ধারাবাহিক উপন্যাস — তারাদের ঘরবাড়ি । অলোকপর্ণা ।। নবম পর্ব

                                                          ৯

 

“কলেজের চার বছর কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনে হল আমি আর নীলের প্রতি কোনো টান অনুভব করছি না।”

ইন্দিরা জিজ্ঞেস করে, “তারপর?”

“নীলকে জানালাম, he was shocked. প্রথমে পাত্তা দিচ্ছিল না, তারপর যখন বুঝলো আমি সিরিয়াস, আমায় বোঝানোর চেষ্টা করল। তাতেও যখন কোনো ফল হোল না, আমার বাবা-মাকে জানালো। আর বোঝোই তো, আমাদের সাথে আমাদের মা-বাবার একটা জেনারেশন গ্যাপ আছে। তাই আমি আশাও করিনি যে ওরা সমস্যাটা বুঝবে। এমনকি আমাদের জেনারেশনেরও সবাই যে বুঝবে তাও না। তো মা-বাবাও বোঝেনি। নীলের হয়ে আমাকে দোষারোপ করে গেছে সবসময়।”

“হুম”

“ইচ্ছে করেই নিজের ফোন নম্বর, অফিসিয়াল মেইল আইডি বদলে ফেললাম। নীলকে কিচ্ছু জানালাম না, কারণ ওর ধারণা হয়েছিল আমি অন্য কারোর প্রেমে পড়ে ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছি। রোজ আমায় ফোন করত, একই প্রশ্ন করে যেত বারবার। তাই কথা বলা বন্ধ করতে হয়েছিল ওর সাথে। রাস্তায় বেরোলে একবার ওকে আমায় ফলো করতে ধরে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম এরপর কোনোদিন ফলো করতে দেখলে পুলিশে রিপোর্ট করে দেবো। অবস্থা হাতের নাগালে বেরিয়ে যাচ্ছে বুঝে খুব গোপনে বাড়ি ছেড়ে দিন দশেকের মধ্যে আমি ইন্টার্নশিপ করতে পুনে চলে এলাম। এমনকি বাড়িতেও আমার অ্যাড্রেস পর্যন্ত দিইনি। তিন সপ্তাহ পর অফিস থেকে ফিরছি দেখি পিজির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। কিভাবে যেন আমার খোঁজ পেয়ে গেছে! আমাকে ধরে রাস্তার মাঝে অপমান করতে শুরু করল। লোক জড়ো হয়ে গেছিল জানো!” আনন্দী থেমে যায়।

ইন্দিরা চুপ করে থাকে।

“পাশ থেকে একেক জন একেক রকম কমেন্ট করছিল। কেউ আমার চরিত্র নিয়েও কথা তুলল। আর নীল সায় দিল তাতে! ভাবতে পারো! আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নীল এইভাবে সমস্ত মানুষের সামনে আমায় কত নীচে নামিয়ে দিচ্ছে। সেদিন যে কি হতে পারতো আমি ভাবতেও পারি না, যদি সমিক আমায় দেখতে পেয়ে ওই ভিড় থেকে বের করে না আনতো। সমিক মানে যার জন্মদিনে তুমি গেছিলে। আমার দাদার বন্ধু, ও তখন পুনেতে ছিল। কি কাজে যেন আমার পিজির সামনে দিয়েই যাচ্ছিল, ভিড় দেখে কাছে এসে দেখে এই অবস্থা। সমিককে দেখে নীলের আরো ধারণা হল যে আমি ওর সাথে জড়িত। সমিককেও অনেক গালিগালাজ করতে লাগল ও। আর লোকজন মজা দেখে চলল।”

ইন্দিরার ইচ্ছে হয় আনন্দীর হাতে হাত রাখে। কিন্তু পারে না। কোথাও যেন একটা দূরত্ব রয়েছে তাদের মাঝে। খুব কাছে এসে পড়েও একটা ছোট ব্যবধান থেকে গেছে এখনও।

আনন্দী বলে, “ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে খানিকটা সামলে উঠে সমিককে সব কথা খুলে বললাম। সমিক বলল পুনেতে এভাবে থাকাটা আমার পক্ষে নিরাপদ হবে না। ও নিজেও পুনে ছেড়ে এই শহরে চলে আসছে। ও আমাকে ওর অফিসে অ্যাপ্লাই করতে বলল। তারপর তো তুমি জানোই। চাকরিটা পেয়ে যেতে এই শহরে চলে এলাম আমি।”

“তোমার মা-বাবাকে সেদিনের কথা জানিয়েছো?”

