নস্টালজিয়া ।। রাজিব মাহমুদ

ক.

প্রাক-কথন

প্রতিদিনকার ছোট ছোট ক্লীশেড স্ন্যাপশট্ গুলোর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে চিন্তার বাঁক বদল করে রঞ্জু। অফিসে বসের এখনো-সই-না-হওয়া ফাইলটা, বাসার ডাইনিং টেবিলে সদ্য আসা বিদ্যুৎ বিলটার গ্লাসগুলোর একপাশে হামাগুড়ি-দিতে-দিতে-উপুড়-হয়ে-ঘুমিয়ে-পড়া শিশুর মত পড়ে থাকা, পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসা ভাড়াটেদের মেঘ-রঙা কামিজের মেয়েটার ঘোলা-কাঁচ স্যুররিয়েল হাসি, নীচের বুড়ো দারোয়ানটার এ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মাঝবয়েসী মহিলার বুকের দিকে (আঁচল যথাস্থানে থাকা সত্বেও) স্থির তাকিয়ে থাকা… এরকম আরও কত কত হোপলেস ইমেজ। ওর মনে হয় দিনের পর দিন একটা অন্ধকার ঘরের দেয়ালে প্রতিফলিত প্রোজেক্টারে একটার পর একটা ছবি দেখে যাচ্ছে। মৃদু ‘খঘট’ ‘খঘট’ শব্দ হচ্ছে একটা ছবি সরে গিয়ে পরের ছবিটা আসার মাঝখানে। ওকে দ্যাখায় নির্বিকার দর্শকের মতো। তবে ছবিগুলোর যদি চোখ থাকত তাহলে তারা দেখতে পেতো রঞ্জুর চোখের মণির ভেতর সমুদ্র-তলের সবুজ শ্যাওলা কিংবা মাঘের কুয়াশা…

        প্রতিদিনকার এই ক্লীশে থেকে অন্ততঃ কিছুটা সময়ের মুক্তিটা খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল ওর জন্য। এই মুক্তি ও খুঁজতে চায় ফেলে আসা জীবনটার লম্বা সুড়ঙ্গের আলো-আঁধারের ভেতর। ওর ভাবনার এই তরঙ্গে ভেসে ভেসে ছোট ছোট কিছু বর্ণনা উঠে আসে। এভাবে আস্তে আস্তে লেখাটা এক সময় শুরু হয়ে যায়। তবে বাক্যগুলোকে ওর কেমন শ্লেষা-জড়ানো মনে হয়; যেন ওরা আলাদা আলাদাভাবে পাশাপাশি থেকেও ভাবগুলোকে স্বচ্ছভাবে বহন করে নিয়ে যেতে পারছে না। ওর কবি-বন্ধু রোকন হয়তো এভাবে বলতো যে, যে ভাবের শেকড় নিয়ে ওর বাক্যগুলো বিস্তৃত হচ্ছিলো তা থেকে হঠাৎ-ই সরে যাচ্ছে মাঝপথে; যেন তাদের মনোযোগ একটি কেন্দ্রে থিতু হতে পারছে না। ব্যাপারটা অনেকটা জগ থেকে ছলকে পড়া ছিরিছাঁদহীন পানির একটা স্ফীত ধারার মতো। ধারাটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে টেবিলের একপাশে, ঠিক ওর বাক্যগুলোর মতো; ওগুলো যেন ফুলস্কেপ কাগজ কালিতে ভিজিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে খাতাটার চারপাশে… ছড়াতে ছড়াতে আনমনেই যেন এঁকে তুলছে একেকটা অদ্ভুত অবয়ব…সেটা দেখে ওর কখনো মনে হয় সদ্য মানচিত্র আঁকতে শেখা কিশোরের আঁকা আফ্রিকা… আবার কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা পাল্টে হয়ে যায় পেগাসাসের মাথা…না না এখন তো মনে হচ্ছে মেরুভাল্লুক… এই করতে করতে কখন যে থ্যাবড়া ধারাটা সব রেখা-মানচিত্র শিকেয় তুলে মেঝেতে আত্মাহুতি দিতে চলে যায় টেবিলের কোণায় সেটা লক্ষ্যই করল না রঞ্জু। বরং এই জায়গাটায় এসে হঠাৎ-ই ওর মনে ভেসে উঠলো শেষবার দ্যাখা রিক্তা আপার বিষণ্ন মুখটা। শুধু কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। হাওয়ার কালিতে আঁকা সময়ের একটা পোট্রেট যেন। এরপর আবার সেই হাওয়া এসেই মুখটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো।

