পৃথিবীর মানুষ তার চারপাশ থেকে যা শুনে শুনে (গ্রন্থও সেক্ষেত্রে লেখকের বক্তব্য শোনার সামিল) বড় হয়, তা দিয়েই তার যাপিত জীবনের শব্দভাণ্ডার অর্জিত হয়।
এখন কথা হচ্ছে, কে কোন শব্দসমূহ শুনছে?
কোন জাতীয় শব্দ শোনার জন্য তার কান কতটুকু প্রস্তুত হচ্ছে?
শোনা কথার দায় চর্মচক্ষুকে নিতে হয়। মর্মচক্ষুর দায়কে অযৌক্তিক ভাবা হয় সাধারণত। কারণ, ঐ সমাজ তার কানকে তৈরি করে দেয় একটা অভ্যস্ত শব্দের জগতের ভেতর।
এখন আসা যাক আসল কথায়।
প্রকৃতিস্থ আর অপ্রকৃতিস্থ বলতে কি বোঝানো হয়?
অপ্রকৃতিস্থ মানে কি?
অভ্যস্ত সমাজ-শব্দের বাইরের জগৎ?
যদি তাই হয়, তাহলে সমাজের ট্যাবুগুলোকে কিভাবে প্রকৃতিস্থ বলা যায়?
অপ্রকৃতিস্থ তো তিনিই যিনি প্রকৃতির ‘ভাষা’য় কথা বলছেন, যিনি অভ্যস্ত সমাজের বাইরে প্রকৃতির প্রতিনিধি।
অথচ,অভ্যস্ত সামাজিক ‘ভাষা’র বাইরের লোককেই আমরা ‘পাগল’ বলছি!
আশ্চর্য লাগে আমার। সমাজের সবাইকেই কেন একই ‘ভাষা’য় কথা বলতে হবে, যেখানে একই মনের অধিকারী সবাই নয়?
কৌশিক গাঙ্গুলির ‘শব্দ’ দেখেছি।
দেখেছি,
কি অদম্য কান সৃষ্টি করেছে ‘তারক’ তার কর্মসূত্রে!
মানুষের প্রবণতা আসলে এমনই।
মানুষের অবদমিত শব্দের ভার যখন সমাজ মানুষকে চাপিয়ে দিচ্ছে তখন অবদমনজনিত কুফলের দায়ভারটিও কেন আর গ্রহণ করছে না?
‘শব্দ’ সিনেমার ‘তারক’-কে এক পর্যায়ে ‘অসুস্থ’ বলা হচ্ছে। অথচ, সসুস্থতার সংজ্ঞা আর কেউ দিতে পারছে না।
না পরিবার, না পরিজন, না কোন মনোবিজ্ঞানী।
অভ্যস্ত নিয়মের বাইরে যেন আর কোন শব্দ থাকতে নেই!
এই চাপিয়ে দেওয়া সমাজের শব্দসম্ভার, যা আদৌ কারো পক্ষে বহন করা সম্ভব কিনা, তার দায় সমাজ না নিয়ে উলটো মানুষটাকেই সমাজচ্যুত করে ফেলে দিচ্ছে। যদিও চূর্ণি গাঙ্গুলির অভিনয় খুব একটা হয়নি, তারপরও তাকে দিয়েই পরিচালক তার সিনেমার মোদ্দা কথাটি বলিয়ে নিয়েছেন। কেন কে জানে?
হয়ত আত্মীয় বলেই!
খুব প্রাসঙ্গিক অভিনয় না করলেও বক্তব্যের যৌক্তিকতা উচ্চারণ করেছে সে-ই।
চূর্ণি গাঙ্গুলি ধরতে পেরেছে বিষয়টা।
ধরতে পেরেছে দর্শকও।
একজন মানুষ তার সারা জীবনে ঠিক কোন জাতীয় শব্দজগৎ দিয়ে কাজ চালাবে তা যেন নিয়তির মতো বা পূর্বনির্ধারিত ধর্মের মতো হয়ে যায়। কিন্তু, মানুষ কি আদতে তাই?
মানুষের মন কি সমাজের আরোপিত সবগুলো শব্দকে গ্রহণ করে? বা করতে পারে?
না।
কখনোই না।
পারে না।
চেষ্টা করে মাত্র।
চেষ্টা আর অবলীলা এক জিনিস না।
ভবলীলার এই ব্যারিকেডের ভেতর মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করে।
আবার বেঁচে ওঠে নতুন শব্দের খোঁজে।
শরীরী মৃত্যু হয় যখন, তখনো মানুষ কথা বলে। কিন্তু আধিপত্যবাদী সমাজ সে ‘ভাষা’ বোঝার জ্ঞান রাখে না। সেক্ষেত্রে মর্মেন্দ্রীয়ের ‘ভাষা’ খুব যৌক্তিক হয়ে হঠে। মানুষ ধ্যান করেও সে ‘ভাষা’র শব্দগুলো আয়ত্ত করতে চায়।
কেউ কেউ পারে, অধিকাংশই পারে না।
আমার পতিদেব, আমার একটি বিষয়ে খুব প্রশংসা করে থাকেন প্রায়ই।
আমার কান নাকি খুব শার্প।
আমি সহজেই নাকি কণ্ঠ চিহ্নিত করতে পারি।
আমিও দেখেছি সেটা।
কণ্ঠস্বর ভুল করি খুব কম।
এটার কারণ হিসেবে বলতে পারি আমি যা শুনি, যেভাবে শুনি তা আমাকে সমাজ দেয়নি, দিয়েছেন ঈশ্বর।
সুতরাং যে শব্দ অন্যেরা যেভাবে শুনে অভ্যস্ত, আমি সেভাবে অভ্যস্ত নই— হতে পারে এমনটা।
শব্দের একটা ছন্দ আছে, যেভাবে নদীর কূলে বাতাস দাগ কেটে রেখে যায় পানির— অনেকটা সেরকম। যে নদী দেখে অভ্যস্ত, নদীর কূল দেখে অভ্যস্ত তার পক্ষে পানি আর বাতাসের এই প্রেম চিহ্নিত করা কঠিন। এই অভ্যস্ততা তাকে দিয়েছে তার চারপাশের শব্দ- ‘ভাষা’।
যাই হোক, তারক তার পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ত, কিন্তু ঔষধের ভেঙ্গে যাওয়া শিশির কাঁচ ঝাড়ু দেওয়া দেখে দেখে সে অভ্যস্ত না। ফলে এই ঝাড়ুর আওয়াজের ‘শব্দ’ কিভাবে সে স্টুডিওতে তৈরি করে সেটা নিয়ে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ, দরজা খোলার আওয়াজ, নদীর ঢেউয়ের আওয়াজ এমনকি আগুন জ্বলবার আওয়াজেরও বিকল্প সে খুঁজে পায়। যা অভ্যস্ত সমাজের মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
অথচ, এই অদ্ভুত ‘শব্দ’শিল্পীকে ‘অপ্রকৃতিস্থ’ সাব্যস্ত করা হয় একসময়!
বিজ্ঞানও একটা পর্যায়ে অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আমরা এতে অভ্যস্ত হতে হতে এক সময় মর্মান্ধ হয়ে পড়ি। আর ঠিক তখনই আমরা সামাজিক মানুষ হয়ে উঠি! আমাদের চোখ থাকে, কান থাকে, নাক থাকে, জিহবা থাকে ঠিকই কিন্তু তা একান্তই ধার করা, তাতে অনুভূতি থাকে না এতটুকুও।
অন্যদিকে তারকের অনুভূতিটুকু একদম নিজের। কারো থেকে ধার করা নয়।
আমি তাকেই অপ্রকৃতিস্থ বলব যে ঘোরতর অভ্যস্ততার শব্দ নিয়ে সামাজিক, এবং নিজের কাছেই নিজে অপরিচ্ছন্ন এবং মনের বাইরে কৃত্রিম। সে অর্থে তারকেরা কৃত্রিম নয়। পুরোপুরি প্রকৃতিস্থ।
যুক্তি তো তাই যা সমাজের ‘ভাষা’য় একটা অভ্যস্ততার কান তৈরি করে দেয়। ‘শব্দের’ মর্ম-গরিমা সে কি বুঝবে?