নতুন কবিতার সন্ধানে | মাসিয়াত জাহিন

ঘড়ি

 

সন্ধ্যাবেলার কোন এক সময়ে তীর্যক ভ্রূর মতন একজোড়া বাতি একটানা গল্প করতেছে। 

 

এত গল্প জমা রাখতে না পাইরা বিষণ্ণ অন্যান্য প্রাণীরা।

 

একটা কুত্তা কিছুক্ষণ শুইনা হাঁইটা যায় দূরে,

শোয় গুটিশুটি।

বেজির মতোন কিছু একটা ছুইটা গ্যালো; একটা বয়ঃসন্ধি বালিকার মতন।

ক্ষুদ্রতার বোধ পরিস্ফুটনের সময় তো।

 

তাদের ছায়ায় অবিরাম কথকতার বর্ষণ। 

 

এইখানে থাইমা যাওয়ার প্রবল ইচ্ছায় আমি দাঁড়ায় আছি

রক্তমাংস নিয়া

একটা দালানসম রাবার দিয়া পৃথিবীর সকল পুস্তক থিকা মুইছা যাইতেছে

 

ঘড়ি আবিষ্কারের ইতিহাস।

 

 

বোধ

 

একটা গভীরতম বোধের অনুসন্ধানে

কতকগুলো শব্দ হাতে নিয়ে যদি কবিতা বলে ডাকি

কিছু পুরনো বাক্য যেমন

মানুষ ভালোবাসার কাঙ্গাল” বা “জীবে দয়া করো”

স্মিত হাসি দেবার জন্য নাকমুখ অনুসন্ধান করে।

 

আমরা কেউ নিজেদের বা বাক্যসমাজের হাসিকান্নার মানে বুঝতে পারিনা

ঠিক কবে থেকে

সেই চিন্তা আমাদের মধ্যে খালি কয়েকজনকে শনশন বায়ুর মতো ঝাপটা দেয়

যখন বাকিরা পলিথিনের উপর দিয়ে চুমু খায়।

 

কারো তৃপ্তির হাস্যের মুখে আমরা নিতান্ত খাদ্য নিয়ে গেছি 

আর সাইকেলের চাকার মত ঘুরতে ঘুরতে কোনদিকে চলছি তা খুব একটা ভাবার উপায় নাই।

সামুদ্রিক ঝড়ের মাঝে বসে স্থিরতার ওকালতিও করি না।

 

এখনো খেত থেকে ধান তুলি আমরা এবং

কবিতায় এক তীব্র অনুভূতি যোগানোর জন্য আত্না নিংড়ে ফিরি।

 

নিজের জন্য করুণা বোধ করতে করতে

মানুষ থামে এ কথা ভুল; প্রধানতঃ চলা হয়।

 

চাঁদ বা তারা এর মধ্যে নিভে যাচ্ছে

ফ্লুরোসেন্ট বাতির তলে।

 

হতে পারে যে

পৃথিবীর কেন্দ্রে বসে সত্যি কিছু মায়েরা

আমাদের নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে

আর আমরা ভাবছি সেখানে কেবল জ্বলন্ত-গলন্ত লাভা।

 

শরতের বাতাসে বসে

অজানা বিড়ালের সাথে ঘন্টাখানেক গল্প করে যে

তার জন্য আমি দশ রাত জেগে থাকবো।  

আর মনোরাজ্যে কিছু দার্শনিক ঘুমিয়ে নেবে

বইয়ের আলমিরা পাকাপোক্ত করতে করতে।

 

 

ভোর

 

চেয়ারটা এমন এক ক্লান্তিতে বসে আছে

পরিত্যক্ত এই ঘরের মাঝখানে

একটা ভগবানের মতোন;

বিগত অধিবাসীর ফেলে যাওয়া অসুখগন্ধ যায় নাই এখনও

 

চারিদিক রোশনাই করে মৃদুচালে আসতেছে ভোর,

একটা চড়ুই পাখির ডিম এরমধ্যে ঘর থেকে মাটিতে পড়ে ফেটে গ্যালো

 

গোলাকার পৃথিবীর এই পথেই মানুষটা হাঁটতেছে

 

(এই দৃশ্যের মুখে গৃহিণী কাপড় মেলে দিতে দিতে ভাবলো তার বোহেমিয়ান স্বপ্নভঙ্গের কথা,

ঈর্ষান্বিত ঢুকে গ্যালো মাংসের গন্ধের মতো মাংসঢিপীতে;

ঈর্ষাও হারায় যায় পলকেই;

যেহেতু এখানে পিঁপড়েরা দলবেঁধে গান করলে খালি নবজাতকই আঁচ করতে পারে।

 

আর ওইযে বাড়ন্ত কিশোরের কাছে

এ দৃশ্য নব বাতায়ন; আত্নার তল্লাটে ঝাপটা বাতাস।)

 

সূর্য নামক হারিকেন তার আঁচ বাড়াতে বাড়াতে পর্যায়ক্রমিক আলো ফেলতেছে মানুষটার উপর;

আর

উন্মোচিত হইতেছে সবকিছু

আর

উন্মোচিত হইতেছে না কিছুই

এই দৃশ্য দেখতে দেখতে

ওই চেয়ারটা নিজস্ব নাটবল্টু খুলে সচেতনভাবে নামতেছে অগ্যস্ত যাত্রায়।

 

তার আগে

অন্তিম মুহূর্তব্যাপী হাওয়া বাতাসের জন্য

ব্যক্তিগত মহাকাল নিয়ে সে স্ফীত হয়,

হয় উদ্বাহু

কী নিদারুণ রসে

কি সকাতর রসে

 

ভোর;

ভোরের মতো মৃদুচালে আসে

 

আসে।

 

 

স্বস্তি 

 

পেন্সিলে কলমে যুদ্ধ করে।

কলমদানির আশেপাশে টুকরা টুকরা গানের কথা জমা হয়।

বারান্দা থেইকা ঘর, ঘর থেইকা বারান্দা, অস্থিরভাবে পায়চারি করি আমি।  

খপখপ কইরা কিছু কথা ধইরা ফেলি।

হাতের ফাঁক দিয়া সুর পইড়া যায় তারপরও। 

যুদ্ধ থাইমা যায়। 

কলমদানির গুড়া গুড়া গ্রাফাইটের মধ্যে গুটিসুটি ঢুইকা পড়ি।

 

সমস্ত ঘর তখন হাফ ছাইড়া বাঁচে।

সনোগ্রাফের সুর আর বারান্দা বায়া আসা গোটা অচলার সুর মিলামিশা ঘর ভর্তি হইয়া যায়। 

একটা একক ঘর হয়। 

ঘর হাফ ছাইড়া বাঁচে। 

 

আমার কথা হইলো

জন্ম থেইকা সনোগ্রাফ পর্যন্ত মানসের নৈরাজ্য কেন।

কোষে কোষে ঝাপটানো পাখার কুচকাওয়াজ কেন।

প্রবৃত্তির সাথে চেতন কেন।

 

অনেকদিন আগে আমার তার্পিনের তেলে পালিশ করা রঙের দেয়ালে

একটা প্রজাপতি মুখ থুবড়াইয়া পড়ছিলো।

সারারাত আমি উপেক্ষা কইরাও উপেক্ষা করতে পারলাম না তারে।

ঘুমের মধ্যে মনে হইতে থাকলো,

একটা সমস্যা

সমস্যাটা আমার না।

কিন্তু একটা ছটফটান প্রাণ; একটা সমস্যা

নিদ্রার পর পর দেখি,

ডানা ঝাপটায়া একটা ছোটাখাটো বৃত্তের মধ্যকার বাতাসে,

প্রচণ্ড আলোড়ন তৈরি করতে করতে, প্রজাপতির দেহান্ত হইলো।

 

একদলা স্বস্তির বাতাস ত্যাগ করার পর,

আমি নিজেরে তিনপাঁচ দিন ঘৃণা করছিলাম।

 

কিন্তু আমার ঘর কেন হাফ ছাইড়া বাঁচে তার সমাধা হয়া গেল।

 

 

বৃষ্টি দেখা

 

তিনটি সাদাকালো কবুতর;

লাল পা যাদের

পাশের বাড়ির ছাদ উপরি ছাদে

এমন চঞ্চলভাবে নাচছে

আর ছড়াচ্ছে সুবাস

অদেখা বনময়ূরীর রক্তে জোনাকির

বাতাসের মতো মিশ্র লাগে।

আশপাশের কিছুই আর অত চঞ্চল নয়।

অত্যগ্রভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে

আমি বৃষ্টিই দেখছি;

কিছুকেই সরাসরি দেখা যায় না বলে।

 

হাতেরা এমন নিভৃতে প্রসারিত

যেন অসাড়।

আর বুঝতে পারছি যে

দেহ বা চোখ সরিয়ে নিলেও

বায়বীয় সিনেমার রিল হয়ে সেপটে থাকবে 

এ দৃশ্যের প্রবাহ

বাস্তবতার অহমের মুখেও

কিছুক্ষণ

কিছুক্ষণ।

এভাবেই জানতে পারি

এটি জীবনের আরেকটি নিদারুণ দেখা।

 

যে জীবন প্রাণ ও মিথ্যার

যে জীবন জড় ও সত্যের।

 

তিনটি সাদাকালো কবুতর;

লাল পা যাদের

হঠাত উড়ে গেলে আমি

বৃষ্টির মুখের উপর

জানলা আটকে দেই।

কিছুকেই সরাসরি দেখা যায় না বলে।

শেয়ার