“হ্যাঁ, জানিয়েছিলাম সেইদিনই। ওরা বলল ঠিকই হয়েছে আমার সাথে। আরও খারাপ কিছু হতে পারতো। আমি মানুষের মন নিয়ে খেলেছি। তার ফল আমাকে ভোগ করতে হবে। আমি বুঝলাম মা-বাবা আমাকে কোনোদিনও বুঝতে পারবে না।”

ইন্দিরা চুপ করে থাকে।

“কিন্তু এই শহরে আসার দ্বিতীয় দিনই সন্ধ্যেবেলা স্কুলের এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছি ম্যাকডোনাল্ডসে, আমার ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। ফোন তুলতেই শুনলাম নীলের গলা। অসহ্য লাগছিল জানো। ছুঁড়ে ফেলেদিলাম ফোন। কিভাবে ও আমার নম্বর পেল জানি না। ওর নম্বরটা ব্লক করিয়ে আমার বন্ধু আমাকে শান্ত করে হোটেলে পাঠিয়ে দিল। পরের দিন রাতে আবার আরেকটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন।– নীল। অকথ্য ভাষায় আমায় দোষারোপ করতে লাগলো। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে তখন আমার ইচ্ছে করছিল কোনো চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। অনেক কষ্টে সামলালাম নিজেকে। এই নম্বরটাও ব্লক করলাম। তারপর কদিন কোনো ফোন নেই। ভাবলাম হয়তো এবার সব ঠিক হয়েছে। এই অ্যাপার্টমেন্টে যেদিন এলাম সেদিন সন্ধ্যেবেলাতেই আবার একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। এবার নীল আমাকে থ্রেট দিল, আমি ওর কাছে ফিরে না এলে নিজেকে শেষ করে দেবে। প্রচন্ড রাগ হোল আমার। রান্নাঘরে এসে বোন চায়নার প্লেটটা সামনে পেয়ে আছড়ে ফেললাম মাটিতে। কাঁচি দিয়ে চুল কেটে ফেললাম। সমস্ত কিছু অসহ্য লাগছিল তখন। তারপর খেয়াল করলাম কখন যেন তুমি এসে দাঁড়িয়েছ, আর পোর্সেলিনে তোমার পা কেটে গেছে। খুব খারাপ লাগলো, অনুশোচনা হল। আর একটা জিনিস বুঝতে পারলাম।”

“কি?” ইন্দিরা জানতে চায়।

“নীলের কাছ থেকে সরে এসে আমার আজ অবধি কোনো অনুশোচনা হয়নি। অথচ তোমার পা কেটে যাওয়াতে হল। তোমার ব্যথা লেগেছে মানছি, কিন্তু এটা তো অতি সামান্য ঘটনা, অন্তত নীলের সাথে ব্রেক আপ করার তুলনায়। টের পেলাম নীলকে আমি কোনোদিন ঠিক মতো ভালোইবাসিনি।”

“তারপর?”

“তারপর আজকে আবার একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন। আমি ভাবলাম বলে দিই যে আমি কোনোদিন ওকে ভালোবাসিনি। বলে দিলাম। নীল আমাকে বলল ও আত্মহত্যা করবে, সেই মুহূর্তেই। আর নোটে লিখে যাবে, আমিই এর জন্য দায়ী। আমি আর পারছিলাম না জানো, আমিও বললাম, তাহলে আমিও সুইসাইড করি। দুজনেরই মুক্তি হবে তাহলে”, আনন্দীর চোখ জলে ভরে যায়।

ইন্দিরার ভিতরটা আবার মুচড়ে ওঠে।

চোখের জল মুছে আনন্দী বলে, “তুমি আমায় আটকে দিলে”

“না আটকে উপায় ছিল? পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা, বাংলা প্রবচন আছে একটা জানো? তুমি তো স্যুইসাইড করে বেঁচে যেতে। আর পুলিশ নাজেহাল করে বেরাত আমায়।” বাতাস হালকা করার জন্য বলে ইন্দিরা।

আনন্দী অল্প হাসে।

ভালো লাগে ইন্দিরার। একটা আরাম বোধ হয়। কিন্তু সে টের পায়, তার ভিতরে ভিতরে একটা কি যেন আটকে আছে,… নীল। নীল,- তো কি হয়েছে? বুঝতে পারে না ইন্দিরা।

আনন্দী বলে, “একটা রিকোয়েস্ট করবো,”

“বলো,”

“আমার না খিদে পেয়েছে খুব, কিছু বানিয়ে দেবে?”

