জন্মলজ্জা
এ বিধি লাগে না ভালো : জন্মলজ্জা ফেলে দিতে
কাঁদিবার কথা
এ বড়ো রহস্যকথা, সান্দ্রকথা, আমি তার বুঝি না তো সার
আমার সঙ্গীরা বলো
কাহার গলায় ধরে বলি আজ জননী জননী
এত যে ঘুরেছি ভূমি তবু আমি জীবন চিনি না
অথচ সে যুবক নই
দিবসে দাঁড়ালে যে সূর্যকণা খেয়ে নিত রাতের দাঁতেরা
আমার নিয়তি ওহো
বারবার ভুলে যাই জন্মদাত্রী আমারই মায়েরই মুখ, স্তন
অথচ গ্রহণপ্রশ্নে
যমজ বোনেরে ক্রমে ঠেলিয়াছি দূরে
আজ বিস্মরণের দিন, আজ এংকা পথে ঘুরিতেছি
আনত দু-হাত নিয়ে
জন্মলজ্জা ফেলে দিতে শূন্যে শূন্যে খুঁজিতেছি গলা
বিষ
এত বিষ দেহকাণ্ডে, দেহে
আজ আমি সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
সকলেই একথা বোঝে আমি কভু ডুবি নাই জহরের জলে
দেহকাণ্ডে তবু এত বিষ…ভাবি তাই
প্রাণের মধ্যে কোন সর্প ঢুকে গেছে ঘুমে?
এ সন্দেহমুক্ত হতে বংশকাহিনি যারা পাঠ করে গেল
তারা দেখে, পিতা বা প্রপিতামহ আলস্য করেনি কেউ
মনসাপূজায়
তবে হই অভিশপ্ত কাহার সন্তান?
দেহকাণ্ডে যত বিষ, তার মর্মে নীল হয়ে যাবে বলে
সংলগ্নজনেরে বড়ো দূরে যেতে বলি
অথচ দূরবর্তী বন্ধুও বোঝে
গোপন ইচ্ছের জোরে সংলগ্নজনের মনে
কত বেশি মগ্ন হতে চাই
ময়ূর
জঙ্গলে ময়ূর পুড়ছে, তুমি তা জানো না
তুমি ক্লান্ত আর বহু দূরাগতা,
চুপে চুপে এসে মিশে গেছ
শান্ত আতরদানে, মর্জিমহলে
আমি এই ওষ্ঠলাঞ্ছিত সুরার ফ্যাসাদে
লিপ্ত হতে হতে কথার প্রকারে ডুবে যাই,
তোমাকে লক্ষ্য করত যদি অনুগায়িকারা
যদিও জেনেছি আমি, এ-ও এক নিদ্রাবিশেষ—
অন্য অছিলা নিয়ে, হাটে হাটে,
কারও কারও ছুড়ে-দেওয়া ফাঁদে
জঙ্গলে পালক পুড়ছে
আমি অতি নিরিবিলি তোমার জঙ্গলে ছেড়ে এসেছি ময়ূর—
কেউ তা জানে না।
ভিখিরিও রাজস্থানে যায়
ভিখিরিও রাজস্থানে যায়!
আমি সেই ভিখিরির মাথা ছুঁয়ে বুঝি
আমার ভূতের হাত ধীরে পৌঁছে গেছে
শীতকুয়াশায় ঘন-হয়ে-যাওয়া নির্জন রাতের কোনো মাঠে,
তার লাল-শাদা মাটি মৃতের কোর্তার মতো লেগে
রয়েছে শরীরে
এবার মনের সেই ভিখিরিকে ছুঁয়ে
গেরুয়া ছাড়াই দেখি নিষ্কাম ভিক্ষুর মতো লেগেছে নিজেকে
সামনে রয়েছে পড়ে দূরমহিলার শিরার মতন এক
দীর্ঘমুর্খ করুণ প্রহর
ভিখিরি তো রাজস্থানে যায়!
ভূতের শরীর নিয়ে শেষমেশ আমিও কি যাব?
