে লিখছি। এই বইটাও যদি আপনাদের ওখানে কেউ বেআইনীভাবে প্রকাশ করে বসে, তাহলে খোদার কসম, আমি যেকোনো দিন দিল্লী এসে আপনার কলার চেপে ধরবো, আর ছাড়বো না আপনাকে—এমনভাবে আপনার ওপর চেপে বসবো যে, আজীবন আপনার মনে থাকবে, প্রতিদিন ভোরে উঠে বলবো, নিমক-চা খাওয়ান। সাথে একটা তাফতানাও। শালগমের শবদেগ তো প্রতি সপ্তাহে থাকবেই।
এই বই প্রকাশিত হলে আপনার নামে এক কপি পাঠিয়ে দেবো। আশা করি, আপনি প্রাপ্তি স্বীকার করে আমার লেখা সম্পর্কে আপনার মতামত ব্যক্ত করবেন।
আমার এই চিঠি থেকে আপনি হয়ত পোড়া মাংসের গন্ধ পাবেন। আপনি জানেন বোধহয়, আমাদের দেশে, কাশ্মীরে একজন কবি ছিলেন, নাম গনি। ‘গনি কাশ্মিরী’ নামেই তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ইরান থেকে একজন কবি এলেন তাঁর কাছে। তাঁর ঘরের দরজা খোলা ছিলো, কারণ তিনি তখন ঘরে ছিলেন না। প্রায়শঃ তিনি লোকজনদের বলতেন, আমার ঘরে আছে কি যে, আমি দরজা বন্ধ রাখবো! অবশ্য আমি ঘরে থাকলে দরজা বন্ধ করে দেই, কারণ আমিই তো তার জন্য একমাত্র সম্পদ।
ইরানি কবি তাঁর জন-বিরান ঘরে নিজের নোটবুকটা ফেলে যান। তার ভিতরে একটি অসম্পূর্ণ কবিতা লেখা ছিলো। কবিতার দ্বিতীয় পংক্তি লেখা আছে, কিন্তু প্রথম পংক্তি তিনি লিখতে পারেননি। দ্বিতীয় পংক্তিতে লেখা
…তোমার পোশাক থেকে পোড়া মাংসের গন্ধ আসছে।
ইরানি কবি যখন ফিরে এলেন তখন নিজের নোটবুকে দেখলেন প্রথম পংক্তিও লেখা হয়ে গেছে:
…এই পোড়া দেহ-মনও কারো আমানত।
পণ্ডিতজি, আমিও একজন ঝলসানো হৃদয়ের মানুষ। আমি আপনার কলারে হাত দিয়েছি এজন্য যে, এই বই আপনাকেই উৎসর্গ করছি।
২৭/০৮/১৯৫৪ —সাদত হাসান মান্টো