ইন্দিরা বলে, “আমি তো ইন্সট্যান্ট নুডলস বা অমলেট ছাড়া কিছু বানাতে পারি না।”

“যা কিছু একটা দিলেই হবে।”

রাত দুটো নাগাদ ইন্সট্যান্ট নুডলসের প্যাকেট খোলা হয়। গ্যাস জ্বালিয়ে অপটু হাতে ইন্দিরা নুডলস বানাতে থাকে। রান্নাঘরের স্ল্যাবে উঠে বসে আনন্দী, বলে, “তুমি তো গান গাও, এই গানটা জানো?”

“কোন গানটা?”

“ছু কর তেরা মন কো?”

“হ্যাঁ, বিখ্যাত গান তো, এটার একটা বাংলা আছে, জানো? রবীন্দ্রসংগীত, তার সুরেই হিন্দিটা তৈরি”

“তাই? শোনাবে?”

“এখন? এত রাতে?”

“হ্যাঁ, গানের আবার সময় হয় নাকি…”

শাস্ত্রীয় সংগীতের সময় নির্দেশ ও অন্যান্য শুষ্ক তত্ত্বকথা তোলে না ইন্দিরা, গ্যাস ওভেনের দিকে চোখ রেখে গেয়ে ওঠে, “তোমার হল শুরু, আমার হল সারা”, একটা ভালো লাগা ছেয়ে যায় ইন্দিরার মধ্যে।

গাইতে গাইতেই ইন্দিরা দেখে আনন্দী তার ফোনটা তুলে নিয়ে তার গানের ভিডিও করছে। ইন্দিরা বোঝে আনন্দী মুহূর্ত জমাতে পছন্দ করে। রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হলে হিন্দিটাও গাইতে শুরু করে ইন্দিরা, “তু যো কহে জীবন ভর…”

ইন্সট্যান্ট নুডলস তৈরি হয়ে যায়। গান শুনতে শুনতে আনন্দী খেয়ে চলে।

গান আর খাওয়া দুটোই শেষ হলে আনন্দী বলে, “আরো একটা রিকোয়েস্ট করবো?” ইন্দিরা কিছু বলার আগেই সে বলে, “আজকে রাতটা তোমার ঘরে শুতে দেবে আমাকে? একা থাকতে ইচ্ছে করছে না।”
দূরত্বে অভ্যস্থ ইন্দিরার সংশয় হয়।
ইন্দিরার মুখের দিকে তাকিয়ে আনন্দী আলতো স্বরে বলে, “এই মুহূর্তে একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে, জানি না তুমি সেটা টের পাচ্ছো কিনা। হয়তো আমি একাই সেটা অনুভব করছি। কিন্তু আমি চাই না সেটা চলে যাক। অন্তত কাল সকাল অবধি যদি… না, তোমার যদি কোনো অসুবিধা হয়, তাহলে দরকার নেই, আমি হয়তো একটু বেশিই চেয়ে বসলাম”

একটু গুঁটিয়ে যায় ইন্দিরা, পরক্ষণেই তার মনে হয় আজ রাতে আনন্দীকে একা থাকতে দেওয়াটা সত্যিই উচিৎ হবে না, সে বলে, “কোনো অসুবিধা হবে না।”

নিজের ঘর থেকে বালিশ নিয়ে আসে আনন্দী। দুটো কুড়ি নাগাদ বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে দেয় ইন্দিরা। আনন্দী পাশ থেকে বলে, “গুড নাইট”

সে উত্তর দেয়, “গুড নাইট”, মোবাইল ফোন হাতে তুলে নেয় ইন্দিরা, দেখে একটা মিসড কল হয়ে আছে তাতে… রঞ্জনার। ভুল করেই হয়তো… ভুল করেই তো সব কিছুই… ইন্দিরা আনন্দীর দিকে ফিরে শোয়।

