নির্বাচিত ২৫ কবিতা ।। পিয়াস মজিদ

প্রেতরূপকথা

এই নিকষ রাত্রিতে
পার হতে হবে
বহু তারার তোরণ।
ভ্রুণের ভেতরমহলে
রাত্রির রাগমালায়
সময়কে দেখা যায়
দ্বিধাবিভক্ত রায় দিতে
জীবন আর মৃত্যু তাই
দ্বন্দ্বসমুজ্জ্বল।
চ্যুতস্বপ্ন চোখে
নীরবের ভেতর বাক্সময় কলরোল
আমাকে শেখায়
ঘুম কী করে গান গায়
তার গীতগহন মন্ত্রমালা।
এই অসুন্দর আবর্ত
নিরবরত বৃষ্টিধারার সামনে এনে দাঁড় করায়।
দেখি আগ্নেয় অভিজ্ঞান সব
সারি সারি শায়িত সেখানে
আর ব্যাকরণ-অজ্ঞ আমার
ধূসর খাতায় উপচে পড়ে
বসন্ত-ছন্দের সবুজ রক্ত।
আমি তবে
কোথায়,
কার কাছে যাব !
নিরস্তিত্বের বোধে দানা বাঁধা
এই বেঁচে থাকা
তুমি একে কোন নামে তাৎপর্য পরাবে?
পূর্ণিমার আয়ু ফিকে হয়ে আসতে দেখে
অন্ধকার-উজ্জ্বল ব্যালাড ধরি।
গানের ভিতর দিয়ে দেখতে থাকি ভুবনখানি
ভুবনের হাটে কত পরিচিত খেয়া
তবু হৃদয়নৌকার খোঁজ নেই কোথাও
নিরুদ্দেশ নৌকাঠামোর ন্যায় জীবনের নীরবিন্দু
গচ্ছিত আছে
রূপকথার সে কোন সোনার কৌটোয়!
না, মরচে পড়া রূপকথায়
নয়তো নোঙর আমার;
যখন এই কুসীদবাস্তব
হুড়মুড় বিধ্বস্ত সহস্র শ্রম-প্রাণপুষ্পের উপর।
আজ আমরা তবে নিরন্তর রক্তরেখায়
আবিষ্কার করে চলেছি এক নতুন কলাবিদ্যা;
ঐ দ্যাখো যুগের যক্ষপুরিতে
ঝুলন্ত নূপুর-পরা মৃতা মেয়েদের
অভিশাপী অন্তিম নিশ্বাসের নদীতে
ভেসে চলেছে
অপরাধী গোটা বাংলাদেশ।

 

স্বপ্নরেখা

ঘুমন্ত হাড়ের ভেতর বেজে ওঠো
হারমোনিয়াম ;
আঁকাবাঁকা সুরের ঢলে তোমাকে দেখেছি
আঁধার-নিকষেও ছায়াশীল।
পাশেই শত শত মৃত্যুভ্রূণ
পদতলে যে আর্তমাধুরী বিছিয়ে গেল
তার আন্তঃঅভিঘাতে
আজ ঐ সার্বভৌম কৃষ্ণকাননে দেখি
গোলাপের রক্তিম ন্যারেশন।
ক্রমে সমুদ্রও শুকিয়ে আসে ;
কেবল আমার নির্জন কান্নার কল্লে¬াল
খরাপ্লুত মরশুমে
তোমাকে করে তোলে
বিপুল তরঙ্গরঞ্জিত।

 

অচিত্রকল্প

অন্ধকার অতঃপর;
বিগত নক্ষত্রের কারুকর্ম ছায়া ফেলে
পাথরের প্রপাতে,
বনভূমির শায়িত সবুজ বৃষ্টিতে শুমার হয়
সব শিলীভূত স্বপ্নের
এই ধূসর ক্যানভাসে কেবল মৃত্যুরই রঞ্জক।
ভুখা আকাশের মালিকানা নিয়ে
পাতালে-জলে যুদ্ধ বাঁধে খাদ্য ও খাদকের।

ইতিহাসের পাতায় বসে একটা ইঁদুর ভাবে :
কোন কানাগলি থেকে আলো এসে না তার
ভোজ্য-দৃশ্যটা গিলে খায়!