মেঘ অথবা নিষিদ্ধ অংশ
ফিরে না আসতাম যদি এই পোড়োগৃহে, তবে
দূরে থেকে যেত প্রিয়মানুষের মুখ, তার গূঢ় প্রবাহ ছুঁয়ে
পরে ভালো লাগে প্রত্নমুখগুলি
অবশ্য আমি মানি জন্মগত রীতি :
আমার কোনও-কিছু ছুঁয়ে আছে মৃদুবিস্মরিত
মানুষের রক্ত কিংবা হাড়
তবু গুরুত্ব দেব প্রিয় মানুষের মুখ…
বিবিক্ত ভ্রমণ শেষে আগে আমি পেয়ে গেছি দুঃখ আর জরা
এইবার শুধু জাগে খননপিপাসা
কে কোন প্রিয় বোধ নিয়ে কেবলই দূরের কথা বলে
এই মর্মে বোধি খুঁড়ে দেখি
থরে থরে গৌণ কিছু মেঘ পড়ে আছে
গৌর
স্থির করে আনো সেই দূরলক্ষ্য গৌরপ্রতিমাটি;
আমার সকল বুঝি আজ ভেসে যায়—
কৃষ্ণসূর্যের পথে কিছু অশনাক্ত লণ্ঠনের বিন্দু বিন্দু
কান্নার স্মৃতি মঙ্গোচিত বৃষ্টিতে ভেজে
আমার এমন লব্ধি আজ কোন অর্থে যে ব্যথিত—
ষড় গোস্বামীরা সেসব জানে না (কিছু জানে জয়দেব রাজ)
তালিতাপ্পিতে-ন্যস্ত করুণ আঙুলগুলি দেখি
আর ভাবি আমার স্ত্রী-আঙুলটি যেন
স্পর্শ করছে রাজকাঁকড়ার দেহ
বিরহিনী
মনে হয় ঘিরিয়াছে জলদস্যু, জলের বণিক।
লাফে-লাফে, মেঘবর্ণ শরীরের বেড়ে-ওঠা দামে
চারপাশে নিলাজ গুঞ্জন—
এ-ও এক ঘূর্ণিনাচ, পয়মন্ত নদীটির তীরে,
কাঁচা পায়রার মাংস খেয়ে
আর পান করে করে তীরে মজলিসে ঢুলুঢুলু
এই চিত্র প্রাণবন্ত আরশিতে দেখি
গজলের রঙ নিয়ে গাঢ়
বিদ্রুপের ছাতা নিয়ে তবু
তীরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছে ক্লান্ত
বিরহিনী
বিরহ
তারে কি বিরহ বলে? বিপরীতে কোন হাওয়া
জানি না তো মিলনের কোন কথা বলে
তবে যে আমের গাছে কামরাঙা পাতা জেগে আছে?
তাহার শরীর কেন পায়রার মতো কেঁপে ওঠে?
আমার সামান্য দেহ, তবু তার সব দিক ছুঁয়ে
দূর থেকে ডেকে যায় লিলাজ ডাহুক
টাঙ্গুয়া হাওরে যেন কবে কোন ফাঁদে পড়ে
হারিয়েছি আমার আঙুল?