তার মনে পড়ে, ঘন্টা দুয়েক আগে সে সত্যিই চেয়েছিল কিভাবে আনন্দী ঘুমিয়ে পড়ে তা দেখতে। কি অদ্ভুতভাবে আজ তার পাশেই আনন্দী একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ছে। মানুষের কোন ইচ্ছেগুলো এমন হঠাৎ হঠাৎ পূরণ হয়ে যায়, কেউ জানেনা। ভাবতে ভাবতে ইন্দিরারও চোখ লেগে আসে।

 

শান্ত সেই চোখটা তাকিয়ে আছে ইন্দিরার দিকে। পলক পড়ছে না কোনো। ইন্দিরাও তাকিয়ে আছে চোখটার দিকে। এই চোখের দিকে তাকালে যে অস্বস্তিটা তার আগে হোত, সেটা আর হচ্ছে না। কিন্তু চোখটা কার সেটা দেখতে পাচ্ছে না ইন্দিরা। কারণ ওই চোখের থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিতে পারেছে না সে। অনেক চেষ্টা করার পর একটা সময় তার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ বন্ধ রেখেই সে বোঝে সকাল হয়ে গেছে। সেই সকালের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ইন্দিরা দুচোখ খোলে। আর দেখে তার পাশে শুয়ে আনন্দী তার দিকেই তাকিয়ে আছে শান্ত, নরম,- ঘুম থেকে জেগে ওঠা নতুন একটা দৃষ্টি নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে সারা শরীরে একটা আরাম বোধ ছড়িয়ে পড়ে ইন্দিরার। তার মনে হয় এখনই চোখ বুজে না ফেললে এই মুহূর্তটা হারিয়ে যাবে। মুহূর্তটাকে হারিয়ে ফেলবে সে। ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলে ইন্দিরা। আনন্দী কিছু বলে না। সারা শরীরে আরাম বোধটা নিয়ে ইন্দিরা বোঝে আনন্দী এখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
ঘুমের মধ্যে যে চোখটা সে দেখেছে সেটা কি আনন্দীর? তা কি করে হয়। আনন্দীর সাথে পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই ওই চোখটা স্বপ্নে দেখছে ইন্দিরা। ইন্দিরা জানে অজানা-অচেনা কারো মুখ বা চোখ মানুষ স্বপ্নে দেখে না। আর কিছু ভাবার ইচ্ছে হয় না ইন্দিরার। অদ্ভুত এই ভালো লাগাটা নিজের শরীরে অবাধে বয়ে যেতে দেয় সে।

 

 

“তোমাকে এতটা খুশি এই প্রথম দেখলাম”, বাসে উঠে রুবাঈয়ের পাশে এসে বসতেই রুবাঈ কথাটা বলে ইন্দিরাকে।

“খুশি… আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি খুশি?”, ভিতরে ভিতরে আনন্দটা পুষে রেখে বলে ইন্দিরা।

“হ্যাঁ, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি”

ইন্দিরা হেসে ফেলে।

“কিছু হয়েছে মনে হচ্ছে?”

“কিছু না। খুশি হতে গেলে কিছু হতে হয়? এমনি এমনি কেউ খুশি হতে পারে না?”

“হ্যাঁ, তা পারে, কিন্তু সেরকম কেউ তো তুমি নও”

“তাই? আমার খুশি হওয়া কঠিন বলছো?”

“না কঠিন নয়” রুবাঈ বলে, “তুমিও এমনি এমনি খুশি হতে পারো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা এমনি এমনি পাওয়া আনন্দ নয়, কারোর সাথে ভাগ করে নেওয়া আনন্দ, কে হতে পারে সেটা…” ইশারায় সামনের দিকে হিরণের পাশে বসে থাকা আনন্দীকে দেখায় রুবাঈ।

ইন্দিরা কিছু বলে না, অল্প হেসে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখে। অদ্ভুত সুন্দর হাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাসটা এগিয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট স্টপেজে এসে বাস থেকে নেমে অন্য দিনের মতো হিরণ আর আনন্দীর পিছু পিছু তারা দুজন হাঁটতে শুরু করে। অল্প যেসব গাছে ট্যাবেব্যুয়া রোসিয়া ফুল তখনও ছেয়ে ছিল হাওয়া লেগে তারা বৃষ্টির মত তাদের চারপাশে ঝরে পড়তে থাকে। আগে আগে হেঁটে যাওয়া আনন্দীর দিকে তাকিয়ে ইন্দিরা সামনের দিকে হেঁটে চলে। নরম নরম গোলাপি ফুল পড়তে থাকে আনন্দীর মাথায় কাঁধে। ইন্দিরার মন খুব ভালো লাগে।

রুবাঈ বলে, “হিন্দিতে গুলাবি শব্দটা শুধু রঙ বোঝাতেই ব্যবহার হয় না, জানো?”