রঞ্জু আস্তে আস্তে লিখে উঠতে থাকে মনের ভেতর কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছুবা দীর্ঘবোধের ছবি… ফেড-ইন, ফেড-আউট…ওর ভাবনা বাতাসের মতো পেছনে ছুটে যায় কিছু হারিয়ে যাওয়া ছবি ধরতে বা শব্দ শুনতে…পথে পথে স্মৃতির তলানিতে আটকে পড়া কিছু ঘোর-লাগা টুকরো টুকরো দৃশ্য…এসব পার হয়ে গেছে সেই কবে…ব্যাপারটা অনেকটা একাকী সমুদ্র মন্থনের মত…থেকে থেকেই মনটা কেমন খাঁ খাঁ করে ওঠে।

এইসব ছবিগুলোর সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া অনেক ‘অপাংক্তেয়’ আবেগও উঠে আসে বৈকি…যেগুলোকে আজ ওর কাছে ভীষণ জলো আর ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়। তবে এই মনে হওয়াগুলোকে ওর অনেকাংশেই আরোপিত মনে হয় যা হয়ত ওর দীর্ঘ শহরবাসের ফল। ফেলে আসা দিনগুলোতে এই আবেগগুলোই ছিল ভানহীন স্বতঃস্ফূর্ত…যখন একটা প্রেমের তুলতুলে অনুভূতির জন্য “মেরা জান হাজির হ্যায়” টাইপ একটা মানসিক গঠন ছিল।  রোকনের ভাষায় বলা যায় অনুভূতির একেকটা দোলায় শূন্যে উঠে গিয়ে এফোড়-ওফোড় হয়ে যাবার জন্য ভেতরটা উন্মুখ হয়ে থাকতো। ‘দুঃখ’ ‘কষ্ট’ ‘আনন্দ’ -এসব মোটাদাগের অনুভূতি ছাড়িয়েও ছিল শরীরের অতল থেকে হঠাৎ ধাক্কা দিতো কিছু তীব্র অচেনা আবেগ। সেগুলো হয়তো আজকের এই কড়াত কড়াত ‘বাস্তবতা’র তোপের মুখে নির্ঘাত পালিয়ে বাঁচতে চাইবে। নাগরিক পাকামো সর্বগ্রাসী ব্যাপার। চাইলেই জামার মতো খুলে ফেলা যায় না। এটা প্রতিদিনকার যাপিত জীবনে আস্তে আস্তে চারার মত বেড়ে ওঠে। রঞ্জুর মনে হয় ও ক্রমশঃ একটা অনুভূতিহীন বিটকেল কীটে পরিণত হচ্ছে। ও শুধুই দেখে যায় অপলক বা শুনে যায় একটানা- কিন্তু মনের ভেতরটায় পাতার সবুজ মুছে গিয়ে এ্যাক্রিলিক রং ঘনিয়ে ওঠে। এই দ্বিতীয় রংটি ওয়েদার-প্রুফ, সহ্য ক্ষমতা অনেক বেশী। আর তাই অল্পতে অনুভূতির স্ক্র্যাচ পড়ে না। আজ বহুদিন পর নিজেকে মেলে দিতে ইচ্ছে করছে এক ধরনের অকৃত্রিম আদিমতায়। কলমের ডগা জিভে ছোঁয়ায় ও…চেখে নেয় তার ধারঃ ওর আদিমতাকে ধারণের শক্তি আছে তো কলমটার? ও ঠিক করে কম্পিউটারে না, কাগজ-কলমেই লিখবে। তবে এক ধরণের আশঙ্কাও নাভির অতল থেকে ঘুরে ওঠে। মনে হয় থাক্ না গল্পগুলো স্মৃতির হারিয়ে যাওয়া জল-হাওয়ায়…ওগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে বের করাটা কি খুব জরুরী?

