নির্বাচিত ২৫ কবিতা | মাসুদার রহমান

 

বাবা

 

 

জঙ্গলের পাশে বাড়ি। বাবা হারিয়ে গেছেন

জঙ্গলে

ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে মায়ের মুখভারি সংসার

 

স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি

ড্রয়িং খাতায় পেন্সিলে ছবি আঁকে জঙ্গলের

 

এখনও স্কুলে না যাওয়া মেয়েটি

ইরেজার ঘষে ঘষে জঙ্গল ফিকে করে— 

 

দেখে, সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন বাবা

 

 

একটি যুবতী লাউগাছ

 

মাচা বেঁধে দিচ্ছি লাউগাছটির জন্যে

 

বউ পাশে দাঁড়িয়ে লাউগাছটির এলোচুল খোঁপা করে দেয়

 

ছোট চারাগাছটিকে বউ খুব যত্ন করে যুবতী করেছে

বউয়ের কথায় আমি ওর জন্য মাচা বেঁধে দিই

 

মাচা তো কেবল মাচা নয়, পালঙ্কও

 

এই পালঙ্কে যুবতী লাউগাছটির সঙ্গে বউ আমাকে ফুলশয্যা দেবে

 

 

 

সকালের সংবাদ

 

লাফিয়ে নামছে অজস্র আলোর বল এবং ছড়িয়ে যাচ্ছে

নানা দিকে

যার দু’একটি এসে ঢুকলো আমার চোখের ভিতরে  

অসুখে পেরনো শৈশব একটি সামান্য ফুটবলও যেভাবে পাইনি

 

ঘাস থেকে মুখ তুলে গরুটি হাম্বা শব্দে ডেকে উঠছে

ওর ঝকঝকে দাঁত মাজা টুথপেস্ট দিয়ে

 

উঠোনের ডাবগাছ, এক এরোপ্লেন দম্পতি কবে যেন

বাসা বেঁধেছিলো

দেখি সে বাসায় দুটো ডিম ফুটে ছানা বেড়িয়েছে;

রোঁয়া ওঠা কচি ডানা

ভোঁ ভোঁ শব্দে ভরে আছে সারাটি সকাল     

 

  

লিভটুগেদার

 

সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক এক ছাদের নিচে এলো

 

আমি আর সিলভিয়া মিলে

মাছ-আড়তের পাশে বাড়িভাড়া নিয়ে আছি

 

শস্তায় মাছ কিনি; সহজ আমিষ খাই

আশপাশে অনেক বরফকল। আমরা প্রস্তুত আছি

 

আমাদের সম্পর্কের

কখনও পচন এলে; শস্তা বরফ কিনে পচন ঠেকাব

 

 

 

না-লেখা কবিতা

 

দেবলীনা সরেনকে মনে আছে

 

ভরাট গড়ন। মুখ ভর্তি নিপুণ বিন্যস্ত

সাদা দাঁত

হাসলেই কালো ত্বকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত

দিস্তে দিস্তে সাদাকাগজ 

 

তবু কেন কবিতা লিখিনি!   

 

 

কুকুর

 

সমুদ্রপাড়ের বালিতে একজোড়া রাবারের জুতো

সামনে নিয়ে বসে আছে একটি কুকুর

 

জুতোজোড়া কার? কুকুরটি জানে… কাউকে বলে না

 

দূর সমুদ্রের দিকে সে কেবল তাকিয়ে রয়েছে

 

কে তার মুনিব?

লোকটি কী স্নানে নেমে ডুবে গেছে সাগরের টানে!

কিংবা দূর বন্দর থেকে সমুদ্র জাহাজে করে আসছেন সিন্দাবাদ

 

কুকুরটি সব জানে, কাউকে বলে না 

 

 

 

পারাপার

 

ছোট নদী। কাগজে ব্রিজ

এঁকে

ঝুলিয়ে দিয়েছি

 

নদী পার হয়ে এসো

 

 

 

টি টাইম

 

চা-এ পাউরুটি চুবিয়ে

চা খেতে বসেছি

 

আমার চা খেয়ে নিচ্ছে পাউরুটি

 

 

 

আপেল চাষির গল্প

 

আপেল চাষির গল্পের অনেক অংশ জুড়ে

শীতকাল

বছরের কয়েকটি দিনমাত্র বরফের ঘটনা

আছে ওর গাছ হতে আপেল নামাবার

একটি সরলযন্ত্র; আপেল বহনের জন্য ঘোড়া দুটি

 

দিন শেষ হয়ে আসে

 

সন্ধ্যার কাছে ছোট আপেল বাগান রেখে

ঘরে যায় চাষি

 

ঘর এক প্রকাণ্ড আয়না

আয়নাটি সারারাত আপেল হয়ে উঠবার গল্প বলে

 

 

 

ডানা

 

দুপুরের বারান্দা হতে নেমে দেখি মেঘের ভেতর রেডিওস্টেশন; দুপুরটি গান হয়ে বাজে। পাড়ার গানের দলে গান হয়ে আমিও ছিলাম। ওরা গেছে বায়নার গান নিয়ে দূরের মেলায়

 

আমার কোথাও যাওয়া কেন যে হয় না !

 

অপেক্ষা দীঘিটির ঘাট হয়ে, কংক্রিট হয়ে পড়ে আছে

 

ঘাটে স্নানের পর রূপসী ফড়িং তার ডানা দুটো ফেলে গেছে, কুড়িয়ে নিয়ে আমি পকেটে রেখেছি

 

আমার ফড়িংজন্মে ডানা দুটো উড়বার কাজে লাগতে পারে

 

 

 

কাঁঠালগাছের নিচে ক্যাপ্টেন

 

কাঁঠালগাছের নিচে ক্যাপ্টেন; ক্যাপ্টেনের ঘোড়া

 

দূরে যুদ্ধের মাঠ

 

শিরস্ত্রাণ খুলে; কোমরের বেল্ট বাঁধা রিভলভার খুলে

ক্যাপ্টেন সামান্য বিশ্রাম নেবেন!

 

কাঁঠাল পাতারা খুব সতর্ক; ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘুম

ক্যাপ্টেন ঘুমিয়ে গেছেন

 

ওই দিকে যুদ্ধের মাঠ

 

ক্যাপ্টেন ঘুমিয়ে গেছেন

 

ক্যাপ্টেনের ঘুমের ভেতর

গড়িয়ে যাচ্ছে অজস্র আপেল ভরা হুইসেল

 

 

 

দাম্পত্য

 

ঘুমের মধ্যে কথা বলছে বউ

ঘুরেফিরে বলছে ওর ছেড়ে আসা প্রেমিকের নাম

 

বলুক না

 

সে না হয় ঘুমের মধ্যে

 

আমি তো কেবল ওর জেগে থাকাটুকু

নিয়ে সুখি হতে চেয়েছি

 

 

 

বনভোজন

 

জঙ্গলের বাইরে পিকনিকের গাড়ি। গাড়িটিতে কেউ নেই

 

জঙ্গলের ভিতরে এসে বোঝা গেল— 

জঙ্গলে ঢুকে পিকনিকের ছেলেময়েগুলো সারি সারি গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে

তাদের কলহাস্য এখন ঝরাপাতা; বাতাসে শব্দ করে

 

বড় এক গিরগিটির পিছে ছুটে যাওয়া ছোট ছোট দু’তিনটে গিরগিটি

ওরা বুঝি পিকনিকের গাড়িটির স্টাফ

 

২.

‘টেলকম পাউডারের গন্ধ’ ! চমকে উঠেছি

নির্জন বনের মধ্যে কোন নারী !

 

খুঁজি তাকে

 

দেখি, এক সবুজ ফড়িং

 

 

 

পোষা বরফের রাজ্য

 

বউদের বিচিত্র শখ; ওরা চায় ঘরের ভেতর

একুরিয়ামে

সমুদ্র পুষতে। কেউ পোষে টবে করে

একটি লঙ্কাগাছ

কেউ আবার কাঠের বাক্সে পোষে একজোড়া মুরগিও

 

বউদের শখ নিয়ে নানা মত আছে

 

বউরা ফ্রিজের মধ্যে যত্নে লালন করে

বরফ ও নির্জনতা ভরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ

 

সেখানেও শ্বেতভালুক! দেখেছেন কেউ?

 

 

 

ডাচ সৈনিকের বউ

 

একজন ডাচ সৈনিকের মৃত্যুদিনে আমাদের শহরে

লোডশেডিং বেড়ে যায়

 

প্রতিবার মোমবাতি জ্বালাতেই ভুলে যাওয়া দিনটিকে

মনে পড়ে

শরীরে আগুন নিয়ে মোমের কান্নাগুলো গলে যাওয়া দেখি

 

ধবধবে সাদামোম মৃত ডাচ সৈনিকের বিধবা স্ত্রী

 

 

 

হাঁস

 

অনেক বৃষ্টির পর উঠোনের হাঁসেরা; তারা কোথায় যে ভেসে গেল !

 

শ্রাবণ পুকুরমাঠ থৈ থৈ; ভরা সন্ধ্যের মুখে জল আর কাদা

 

মাথার উপরে ধরে বউয়ের এগিয়ে দেয়া

ছাতা ও হেরিকেন হাতে খুঁজতে চলেছি !

 

হাঁসের পিছনে হেঁটে কখনও কেটেছে কোন কবির জীবন ?

 

ভয়ে আছি ! কিভাবে লুকাবো যদি হারানো হাঁসেরা; ফের

ডেকে ওঠে বাঙলা কবিতায়

 

 

 

নৌকা

 

জমে যাওয়া সমুদ্রের নিচে কোথাও রয়েছে কাঠের নৌকাটি

 

উত্তর থেকে দক্ষিণে

এক জাদুপুস্তক পৌঁছে দিতে গিয়ে নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল

 

সে কথা জানে সাদা ভল্লুকেরা; ওরা বংশপরম্পরায় খুঁজেই চলেছে

বরফে লুকানো সেই জাদুর পৃথিবী

 

 

 

বটপাতার ছবি  

 

ছবি আঁকতে না পারার দুঃখগুলো কবিতায় জমে ওঠে

উড়ে চলা শুকনো বটপাতা

হাতে ধরে তাতে কিছু আঁকতে চেয়েছি

 

বয়ে যাওয়া ছোট নদী; স্নান সেরে কয়েকজন নগ্ন রমণী

গাছের আড়াল হতে হাত বাড়িয়ে বলছে

—  আমাদের পাতার পোশাকগুলো দাও

 

পাতার পোশাক পরা মেয়েগুলো সেই থেকে

আমার সাথে জঙ্গলে জঙ্গলে হেসে হেসে ঘুরছিল

কে জানতো এই সব পাহাড়ি জঙ্গলে জুমচাষিদের এখনই আগুন দেবার সময় হয়েছে

পুড়ে গেছে মেয়েদের পাতার পোশাক

 

মেয়েগুলো লজ্জায় গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আবারও

 

 

 

প্রিয় পাখি

প্রিয় পাখিদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে বলে

আমাদের গ্রামে উঁচু শিরিষের ডালে

একটি মোবাইল ফোন রেখে শহরে এসেছি

 

মাঝে মধ্যে আমার ফোনে কল আসে

কথা বলেন মা ও বাবা

 

 

 

জিওগ্রাফি

 

খুব বরফ পড়ছে; স্কটল্যান্ডের দূরতম আদিবাসি গ্রামে

ফায়ারপ্লেসের কাছে উলের পোশাকে মোড়া কয়েকজন এস্কিমো

 

এতো ভয়াবহ শীত; হাতমোজা জ্যাকেট জুতো ও টুপি ছাড়া

 বাইরে কেন?

আমার শিশুকে এই প্রশ্ন করেছি

 

মাথার উপরে তখনই সূর্য জ্বলছে

কালাহারি মরুপথে চালিয়ে দিচ্ছে বহু উটের কাফেলা

 

ওদিকে গরমে ঘেমে-নেয়ে অস্থির আমার গৃহিনী

পৃথিবীকে ডিপফ্রিজের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে 

বলছে; আমরা আবারও হিমযুগে প্রবেশ করেছি

 

 

 

ক্যাপ্টেনের অবসর

 

রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন জীবনে কোন তাড়া নেই

 

কেবল ঘুমোতে গেলে বুঝতে পারেন

অবলুশ কাঠের পালঙ্কটি ভেসে আছে

             মাদ্রিদ উপকূলের অনেকটা কাছে

 

আবারও জাহাজডুবি

             দুঃস্বপ্ন জাগিয়ে দিয়ে

মধ্যরাতের ঠোঁট ভিজে নেয় জলভরা গ্লাস

 

সারাদিন নোনা হাওয়া জল এসে খেলা করে

                     ম্যানগ্রোভ বনের গভীরে

পেট বিছিয়ে শুয়ে থাকে এক বুড়োবাঘ

 

 

 

আমব্রেলা কলোনি

 

কলোনির কেউ নই। হতে পারি এক ঝাপটা হাওয়া

গলির এপথ দিয়ে ঢুকে

ওপথে বেরিয়ে যেতে তোমাকে দেখেছি

আর থমকে গিয়েছি

 

হাওয়া থমকে গেলে কী ভ্যাপসা গরম; পরে বৃষ্টি নেমেছিল

 

বৃষ্টির দিনে সমস্ত পৃথিবী এক আমব্রেলা কলোনি

 

সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাতাটি তোমার

 

 

 

মিস্টার সোনাপাড়ার একদিন

 

সমস্ত দিন পড়ে রইলো, তুমি তার কী কী নিলে!