“আরো মানে আছে শব্দটার?” ইন্দিরা জানতে চায়।

“একটা গান আছে, মোহিত চৌহ্বানের, শুনেছো কিনা জানিনা, ‘গুলাবি সি সুবহা…’ ঠিক আজকে যেমন বোধ করছো তুমি, সকালটাকে তোমার যেমন লাগছে, সেটাই গুলাবি সুবহা, তেমনই হাওয়া দিলে যে ঠান্ডাটা লাগছে তোমার, সেটা হল গুলাবি শীত, বোঝাতে পারলাম?”

নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে না ইন্দিরা। মাথা নেড়ে সায় জানায়। গুলাবি… শব্দটার এই অর্থটা খুব সুন্দর লাগে ইন্দিরার। যত্ন করে মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখে দেয় সে অর্থটাকে।

 

 

“দাদা আসছে আগামীকাল…”

খেতে খেতে থেমে যায় রুবাঈ, “সাথে কে আসছে?”

“কেউ না, একাই আসবে”

“তুমি যে বলেছিলে, উনি কোথাও যান না…”

“গত পাঁচ-ছয় বছর বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি, তার আগে অবশ্য কনফারেন্সের কাজে নানা শহরে ঘুরে বেরিয়েছে”

“তা হঠাৎ আসছেন, কিছু হয়েছে?”, একটু আচার মুখে ঠেকায় রুবাঈ।

“না, বাড়ির বাকিরা তো ভালোই আছে, এমনকি জয়তীও ঠিক আছে এখন”

“তাহলে দুঃশ্চিন্তা কিসের? এয়ারে যদি আসেন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়”

“তুমি তো জানোই রুবাঈ, দাদার সাথে যা হয়েছে তারপর আমার দুঃশ্চিন্তাটা অমূলক নয়। তাছাড়া দাদা আমাদের বাড়ির সব থেকে বুদ্ধিমান মানুষ। If he is concerned about something, there must be something to be concerned about.”

রুবাঈ বলে, “বুঝলাম। কাল তুমি যাবে ওনাকে আনতে? আমি যাবো সাথে?”

“না, আমাকে একাই দাদার মুখোমুখি হতে হবে, অন্য মানুষের সামনে হয়তো ও গুঁটিয়ে নেবে নিজেকে।”

“আনন্দীকে জানিয়েছো?”

“হ্যাঁ, অসুবিধা নেই”

“আমি দাদার অসুখের ব্যাপারে বলছিলাম…”

“না, সেটা বলা হয়নি”

“একটা কথা বলবো ইন্দিরা,” বিরতি নেয় রুবাঈ।

“বলো,”

“আনন্দী তোমার থেকে যতটা দূরে আছে, তুমি কিন্তু ওর থেকে ততটা দূরে নও। ও চাইলেই তোমাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে যেকোনো মুহূর্তে। তাই তোমার অজান্তে ও চলে আসার আগেই ওর হাতটা ধরো, হাত ধরে নিয়ে এসো ওকে বাকিটা। ওর আসাটা অনেক মসৃণ হয় তাহলে। নিজের সাথে তোমার অনর্থক যুদ্ধটাও রদ হয়।”

“ও কি আসবেই রুবাঈ?”

তারা দুজনেই পাশের টেবিলে গল্পে ব্যস্ত হিরণ আর আনন্দীর দিকে তাকায়।

রুবাঈ বলে, “অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ আর দেখছি না ইন্দিরা।”

থালা খালি হয়ে যেতে রুবাঈ উঠে পড়ে টেবিল ছেড়ে, ইন্দিরা শোনে চলে যেতে যেতে সে গুনগুন করে গাইছে, “রঞ্জিশ হি সহি…”

ইন্দিরা আনন্দীর দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তে আনন্দী অল্প হাসে ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে। উত্তরে ইন্দিরাও হাসি বিনিময় করে। ইন্দিরা ভাবে, আজ ক্লাসের পর সুযোগ বুঝে আনন্দীকে দাদার ব্যাপারে বলে রাখবে।

 

 