আমার কোমরে দেওলা-বাঁচানো এক তাবিজ রয়েছে যদিও
হাওয়ায় হাওয়ায় এসে আরো বহু হাওয়া ছুঁয়ে যায়
জানি না তো এই হাওয়া
বিরহেরই অন্য নাম কি না, মিলনের কথা বলে কি না
জল ও শ্রীমতী
সমুদ্ররাজ্যের কথা ভেবে
কাতর শ্রীমতী আজ বাঘসিংহের থাবার মুখে
হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের নীলবাড়ি যায়
কোনো অনসূয়া পাখিপরিবার পেলে কণ্ঠে তার
উজ্জ্বলন্ত গান তুলে নেবে—
যেখানে নাচে-নৃত্যে ভরা যে প্রহর
মাথা ও শরীরের চারপাশের হাওয়ার স্তব্ধতা ভেঙে অনাকার
একধ্যানী কাকও যার কিছুই জানে না
এই ঘটনার ফলে আমি দেখিয়েছি
রূপকথারঙিন রাজার মুকুট,
আর প্রজাপতিরাঙা ভাবীসময়ের
দ্রুতি ও বিস্তারে-কাঁপা হৃদয় তুলে
অনাপদ দূরত্বে থেকে শুনিয়েছি জলবৃন্দগান—
তাতে একটু-আধটু কেঁপেছে শ্রীমতী
দুই জন
হাওরের মুখোমুখি হয়ে মনে হলো,
এই মুখ সহনীয় নয়
দুঃখিত পাঁপড়ির রঙে মিলেমিশে
খুলে যাচ্ছে সমস্ত দুয়ার;
মনে হলো, এই চোখও বিষম দুঃসহ,
কতোয়ালের মতো দ-গভীর, কালো আর লাল, হয়ত-বা ধূসরহলুদ,
যার দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে
উড়াল জালের মতো ঘিরে ধরে সমগ্র হৃদয়
যার চোখের আলোয় কখনও-কখনও
জিনকন্যার অচেনা বিস্ফার
পিঠ ফিরে বসে দুই জন;
দুই হাত দুই মুখ আর এক-পৃথিবীকে নিয়ে
নির্জন হাওরের পারে
মুখোমুখি : বিষম দুর্বহ
ফেরা
ফিরছি বাঁওর থেকে
একা একা
বৃষ্টি নামছে আর
পথে পথে শুনি
সাপেদের শ্বাস
বুঝি যে ঘরের মেয়ে
বসে বসে
কাঁদছে নিরলে
এমন রাতেও বুঝি
ভয় পায় কেউ?
মেঘে ও হাওয়ায় উড়ে
কেঁদে ওঠে কোনো নীলপরি?
ধুলো ভিজে যায় আর
কালি ও কলঙ্ক লেপে
বিশ্রী হয়
কারও কারও মুখ
আমিও অন্ধের মতো
সেই সব ছায়াভেজা
মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
কখনো-বা মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে
জ্যোৎস্নার রূপে পুড়ে
কিছুটা নীলাভ আর
কিছু জলশাদা
বুঝি তো ঘরের মেয়ে
একা একা, বসে বসে
কাঁদছে নিরলে…
হিজল গাছ
দেখো ও হিজল গাছ
কেমন অন্যমনা লাগছে নদীকে।
অথচ ভর বর্ষাকাল
দশদিকে আষাঢ়শ্রাবণ।
ধৈবতে দু-পাড় ছুঁয়ে রোজ রোজ
গস্তি নৌকা, গয়না নৌকা যায়
ভাঙা সেতুর ছায়া পড়েছে ওই
খোয়াই নদীর পিঁজরায়।
ধীরে পানাঝোঁপ, ধীরে ধর্মহাঁস
বেঁকে-চুরে, হেলে-দুলে যায়
যেন কালগোধূলিরঙে রক্ত-ভেজা জল
সায়রে পৌঁছার আগে আর কোনো
পরিবর্ত মানবে না নদী
অথচ কাল-পরশু নৌকাবাইচ।
হেইয়া হো শাহনুরের সারি।
করতালের বাড়ি খেয়ে খলবল করবে না জল?
স্নানের জলের ভারে ভাঙবে না পাড়?
সেদিনও এমনভাবে অন্যমনা লাগবে নদীকে?
মধুরাকে?
লুলা গম্ভীরাকে?
বিল
তোমাকে নিরলে পেয়ে মনে হয়
আমার সমস্ত দিকে একলগি জল
তখন তীরের দিকে পাখি উড়ে যায়
ভীষণ অনাত্মীয় মনে হয় অন্ধকার বিল
তখন ইতর প্রাণী অন্যভাবে তুলছে গুঞ্জন
যেন-বা শিকারি আমি
প্রেমমত্ত পাখি ও পাখিনী দেখে
বিদ্ধ করে একা একা করেছি উল্লাস
অথবা সেই দস্যি আমি
অভোলা গেরামে গিয়ে করি ডাকাইতি
আমার হৃদয় ঘিরে তাহাদের এমন নিন্দন
তবু তো বেঁচেছি সখি, এই দেহ জারুলের গাছ
আপন লগির গুণে চারদিকে একলগি জল মনে করে
অশেষ বিলের দিকে উড়ে চলে যায়
স্ফটিকচূড়ার নিচে
আজ একই পাত্রে যখন আমাদের
দু-জনেরই পান করবার কথা ইঁদারার সবটুকু জল
তখনও বুঝতে পারছি না এই গহীন রাজ্যে
জলই কি সত্য
না কি এই জলপানই শেষ সত্য হয়ে আছে
এখনো জানি না আমি, এখানে কেমন আছে জল,
পাত্র কোন রঙ ধরে আছে
কোন রূপ ধরে আছে
আর কেমন আছে সেই খাস জলের প্রেমিক?
আজ একই পাত্রে যখন একই সঙ্গে
আমরা দু-জনেই পান করছি ইঁদারার সবটুকু জল
তখন আমার কালো ঠোঁটের পাশে
তাম্বুলরাঙা তোমার লাল ঠোঁট দেখে
গুঞ্জনে গুঞ্জনে জানি ভরে উঠবে জেনানামহল
পিতা
ঘুমেও শিহরিত ছেলে
মাটি ও ফেরেশতার সর্ববিধ আদর খেয়ে
নিকট-অতীতে শব্দ সঞ্চয়নে গেছে
গেছোভূত নিঃশব্দে দেখে
তার অন্যায্য পিতার চোখ
আর কান শুনে নেয়
অতলে বিস্তৃত এক সর্প-শিহরন
কখনও জগদমায়ায় এলে
দুইজনা এইরূপ ছন্দে মুখোমুখি…
বহুকাল পর,
আদিদর্শনের যোগছলে
দুই পথিকের ছাতা দুটি
মিথ্যে দুই ভাব নিয়ে ওড়ে
অঘ্রানী
অতনু ঘাসের ঘ্রাণ ফেলে রেখে
আমি আজ অঘ্রানের খোঁজে।
ওই মাঠ কতটা ভিজেছে দেখো
ধানের বৃষ্টিতে।
সোনার ক্ষেতের পাশে
কতটা পয়মন্ত হয় দেখি
অঘ্রানী, তোমার শরীর
শয়তান
মেহফিলে হাজির আজ দীর্ঘকণ্ঠ
স্মার্ত লুসিফার!
গজলের মজমা ছুঁয়ে আছে তথাপি অসুর আর
কঠিন ভূমির পত্রে বিরাজিত,
তবু মনে হয় পীন হাবশি রমণীকে
মনে ধরে করে তানালাপ
নাগামরিচের লাল প্রকৃতিকে ছুঁয়ে এসেছে তার আনোখা হৃদয়
তাকে দেখেও তো কারো কারো
হৃদয়ের ধুলোপথ ভেজা—
গোল জলাশয়ে যেতে বেফানা শরীর;
উচ্চণ্ড গোধূলিকে দেখে যেরকম কারো কারো
নিদ্রাহীন কাটে সারারাত—
সেই ছাঁদে ডুবে যেতে ফড়িঙের রূপ ধরে আছে
গ্রীষ্ম
নেমেছে শীতল ধারা
নালিতার পাঠ শেষ হলে,
তবু মুখ ভার করে আছে রাঙা মিনজিরি ফুল,
যেন সাপের ফণার ঢঙে বিষালো বৃষ্টি,
আর, পূর্বমেঘের রাগে
চিরপতনের নাম ধরে গর্জে উঠবে পুরাণশিঙাটি
মনে ক্ষারছায়া মেখে আজও
চুপ মেরে বসে আছে বাগানের কৃষ্ণচূড়া গাছ,
জলরাঙা রঙ্গন-গোলাপ;
ভেজা ভেজা ছিল ঘাস, ভেজা ভেজা ছিল কদম-জামির,
তবু মন আহাকারে হাহাজারে ভারী,
হুয়ারা গাছটি ধরে জারিদীর্ঘ বারোমাসি
গেয়ে ওঠে বাগানের প্রহরী ও মালী
যেন সারাটি বছরজুড়ে
খরাদাহ-স্মৃতি নিয়ে রয়ে যাবে এই গ্রীষ্মকাল!