 

জানালার ফ্রেমে নিবিড় বাঁশবন, চীনাচিত্রকলা ফুটে আছে, ক্ষীণ শব্দে বেজে যাচ্ছে টোকিওসঙ্গীত

 

দড়িতে কাপড়, বাতাস দোলাচ্ছে তাকে

বাতাসের ক্লান্তি নেই দেখে, নিজেই ক্লান্ত হয়ে হয়ে চুপচাপ বসে-পরা

 

শুকনো পাতার উপরে গিরগিটি, কিছুটা সময় নিজেকেও গিরগিটি ভেবে নেওয়া

পাতার উপরে ছুটে যাওয়া; সরসরটুকুও

 

মাঠের ওপারে এক কপিকলে সূর্যকে পুব থেকে পশ্চিমে

টেনে তুলছে শ্রমিকের দল, আগামীকাল থেকে তাদের দলে আমিও কাজ করতে যাব

 

 

 

আমাদের জাতিসংঘ আমাদের বান কি মুন

 

আমি ও আমার বউ পালঙ্কের এক-ই পাশে

শোবার দাবি নিয়ে সমস্যা

সমাধান আসছে না বলে বউ প্রায় বলছিল

একবার জাতিসংঘে যাও না গো

একবার বান কি মুনের সঙ্গে দেখা করলেই পার

 

প্রাইমারি স্কুলে পড়াই; ৯.০০-৪.৩০

আমার সময় কই?

অতএব; মুঠোফোনে এসএমএস-ই ভরসা

 

আর কি সৌভাগ্য; আমাদের উঠোনে পরদিন

বান কি মুনের হেলিকপ্টার অবতরণ করে

 

আমি ও আমার বউ সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিই

 

আসুন আমাদের শোবার ঘরে

সরজমিনে একবার তদন্তে আসুন

 

 

 

মন খারাপ

 

আমি ও আমার মন খারাপ

ভাঙাব্রিজে বসে থাকি

 

সন্ধ্যা নেমে আসে। রাত হয়ে আসে।

 

মন খারাপ হলে আমি আকাশ দেখি না

পায়ের আঙুল দেখি

পা ঝুলিয়ে

অনেক ওপর থেকে জলের গভীরতল দেখি — 

 

ভাঙাব্রিজ পার হতে গিয়ে

চাঁদ পরে আছে জলের শরীরে

 

 

 

হাওয়াবাড়ি

 

হাওয়াদের বাড়ি। ওদের ড্রয়িংরুমের

               নীল দেয়ালের দিকে দেখতে দেখতে

হঠাৎ খেলতে ডাকে উধাও আকাশ

            আর ক্যালেন্ডারের পাখিগুলো উড়তে থাকে

আর লাফিয়ে নামে নীল কার্পেটের জলে

 

হাওয়াদের কিচেনে কোন ফুয়েলস্টোভ নেই

                              নেই ইলেকট্রিক ওভেন

সূর্যঠাকুর ওদের একজনই রাঁধুনি

              সমস্ত কিছুই তার সোলার সিস্টেম।

মেঘ আর বৃষ্টিপ্রবণ বড় স্নানঘর। বেডরুম বিছানাটি ঢেউতোলা

              আঁতুরঘরের মধ্যে বাচ্চা হাওয়ারা কাঁদছে

কোথাও গর্জনধারি হাওয়াদের স্বর

 

অ্যাকুরিয়ামের দুর্দান্ত ফিশিং জোনগুলোয়

         ফিশারম্যানদের মাছধরা দেখতে দেখতে

আমাদের ইস্টিমার ভেসে যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে

 

মাসুদার রহমান


জন্মতারিখ ও জন্মস্থানঃ ১সেপ্টেম্বর ১৯৭০। সোনাপাড়া, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট।

পেশাঃ শিক্ষকতা।

এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৩টি

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ

হাটের কবিতা। উত্তরবঙ্গ সিরিজ। সমুদ্র। মাসুদার রহমানের কবিতা।  ডাকবাংলো। ডায়ালের জাদু। হরপ্পা। ভ্যান গঘের চশমা। কামরাঙাগাছ রাজি হচ্ছে না। চাঁদের বই।  

শেয়ার