 

হিরণ্য

নিরঞ্জন আমি;
অবগাহনের গোলাপছন্দে
ভেসে যেতে যাই লেলিহান সান্ধ্যপ্রবাহে।
জন্ম থেকে একটা কালো পিয়ানোর
কান্নারেখা অনুসরণ করে
আবিষ্কার করেছি
জগতের যাবতীয় হর্ষসিন্ধু
নিসর্গের নোটে এইসব কিছু নেই,
কেবল সন্ধ্যার শ্বাসমূলে ঝুলে থাকা
আসন্ন রাত্রির গর্ভ ও কঙ্কাল
যুগপৎ আমার নাম ধরে ডাকে।
অন্ধ হতে হতে বুঝি প্রলয় কতটা শোভাময়!
নৃবেদনার দুয়ারে এমত সুরভিক্ষা শেষে
রাজপথে দেখি
মিছিল এখনও শুরুই হয়নি।

 

অমাবস্যা

তারা মিছিলের প্রতিবিম্ব
বৃষ্টি-আকারে ঝরে গেছে
খিড়কিদুয়ার থেকে
সদর মোকামে;
তবু আমি
অনন্ত তমসার তান।
সৌরবাজারের পিছে
চাঁদ নামের যে নির্দয় বণিক
পূর্ণিমার একরাত্রি জেগে থাকার দামে
খরিদ করেছে সমুদয় নিদ্রাক্ষমতা।

 

পূর্ণিমাপট

শারদসন্ধ্যার ভিত্তিপ্রস্তর শেষে
চলেছি ঐ অমাচাঁদনিঘাটে
রাত্রির ভেতর যেখানে
সহস্র তারার সংস্থান;
এর মধ্য থেকে জীবনের যত
একক ও যৌথ নির্জ্ঞান
ছেঁকে নিয়ে বুঝি
অগ্নিগিরির ভাঁপ পেয়ে
নদীনৃত্যকলা এত রত্নবতী!
পাশে বনভূমির হরিৎ তন্ত্রীতে
বহমান মৃত্যুনীলমণি
ট্র্যাজিকমিক আবহের সুর তুলে
ক্রমশ উজ্জ্বল করে চিতার বৈভব।
পাখিপরিবাহী এই দিগন্তের তুলি
রৌদ্রমেঘবৃষ্টি পেরিয়ে দেখে
সামনে ধু ধু চন্দ্রাস্তের আঁতুড়ঘর।

 

পরাজ্যামিতি

এই ভোর থেকে খানিকটা এগিয়ে
আমি ও আমার সান্ধ্য-প্যারাডাইম
অকূল পড়ে থাকে।
তোমার স্নায়ুর অবরোহে
দেখেছি গোলাপ–
রুধিরে নিকষিত।
যখন পাদ্রিশিবপুরের ঘণ্টাগুচ্ছ
মহিমা মুলতবি রেখে
ঘুমের নীরবে চলে;
মরুভূমির জলাচ্ছন্ন হৃদয় উপচে
ওঠে ডাঙায় ডাঙায়।
এমন সমুদ্রসন্ধ্যায়
হাঁটতে গিয়ে বুঝি
জীবন কতটা বহ্নিবাহুময়!

 

তারা ঢাকা মেঘ

মূল ভূখণ্ড থেকে
ঝরে পড়েছি
স্বপ্নের ছিটমহলে।
সেখানে সীমান্তরক্ষীর
চেয়েও গাঢ়-রঙে
রাত্রির তুলিতে চলে
মৃত্যুর ডিটেলিং।

প্রতিবেশী আকাশে
সমুদয় তারারা
লালনীল ভূত হয়ে ভাসে।
এমন দৃশ্যের অতর্কিত হামলায়
এতদিনের গুমরে গুমরে মরে থাকা
কী সুন্দর বেঁচে ওঠে !

 

গ্রহণলাগা রূপকথা

তোমার স্বর্গপরিখা থেকে
আমি এখন এই
ক্রুশে ডোবা রাত;
আঁধার-গানে ভর দিয়ে নাচি
নক্ষত্রের বার্ন ইউনিটে।
দিকে দিকে
ধ্বংসশোভন
মৃত্যুর অমল জ্যোতি,
নরকের অনন্ত লুব্ধতায়
জাগ্রত সব মরচে পড়া মার্গ।
মধুভোর আর সন্ধ্যাবিষব্যাপী
কত সুসমাচার
উড়ে
আসে!
তন্বী রাক্ষসীর কোলে
ঢলে পড়ে
ঘুমন্ত তথাগত।

 

পারফিউম

জীবন এক
নাশক সন্দর্ভ ;
আমি তার
ব্যথানীল পৃষ্ঠার
পাঠক।

 

হিমবেহালা

সকল অন্তরালে
অর্কেস্ট্রা এক বেজেই চলে নিঃসঙ্গ
এই সুরপ্রবাহের অনন্তে
সমুদ্রে হঠাৎ দ্বীপের মতো জেগে ওঠে
রঙ্গনিপুণ নাট্যশালা।
তার পিছদুয়ারে গুলবাগিচায় বসে বসে
একগুচ্ছ মেঘবালিকা হাঁড়িতে চড়ায়
জনমভর কুড়িয়ে পাওয়া রোদেলা মল্লার।
এমন ভোজের লাভায়
খানখান হয়ে যেতে যেতে ভাবছি
কালো এই দীপ্ত-স্মৃতির কবল থেকে
ক্ষুধার্ত আমার যদি মুক্তি না মিলত!

 

মৃত্যুবাস্তব

অন্ধকার
সৃজনস্বভাবে চূর্ণ করে চলে
পাষাণ-আলোর স্বর্ণশৃঙ্খল;
বেঁচে থাকার গ্রহবাস্তবে
নক্ষত্র এক মহাফেজখানা।
প্রেমকরুণ বিস্ফারে ছাওয়া
ওই যে বিস্তৃত আকাশপথ।
কত তারাবাজি, কত রক্তরথের
উড়ন্ত ঘর্ঘর শুষে এই আকাশ আজ
একলা কান্নায় ভারি হয়ে আছে!

পাতালের কান্নাখনি সেও তো আমারই;
স্বপ্নের মাটিতে যে শুধু ভূমিহীন নয়।

 

কালের প্রকরণ

পাতাল-অবতরণে
আকাশ পেয়েছে পরমাণু-পাখা;
ডানার ওপরে বসে
হীরাশকুন শয়ে শয়ে।
মৃত সব বন্ধুতার স্মৃতির পাহারায়
বেঁচে থাকি।
দেখি—নরক কেমন নিরুপম নান্দনিক!
স্বর্গের মঞ্জরি পড়ে থাক;
ভালো লাগে অন্তহীন প্রেতিনীর প্রদর্শনী।
আলো-ব্যবসার হাত হতে
বেঁচে থাকো অন্ধকার অপেরা আমার।
ভাদ্রের এমন বৃষ্টি;
তার নৃত্যময় নীরবের ভেতর
তারানিরপেক্ষ আকাশ
হঠাৎ কথা বলে ওঠে স্বাতীস্বরে।
ঘড়ি থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ে
শেষতম সোনাঝুরি সময়।

 

পাথরবাগান

কত কেন্দ্রাতিগ চিন্তাসিঁড়ি বেয়ে
পরমার্থের প্রভাবকণা ফিকে হয়ে
প্রকাশ্যে-অবগুণ্ঠনে পড়ে থাকে
বিচিত্রবিধ সুরে ও নৈরাজ্যে।
দূরে তোমার রেশমি মালঞ্চে ফোটা
গোলাপের রক্তিম প্রজ্ঞায়
ক্রমশ নিরক্ষর ঘাস হতে হতে বুঝি
কখনও ব্যর্থতাও কতটা সবুজ
মানুষজীবনের এই রক্তচর্বির ঝরনায়!

 

পুষ্পায়ন

ঠেকাতে পারিনি অশ্র“র স্বপ্নপাত
তাই শ্রাবণস্নায়ুতে অগ্নির তালে তালে
আবহমান একা থাকা আমার।
এই লোডশেডিং-শহরে
জ্বলমান মোমবাতিমনের মতো
বেদনার নিরঙ্কুশ রেট্রোস্পেকটিভ শুরু।
নোনা অর্চনায় সমুদ্র ঘুমোলে
রাক্ষস তার পরি-ভাষা সাজায়।
নবান্নের স্মৃতিতে
অনন্ত অভাবমঙ্গলে বেজে ওঠে
রাত্রির কৃষ্ণঘন বোধি।
অনন্তের উপকণ্ঠে বসে বুঝে ওঠি
তামস কতো রক্তক্ষণিকায় গড়ে ওঠে
এক একটি সেঞ্চুরি ফ্লাওয়ার!
তার পাপড়ি-পথ ধরে
জীবন আজ এইমতো
এপিটাফের গান।

 

আলেখ্য  র‌্যাবোঁ

রাত হল
বেবুনের বিস্তৃত আত্মকথা;
এক একটি পৃষ্ঠার জন্য বরাদ্দ
অভিশপ্ত চোখ আমার।
দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে
যেদিকেই যাই
লিরিক-প্রস্রাবকারীর সরাইখানা ;
যদিও জীবন ছিল
কুকুরের পরিভাষাময়
তবু স্বর্গীয় সব মচ্ছবে ফেনিল
তোমাদের বর্ষা-বসন্ত।

অদূরে এক নিঃসঙ্গ আবর্তে
সযতনে বাঁচিয়ে রাখে কেউ
সুনীল নরকের নন্দন।
অন্ধকার জয়ন্তী

সাতসন্ধ্যার অস্থি পেরিয়ে রাতপরি তুমি।
তারাস্তম্ভের নিচে চাপা পড়ে আমি অপূর্ব শহিদ
কত ঝরাপাতা মঞ্জিলে স্মৃতিকে উদ্বাস্তু করে
মৃতমালঞ্চে উদ্যাপিত হয়েছি
নক্ষত্রপুষ্পের নিঃসঙ্গ জয়ন্তী।
নেপথ্যে ঘনীভূত দেবছায়ার
হ্যাংওভার কাটাতে কাটাতে
ঘুম ফোটায় তার
ঘরানা-বাহিরানা।
মেঘের পর মেঘ জমে
আঁধার করে সিটি- লাইট আসে;
অতঃপর প্লাবনভূমির বংশলতিকায়
আশ্চর্য এই খরা-মুঞ্জরণ আমার।

 

ঝরা পাতার সিংহাসন

ঝরে পড়া প্রেমের মতোই
তুমি মালঞ্চে চির-চৈত্রশীল।
ঘাতকের নিষ্ঠায়
রচনা করে তোলো
সহস্র রূপমৃত্যুর মঞ্জুষা-ফাঁদ।
মরচে পড়া আলোর ঝলকানি
তামাদি করে বেছে নিই
জীবনের সেইসব অন্ধকার নন্দন!
আর যত ফেরারি পুষ্পে ছিল
ফেলে আসা ফাল্গুনরাত্রির
সবুজ কন্সট্রাকশন।
হৃদয়ের বসন্তবনে গুঞ্জরিত
মরা পাতার দল
ফাঁপা ফসলের চেয়েও
জাগায় বেশি আনন্দধ্বনি।

অনন্ত অনাঘ্রাতার দিকে
রিক্তের এই চৈত্রযাত্রা
চলছে, চলবেই।

 

রিমঝিম মাংসবিতান

বরিশালের বেলস্পার্কে বসে
জীবনানন্দ বিকেলকে বলছিলেন
ফুলপাখিতরুলতার আবডালে
ব্যাপক-বিপুল মাংস মহোৎসবের কথা।
বিকেল ঠিক জানে কিন্তু ক’জন বুঝি
এই ঘুমন্ত নিসর্গনেপথ্যে
রক্তগর্ভ নানা উন্মীলনের গল্প?
কুসুমকলির আড়ালে কীটমাংসের আরাধনা তো
জীবনানন্দের জন্মের আগেও ছিল
মাংসোদ্ভূত রণরক্ত সাফল্য কি ব্যর্থতার গল্প
এমন করে কেউ তো বলল না ;
সব কেবল ফুল্ললিত সামন্ত বন্দনা!

ওই দ্যাখো দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে
মাংসচর্বি-ভুরভুর ট্রামকাটা
জীবনানন্দ নাম্নী অনন্ত শতাব্দী
নির্বিকার ঝুলে থাকে ;
তার গা থেকে টপ টপ ঝরে পড়ে
আধুনিক বাংলা কবিতার লীলাবিধুর রক্ত।

 

নৃত্যচ্ছিন্ন মুদ্রারা

রক্তরোদনের প্রবাহ এমন
গীতাভ ভেসে যাবে
নিঃসুর এই সমুদ্রসমগ্র।

ঘাসপাতার সমাগত নৈঃশব্দ্যে
আপাত নতজানু থাকি;
আসন্ন সবুজ রণনে
খাক হয়ে যাই যেন।

শীত চলে গেছে
বিরহী গ্রীষ্মবাসব্যাপী
কুয়াশাছন্দের অবিরত নাচ;