স্বীকারোক্তি
নগর-টোলের ছাত্র, আজ বসে আছি লু-নিবিড়
অন্ধকারে একা—যেন চার প্রহরের এই রাত
উদযাপন করতে যাচ্ছি অজপাড়াগাঁয়, যেন
জোনাকবাতির নিচে পুথি পড়া যাবে সারারাত।
আমি তো এসেছি ফিরে, তবু, নাগরিক পাঁজি হেন
সিরিফ নাদান শিশু; ভয় লাগে হরফের ভিড়…
বলো কে বলবে পই, ছিলক, ডিঠান? তবু তাতে
নাগরিক চতুরালি থাকে; জারিতে ভরে না প্রাণ—
দষ্ট গ্রন্থ ঘেঁটে খুঁটে পেয়ে গেছি শত প্যাঁচে-ভরা
কালো ইষ্টকের বই : সারি নয়, ছাদ-পেটা গান
শীত বর্ষা ভেবে পাই ঘূর্ণিবাত্যা, বালিঝড়, খরা
ণত্ব, ষত্ব সব কিছু ভাসে শুনি ঘোর বৃষ্টিপাতে…
জেনেছি দেহাতি ছাত্রী, তবু তুমি বিদুষী, শ্রবণা
তেরচা রেফের নিচে নাগরের দ্বিত্ব মানবে না
হাবা
কোথাও যাব না বলে স্থির বসে আছি
একা একা, গঞ্জনার তীরে
বসে বসে পেছনের প্রতিও তাকাই
দূর থেকে ঘাড় নাড়ে বেগানা হিজল
তবু মনে হয়, তার পাশে, আড়ঠারে
সর্প পাখি কীটেরাও মন্দভাবে ডাকে
যেন আর যাবই না আমি
বেতের জঙ্গলখানি সাফ করে দিয়ে
পেছনের ঘুরপথও দশমুখে ডাকে
খরাজীর্ণ প্রত্মমেলা সামনে নিয়ে
যাব না ফিরব তার কিছুই জানি না
বসে আছি নিম্নস্রোত গঞ্জনার তীরে
মেঘ, মেঘ নয়
তোমার মাথার নিচু পথে তাকিয়েছি
অতি নিরিবিলি উঠে গেল কার্তিকের শাদা ছাতা;
জানো না জলের বিচ্ছেদ-ব্যথা ফোটে কি না,
নতুন ধানের ছায়া চোখে নিয়ে আসা নারীমুখে
ছড়িয়ে দিয়েছে কি না নাদান তুলির কোনও কবি
পায়ে পড়ে আছে শাদা ছায়া
কিছুই-না-বোঝা কোনো মাথার ওপর
ছাতাটিকে মনে হয় ভৌত উদ্দীপনা—ভ্রমজাল—
আমি তার নিচু পথে গিয়ে কঁকিয়েছি
চোখে-ব্যথা-পাওয়া কোনো মুরগির মতো মনে হয়েছে নিজেকে
প্রবাস
একলা প্রবাসে আছে, ঘরে কবে ফিরবে ধীবর?
এপারে করচ গাছ, অড়হর, সকলে একাকী;
বাকিরাও চুপচাপ, পথপাশে জননী ও জায়া
ফিরবে হিঙ্গুল রাতে, যদি পায় গোধূলির বর?
শিকারি ঘনিষ্ঠ হলে টের পায় তিত্না ও পুটি;
জাল ফেলা হয়ে গেলে, নিরুপায় মাছেদের ভিড়;
তবু তো সকলে সেই স্বর-অন্ধ, কিছুই শোনে না :
কোথায় মাৎস্যন্যায়, কোন স্থানে ধীবরের ত্রুটি।
জলদাসী খরাগ্রস্ত, ঘূর্ণিবাত্যা, হৃদয় বেহাল
নাগর-গঞ্জিত দেখে সধবাও হেলে-দুলে হাসে;
গুঞ্জরন, বিলপারে, কথা ওঠে ধীবরপাড়ায় :
ধীবর ফিরলে ঘরে, ফের সে কি হাতে নেবে জাল?
দর্শক
একটি আগুন তার দীন আকুলতা নিয়ে জানে
বিষম করুণ জলে ডুবে মরেছে যেজন, সেও
খুব নিচু বীজ-ভেদ-করে-ওঠা নীল কেয়াগাছ
অযথা প্রেরিত তাই তার ও ইমেল,
মান্দার বাগানে ফের ফিরে আসে কৃষ্ণভ্রমরের
লাল বর্ণমালা; এর ক্ষুদ্র দর্শক আমি দেখি—
তার প্রৌঢ় ব্যথা এক অচিন কুষ্ঠিনীর কাছে
চায় নিরাময়; চায়, অতি খলবল না-হলেও দেহ এসে
নিঃশব্দে বিদ্ধ করে যাক।
গৃহী মুসাফির
ঘরেই রয়েছি তবু, পথিকপথিক গন্ধ গেল না আমার : তিরি ও পুত্রের কাছে আমি
তাই আজও মুসাফির-যে-জন অছিলা পেলে যেতে পারে দূর বৈদেশে
আমার কি আগেও ছিল বাউলের বেশ? দেখার হাওরে গিয়ে যে-নারীর হৃদয়
পেয়েছি, সেও তবে আড়চোখে আমাকে দেখেছে!
রাতে ও বিরেতে হঠাৎ ঘরছাড়া হয়েছি যে ডাহুকীর ডাকে, সেই দোষে আজও
আমি পথিকপথিক—তিরি ও পুত্রের কাছে দু-দিনের গৃহী মুসাফির
নাইওর
আমাকে নাইওর নিও আগনের আগে
এখন ধানের গন্ধে মনে লাগে ভয়, এখন ধানের শব্দ, বুকে কেউ চিড়া-বারা
কোটে; ধানের উয়ানি দেখে চোখে লাগে ধুলোবালিকাচ
আমাকে নাইওর নিও কালবোশেখেরও আগে। এখন ভীষণ লাগে ঝড়-ঝঞ্ঝা,
মারি ও মড়ক। আউলা বাতাসে আগে উড়েছি যে বিজুলিরও আগে, মৃদুমন্দ
বাওয়ে আজ কেঁপে ওঠে বুকের পাঁজর
আমাকে নাইওর নিও নিদানের কালে : চৈতে ও কার্তিকে; আগনের-বোশেখেরও
আগে

মোস্তাক আহমাদ দীনের জন্ম ১৯৭৪ সালে, সুনামগঞ্জ জেলায়।
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই দুই বাংলার সাহিত্যকাগজগুলোতে কবিতা লিখছেন মোস্তাক আহমাদ দীন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর থেকেই পাঠক-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ভিখিরিও রাজস্থানে যায়-এর জন্য পান ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১২’ এবং কবিতায় সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘চিহ্ন পুরস্কার ২০১৬’ ও ‘লোক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬’।
কবিতার পাশাপাশি সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতিবিষয়ে বিভিন্ন জার্নাল ও সাহিত্যপত্রিকায় গদ্য লিখছেন মোস্তাক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মোস্তাক আহমাদ দীন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. তপোধীর ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব শীর্ষক অভিসন্দর্ভ লিখে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ২০০৯ সালে, সেই অভিসন্দর্ভ ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রাচীন ইতিহাসের প্রতি আগ্রহবশত অনুবাদ করেছেন [প্রথমে ফারসি এবং পরে] উর্দু ভাষায় লিখিত সিলেটের ইতিহাসবিষয়ক প্রাচীনতম গ্রন্থ তারিখে জালালি। তিনি সম্পাদনায়ও আগ্রহী। প্রাচীনতম গ্রন্থ ফকির বিলাশসহ সম্পাদনা করেছেন সিলেট অঞ্চলের লোককবিদের গান। ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, সিলেট সম্পাদনা করেছেন যৌথভাবে।
মোস্তাক আহমাদ দীন পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষক, বর্তমানে লিডিং ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বাংলা বিভাগে শিক্ষক। নিচে তাঁর পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থতালিকা উপস্থাপিত হলো :
কবিতাগ্রন্থ
কথা ও হাড়ের বেদনা, প্রকাশক, পাঠকৃতি, সিলেট, ২০০১।
জল ও ত্রিকালদর্শী, প্রকাশক অর্কিড, সিলেট, ২০০৪।
জল ও শ্রীমতী, প্রকাশক পাঠসূত্র, ঢাকা, ২০০৮।
ভিখিরিও রাজস্থানে যায়, প্রকাশক, বইপত্র, সিলেট, ২০১২।
বানপ্রস্থের আগে, প্রকাশক, চৈতন্য, সিলেট, ২০১৪।
কবিতাসংগ্রহ, প্রকাশক, চৈতন্য, সিলেট, ২০২০।
স্ফটিকচূড়ার নিচে, প্রকাশক, বাতিঘর, ঢাকা, ২০২০।
প্রবন্ধগ্রন্থ
কবিতাযাপন, প্রকাশক, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, (২০১১); চৈতন্য সংস্করণ, সিলেট ২০১৮।
আটকুঠুরি, প্রকাশক, শস্যপর্ব, সিলেট, ২০১২; চৈতন্য সংস্করণ, সিলেট ২০১৫।
মাটির রসে ভেজা গান, চৈতন্য, সিলেট, ২০১৭।
কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব,বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭।
মননচিন্তা বিবেচনা, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৮।
অনুবাদ
তারিখে জালালি [১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সিলেটের ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ, মূল মবশ্বির আলি চৌধুরী,] প্রকাশক, উৎস, ঢাকা, ২০০৩।
সম্পাদিত গ্রন্থ
পরার জমিন, মকদ্দস আলম উদাসী, প্রকাশক, লোকচিহ্ন, সিলেট, ১৯৯৯।
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান, প্রকাশক, লোকচিহ্ন, সিলেট, ১৯৯৯।
অকূল নদীর ঢেউ, শাহ সুন্দর আলী, প্রকাশক, শঙ্খ, সিলেট, ২০০৪।
মাসিং নদীর তীরে, ফকির সমছুল, প্রকাশক, বিকাশ, সিলেট, ২০০৫।
নূরে মারিফত, শাহ ছাবাল আলী, প্রকাশক, শাহ তেরাব আলী, কামারগাঁও, সুনামগঞ্জ, ২০০৫।
ছহি ফকির বিলাশ অর্থাৎ মারফতি ভেদ, মুন্সী মোহাম্মদ আশ্রফউদ্দিন, প্রকাশক শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১০; চৈতন্য সংস্করণ ২০১৯।
কামালগীতি, কামাল উদ্দিন, প্রকাশক, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১০।
আশিকের রত্ন সমগ্র, ফকির সমছুল, প্রকাশক, শঙ্খ, সিলেট, ২০১২।
এ, জেড, আব্দুল্লাহ রচনাসমগ, কেমুসাস, সিলেট, ২০১৭।
নির্বাচিত গান, মকদ্দস আলম উদাসী, জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ, ২০১৭।
পূর্বাপর, রবীন্দ্রমূল্যায়নগ্রন্থ, শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ, সিলেট, ২০১৯।
শত জলঝর্নার ধ্বনি, শামসুল করিম কয়েস মূল্যায়নগ্রন্থ, ঘাস, সিলেট, ২০২০।
নির্বাচিত কবিতা, দিলওয়ার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০২০।
সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা
বিকাশ [১৯৯১-১৯৯৭]।
মুনাজেরা [২০০৮ থেকে চলমান]।