জানালার বাইরে থমথমে রাত। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি এই সময়ে সবসময় শুনতে পাওয়া কুকুরটার টানা ঘেউ ঘেউও নেই। লেখার জন্য ওর হাতের তেলোর নীচের চামড়ায় যেন শব্দগুলো পোকার মত কিলবিল করতে থাকে। না লিখে যেন উপায়-ই নেই। যেন এইসব স্মৃতির কালচে রক্ত আর শরীরে বইতে পারছে না রঞ্জু। এদের মহাপ্রয়াণ হোক আজ…তবে সিদ্ধান্ত নিল যে ও লিখবে তৃতীয় পুরুষে অর্থাৎ একটা চরিত্রের আড়াল নিয়ে। স্মৃতির সাথে এই বরফ পানি খেলায় ও অচ্ছুৎ-ই থাকতে চায়। ধরা যাক চরিত্রটার নাম মঞ্জু…

 

খ.

স্বপ্নের রাজকন্যা

 

একটাপুরো রাত জেগে থাকার ভারী অবসাদ, সকালে তেল চুপচুপ পরোটা আর গরুর ভুনা মাংসের ভুরিভোজনের ভাত-ঘুম ক্লান্তি—এই দু’য়ের সাথে লেপ্টে রইল ভোজন-পরবর্তী ঝাঁঝালো ঢেকুর আর তলপেটের অন্ধকারে জন্মানো টান টান কামেচ্ছা। মঞ্জুর সংক্ষিপ্ত বাসযাত্রাটা এই ত্রিকোণ ঘোরে কাটছিলও বেশ; হাল্কা একটা তন্দ্রাবেশ ওর দুই চোখের পাতার ভাঁজে ভাঁজে রোদ-ছায়া, রোদ-ছায়া লুকোচুরি খেলছিল।

        আধ-খোলা চোখে সামনে তাকিয়ে ও দ্যাখে চলমান জেগে উঠতে থাকা শহরটাকে আগলে কে যেন বসে আছে। একটু ভালো করে তাকাতেই বোঝে যে ওটা একটা মেয়ে। কাঁধের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল থেকে উঠে আসছে অভিজাত কর্পোরেট সুবাস; সদ্য স্নানের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পানির বিন্দু চারপাশে ছড়াচ্ছে এক সতেজ মৌতাত। বুকের বিজ্ঞাপন-অনুমোদিত উপরি অঞ্চল অবধি নগ্ন সুন্দরীর ছবি সাঁটা সাবানের বিজ্ঞাপনের হাল্কা একটা গন্ধও যেন পেল। এইসব চটকে ঘুমঘুম আমজটা ছিঁড়ে গেলেও এই লাউড শহরটার নানা স্কেলের শব্দের মন্থন ওর মগজে ঢুকে তখনো ঝাঁকি ঠিক ঝাঁকি দিয়ে ওঠেনি। তারপর হঠাৎ…
“শালা বাঞ্চোত টেরাফিকেরে আমি………………”

        ড্রাইভারের এই খিস্তিও কানের পাশ ঘেঁষে প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল যদি না এর সাথের কড়া ব্রেকটা মঞ্জুকে কঁকিয়ে তুলতো তার আচমকা ধাক্কায়। পুরোপুরি সজাগ হয়ে কানের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকা শব্দগুলোকে সামলাতে না সামলাতেই চোখ-কচলে পিঁচুটির অস্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে ও দ্যাখে সামনে তিলোত্তমার একরাশ ভালগার ছবিঃ পাকা রাস্তার পাশেই প্যাঁচপ্যাঁচে কাদার বাদামি-কালো পেস্ট পিষে উত্তর-দক্ষিণে ছুটতে থাকা বুড়ো-যুবা-ছোঁড়া-ছুঁড়ির ধাক্কাধাক্কি, রিকশা সিএনজি বাসের নিজস্ব ঢঙের কর্ণ-অন্দর কাঁপানো হর্ন, হকারদের হাতে ড্যান ব্রাউনের বই, মিনারেল ওয়াটার, গরম খবরের কাগজ ব্লা ব্লা ব্লা…। এসবের ফাঁক দিয়েই মঞ্জু পড়ে ফেলে ইলেকট্রিক থাম্বার উপর আলগোছে ঝুলতে থাকা ‘শেষ চিকিৎসা’ দাওয়াখানার ছোট্ট টিনের সাইনবোর্ডঃ ‘ধাতু দৌর্বল্য’,’স্বপ্নদোষ’,’আগা মোটা গোড়া চিকন’ ইত্যাকার যাবতীয় সমস্যার গ্যারান্টিসহ সমাধান ২৪ ঘন্টার মধ্যে। এর ঠিক পাশেই জ্বলজ্বল করছে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী সুন্দরীর ঝাঁ চকচকে দীপ্র গোলাপি চেহারা।

        মেয়েটা আগের জায়গাতেই স্থির। অচঞ্চল। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখারও যেন তার কিছু নেই। যেন এই নোংরা শহরকে দু’পাশে ফেলে গন্তব্যের সুরম্য অট্টালিকায় না পৌঁছানো পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। মেয়েটার সবকিছুই যেন স্যুররিয়েল—চুলের ইতস্ততঃ ঢেউ, পোষাকের নকশায় আঁকা অচিন রূপকথার মাঠ, ডান পাশে মুখ ঘুরিয়ে থাকা প্রোফাইলে অভিজাত গাম্ভীর্য, হাতের ব্রেসলেটে রিনরিনিয়ে ওঠা মিষ্টি ক্যাকোফোনি— সব মিলিয়ে এই ঈশ্বর-পরিত্যাক্ত শহরে যেন এক ঝলক স্বপ্নদোলা হিমেল বাতাস।

 

সে-সময়-পর্যন্ত-অনাঘ্রাতা এক মধুর সুবাসে মঞ্জু নিজেকে জাগিয়ে রাখল। চারপাশের সবকিছু ব্যাকগ্রাউন্ডে চলে গেল মুহূর্তের মাঝেই। শুধু স্বপ্নের রাজকন্যা পিঠ দিয়ে ওর সামনে বসে ওকে দোলাতে থাকল সেই হিমেল বাতাসে। বাসের ভেতরের অসহ্য গুমোট গরমেও ওর কেমন ফুরফুরে আর সজীব লাগল। মেয়েটার চুলের ভেতরটা হঠাৎ-ই হয়ে গেল মেঘলা দিনের ময়নাপাড়ার মাঠ; ওই তো কৃষ্ণকলি উঠে আসছে… ওর ঠিক সামনেই চুল খুলে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল সে। ওর বুকের ভেতর গুরুগুরু মেঘের ডাক শুরু হলে কৃষ্ণকলি জানালা থেকে ওর দিকে তাকিয়ে কেমন খোলতাই হেসে উঠল- যেন হাওয়ায় উড়ে যাওয়া মঞ্জুর মনের গহীনের পৃষ্ঠাগুলোকে সে পড়ে নিচ্ছে এক কিশোরীর কৌতুহলে। মঞ্জু কী করবে বুঝে উঠতে পারে না; ওর মুখ সদ্যোজাত খরগোশের ছানার রঙ ধারণ করল। সেই সাথে ওর ভেতরের একটা খুশির গভীর নলকূপ যেন উদ্বোধন করল ও নিজেই। জগৎ কী মায়াময়! কী ঐশ্বরিক দ্যুতি চারিদিকে!! এসময় কানের কাছে কে একজন বেয়াদবের মত বলে উঠল, “ভাই ভাড়াটা দিয়েন।” ভাড়া গুনতে পকেটে হাত দিতে দিতে সামনের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ঊঠলঃ রাজকন্যার সিটটা ফাঁকা; কৃষ্ণকলিও উধাও। মুহূর্তেই বুকের ভেতরটা হা হা করে উঠল…কী নিঃসীম সেই শূন্যতাবোধ…যার হয় শুধু সেই জানে।

 

গ.

সিন্ডারেলা

একটা পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বে জলছে রোগা আলো। মাঝারি আকারের ঘরটার দু’পাশে দেখা যাচ্ছে দুটো খাট। ঘরের এক কোণায় উঁই খাওয়া ঝুরঝুরে কাঠের গুঁড়া ছড়ানো একটা টেবিল। তার উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দুইটা চুল জড়িয়ে থাকা চিরুনি, একটা পাউডারের বাক্স, একটা লিপ্সটিক মোছার ত্যানা কাপড়ের টুকরা, আর একটা অডিও ক্যাসেট।
        ঘরের খাটের মাঝখানে হেঁটে ঢুকতে গিয়ে ওকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যায় মঞ্জু। ও বসে আছে বাঁ দিকের খাটের মশারির স্ট্যান্ডের চৌকোনা ঘেরাটোপে। ওপরে সেই আদ্দিকালের একটা হলদেটে ফ্যান ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছে।ওর হাতে অলস ভঙ্গিতে পড়ে আছে একটা বাক্স মার্কা রেডিও। ও ক্রমাগত নব ঘোরাতে থাকায় এক স্টেশানে বাজতে থাকা ‘রূপ দেখে তোর হইয়াছি পাগল’ শিস কেটে ভেঙ্গে পড়ে পরের স্টেশনের আবহাওয়া সংবাদেঃ “আজ রাতে হাল্কা থেকে মাঝারি ধরণের বর্ষণ হতে পারে।‍”
        মেয়েটা উঠে এসে আমার মঞ্জুর হাত ধরে বিছানায় ওর পাশে বসায়। কোন আড়ষ্টতা নেই ওর ব্যবহারে। ঘরের রোগা আলোয় একটা ভীষণ-মন-খারাপ রেশ। সোঁদা একটা পুরানো গন্ধ নাকে এসে লাগে। মেয়েটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রেডিওটা বিছানার একপাশে রেখে হাসে। ছড়ানো এলোচুলে বালিশের উপর রাখা একটা চিরুনি চালিয়ে নিজেকে একটানে প্রস্তুত করে নেয়। ওর পরনে কমলা-রঙা একটা কামিজ। বুকের মসৃণ ঢেউয়ের আবেদন অচঞ্চল, নিভৃত। সামনে ঝুলে থাকা চুলের গোছা মুঠির মধ্যে নিয়ে ছুড়ে দেয় পেছনে। ঠোঁটের দুই কোণায় একটা আবছা হাসি,  ঘষা কাঁচের মত ম্লান। দেখেই মন কেমন করে ওঠে মঞ্জুর; হঠাৎ-ই খুব নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। কেমন সময়হীন মনে হয় সবকিছু- একটা আত্মা ঘিরে ধরা নিঃসঙ্গতা যেন ঘড়ির ভেতরে ঢুকে সময়ের প্রত্যেকটা কাঁটাকে ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলছে। রঞ্জুর কেমন পিপাসা পেয়ে যায়, অস্থির আর ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে। 

        ৯ টাকার লাক্স মিনিপ্যাক সাবানের গন্ধে কেমন একটা চেনা-অচেনা আবেশ—মগজের কোণা থেকে হারিয়ে যাওয়া বহুদিনের একটা গন্ধ সাবানের গন্ধটার সাথে মিশে যায়। করোটির ভেতরের অন্ধকার ঘরের হলুদ আলোকে কেমন কালচে করে তুলেছে। মনে পড়ে মঞ্জুদের পাশের বাসায় থাকতেন রিক্তা আপারা। মঞ্জু তখন স্কুলে পড়ে। রঞ্জুকে ডাকতেন “সুজয় চপ্পর” বলে যার অর্থ মঞ্জু আজো জানে না। শীতের সকালে উনাকে দেখা যেত এই মেয়েটার জামার মতো একটা কমলা-রঙা জামায়। উনি কারণে অকারণেই হাসতেন। এক সকালে মঞ্জুকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে উনি ছাঁদ থেকে হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ্যাই সুজয় চপ্পর। ছাদে আয়।” ও ছাদে যাওয়ার পর উনি উনার চুল বাতাসে দুলিয়ে বলতেন, “জানিস আমার না একটুও শীত করে না। কেন করে না বলতে পারলে তোর জন্য একটা পুরস্কার আছে”। আবার মাঝেমাঝে খুব গম্ভীর আর আত্ম-নিমগ্ন হয়ে যেতেন। উনার তখন বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। একদিন ভোর বেলা ছাদে জগিং করতে উঠে রঞ্জু দেখল রিক্তা আপা কেমন মূর্তির মত বসে আছেন। মঞ্জুকে দেখেও মনে হয় চিনতে পারলেন না।তখন উনার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এর তিন দিন পর উনি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। পারেন নি। পেরেছিলেন বিয়ের ৩ দিনের মাথায়। উনার শ্বশুরবাড়ি থেকে যেদিন খবরটা আসে সেদিন ওদের বেড়াল মিনি সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরলো। কেউ খাবার দিল না তাকে। আমাদের বাড়ির বারান্দায় এসে নিঃসাড় পড়ে ছিল সারাটা দিন। এই ঘটনার তিন দিন পরে রিক্তা আপার বাবা-মা আর ছোটবোন খুব ভোরে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। উনারা যাওয়ার সময়ে কাউকে ঠিকানা দিয়ে যান নি।

        মেয়েটা উঠে এসে মঞ্জুর হাত ধরে বিছানায় ওর পাশে বসায়। খুবই আড়ষ্ট হয়ে যায় মঞ্জু। কথা বলতে পারে না। সমস্ত শরীর যেন জমে শক্ত হয়ে গ্যাছে। মেয়েটা মঞ্জুর ঘাড়ে হাত রাখে, মৃদু আকর্ষণ করে নিজের দিকে, কণ্ঠে স্বাভাবিক আমন্ত্রণ, বলে ‘আসেন ভাইয়া’। মঞ্জু সহজ হতে পারে না কিছুতেই। মেয়েটা ওর গালের কাছে মুখ নিয়ে আসলে মঞ্জুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পরপর কয়েকটা আলতো চুমু খেয়ে মঞ্জুর আড়ষ্টতা ভাঙতে চেষ্টা করে। কিন্তু এবার আরও আড়ষ্ট হয়ে যায় মঞ্জু। এই অস্বস্তির ভেতরে হয়তো অন্য কিছু ছিল। এমন কিছু যা হয়ত ও বুঝতে বুঝতেও ঠিক বুঝে উঠছিল না। মেয়েটার অকপট পেশাদারি ভঙ্গির ভেতর কী যেন খুঁজছে ও। সিনেমাটিক কিছু? ভালবাসা-টাসা নাকি? নাকি স্নেহ? কোন একটা উপন্যাসে ও পড়েছিল লালবাতি এলাকার এক পেশাদার গণিকা একটা চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলেকে তার দরজায় দেখে অবাক হয়ে ভেতরে ডেকে বসিয়েছিল। ভেবেছিল ছেলেটি ভুল পথে তার কাছে চলে এসেছিল। কিন্তু এই মেয়েটির তো এমন ভুল হওয়ার কথা নয়, ভাবে মঞ্জু। আর তাছাড়া রঞ্জু কল্পনার কোন প্রলম্বনেই বাচ্চা নয়। আর মেয়েটাও বয়স্ক গণিকা নয়। তবে সে রঞ্জুকে অমন স্নিগ্ধ স্বরে ‘ভাইয়া’ ডাকছে কেন? ‘ভাইয়া’ সম্বোধনটাকেও কেমন একটা সুদূর-পরাহত হাহাকারের মত শোনাচ্ছে। এটাও হতে পারে যে মেয়েটাই হয়তো এ পথে নতুন। খদ্দেরকে কিভাবে এ্যাপ্রোচ করবে ঠিক বুঝে পারছে না। তার চুমু খাওয়ার ভঙ্গিটা বেশ কাঁচা। পটাপট বাঁধা কিছু জায়গায় চুমু খেয়ে দ্রুত উত্তেজনা সৃষ্টি করে খদ্দেরকে এক ফুঁয়ে দপ করে নিভিয়ে দেবার ব্যাপারটা ছিল না ওর মধ্যে। নাকি ছিল? থাকলেও হয়তো সেটা শুধু মাথার মধ্যেই ছিল ‘জানা’ আকারে। 

        মঞ্জুর ভেতরে একটা ছবি ভেসে উঠতে উঠতে স্পষ্ট হতে থাকেঃ শৈশবের একটা খোলা খেলার মাঠ। খুব দ্রুত সন্ধ্যা নামছে। বাড়িতে ফিরতে দেরী হয়ে যাবে ভেবে ও একসময় দৌড়াতে থাকে। মঞ্জুদের বাড়িটা দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসলে ও দ্যাখে বারান্দায় মা দাঁড়িয়ে আছেন।       
অনেক দূরে একটা কালচে পেঁয়াজ-রঙা ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়।

 

ঘ.

শেষের গদ্য

লেখাটা শেষ করে ওর ই-মেইলে এ্যাটাচ করে একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতার ই-মেইল ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয় রঞ্জু ওরফে মঞ্জু । ‘সেন্ড’ বাটনে ক্লিক করার পরই ওর কেমন অস্বস্তি লাগতে থাকে। লেখাটা আবার ওপেন করে ওঃ  টুকরো টুকরো গল্পের দাঁড়ি-কমা দিয়ে আলাদা করা বাক্যগুলোকে কেমন অচেনা লাগে ওর কাছে। যেন একটা বিস্তীর্ণ জীবন বিছিয়ে আছে পাতার সাদা পাতায়। ও নিজেকে প্রশ্ন করেঃ এসব ঘটনা কি সত্যিই আমার জীবনে ঘটে গেছে? লিখিত অক্ষরে বিছিয়ে থাকা ঘটনাগুলো যেন ওর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন প্রশ্ন তুলছে যে ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দেয়া হল না কেন; ওরা তো রঞ্জুর মগজের অন্ধকারেই নিরুপদ্রব ছিল; এভাবে ভাষা-বন্দী হয়ে পাঠকের চোখে নগ্নভাবে বিকোতে চায় নি। উপরন্তু,ভাষার প্রকাশক্ষমতা সীমিত। সেই সীমিত ক্ষমতায় যা কুলোয় না তাকেও ভাষাবন্দী করতে চায় তার অথর্ব শুঁড় দিয়ে; ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে শুঁড় পেঁচিয়ে মেরে ফেলে। নিজের অক্ষমতার ব্যাপারটা প্রকাশ্য হয়ে পড়া ভাষার একেবারেই পছন্দ নয়। আর ঘটনাগুলো শেষ পর্যন্ত আটকা পড়তে হলো এই ভাষার ভেতরেই। আর কোনদিন তাদের আদি কোমলরূপে ফেরা হবে না। লেখাটা প্রকাশিত হলে পাঠকের দৃষ্টি ওদের ভাষা-বন্দী শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিছলে যাবে। এই দৃষ্টির কোন কোনটা হবে প্রখর রৌদ্রের মত গনগনে, আবার কোনটা ফ্রিজে রাখা পায়েশের মতোই বিস্বাদ-শীতল, কোনটা বা আবার বিদ্রুপের পশমে মোড়া। ওরা আসলে এরকম পড়ে ফেলা ছিন্নপত্র লেখা হতে চায় নি। ওরা রঞ্জুর মগজের শিরা-উপশিরার রক্তের উষ্ণতার আঁচেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিল।

        রঞ্জুর ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তিকর উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মনে হয় ও ওদেরকে এভাবে লিখে ফেলে খুব অপরাধের কাজ করে ফেলেছে; প্রকাশের পর পাঠক-সমালোচকেরা তাঁদের বিশ্লেষণের ছুরির নিচে শুইয়ে ওদের কাঁটা-ছেড়া করবে। আর এই ময়নাতদন্তের ভেতর দিয়েই রঞ্জু হয়ত খ্যাতির আকাশে তারকা- নক্ষত্র হয়ে উঠবে। অন্ততঃ ও তাই হয়ে উঠতে চেয়েছে। নিজেকে রঞ্জুর মাছির মতো খুব লোভী আর পানির মতো শস্তা মনে হয়।

        বাইরে ঝড়ো হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দে ভিজে একসা রাতটাকে কেমন ক্লান্ত আর অসহায় লাগে। যেন এই নিরন্তর জল-হাওয়ার ভেতরে মুখ নীচু করে ভিজে যাওয়াটাই রাতটার নিয়তি।

শেয়ার