এতদিনে তবে প্রেমহিমে
অধিকৃত হলো
তোমার আত্মার ঊষর ভূখণ্ড।

 

স্বপ্নমৃত্যুপ্রসারণ

এই গ্রীষ্মেও
মুষলধারে কাঁদছে আকাশ;
কান্নাপ্রণালি
কোনো ঋতু মানে না।
দিগন্তপাতালে
রন্ধনশালার বিস্তার তার।
এর মাঝে আমি এক
ঋজুরেখ নক্ষত্রবাদি,
এই ক্রন্দনসিম্ফনির
কারুকাঠামো ভেদ করে
শুক-স্বাতী-অরুন্ধতীর
হৃৎমহলে যাই;
দেখে আসি
এক একটি নক্ষত্রের
নির্মাণশেষে
তোমার চোখের জল
কত যুগের
বর্ষা হয়ে
ঝুলে থাকে
অনন্ত
অন্তহীনে!

 

নির্নন্দন

ধ্বংসের ছন্দোবন্ধনে ছাওয়া
স্নায়ুবৃক্ষ আর আসন্ন অন্ত্যেষ্টি আমার।
রুঠা সত্যে ছিল আকীর্ণ এতকাল;
কৃষ্ণ সব স্বপ্নের স্থপতি
এখন গড়ে নক্ষত্রের রংরুট।
উষ্ণতম রক্তবাহের প্রাণপথে
যখন মুহূর্মুহু হেঁটে বেড়ায় জলদেবের কন্যা,
অন্ধকার আয়ুষ্কালে তার খান খান
নিরঞ্জন আলোর ইমারত যতো।
জ্যোৎস্নার এইমতো জ্যামিতিতে
সুনিকেত রাত্রি আজ অনন্ত জিপসি ব্যালাদ।
মহাসংগীত, তোমার শীর্ষসুরও ধারণ-অক্ষম
অগীতল জীবনের এমন অভূত রূপাভিঘাত

 

অরুন্ধতী

শূন্য এই প্রাণের প্রেক্ষিতে
নামে রাত,
রাত্রির অন্ধকার ছন্দ;
ছায়া কালো-কালো
শুষ্ক স্বর্গের পটভূমি চূর্ণ করে
বাড়ায় ধীরে
রাজকীয় নরকের পরিধি যত।
পুষ্পতলে কত কান্নার্ঘ্য জমে
তারা ক্রমে শুক, স্বাতী তনু পায়;
অনেক ভোরের দামে অমারজনী
সহস্র পাখা মেলে
এক জীবনের
স্কন্ধকাটা শ্রাবণে-আশ্বিনে।

 

রক্তঋদ্ধ

চৈত্রশেষ
তবু ঝরা পাতার পটভূমি অপার।
সমুদ্রের ইন্দ্রিয়সমুচ্চয়
স্রোতের ভাঁজে ভাঁজে দেখায়
কত সুরম্য রক্তের নন্দন।
বাহারি অগ্নির মুঞ্জরণে
পুষ্পও প্রকরণ পাল্টায়।
আজ তাই নৃত্যভেলায় একচ্ছত্র
গোলাপের মিউজিক শুধু।
জীবন নামের এই রূপসি মঞ্জিলে
কঙ্কালেরও বয়স বাড়ে,
রাত্রির কৃষ্ণ কেশে চলে
জ্যোৎস্নার চিরুনি।
মৃত্যুপঞ্জির নির্জন কত কারুকাজে
নরক আছে বিভাশীল।
তোমার লিরিকের প্রবেশিকায় অনুত্তীর্ণ আমি;
রূপকথা-স্বর্ণকথার বিষণ্ন বাদ্যে
ক্রমশ গুম হয়ে যাই।
এভাবে সুন্দর-নিঠুরের গীতিময়তা
তারাশস্যের মতো অস্তিমান ফুটে থাকে
ভূমিহীন স্বপ্নক্ষেত্রে আমার।

 

কুরুক্ষেত্রের আলোকুয়াশা

এই পরিব্যাপ্ত হিমের দামামা
নিখিল নিদ্রার প্ররোচনা ছড়ায়
তবু পাখিদের প্রভাতী এলার্ম শুনে
প্রতি ভোরে পৃথিবীর মাঠে যাই
দেখে আসি
কুয়াশার কফিনে ঢেকেছে কি না
আমাদের কুরুক্ষেত্রগুলো।
কিন্তু না, রক্তের অলিন্দে
যুধ্যমান তন্ত্রীগণ
ক্রমশ আরো শিশির-তাঁতা।
বাকি সব ভালগার
রণরক্ত ব্যর্থতা ও সফলতাই
আমাদের মহান ক্ল্যাসিক।

আমি কি যুদ্ধরহিত!
এই প্রশ্নের উত্তরে
ফের নিক্ষিপ্ত হই
মাতৃজঠরে।
সঙ্গহীন যোদ্ধা ;
একলা পরাক্রমে
গর্ভগৃহের অন্ধকার থেকে
এসেছি বেরিয়ে
মা, তোমার কষ্টের গ’লে
করুণ জন্মের
মহিমা পরিয়ে।

তারপর হঠাৎ আলোর ঝলকানি
লাগতেই দেখি
হৃদয়ে হৃদয়ে তাক করা মাইন।
যখন এমনকি পুষ্প নেয়
বিধ্বংসী আকার
তখন জলকে করে নিই
আমাদের অমল প্রতিরক্ষা।

একটি আঁধার রাতের দামে
চেয়েছিলাম অনেক ভোরের আলো
জানতাম না
এই কানন ঋতুহারা
সার্বভৌম শুধু এক গহন কৃষ্ণকাল।
রাত্রির রতিস্তম্ভ থেকে
দিনগত পাপক্ষয় সবকিছু
তমস কলকণ্ঠময়।
তবু কি চাই
নিরঙ্কুশ আলোর ভাঁড়ার?
এমন ধন্দের ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে
কে যেন বলে
দেবগ্রস্থ জীবনের চেয়ে অভিশপ্ত
আর কিছু নেই মানুষজীবনে;
না, আমরা তো চাই
রক্তপুঁজক্লেদময় মানুষজীবন।
অন্ধকারের অফুরান ঝনৎকারে
থাকলেও থাকতে পারে
আমাদের পরম মোক্ষ কোনো
স্বর্গের নীচে দাঁড়িয়েও তো
নিরন্তর শুনি
নীল নরকের ডাক।

এই বর্ণিল ইতিহাসের বাইরে
আজকের এক নীরক্ত শতকে
অবশিষ্ট নেই
নারকীয় ভুবনের কবিতা কোনো।

শুধু প্রস্তাব করতে পারি
রক্তের ভেতর বহমান চুপচাপ তান।
মৃত নাচঘরে
যে নর্তকীর স্মৃতিও কবর হয়ে গেছে
তার বিগতসব ঘুঙুরের বেঁচে যাওয়া
এক ফোটা বাজনা হয়ে
আমি আমার ভেতর
ঘনীভূত শীতপ্রাসাদে
আপনাদের হাত ধরে নিয়ে যেতে পারি।
কবিতার মুখোশে দেখবেন
কত অপমৃত ফাল্গুন-চৈত্রের
শোকসভা চলছে সেখানে।

আরব্যরজনীর কত রাজাখোঁজা
কলম্বিয়ার এরেন্দিরা
মহাভারতের সৌতি
সবে মিলেঝুলে বলে যাচ্ছে একটাই গল্প;
আমাদের কোনো কবিতা-গানই
এই গল্পের মুকুটে যোগ করে না নতুন পালক।
তাই শুনে যাই শুধু;
মৃত্যু থেকে সার্ধশত দূরত্বে বসে শুনি
আলো আর কুয়াশার গভীর আলাপ;

কুয়াশা –  চলো চলো বাগানে চলো
পুষ্পময়ী নন্দনকাননে

আলো –   বাগানের পথ বন্ধুর
কারণ পথে পথে
হিমশিখা জ্বালিয়েছ তুমি

কুয়াশা-  এত আলো-ঝলমল সব
এবার একটু ধাঁধা চাই
চাই আঁধারের আভা

আলো-    সরাও তোমার মরণবাহু
ফুলকে নিতে দাও নিশ্বাস

কুয়াশা-  রূপেরও তো ক্লান্তি আছে
বুকের ভেতর নদী হোক
বয়ে যাক অরূপের ধারা

আলো-    বলো তুমি
মৃত্যুতে নিহিত
কোন অরূপরতন

কুয়াশা-  মরণও হতে পারে
কান্তিমান
ঝিরিঝিরি সোনার নির্ঝর

আলো-   মরণ মানে কেবলই মরণ
মাংস আর রক্তের রোল

কুয়াশা-  মরণ হতে পারে
দুধরাজ সাপ
বিষবাহার

আলো-    কঙ্কালের প্রভায়
কী সুন্দরতা
খুঁজে পাও তুমি

কুয়াশা-  নিরক্ত রাগিণীরই’বা
মাধুরী কোথা
গানও হতে হয়
সুরবিধুর

আলো-   তুমি প্রদাহের পূজারি
আমি সবুজ আর সোনালির

কুয়াশা-   কৃষ্ণতায় চুরমার
সমুদয় স্বর্ণালি-হরিৎ

আলো-    হাড়ের জোয়ারে
আমি চাই না ভেসে যেতে
সমুদ্রউত্তালে চাই
ময়ূরপঙ্খি

কুয়াশা-  ভাসতে হয় ভাঙা ভেলায়
কারণ জল মানে
শত শত বেদের কফিন

আলো-    থাকো তুমি জলের কিনারে
চলি আমি নীলিমাবিশালে

কুয়াশা-  দেখো দেখো নীলিমাও মেঘাক্রান্ত
চলো যাই পাহাড়বিলাসে

আলো-    ঐ পাহাড়
সেই তো মরুভূমি ধু ধু

কুয়াশা-  মালভূমি
মরুভূমি
এভাবেই ফুলভূমি

আলো-    তোমার রসনা যত
আদিম লতাগুল্মে
আমি শ্বাস নেই
হীরা চুনি পান্নায়

কুয়াশা-  আমি দেখি বাগান;
ফুলে ফুলে ভরা
ফুল দিয়ে গাঁথা
রক্তের মালা

আলো-    জন্ম তোমার ক্ষতের ঋতুতে
আমার মৃত্যুও নয় নেহায়েত মৃত্যু
হরিণের পিছে পালে পালে ধাবমান
চিত্রামরণ

কুয়াশা-  ঊষা মানে বিচূর্ণিত রহস্যসুন্দর
আঁধিই অনিন্দ্য
যেমন চান্দ্রেয় তৃণ ও তরু

আলো-    শ্মশানেও কেন
তোমার তরঙ্গ-অন্বেষা?
সুন্দর মানে
মৃত্যুহীন
অনন্ত দীপ্তি

কুয়াশা-  এ জগত শান্তিকল্যাণের
এ জগত যুদ্ধকল্যাণের
পুষ্পের সাথে আছে
দীপ্তি বারুদের

আলো-    আজ তবে
জগতের এমত
আনন্দযজ্ঞে
সমস্ত গান হোক নাঙ্গা
নাচ হোক খর
আর রূপক্লান্ত রাত্রি
মিশে যাক
চার রাস্তার মোড়ের
ঐ ঘুমন্ত ফোয়ারায়
তারপর
এই আমি আলো
এই আমিই তো কুয়াশা।

 

কবি পরিচিতি:

পিয়াস মজিদ
জন্ম : ২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৪

প্রকাশিত গ্রন্থ :

কবিতা :
নাচপ্রতিমার লাশ (২০০৯)
মারবেল ফলের মওসুম (২০১১)
গোধূলিগুচ্ছ (২০১৩)
কুয়াশা ক্যাফে (২০১৫)
নিঝুম মল্লার (২০১৬, কলকাতা)
কবিকে নিয়ে কবিতা (২০১৬)

গল্পগ্রন্থ :
নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ (২০১৬)

প্রবন্ধ :
করুণ মাল্যবান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০১২)
কবিতাজীবনী (২০১৪)
কামু মার্কেস ইলিয়াস ও অন্যান্য (২০১৫)

মুক্তগদ্য :
এলোমেলো ভাবনাবৃন্দ (২০১৬)

সাক্ষাৎকার সংকলন :
আলাপন অষ্টমী (২০১৫)

সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু গ্রন্থ।

পুরস্কার :
এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার ২০১২, কলকাতার আদম লিটল ম্যাগাজিন প্রদত্ত তরুণ কবি সম্মাননা ২০১৫, সিটি-আনন্দ আলো পুরস্কার ২০১৬

* তার ছোটগল্প অবলম্বনে আশুতোষ সুজন নির্মাণ করেছেন টেলিছবি নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ। ২০১৫-তে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছেন চীনে অনুষ্ঠিত চীন- দক্ষিণ এশিয়া- দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া লেখক সম্মেলনে।
বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।

শেয়ার