নিধনের সাইরেন ।। বাপি গাইন

সূত্রপাত দাও। একটা মুহূর্ত ঘটুক। ভালোবাসা আর তেমন রক্তিম লাগছে না। কালক্রম ব্যস্ততা নিয়ে আসছে। ফলে সন্ধ্যার দিকে একটা চা বিষণ্ণ হয়ে এলো। একটা দীর্ঘ আলাপ নিজেকে ভদ্রতার পোশাক পরালো, যতদূর তাকে মানায়।

পোশাক কি মানুষটাকে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে, ভেবেছে কখনও? ভেবেছে নিশ্চয়। না হলে তার প্রতিটা ওঠাবসায় সে এতো নিখুঁত জীবন রাখছে কিভাবে!

‘ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়ে গেছে’ বলে কান্নাকাটি করছে সম্পর্ক। সান্ত্বনা বোঝাচ্ছে- তুমি তো মানুষ। এতে দুঃখিত হওয়ার কী আছে। দুঃখিত হলে পশুরা একা থাকে। একার ভেতর কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। তুমি তো মানুষ।

মানুষে মানুষ জড়িয়ে যায়। জানালায় রাস্তা। রাস্তায় যে দিকনির্দেশ দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে জানালার কী? একটা অ্যাম্বুলেন্স কাঁদতে কাঁদতে স্বর্গের দিকে যায়। একটা পাগল দিকনির্দেশের নিচে দোকান খুলেছে। জানালার কী এমন তাতে।

গত পরশু থেকে সমস্ত পুণে শহর জুড়ে কুকুরের কান্না ছাড়া আমি কিছু শুনিনি। রাস্তায় কুকুর ধরা চলছে। গলায় স্টিলের ফাঁস পরিয়ে টেনে তোলা হচ্ছে গাড়িতে। একটা কুড়ি-বাইশ দিনের বাচ্চা রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা দৌঁড়ে যাচ্ছে, কাঁদছে, আবার ফিরে এসে ধুলো শুঁকছে, আবার কাঁদছে। গাড়ি ওর মাকে নিয়ে গেছে। গাড়ি ওর শৈশব নিয়ে গেছে।

এইসব কুকুরদের নিয়ে ওরা কী করবে? কী করে? সরকার কি ওদের দায়িত্ব নিলো? পেট ভরে খাওয়াবে ওদের? মেরে ফেলবে না তো? মেরে ফেলে যদি? ফেললেই বা কে দেখতে যাচ্ছে। এখনও না খেতে পেয়ে পৃথিবীতে মানুষ মরছে। পিঁপড়ের ডিম খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে যেদিন জেনেছি, তখন যত না খারাপ লেগেছিলো তারও চেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম মনে আছে। এখন আর কোনো কিছুকেই তেমন আবিষ্কার মনে হয় না। আমার অনুভূতি কি মরে যাচ্ছে? আমি মরে যাচ্ছি কি?

এই যে কুকুরগুলো গেল গাড়িতে চড়ে, ওরা কি খুব আনন্দে আছে? গাড়িতে চড়েছে বলে যে ওদের বুক ফুলে উঠেছে সেরকম তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ওরা যে কান্না ছড়াতে ছড়াতে দৃশ্যের বাইরে গেলো- এসব নিয়ে কি ভাবছে আমার প্রেমিকা? গত পরশু থেকে আমি রাস্তায় বেরোতে সাহস পাচ্ছি না। যদি কুকুরের বাচ্চাটা পা জড়িয়ে ধরে। আমি কী করবো? লাথি মারব কি? তাড়াহুড়ো করে কোনো ফুডপ্লাজায় ঢুকে পড়বো সুযোগ বুঝে?

একদিন পেটের কথা না ভাবলে রান্নাঘর আমাকে ক্ষমা করেনি। একদিন ক্লান্তিকে চুমু খেয়েছি তো মাসের শেষে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আমাকে করুণার চোখে দেখে।

অথচ আজ তিনদিন। জানালা জানে। বাইরে ওই বিশাল কংক্রিট সভ্যতার আঙুল যেন আমাকেই দেখাচ্ছে। বেমানান। গায়ে মাংস নেই। পকেটে টাকা নেই। খাবার খুঁজছি। বাসস্থান খুঁজছি। একটা কুকুর বেড়ে উঠছে আমার ভেতর। আমার চলাফেরাও দিনদিন সন্দেহজনক হয়ে উঠছে খিদের পাল্লায়। দূরে পৌরসভার গাড়ির আওয়াজ আরো তীব্র হয়ে আসছে।

 

শেয়ার