ক্লাস একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে আজ। ইন্দিরারা চারজনে কাছের একটা লেকের ধারে এসেছে ঘোরার জন্য। যেমন অবিরাম হাওয়া বয়ে যায় এখানে, তেমনই জায়গায় জায়গায় বহু লেক থেমে আছে শহরের গায়ে। তাদেরই একটার বাঁধানো ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে ইন্দিরা। হিরণ তার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। একটু দূরে বেঞ্চে বসে লেক দেখছে রুবাঈ আর আনন্দী।

হাঁসের দল দেখতে ইন্দিরা দাঁড়িয়ে পড়লে হিরণ তাকে ধরে ফেলে।

“তুমি সবসময় নীল রঙের জামা পরো কেন?”

“নীল?”, অবাক হয় ইন্দিরা, “কই তেমন কিছু তো নয়…”

“আজ অবধি তোমাকে অন্য কোনো রঙ পরতে দেখিনি তাই বললাম”, হিরণ আর ইন্দিরা পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে।

হিরণ বলে, “জানো, একেকটা রঙ, একেকটা আবেগ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। যেমন ধরো হলুদ বা কমলা, মানুষের মনকে ভালো রাখে। তাই আমি সবসময় চেষ্টা করি হলুদ বা কমলার শেড আমার জামার কোথাও না কোথাও রাখতে। যেমন দেখ, আজকে ওড়নায় গেরুয়া আছে।” এক হাত দিয়ে নিজের ওড়নাটা তুলে ধরে হিরণ।

“হ্যাঁ, কোথাও পড়েছিলাম, এই ব্যাপারটা। এখন ঠিক মনে নেই”

“You also should wear something vibrant, otherwise… আনন্দী বলছিল, শুধু ও নয়, আমারও মনে হয়, you stay in sorrow most of the time,”

ইন্দিরা উত্তর খুঁজে পায় না কোনো। লেকের থেকে একটু দূরের বসন্তরানি গাছের দিকে চোখ রাখে। সেখানে হাওয়া লেগে গোলাপি ফুল ঝরে ঝরে পড়ছে। তখনই দূর থেকে রুবাঈ আর আনন্দীর গলা শুনতে পায় তারা, কাছেই একটা ছোট পার্কের দিকে আঙুল নির্দেশ করে তারা ডাকছে ইন্দিরা আর হিরণকে।

 

পার্কের সবকিছুই বারো বছরের পরের সবার জন্য নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের টান সুপ্রাচীন। হিরণ আর রুবাঈ পার্কের ভিতরে ঢুকে দোলনায় বসে দুলতে শুরু করে দিয়েছে অবিলম্বে। আনন্দী তাদের থেকে দোলনার ভাগ চাইছে। ওদের দেখে ইন্দিরার আনন্দ হয়। ছোটবেলার কিছু টুকরো চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যায়। আর সাথে সাথে ইন্দিরা সংযত হয়ে আসে। সংযম। ছোট থেকে বিভিন্নভাবে তাকে শিখতে হয়েছে, কিভাবে নিজেকে আটকে রাখতে হয়। কিভাবে এক পা-ও গণ্ডীর বাইরে না ফেলে তাকে হেঁটে যেতে হবে, সেটা বৃত্তাকারে নিজেকেই প্রদক্ষিণ করা হলেও থেমে যাওয়া চলবে না।

“ইন্দিরা!”

আনন্দীর গলায় ঘোর ভাঙে ইন্দিরার, দেখে একটা স্লিপের উপরে উঠে আনন্দী ডাকছে তাকে। তার মুখ শুকনো। ইন্দিরা এগিয়ে যায় স্লিপটার দিকে।

“আমি নামতে পারছি না”

“মানে? স্লিপ খেয়ে নেমে এসো… এতো সহজ”

“Not for me, আমার ভার্টিগো আছে ছোট থেকে”

“তাহলে উঠলে কেন…” একটু বিরক্ত হয় ইন্দিরা।

“ভেবেছিলাম ভয় কেটে গেছে… কিন্তু এখন আর নামতে পারছি না”, কথা বলতে বলতে ঘেমে যায় আনন্দী।

করুণা হয় ইন্দিরার। এক হাত এগিয়ে দিয়ে সে বলে, “স্লিপ খেতে হবে না, যেভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছো সেভাবেই নেমে এসো আমার হাত ধরে”

ইন্দিরার হাতটা ধরে ফেলে আনন্দী, শক্ত করে ধরে থাকে।

“এবার এক পা এক পা করে নেমে এসো”

“হাত ছেড়ে দেবে না তো?”

আনন্দীর কথায় চমকে ওঠে ইন্দিরা, মনে পড়ে যায় দুপুরে খাওয়ার সময় রুবাঈ বলেছিল,- হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা।

শক্ত করে আনন্দীর হাত ধরে রেখে ইন্দিরা বলে, “ছেড়ে দেবো না।… এসো।”

 

 

“আমার তখন তিন বছর বয়স, সেবার হিমাচল ঘুরতে গিয়ে খেলতে খেলতে কিভাবে যেন আমি সবার চোখের আড়াল হয়ে গেছিলাম, মা বাবা, আরো বড় যারা ছিলেন তাদের খেয়াল হতে দেখেন ধারে কাছে কোথাও আমি নেই। টানা চার পাঁচ ঘন্টা তারা খুঁজেছিলেন আমায়। এর মধ্যে পুলিশ চলে আসে। পুলিশের সাথে পুলিশ কুকুরও আসে। ওরাই আমায় খুঁজে বের করে। হোটেলের পাশেই একটা গোপন রাস্তা দিয়ে অল্প একটু এগিয়ে গিয়ে যে খাদ, সেই খাদে প্রায় বারো ফুট নিচে পড়ে ঝোপঝাড়ে আটকে ছিলাম আমি ঘন্টা পাঁচেক। ভয়ে ঠান্ডায় নীল হয়ে ছিলাম। ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ খাইয়ে সেদিন ঘুম পাড়ানো হয় আমাকে। দিন দুয়েক পর আমরা ফিরে আসি সমতলে। এসব স্মৃতি কিছুই আমার নেই। এরপর আমায় নিয়ে কখনও পাহাড় বা সমুদ্রে যায়নি বাবা-মা। মা মাঝে মাঝে বলে এখনও, খাদে গাছপালা না থাকলে আমি বেঁচে ফিরতাম না।” আনন্দী বিরতি নেয়, “কিন্তু দেখো স্মৃতিটা না থাকলেও ভয়টা কিভাবে যেন থেকে গেছে। কি অদ্ভুত না?”

হিরণ বলে, “এটা হয় জানো তো। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে এভাবেই সতর্ক করে দেয় বারবার।”

ইন্দিরা কিছু বলে না। একটু আগে কি কাজে রুবাঈ নেমে গেছে বাস থেকে।

নির্দিষ্ট স্টপেজ আসতে হিরণও নেমে যায়।

আনন্দী আর ইন্দিরা চুপচাপ গন্তব্যে এসে নেমে পড়ে। অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে আনন্দী বলে, “একদম মনে ছিল না, এক প্যাকেট দই আনবে? রাতে পরোটা দিয়ে খাওয়া হয়ে যাবে তাহলে। তুমি নিয়ে আসো, আমি গিয়ে আটাটা মেখে ফেলি।”

অ্যাপার্টমেন্টের পাশেই দোকান। এক প্যাকেট দই কিনে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফিরে আসে ইন্দিরা। দেখে একটা ট্যাক্সি তাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ানো।… কেউ এসেছে মনে হয়। অথবা চলে যাচ্ছে।

কাছে আসতে ইন্দিরা বোঝে কাউকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে ট্যাক্সিটা। সিঁড়ি বেয়ে দইয়ের প্যাকেট হাতে উঠে আসে সে। সমিকের অ্যাপার্টমেন্ট অন্য দিনের মতই বন্ধ। অনেক রাতে বাড়ি ফেরে সে। তিন তলার কাছাকাছি পৌঁছোতে ইন্দিরা শুনতে পায় আনন্দীর সাথে কথা বলছে কেউ একজন, স্পষ্ট বৃটিশ উচ্চারণে।

সিঁড়ি দিয়ে প্রাণপণে উপরে উঠে আসে ইন্দিরা। দেখে তিনতলার বারান্দায় ছোট একটা ট্রাভেল ব্যাগ হাতে ধোপদুস্তর জামা পরা, ঝকঝকে চেহারার পিকলু ইন্দিরাকে দেখিয়ে দরজা আগলিয়ে দাঁড়ানো আনন্দীকে বলছে, “আমি মৈত্রেয় চৌধুরী। ইন্দিরা চৌধুরীর দাদা।”

(চলবে)



অষ্টম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার