তারাদের ঘরবাড়ি ১৪
স্নান সেরে ইন্দিরা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেখানে রবীন্দ্রনাথ জেগে আছেন। ছবিটার কাচে ইন্দিরার ছায়া পড়ে। চেয়ারে বসে পড়ে ইন্দিরা। দুহাত জড়ো করে চোখ বন্ধ করে সে। মনে মনে বলে, “আমি ফিরে যেতে চাই না, আর যাই হোক, আমায় যেন ফেরত না যেতে হয়।” চোখ খোলার ঠিক আগের মুহূর্তে ইন্দিরা এক ঝলক সেই শান্ত চোখ দুটো দেখতে পায়। চোখ খুলতে সে দেখে সাদা দাড়ি-গোঁফ সমেত রবীন্দ্রনাথ তার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই প্রথম, জীবনে এই প্রথমবার ইন্দিরার মনে হয়, গম্ভীর নন, দাড়ি-গোঁফের আড়ালে রবীন্দ্রনাথ আসলে হাসছেন। ইন্দিরা অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঝকঝকে অফিসটা যেন আরো বেশি করে আলো উগড়ে দিচ্ছে ইন্দিরার চোখে। বেশিক্ষণ সেই ঔজ্জ্বল্য সহ্য হয় না তার। ইন্দিরা দেখে এক্সামিনেশন রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই যে যার মত স্টাডি ম্যাটেরিয়াল বা নোটস পড়তে ব্যস্ত।
রুবাঈ জিজ্ঞেস করে, “ভয় করছে?”
ইন্দিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
“ভেবো না, আমি শুনলাম একবারে পাশ করতে না পারলে আরো একবার ওরা এক্সামে বসার সুযোগ দেয়।”
ইন্দিরা কিছু বলে না।
“দেখ কতটা পারো, যদি না হয় আরেকটা সুযোগ তো আছেই”
“আমি আজ পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় ফেল করিনি রুবাঈ।”
ইন্দিরা দেখে রুবাঈ তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।
“হাসছো?”
“পরীক্ষাটাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে এক-দুই বার ফেল করা প্রয়োজন ইন্দিরা। কেন পরীক্ষাটা নেওয়া হচ্ছে, নাহলে তার মূল্যায়ন হয় না। তুমি তো জীবন বোঝো, এ-ও সেইরকমই।”
ইন্দিরা রুবাঈয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে,- সে জীবন বোঝে?!
একসময় একজন ইনভিজিলেটর এসে তাদের ভিতরে নিয়ে যান।
দূরে দূরে বসে আছে সবাই। একটা টেবিলে একজন করে। সামনের কম্পিউটারে হিরণ যেমন বলেছিল, তেমন শুধু পরীক্ষার উইন্ডোটুকুই সচল। একটা দুটো প্রশ্ন দেখার পরে ইন্দিরা খেয়াল করে উত্তরগুলো তার জানা। ইন্দিরা অবাক হয়ে যায়। তার হাতের মাউস সরে না। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সে টের পায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সে জানে। কি উপায়ে ইন্দিরা বুঝতে পারে না। না বুঝতে পারায় তার সারা গায়ে কাঁটা লেগে যায়। ইন্দিরা একবার উপরে সিলিঙের দিকে তাকায়। ফলস সিলিঙের ছাদে তার চোখ আটকে যায়। একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলে ইন্দিরা। সময় শেষ হওয়ার মিনিট পনেরো আগে তার উত্তর দেওয়াও শেষ হয়ে যায়। বাকিদের দিকে তাকিয়ে ইন্দিরা দেখে তখনও অনেকে উত্তর খুঁজে চলেছে। আনন্দীর দিকে তাকাতে তার সাথে আনন্দীর চোখাচুখি হয়। ইশারায় আনন্দী তাকে জিজ্ঞেস করে শেষ হয়েছে কি না। ইন্দিরাও উত্তরে ইশারায় হ্যাঁ বলে। তারপর সে হিরণ আর রুবাঈয়ের দিকে তাকায়। রুবাঈকে নিশ্চিন্ত আর হিরণকে চিন্তিত দেখায়। মিনিট পনেরো পর পরীক্ষা শেষ হতে সবাই বাইরে চলে আসে।
বিভিন্ন প্রশ্ন ও তার সম্ভাব্য উত্তর নিয়ে সবাই যখন জল্পনায় ব্যস্ত, রুবাঈ ইন্দিরাকে জিজ্ঞেস করে, “এবারো ফেল করছ না, তাই তো?”
ইন্দিরা হেসে ফেলে, বলে, “শংকা কম।”
হিরণ তাদের দুজনের উদ্দেশে বলে, “রেজাল্ট আউট হতে এক ঘণ্টা মত বাকি, চলো লাঞ্চ করে আসা যাক।”
লাঞ্চ টেবিলে কেউই সেরকম কথা বলে না। ইন্দিরা বোঝে সবাই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে চিন্তিত। অনেকেই ক্ষুব্ধ স্টাডি ম্যাটেরিয়াল থেকে প্রশ্ন না আসায়। আনন্দীর থেকে জানা যায় ট্রেনার কোনো একদিন ক্লাসে এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। ইন্দিরা দেখে দুশ্চিন্তায় হিরণ ভরা প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে। অদ্ভুতভাবে তারই সেরকম চিন্তা হচ্ছে না। কিভাবে যেন ইন্দিরা জেনে গেছে সে এই পরীক্ষাটায় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। লাঞ্চ শেষ হতে বাকিদের সাথে ইন্দিরা এক্সামিনেশন রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ইনভিজিলেটর এসে একটা কাগজ লাগিয়ে দিয়ে যান দরজার পাশের নোটিশ বোর্ডে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই কাগজের উপরে। কোনোরকমে উঁকি দিয়ে ইন্দিরা শুধু সবার প্রথম নামটা দেখতে পায়,- আনন্দী। ভিতর থেকে একটা আনন্দ উঠে আসে ইন্দিরার মুখে। সাথে সাথে ধাক্কা খেয়ে সে ভিড় থেকে ছিটকে যায়। একটু পরে হিরণ ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে, সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে।
“কি হল?”
“তুমি কি মিথ্যে কথা বলো?”
ইন্দিরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, “মানে?”
“পাঁচ নম্বরে তোমার নাম, কি করে!?”
ইন্দিরা নিজেও বিশ্বাস করতে পারে না, ভিড় ঠেলে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে সে দেখে সত্যিই পাঁচ নম্বর নামটা ইন্দিরা চৌধুরীর। হিরণ আটে, রুবাঈ এগারোয়। অপ্রত্যাশিত ফলে ইন্দিরা নিজেই অবাক হয়ে যায়। সাথে সাথে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে… সবুজ দেওয়ালের একটা ঘর, ছাদের পাশে, টেবিলে বসে আছে চশমা পরা একজন। তার সামনে বসা ইন্দিরা। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিঙের মোটা বই থেকে নোট তৈরি করে বলে চলেছে ইন্দিরা। সামনের মানুষটা সেই নোট নিজের খাতায় লিখে চলেছে। ইন্দিরা এক্সামিনেশন রুমের দরজার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রুবাঈ এসে তার পাশে দাঁড়ালে ঘোর কাটে ইন্দিরার।
“রুবাঈ, তোমার কি এমন কখনও মনে হয়, জীবনে আমরা যা যা শিখছি, দেখছি, করছি, তার এক কণাও ফেলনা নয়?”
“কখনও কেন, সব সময়ই মনে হয়, এই যে সকালে ঘুম থেকে উঠে শোনা কাকের ডাক, রাস্তায় বেরিয়ে ভুল করে শুনে ফেলা ভিখারির গান, বাসে যেতে যতে দেখে ফেলা দোকানের নাম, নামের ভুল বানান, সমস্ত কোনো না কোনোভাবে আমাদের জীবন যুগিয়ে চলেছে, সব কিছু একদিন আমাদের কাছেই ফিরে আসবে। আজ না হোক কাল তা দিয়ে আমরা জীবনের সেই সমীকরণটা সমাধান করে ফেলবই”
ইন্দিরা হাসে রুবাঈয়ের দিকে তাকিয়ে, “আজ আমার জীবনের একটা সমীকরণের সমাধান হল”
“যেমন?”
“মনে আছে তোমায় বলেছিলাম মামনি মানে রঞ্জনার মায়ের কথা,”
“হ্যাঁ, ওনার অসুখ করেছিল…”
“ঠিক, সেসময় আমার কোনো রোজগার ছিল না, শুধু রঞ্জনার উপর পুরো দায়িত্বটা এসে পড়েছিল, তাই আমাকে এদিক-ওদিকে নানা কাজ খুঁজতে হয়, কম্পোজিশনের কাজ করতাম, তাতে কিছুটা টাকা আসত, আর টিউশনি করতাম, সারা দিন, সারা সন্ধ্যে। সাইকেল নিয়ে ক্লাস ফাইভ থেকে বি-টেক পর্যন্ত, বাংলা, ভুগোল, ইতিহাস থেকে শুরু করে জয়েন্ট এন্ট্র্যাস, ইলেক্ট্রিকাল মেশিনস, এমনকি কম্পিউটার সাইন্স অবধি, কোনো বাছবিচার রাখিনি। সকাল আটটার মধ্যে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ানো, তারপর হয় রঞ্জনার বাড়ি নাহয় মামনিকে নিয়ে হাসপাতাল, কেমো শেষ হতে ফিরে আবার পড়ানো, পড়িয়ে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরা। বছর দেড়েক টানা এই চলেছে।”
দম নিতে থামে ইন্দিরা।
“আজ হঠাৎ এসব বলছ?”
হেসে ইন্দিরা বলে, “বি-টেকের যে ছাত্রটিকে পড়াতাম, সে জানত আমি মাস্টার্স করছি, লাইব্রেরী থেকে বই তুলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিঙের নোট তৈরি করতাম রাত জেগে, পরদিন সকালে গিয়ে শুধু নোটটুকু বুঝিয়ে দিতাম, সে মাঝারি রেজাল্ট করেছিল সেই সেমেস্টারে। আমি তার কথা একেবারেই ভুলে গেছিলাম। কেন যে আমি সব ভুল যাই… কে জানে, আজ প্রশ্নগুলো দেখে ভিতর থেকে যেন উত্তরগুলো বেরিয়ে এল!”
ইন্দিরার কাঁধে হাত রাখে রুবাঈ। মুখে কিছু বলে না।
পিছন থেকে আনন্দী বলে, “আজ তাহলে পার্টি হোক…”
ইন্দিরা পিছু ফিরে দেখে হিরণ আর আনন্দীও তাদের কথোপকথন শুনছিল এতক্ষণ, সে টের পায়নি। ইন্দিরা হেসে বলে, “হ্যাঁ, আর স্পনসর আমি করব।”
“জ্যেঠু, দাদাকে দেবে একটু…”
মিনিট খানেক ডাকার পর পিকলু ফোন তোলে, “বল”
“অ্যাসেসমেন্ট ছিল আজকে, পাশ করেছি”
“আচ্ছা”
“তুই এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পথে মন তৈরি করার কথা বলছিলি কেন?”
“কখন?”
“এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে, বাস থেকে নামার ঠিক আগে বললি…”
“মনে নেই”
ইন্দিরা বোঝে পিকলু উত্তর দিতে চাইছে না।
ওপাশ থেকে ধীরেশের গলা শোনা যায়, “ও ঘরে চলে গেল বুঝলি, কিছু বলতে হবে?”
“না, থাক, তোমরা কেমন আছো? জয়তীর সাথে অনেকদিন কথা হয় না”
“জয়তীর শরীরটা ভালো নেই কদিন”
“কি হয়েছে?”
“মেনোপজ শুরু হয়েছে মনে হয়”
“আচ্ছা, ডাক্তার দেখালে?”
“হ্যাঁ, উনিও এটাই প্রেডিক্ট করছেন। আর তোর বাবার কাছে…” ধীরেশ চুপ করে যান।
“বাবার কাছে কি?”
“একটা ফোন এসেছিল এর মধ্যে”
“কার ফোন?”
“তোর মা… ভাস্বতী ফোন করেছিল”
ইন্দিরা চুপ হয়ে যায়। হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে তার। ইচ্ছে হয় আনন্দীর মত সেলফোনটা ছুঁড়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে।
“হ্যালো, হ্যালো, কেটে গেল?”
“না, বলো”
“আমিই ধরেছিলাম ফোনটা, সরাসরি বলল তোর বাবার সাথে কথা বলতে চায়, আমায় জিজ্ঞেসও করল না কেমন আছি বা অন্য কিছু…”
“তুমি কেন আশা কর যে উনি জানতে চাইবেন?”
“স্বভাব দোষে… আর কি। যাই হোক, কি কথা হল বুঝলাম না, অপরেশও তো খুলে কিছু বলে না, আর তুইও তোর বাবার সাথে কথা বলবি না ঠিক করেছিস। আমার আর ভালো লাগে না। জয়তী যদি ঠিক থাকত, আমরা দুজন মিলে বেনারস চলে যেতাম আমার রিটায়ারমেন্টের পরেই।”
ইন্দিরা কিছু বলে না। ফোন রেখে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়।
একটু দূর থেকে হিরণ ডাকে ইন্দিরাকে, “এই দাঁড়াও! আজকে এটা ট্রাই করবে?”
ইন্দিরা দেখে হিরণের হাতে একটা হুকাহ স্ট্যান্ড, ইন্দিরা বলে, “কি করে অ্যারেঞ্জ করতে হয় জানি না… তুমি জানো?”
“হ্যাঁ, তুমি নেবে কিনা বলো।”
চারকোল, ফ্লেভার, পাইপ এবং কিটসহ কিছু হার্ড ড্রিঙ্কের বোতল নিয়ে ইন্দিরা আর হিরণ বেরিয়ে আসে এমআরপি দোকানটা থেকে। রুবাঈ আজ আনন্দীর সাথে কিছু একটা রান্না করবে বলে আগেই অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেছে।
অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে ভিতরে আসতেই কেকের গন্ধে ইন্দিরাদের মন ভরে যায়। কিচেনে উঁকি দিয়ে ইন্দিরা দেখে প্রেসার কুকার বসানো রয়েছে গ্যাসে। আনন্দীর ঘরে নক করতে দরজা খুলে যায়, বিছানার উপর রুবাঈ আর আনন্দী উনো কার্ড ছড়িয়ে বসে আছে।
আনন্দী ইন্দিরাকে উনো খেলার নিয়ম শেখাতে শুরু করে আর হিরণ এক পাশে বসে হুকাহ স্ট্যান্ড তৈরি করতে থাকে। স্ট্যান্ড তৈরি হয়ে এলে এক বুক ধোঁয়া ছেড়ে স্ট্যান্ডটা রুবাঈয়ের দিকে এগিয়ে দেয় হিরণ। রুবাঈ কিছুটা টেনে ইন্দিরার হাতে দেয় পাইপ, চোখ বুজে বুক ভরে শ্বাস নেয় ইন্দিরা। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে তার, মিষ্টি স্বাদ গলা ছেয়ে যায়। ইন্দিরা পাইপটা আনন্দীর দিকে এগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর কেক নিয়ে আসে রুবাঈ। গ্লাসে গরম পানীয় ঢালা হয়।
হিরণকে কিছুতেই উনোর নিয়ম ঠিক মত বোঝানো যাচ্ছে না। একটা সময় পর অধৈর্য হয়ে হিরণ সবার কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে সব ওলটপালট করে দেয়। হতোদ্যম হয়ে কেকে কামড় বসায় রুবাঈ, ইন্দিরাকে বলে, “একটা গান করো, শুনি”
হাতের গ্লাসটা চট করে গলায় ঢেলে ইন্দিরা গেয়ে ওঠে, “আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা…”
ইন্দিরার চোখ বুজে যায়। গাইতে গাইতে সে টের পায় হোলির দিন মন্দিরে বসে যেমন দুলুনি এসেছিল, ঠিক তেমনই শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ছন্দ উঠে আসছে ইন্দিরার মাথায়। চোখ বুজে গাইতে গাইতে ইন্দিরা টের পায়, শুধু এই গানটা ছাড়া আর যেন কিছু কোথাও নেই। ইন্দিরার কান্না পেয়ে যায়। কোনোরকমে নিজেকে ধরে রেখে গানটা শেষ করে চোখ খোলে সে। দেখে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইন্দিরার খেয়াল হয়,- বাকিরা কেউ বাংলা বোঝে না।
“সরি… আমি ভুলে গেছিলাম তোমরা বাংলা বোঝো না।” ইন্দিরা দেখে আনন্দী তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
“sometimes I find you so weird, you know…”, মন দিয়ে ধোঁয়া টানে হিরণ।
ইন্দিরার লজ্জা করে হঠাৎ।
রুবাঈ বলে, “কোনো ব্যাপার না, আমরা মোবাইলেই গান শুনি আজ, আনন্দী, রাতের খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দাও।”
হোম ডেলিভারি অর্ডার দিয়ে আনন্দী বলে, “কাল থেকে আমাদের সবার প্রজেক্ট শুরু, I wish us all best of luck for our professional life!”
নিজেদের ভবিষ্যতের উদ্দেশে পান করে তারা।
হিরণ বলে, “জানো তো, আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম…”
রুবাঈ জিজ্ঞেস করে, “তারপর?”
“আমি রক্ত দেখলেই অজ্ঞান হয়ে যাই, তাই আর হওয়া হলো না”
হেসে ফেলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় রুবাঈ।
আনন্দী বলে, “আমি ব্যবসা করতে চেয়েছিলাম”
হিরণ জিজ্ঞেস করে, “কিসের?”
“ট্যুরিজমের, বাবার হোটেলের সাথে টাই আপ করে, কিন্তু…”
রুবাঈ জানতে চায়, “কিন্তু?”
“বাবা আমার সাথে বিজনেস শেয়ার করবেন না বলে দিয়েছেন, কারণ আমি নাকি whimsical… আমার মতির ঠিক নেই”, ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে বলে আনন্দী।
হিরণ বলে, “উনি এরকম মনে করেন কেন?”
রুবাঈ তাকে থামিয়ে দেয়। ইন্দিরা দেখে আনন্দী তার দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। ইন্দিরা তাকে বলে, “তুমি চাইলে এখনও ব্যবসা শুরু করতে পারো”
“কিভাবে?”
“ইন্ডিপেন্ডেন্টলি, তোমার বাবার হোটেলের সাথে টাই আপ না করেই, নিজে থেকে, শুধু ট্যুরিজমের ব্যবসা, একবার যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পারো, তোমার বাবা নিজেই এগিয়ে আসবেন তোমার দিকে”, পাইপটা মুখে লাগায় ইন্দিরা।
অ্যাপার্টমেন্টের বেল বেজে ওঠে। রুবাঈ উঠে যায় খাবার আনার জন্য।
হলঘরে মেঝেতে রুটি সবজি নিয়ে বসে চারজন।
চুপচাপ খেয়ে চলেছে আনন্দী। হিরণ আর রুবাঈ আগামীকালের অফিসের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছে। খাওয়া থামিয়ে হঠাৎ আনন্দী ইন্দিরাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি হতে চেয়েছিলে ইন্দিরা?”
রুটিটা প্লেটে নামিয়ে রেখে ইন্দিরা একটু ভাবে, তারপর বলে, “খুব ছোটোবেলায় ভাবতাম বিজ্ঞানী হব, তারপর হাইস্কুলে উঠে ভাবতাম অধ্যাপনা করব, কলেজে ওঠার পর ভাবলাম লিখবো, আপাতত এখানে এসে পৌঁছেছি।”
“it’s not bad, right?” হিরণ জানতে চায়।
ইন্দিরা কিছু জবাব দেওয়ার আগে আনন্দী আবার জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখন কি হতে চাও?”
হিরণ বলে, “হতে চায় মানে? She is already a professional now!”
“লেখক… আমি লিখতে চাই”, ইন্দিরা জবাব দেয়।
“লিখে কি টাকা পাও ইন্দিরা?” হিরণ বলে।
“না, আমি যা লিখি তাতে অর্থ আসে না, নামও হয় না। কিন্তু…”
“কিন্তু কি?” আনন্দী বলে।
“আমি যখন লিখি তখন আমি “আমি” হয়ে যাই।”
“মানে?” ইন্দিরা দেখে, হিরণের হাতে রুটির টুকরো ধরা, তার থেকে টপটপ করে সবজির ঝোল তার প্লেটে ঝরে পড়ছে।
“ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না এটা…”
“একটা উদাহরণ দাও…”, আনন্দীর কথা শুনে তার দিকে তাকাতে ইন্দিরা দেখে আনন্দীর চোখে অপূর্ব এক মোহ ফুটে আছে।
ইন্দিরার সারা গা শিরশির করে ওঠে। একটু ভেবে সে বলে, “একটা গল্প, সারারাত জেগে হঠাৎ করে লিখেছিলাম। হঠাৎ করে বলা ভুল হবে, একবার শিয়ালদহ স্টেশনে কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম অনেকক্ষণ ধরে, দেখলাম একটা রেলশিশু একটা ফ্রুটির প্লাস্টিকের বোতলে লাথি মেরে মেরে খেলে বেড়াচ্ছে এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে। গল্পটা তখনই মাথায় এসেছিল। তারপর একদিন সারারাত ধরে লিখলাম গল্পটা। আর লেখার পর…” ইন্দিরা থেমে যায়। ভাবে বাকিটা বলা উচিৎ হবে কিনা। রঞ্জনার গলা আবার তার কানে বেজে ওঠে, “কারোর সামনে নিজেকে নগ্ন করা চলবে না।”
“তারপর?”, আনন্দীর চোখে হঠাৎ করে আটকে যায় ইন্দিরা।
সে বলে চলে, “গল্পটা লেখা হতে আমি কেঁদে ফেললাম। মাঝরাতে, ওরকম কান্না, অকারণে বা এমন কোনো কারণে যা আমি নিজেই জানি না, কেন পেল কে জানে। ভোর হতে আমি আমার এক খুব কাছের মানুষকে ফোন করলাম, গল্পটা শোনাবার পর তাকে বললাম আমার কান্না পাওয়ার কথাটা, তার কোনো ব্যাখ্যা তার জানা আছে কি না জানতে চাইলাম। ওপাশ থেকে সে সেদিন কিচ্ছু বলেনি। চুপ করে ছিল। আর গল্পটার নাম দিয়েছিল, নামহীণ রূহ্।”
খাওয়া শেষ হতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে হিরণ বলে দিয়ে যায়, “চারকোল এখনও বাকি আছে, তোমরা শেষ করে দিও।”
অ্যাপার্টমেন্টের দরজা আটকে দিয়ে ইন্দিরা আনন্দীর ঘরে আসে। সে দেখে বিছানা ঠিক করে আনন্দী হুকাহ স্ট্যান্ডটা বিছানার একদিকে সরিয়ে রেখেছে। বিছানায় বসে কাঠি দিয়ে চারকোলে আরও একটু আগুন লাগিয়ে ইন্দিরা পাইপটা মুখে লাগায়। আর তখনই আনন্দী বেরিয়ে আসে ঘর লাগোয়া বাথরুম থেকে। তার গায়ে ঘন নীল রঙের রাত পোষাক, ইন্দিরার চোখ ঝলসে যায়। সে মাথা নামিয়ে বলে, “সরি, আমি না বলে তোমার ঘরে এসে বসেছি…”
আনন্দী বলে, “Why do you apologize most of the time?”
জবাবে ইন্দিরা বলে, “আমি চাই না আমার জন্য কারোর কোনো অসুবিধা হোক”
“অসুবিধা হচ্ছে না”
ইন্দিরা দেখে আনন্দী নিজের কাঁধ অবধি এলিয়ে পড়া চুলগুলো যত্ন করে বেঁধে নিচ্ছে। ঘন নীল রাত পোষাকে তার কাঁধ, বুক এবং পিঠের অনেকটা দৃশ্যমান। ইন্দিরার অস্বস্তি হয়, সে চোখ সরিয়ে নিয়ে আনন্দীর ঘরের বাকিটুকু দেখতে থাকে। ইন্দিরার ঘরের সাথে এই ঘরের মূল পার্থক্য হল, এই ঘর অগোছালো নয়। আনন্দীর যা যা নিজস্ব কিছু আছে সব মাপমতো জায়গায় রাখা। চুলের ক্লিপ থেকে স্যান্ডেল পর্যন্ত। ঘরের দেওয়ালে কিছু ফটোগ্রাফ আটকানো আছে। আন্দাজে ইন্দিরা বোঝে সেগুলো আনন্দীর ছোটবেলার এবং তার বাবা-মায়ের ছবি। আরও যা এই ঘরে আছে, এবং ইন্দিরার ঘরে নেই, তা হল আনন্দীর সেই গন্ধটা। একটু দূরে তার মুখোমুখি আনন্দী এসে বসতে সেই গন্ধের উপস্থিতিটা ইন্দিরা আরো বেশি করে টের পায়। ইন্দিরার হাত থেকে পাইপটা টেনে নিয়ে আনন্দী মুখে ভরে দেয়। চোখ বুজে অনেকটা সময় নিয়ে শ্বাস নেয় সে। তারপর ইন্দিরার হাতে পাইপটা ধরিয়ে দিয়ে মুখ খোলে।
ইন্দিরা দেখে আনন্দীর মুখ থেকে সাদা সাপের মত ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। নিজের মুখে পাইপ লাগায় ইন্দিরা। সে দেখে আনন্দী তার দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে। যতটা সম্ভব ধোঁয়া বুকে ভরে নেয় ইন্দিরা। তারপর আনন্দীর চোখে চোখ রেখে ধোঁয়া ছেড়ে দেয়। বন্ধ ঘরে ধোঁয়ায় সবকিছু আবছা দেখায়। ইন্দিরার মাথাটা টলে ওঠে। ইন্দিরা দেখে এক হাত দিয়ে বড় আলো বন্ধ করে নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল আনন্দী। আধো অন্ধকারে, লালচে আলোয় হাতের পাইপটা আনন্দীর দিকে এগিয়ে দিতে আনন্দী ইন্দিরার কাছে সরে এসে তার হাত ধরে নিল। ইন্দিরার হাতে হাত রাখা অবস্থাতেই পাইপটা নিজের মুখে ভরে দিল আনন্দী। ইন্দিরা টের পেল তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। আনন্দী মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিল তাদের দুজনের মাঝখানে, আর পাইপটা নিজের হাতে করে ভরে দিল ইন্দিরার মুখে। আচ্ছন্ন অবস্থায় ইন্দিরা টের পেল আনন্দী তার খুব কাছে এসে পড়েছে, ইন্দিরা চোখ বুজল, এক বুক ধোঁয়া ছাড়ার জন্য ঠোঁট ফাঁক করতেই সে টের পেল তার ঠোঁটের উপর আনন্দীর ঠোঁটের নরম ছোঁয়া। ইন্দিরার মুখ থেকে নিজের মুখে ধোঁয়া টেনে নিচ্ছে আনন্দী। আনন্দীর মুখটা নিজের অজান্তে আলতো করে ধরল ইন্দিরা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ইন্দিরার। ঠোঁটে ও জিভে অনবরত পেলব স্পর্শ তার চোখ বন্ধ করে রাখে। একটা ঝিমঝিম ভাব ইন্দিরার সারা শরীরে ছেয়ে যায়। আনন্দীর দেহের ভার নিজের উপর টের পায় ইন্দিরা। আর তখনই ইন্দিরার ফোন বেজে ওঠে।
আনন্দী ছিটকে সরে যায় ইন্দিরার উপর থেকে। কোনো রকমে চোখ খুলে ইন্দিরা দেখে একটা আননোন নম্বর। ফোনটা কেটে দিতে যায় ইন্দিরা।
আনন্দী বলে ওঠে, “রিসিভ করো।”
ফোন কানে তুলে ইন্দিরা বলে, “হ্যালো”
ওপাশ থেকে কিছু নয়েজ আসে তার কানে।
“হ্যালো, শুনতে পাচ্ছি না,”
আনন্দী বলে, “বাইরে গিয়ে দেখো…”
ইন্দিরা উঠে হলঘরে চলে আসে, “হ্যালো, কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠ জানতে চায়, “আপনি কি আনন্দীর রুমমেট?”
“হ্যাঁ, আপনি কে?”
“আমি নীলেশ, আনন্দীর ফিয়ন্সে”
ইন্দিরার মনে হয় তার কাঁধে যেন পৃথিবীর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়েছে কেউ।
“হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন?”
ইন্দিরা বলে, “হ্যাঁ বলুন”
“আমি আনন্দীর সাথে কথা বলতে চাই, একটু দেবেন প্লিজ?”
“হোল্ড করুন একটু”
ধীর পায়ে ইন্দিরা ফিরে আসে আনন্দীর দরজায়। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে চাইলে ইন্দিরা বোঝে আনন্দী ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।
নীলেশের ফোন হাতে ইন্দিরা আনন্দীর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওপার থেকে বার কয়েক “হ্যালো” বলে বলে ফোনটা কেটে যায়। ঠোঁটে একটা সদ্যমৃত স্পর্শ নিয়ে ইন্দিরা একা দাঁড়িয়ে থাকে সাদা, বন্ধ একটা দরজা,- আনন্দীর দরজার সামনে।
(চলবে)
ত্রয়োদশ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন