তারাদের ঘরবাড়ি ১০
বিস্ময় চেপে রেখে পরোটার টুকরোগুলো এক এক করে মুখে ভরছে ইন্দিরা। পিকলুকে দেখলে মনে হচ্ছে যেন গত ছ বছর একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।
নিজের প্লেট থেকে পরোটার টুকরো মুখে ভরে পিকলু আনন্দীকে প্রশ্ন করে, “তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?”
আনন্দী জবাব দেয়, “বাবা আর মা”
“বাবা কি করেন?”
“পারিবারিক ব্যবসা আছে আমাদের”
“কিসের ব্যবসা?”
ইন্দিরা পিকলুকে ইশারা করে থেমে যাওয়ার জন্য। কোনো ফল হয় না। ইন্দিরা অপেক্ষা করে কখন পিকলুকে একা পাওয়া যাবে।
আনন্দী বলে, “হোটেলের”
একটু থেমে পিকলু আবার জানতে চায়, “কিসের ব্যবসা?”
আনন্দী বলে, “হোটেলের”
“কিসের ব্যবসা?”
ইন্দিরা থামানোর চেষ্টা করে পিকলুকে, “হোটেলের দাদা, হোটেলের ব্যবসা”
“হোটেলের… হোটেলের ব্যবসা… হোটেলের”, নিজের চেয়ারে বসে দুলতে থাকে পিকলু।
আনন্দী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিকলুর দিকে।
আরো কিছুক্ষণ পরে, পিকলু আবার জানতে চায়, “লাদাখ জেলায় তোমাদের কোনো হোটেল আছে? তোমাদের কোনো হোটেল আছে, লাদাখ জেলায়? লাদাখ জেলায় হোটেল?”
“না, জম্মুতে আছে। হোটেল, হাউস বোট দুটোই” বিস্ময় চেপে রেখে আনন্দী জবাব দেয়।
“তিতিরের তো লাদাখ যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছে, বলেছে তোমায়? ভীষণ ইচ্ছে… ভীষণ… লাদাখ যাওয়ার… ইচ্ছে।”
আনন্দী জানতে চায়, “তিতির…? মানে ইন্দিরা?”
“হ্যাঁ, মায়ের দেওয়া, ডাকনাম,- তিতির। ওর ডাকনাম। তিতির। ওর ডাকনাম তিতির। মা দিয়ে গেছে।” ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে পিকলু বলে চলে।
“আর খাবি পরোটা?” প্রসঙ্গ বদলে দেওয়ার জন্য বলে ইন্দিরা, নিজের গলা তার বেশ হতাশ শোনায়।
“না, তোরা খা”, হঠাৎই টেবিল ছেড়ে উঠে পরে পিকলু। ইন্দিরা দেখে নিজের মনে মাথা নাড়তে নাড়তে হাত ধুয়ে ইন্দিরার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে পিকলু।
পিকলু চলে যেতে আনন্দী বলে, “উনি কি কোনো কারণে বিচলিত?”
“না।”
“ও”, আনন্দী অদ্ভুত চুপ হয়ে যায়।
একটু ভেবে ইন্দিরা বলে, “একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল ছ বছর আগে। তারপর থেকে ও ওরকম হয়ে গেছে।”
আনন্দী তাকায় ইন্দিরার দিকে, অপেক্ষা করে আরো কিছু শোনার জন্য।
“আমি ভেবেছিলাম তোমাকে জানাবো, কিন্তু তার আগেই দাদা চলে এল। এমনিতে ও নিজের মনেই থাকে। তবু যদি কোনো কারণে তোমার কোনো অসুবিধা হয় বোলো, আমি ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো।”
“না, ঠিক আছে। তোমার যদি কিছু লাগে আমায় জানিও। তিতির…” একটু বিরতি নিয়ে আনন্দী বলে, “নামটা কিন্তু মিষ্টি, মানে কি?”
“মানেটা খুব একটা সুন্দর নয়, তিতির ফ্র্যাঙ্কোলিন জাতীয় পাখি, পোলট্রি”
“কিন্তু শুনতে তো বেশ সুন্দর, না?”
সম্মতি জানায় ইন্দিরা, নামটা শুনলেই মনে হয় দু হাতের মুঠোয় তিরতির করে কাঁপছে এমন কিছু, খুব পেলব। বাইরের আলো, হাওয়ার আঁচ তাতে লাগতে দেওয়া চলবে না। ইন্দিরা ভাবে আর অবাক হয়,- মা’ই তাকে এমন একটা নাম দিল!
খাওয়া শেষে আনন্দী চলে গেলে ইন্দিরা ঘরে ঢোকে। দেখে চেয়ারে বসে পিকলু ইন্দিরার নিয়ে আসা শেষের কবিতাটা পড়ছে। ইন্দিরা ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে।
বই থেকে মুখ না সরিয়ে পিকলু বলে, “আমাকে আসতেই হোত।”
“কেন দাদা? আমি তো ঠিকই আছি, সব ঠিক আছে এখানে।”
“জানি”, বইয়ের পাতা ওলটায় পিকলু।
ইন্দিরা অবাক হয়, “তবে?”
“সেকারণেই এসেছি। এসে দেখছি… I found out that you are happy… I found out…”
“মানে? সেটা তো ভালোই…”
টেবিলের উপর বইটা আছড়ে ফেলে পিকলু বলে, “How could you be happy Indira? After everything?! You should not be happy so easily, this is so wrong!”
কিছু বলতে গিয়েও ইন্দিরা থেমে যায়, পিকলুর কণ্ঠস্বর বদলে গিয়েছে। বাইরে থেকে আনন্দীর গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিজের মায়ের সাথে রুটিনমাফিক কথা বলছে মেয়েটা।
“Oh I see!!” বিস্ময় নিয়ে পিকলু ইন্দিরার দিকে তাকায়, “এই কারণে! এত সহজে ইন্দিরা? এত সহজে! I didn’t expect this from you! I didn’t… I didn’t… এত সহজে! এত!” জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে পিকলু।
ইন্দিরা বলে, “সবকিছু কঠোরভাবে আসবে তার তো মানে নেই… আর কেনই বা আসবে? আমি আমার কঠিন সময় পার করে এসেছি দাদা”
পিকলু স্থির হয়ে যায়, ইন্দিরার চোখে চোখ রেখে বলে, “Do you think you had enough?”
টেবিলের উপর আছড়ে ফেলা শেষের কবিতার প্রথম পাতাটা ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে উড়ে যেতে চায়, রঞ্জনার হাতে লেখা লাইনটার কয়েক ঝলক দেখতে পায় ইন্দিরা। ইন্দিরা খেয়াল করে পিকলু হঠাৎ ইংলিশে টানা কথা বলছে। সে মুখ তুলে তাকায় পিকলুর দিকে, সে ততক্ষণে আবার শেষের কবিতাটা মুখের সামনে তুলে ধরেছে।
কিছুক্ষণ বিছানার কোণায় বসে থেকে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে ইন্দিরা হলঘরে চলে আসে। আলো বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চাদর মেলে দেয়। তার ঘর থেকে আলো এসে পড়ছে হলঘরের মেঝেতে। শেষের কবিতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পিকলু ঘুমোবে না। ইন্দিরা জানে। পিকলুর শেষ কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। enough –এর সংজ্ঞা কি? ‘কতটা পথ পেরোলে’ তাকে “enough” বলা চলে? ইন্দিরা জানে না। অজান্তেই তার চোখে ঘুম নেমে আসে।
ভোররাতে চোখ খুলে যায় ইন্দিরার। সোফায় শুয়ে সে শুনতে পায় তার ঘর থেকে পিকলুর গলা ভেসে আসছে, জোরে জোরে সে আবৃত্তি করছে, “মোর লাগিয়া করিয়ো না শোক,/ আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।/ মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই–/ শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।”
সোফা ছেড়ে উঠে এসে ইন্দিরা নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। দেখে ঘরের মধ্যে অস্থির পায়চারী করছে পিকলু, তার দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। আবৃত্তি করতে করতে পিকলু চেয়ারে বসে পড়ে, দুলে দুলে শেষের লাইনগুলো বলার সময় তার গলা কেঁপে যায়। আবৃত্তি শেষ করেও সে বারবার একই সুরে বলতে থাকে, “হে বন্ধু বিদায়। হে বন্ধু বিদায়।”
ঘরে ঢুকে ইন্দিরা পিকলুর কাঁধে হাত রাখে। পিকলুর চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরে পড়ছে।
হঠাৎ কান্না থামিয়ে পিকলু স্থির হয়ে যায়। স্বাভাবিক গলায় ইন্দিরাকে জিজ্ঞাসা করে, “মা-ও তো ভালো আছে, না?”
কি বলা উচিৎ বুঝতে পারে না ইন্দিরা।
পিকলু আবার জিজ্ঞাসা করে, “তুই জিজ্ঞেস করিসনি মাকে? আমি তোকে বলেছিলাম না, কখনও দেখা হলে মাকে জিজ্ঞেস করবি, ভালো আছো?…”
“করেছিলাম”
“কি বলল?” ইন্দিরার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় পিকলু।
“ভালো আছে”
“ভালো আছে? ভালো আছে!”, বার কয়েক কথাটা বলে পিকলু চুপ হয়ে যায়।
“তুই ঘুমো এবার একটু”
“হুম”
“সকাল হতে চললো প্রায়”
“হুম”
ইন্দিরা পিকলুকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। পিকলু শুয়ে পড়তে আলো নিভিয়ে ইন্দিরা হলঘরে চলে আসে। সোফায় বসতে সে টের পায় এখন আর তার ঘুম আসবে না। ঘর থেকে একটা পাতলা জ্যাকেট গায়ে গলিয়ে বারান্দায় চলে আসে ইন্দিরা। ঠাণ্ডা হাওয়া এমনভাবে এসে তার গায়ে আছড়ে পড়ে যেন তার কিছু অংশ নিজের সাথে উড়িয়ে নেবে। ইন্দিরার মনে পড়ে প্রায় এরকমই শীতল ছিল মায়ের অফিসরুমটা। যদিও সে শৈত্যে এমন অন্তরঙ্গতা, এমন জড়িয়ে নেওয়া ছিল না।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিল আগেই।
সময় ধরে ঠিক বিকেল পাঁচটায় মা ইন্দিরাকে ভিতরে ডাকলেন।
“বসো”
কোনো কথা না বলে ইন্দিরা নরম গদি বসানো সোফায় বসে পড়ে। এত নরম সোফায় যেন সে আগে বসেনি। অপ্রস্তুত লাগে তার নিজেকে।
“তোমার নামই ইন্দিরা?”
“হ্যাঁ”
“অপরেশ পাঠিয়েছে তোমায়?”
“না”
“তবে?”
কি প্রয়োজনে মায়ের সাথে সে এত বছর ধরে দেখা করতে চেয়ছে তা ভুলে যায় ইন্দিরা।
“মৈত্রেয় পাঠিয়েছে?”
“পিকলু…” মা’কে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন ডাকনামটা জোর করে মুখে আনে ইন্দিরা, “না, ও পাঠায়নি”
“তবে? এত বছর পর, কি মনে করে তুমি এলে আমার সাথে দেখা করতে?”
“আমি জানতাম না আপনি…”
“জানতে না যে আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি?!” গলা চড়ে যায় ভাস্বতী মুখার্জির।
ইন্দিরা সিঁটিয়ে আসে। সে টের পায় ভাস্বতী মুখার্জির কড়া নজর তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নিচ্ছে।
“চা খাও?”
ইন্দিরার উত্তর শোনার আগেই তিনি ঘরের বাইরে কাউকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “রাণী দুকাপ চা পাঠিয়ে দাও ঘরে!”
ইন্দিরার জানানো হয় না যে সে চা বা কফি পান করে না।
ভাস্বতী জানতে চান, “এখনও বললে না, কি প্রয়োজনে তুমি এসেছো আমার কাছে”
“আমি এমনিই এসেছি”
“এমনি?!? এমনি এমনি কেউ ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের কাছে আসে?”
‘ছেড়ে চলে যাওয়া…’ বুকে কেউ যেন একটা ছুঁড়ি গেঁথে দিল ইন্দিরার। তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোয় না। মাথা নিচু করে সে নরম সোফার মধ্যে যেন আরো ঢুকে যেতে থাকে।
“মৈত্রেয় কেমন আছে? সে জানে যে আমি জীবিত? না তাকেও তোমরা বুঝিয়ে রেখেছো এসব?”
ভিতরটা অসাড় হয়ে আছে ইন্দিরার, কোনো রকমে মুখ খুলে সে বলে, “দাদা ভালো আছে। ও জানে সব।”
ভাস্বতী ইন্দিরাকে দেখতে থাকেন, “কি করো তুমি?”
“চাকরি”, ইচ্ছে করে অর্ধসত্যটা বলে ইন্দিরা।
“কোথায়, স্কুলে?”
“না, আইটি ফার্মে”
“আইটি ফার্ম?! অবশ্য অপরেশের মেয়ের কর্পোরেট দুনিয়ায় কাজ করাটা বেমানান নয়। মৈত্রেয় কি করে এখন? শেষবার যখন দেখেছিলাম ওকে, ও তখন কলেজে ভর্তি হয়েছে, কি সাবজেক্ট যেন…”
“ইংলিশ। দাদা লেকচারার, লিঙ্গুইস্টিকের”, ইন্দিরা আবার ইচ্ছাকৃত অর্ধসত্য বলে।
“তাও ভালো”
একজন মধ্যবয়সী মহিলা ঘরে ঢুকে আসেন ট্রেতে দুকাপ চা আর একটা মিষ্টি নিয়ে।
“মিষ্টিটা তোমার, আমার ডায়বেটিস”
ট্রে থেকে নিজের কাপ তুলে নেন ভাস্বতী, চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “অপরেশ, জয়তী, ধীরেশদা ওরা কেমন আছেন? দিদিভাই?”
“ওরা ভালো আছে। পিসি নেই আর, মারা গেছেন দুবছর হল”
ভাস্বতী চুপ করে যেন কিছু ভাবেন। তারপর বলেন, “চা খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে”
অনিচ্ছা চেপে রেখে ইন্দিরা কাপটা তুলে নেয়।
“মৈত্রেয় আমাকে চিনতে পারেনি। অরীন আর আমি যে বছর সাহিত্যমঞ্জুষা পেলাম যৌথভাবে, সেবছর বইমেলায় ওকে দেখেছিলাম। একগাল দাড়ি নিয়ে অরীনের থেকে সই সংগ্রহ করতে এসেছিল। অরীনকে চেনো তো? কবি অরীন রায়, আমার বিশেষ বন্ধু হন।”
মাথা নাড়িয়ে ইন্দিরা জানায় যে প্রখ্যাত কবি অরীন রায়কে সে চেনে।
ভাস্বতী বলে চলেন, “চোখদুটো তোমাদের দুজনেরই অপরেশের মতই, সামনের দিকে তাকিয়েও যেন বহুদুরে চেয়ে আছে… অরীনকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করালাম ওর নাম, বুঝলাম ভুল চিনিনি, আরো জিজ্ঞাসা করালাম কি করছে তখন। জানালো কলেজে পড়ে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইলে ধরা পড়ে যেতাম ওর কাছে। তাই জিজ্ঞেস করিনি।”
গরম চায়ে চুমুক দিতে ইন্দিরার জিভ পুরে যায়, জ্বালাটা চেপে রেখে সে মায়ের কথা শোনে।
“তা এত বছর পর তোমাকে কে জানালো আমার কথা?”
“পিসি অসুস্থ হওয়ার দুদিন আগে আপনার নাম জানায় আমাকে”
“মানে সে তো দুবছর আগের ঘটনা… তখন না এসে এখন কেন এসেছো? এতদিন লাগলো মায়ের জন্য মন উতলা হতে?”, শ্লেষ ঝরে পড়ে ভাস্বতীর স্বর বেয়ে।
“তারপরই পিসি মারা গেলেন, আর একেক করে নানা ঘটনায়…”
“বিপর্যস্ত ছিলে না ভুলে গিয়েছিলে?”
ভিতরে ভিতরে হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হয় ইন্দিরার, ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলে ওঠে, “আপনিও তো আসেননি, আপনিও তো ভুলে গেছেন আমাদের কথা…” বলতে পারে না। চায়ের কাপের আড়ালে চোখের জল জোর করে লুকিয়ে ফেলে।
“কবিতা পড়ো?”
“না” জোর করে মিথ্যে কথা বলে ইন্দিরা।
“কেন?”
“ভালো লাগে না” আবার স্বেচ্ছায় মিথ্যে কথা বলে সে।
“ভালো লাগে না, নাকি বুঝতে পারো না? তুমি মনে হয় অপরেশের মতই। অনাব্য।”
ইন্দিরার ইচ্ছে হয় পালিয়ে আসতে। নিজেকে জোর করে সোফায় ঠেসে ধরে থাকে সে।
“তোমার নিশ্চয়ই ক্ষোভ আছে আমার প্রতি, মানে যেটা সচরাচর হয়ে থাকে…”
“না। ক্ষোভ নেই”, নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাটা শুনে ভিতরে ভিতরে হঠাৎ শান্ত হয়ে যায় ইন্দিরা, মনে মনে ভাবে কি বলা উচিৎ তার এই আবেগকে? অভিমান?
“তবে? দেখো ক্ষোভ থাকুক বা দুঃখ, তা তোমার। সেসবের দায় আমি তেইশ বছর আগে চুকিয়ে এসেছি। অপরেশের সাথে সংসার করাটা একটা ভুল ছিল। চৌধুরী বাড়িতে কাটানো দশটা বছর একটা ভুল ছিল। আমি দোষী, কিন্তু সেই ভুলের খবর পাওয়ামাত্র আমি সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি। ততক্ষণে হয়তো তোমরা এসে গেছ। সারা জীবন একটা অপরাধবোধ বয়ে বেরানোর থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়াটা কি শ্রেয় নয়? আমি যদি সেদিন ও বাড়ি ছেড়ে চলে না আসতাম, তবে তোমাকে, মৈত্রেয়কে, অপরেশকে ঠকানো হত না?! আর অপরেশের সাথে আলোচনা করেই তো আমি বাড়ি ছেড়েছি। যে মুহূর্তে তুমি বুকের দুধ খাওয়া বন্ধ করেছিলে, আমি আর দেরি করিনি। আমরা সবাই জানতাম কি ফলাফল হবে। বুকে হাত রেখে বলো তো কোনো ক্ষতি হয়েছে এতে? আমরা সবাই কি ঠিক নেই এখন?”
“আপনি নিজেকে justify করছেন!? আপনারও অপরাধবোধ হয়!”, ঠাণ্ডা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে ইন্দিরা। বেশ শীত করতে শুরু করলে মায়ের অফিস থেকে অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় ফিরে আসে সে। মায়ের কথাটা কানে বাজতে থাকে তার। “… সবাই ঠিক আছি।” ঠিক থাকা আর ভালো থাকার মধ্যে কতটা ফারাক আছে? উত্তরের অপেক্ষা না করে ইন্দিরা হলঘরে এসে দরজা বন্ধ করে। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছটা বাজে। ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিতে ইন্দিরা রান্নাঘরে চলে আসে।
রোজকার মত আজও লেকচার কানে ঢুকছে না ইন্দিরার। সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখে সে স্থির হয়ে আছে। পাশ থেকে ফিসফিস করে রুবাঈ বলে, “দাদাকে ভাবছো?”
“হ্যাঁ আবার নাও”
“উনি কি অ্যাপার্টমেন্টেই আছেন?”
“হ্যাঁ, দুপুরের খাবার আর কিছু বই দিয়ে এসেছি”
“তাহলে ভাবনা কিসের?”
রুবাঈয়ের ওপাশে আনন্দীর দিকে চোখ রেখে ইন্দিরা বলে, “গতকাল ও আনন্দীর সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছে…”
“আচ্ছা”
“তোমার মত দাদারও একটা সিক্সথ সেন্স আছে, বিশেষত আমার ব্যাপারেই”
“সিক্সথ সেন্স বলবো না, বলবো আমি দেখি, যেমন সেই প্রথমদিন বলেছিলাম,- তোমাকে দেখি, চারপাশটা দেখি, দেখতে দেখতে অনেক সূত্র তৈরি হয়, অনেক সমানুপাত ব্যস্তানুপাত আমাদের মাঝে এসে বসে পড়ে”
রুবাঈকে থামিয়ে ইন্দিরা বলে, “দাদা আনন্দীকে টের পেয়েছে…”
রুবাঈকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইন্দিরা বাক্যটা শেষ করে, “আমার মধ্যে।”
ট্রেনারের ফোন বেজে উঠতে তিনি ক্লাসের বাইরে চলে যান।
আনন্দীর ওপাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে হিরণ প্রশ্ন করে, “এই তোমরা হোলির প্ল্যান করছো?”
চমকে ওঠে রুবাঈ আর ইন্দিরা, রুবাঈ বলে, “হোলি? কবে?”
হিরণ বলে, “আরে এতক্ষণ ধরে ট্রেনার হোলির কথা বললেন, কোথায় থাকো তোমরা দুজনে! পরশু হোলি, আমাদের ছুটি আছে”
“তোমার দাদা থাকছেন তো হোলিতে?” রুবাঈ জানতে চায়।
ইন্দিরা বলে, “তাই তো জানি”
হিরণ বলে, “তাহলে ওনাকেও দলে নাও”
ইন্দিরা বলে, “ও খেলে না”
হিরণ অবাক হয়, “খেলে না মানে? কেন?”
“ও ঠিক রঙ দেওয়াটা পছন্দ করে না”
হিরণের ভ্রূ কুঁচকে যায়, “কেন?”
ইন্দিরাকে চুপ থাকতে দেখে রুবাঈ কিছু বলতে যায়, তাকে থামিয়ে দিয়ে আনন্দী বলে ওঠে, “আমার মনে হয় সেটা ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার”
হিরণ চুপ হয়ে যায়।
“তবে আমরা খেলতেই পারি”, আনন্দী বলে।
হিরণ আর রুবাঈ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ইন্দিরা আনন্দীর দিকে তাকায়, আনন্দীর হাসি আজকাল তার সহনীয় হয়ে এসেছে। যেমন ব্যথার উপর জ্বলতে থাকা মলম একসময় ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে আরাম দেয়।
হাসতে হাসতেই ইন্দিরার ফোন বেজে ওঠে,- বাড়ির নম্বর। ইন্দিরা ক্লাসরুমের বাইরে চলে আসে, ধীরেশের গলা শোনা যায়। পিকলুর ব্যাপারে সব শুনে তিনি বলেন, “টানা আধঘন্টা ও মেয়েটার সাথে কথা বলল!”
“হ্যাঁ, বিভিন্ন প্রশ্ন করল, আর ও উত্তর দিল”
“তাহলে কি… পিকলু…”
“না জ্যেঠু, দাদা পুরোপুরি ঠিক যে হবে না ডঃ রায় তো বলেই দিয়েছেন”
“তবু, পৃথিবীতে মিরাক্যালও তো ঘটে কিছু, যদি ও আবার আগের মত হয়ে যায়…”
ধীরেশকে থামিয়ে দেয় ইন্দিরা, “জ্যেঠু, আমাদের জীবনে আজ পর্যন্ত কোনো মিরাক্যাল ঘটতে দেখেছো? মা চলে গেছে, আমি ঠিক মত বড় হওয়ার আগেই পিসি চলে গেল। দাদার সাথে এত বড় একটা ঘটনা ঘটল।… আমাদের কথা না হয় বাদ দিলে, জয়তী… বারবার নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে, আর পাঁচটা মানুষের মত দাম্পত্যজীবন পেয়েছো তোমরা? Sorry to say, তোমার জীবনেও আমি আজ অবধি কোনো মিরাক্যাল ঘটতে দেখিনি।”
“ঘটেছে”, ধীরেশের চাপা, ক্লান্ত গলা শুনতে পায় ইন্দিরা, “বলতে গেলে রোজই ঘটে…”
“মানে?”
ক্লান্ত গলায় ধীরেশ বলেন, “জয়তী… জয়তী যখন ঘুমোয়, তুই, কখনো জয়তীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিস?”
ইন্দিরা কিছু বলতে পারে না। কাঁচা পাকা এলো চুল মাথায় করে ঘুরে বেড়ানো জয়তীর মায়া মায়া চোখ দুটো ইন্দিরাকে ছুঁয়ে যায়, ইন্দিরা শুনতে পায় জয়তী বলছে, “তোর শহরে কাক আছে?”
নিজেকে টেনে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ইন্দিরা। বলে, “আমি যাই জ্যেঠু, ক্লাস শুরু হবে আবার”
ধীরেশ বলেন, “তোকে একটা কথা বলার ছিল…”
“বলো,”
“রাগ করিস না, অনেক দিন তো হল, আমার মনে হয় এভাবে ভিতরে ভিতরে নিজেদের অভিমান পুষে রেখে তোরা নিজেদেরই কষ্ট দিচ্ছিস,”
কাটা কাটা কথায় ইন্দিরা বলে, “বাবার ওপর আমার কোনো অভিমান নেই জ্যেঠু, আমার মনে হয় না বাবারও আমার প্রতি অভিমান আছে। অভিমান তো দূরের মানুষের প্রতি হয় না। অভিমানের আঁচ পেতে গেলে কাছে আসতে হয়।”
ফোন কেটে দিয়ে ইন্দিরা ক্লাসের দরজার কাছে চলে আসে। কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখে ভিতরে বাকীদের সাথে বসে আনন্দী হাসিমুখে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছে, হোলির প্ল্যান নিশ্চয়ই। কয়েক মুহূর্ত তাকে দেখে নিয়ে একটা আরাম বোধ ভিতরে পুরে ইন্দিরা ক্লাসে ঢোকে।
“মনে হচ্ছে এখানে পাওয়া যাবে না…” হতাশ গলায় বলে হিরণ।
রুবাঈ কপালের ঘাম মুছে নির্দেশের অপেক্ষায় ইন্দিরার দিকে তাকায়।
ইন্দিরা একটু দূরে গাছের তলায় থম মেরে বসে থাকা পিকলুর দিকে চোখ রেখে বলে, “কোথাও না কোথাও তো পাওয়া যাবেই… ভারতের বাইরে তো নয় শহরটা… এক কাজ করা যাক, তোমরা এই সিগনাল থেকে ডান দিকে যাও, আমি আর দাদা বাঁ দিকে যাচ্ছি”
“আর আনন্দী?” হিরণ জানতে চায়।
“ও তো সেই আধঘণ্টা আগে গেছে, ফেরেনি এখনও…” রুবাঈ চিন্তিত মুখে তাকায় আনন্দীর পথের দিকে।
“আমি ওকে হোয়াটসঅ্যাপে বলে দিচ্ছি ফিরে এসে এখানে অপেক্ষা করতে”, মেসেজ টাইপ করতে করতে বলে ইন্দিরা।
হিরণকে নিয়ে রুবাঈ ডানদিকে চলে যায়। ইন্দিরা পিকলুর কাছে ফিরে আসে।
“আমি জানতাম তুই রঙ পছন্দ করিস না- কি তাই তো? তাই না? বল! তাই না?”
“এখন করি”, পিকলুর পাশে দাঁড়িয়ে বলে ইন্দিরা।
“তুই বদলে গেছিস! একে… একবারে বদলে গেলি!” পিকলু অবাক চোখে দেখে ইন্দিরাকে।
“মানুষ বদলায় দাদা, বদলে যাওয়াটাই কাম্য”
অবাক হয়ে ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে থাকে পিকলু, তারপর ধীরে ধীরে স্বগতোক্তি করে, “কিন্তু আমি তো… আমি যে আর বদলাবো না তিতির…”, মাছের গলার বর্শির মত তার স্বরে হতাশা গেঁথে থাকে।
বুকের ভিতরে একটা শিরশিরে ব্যথা বয়ে যায় ইন্দিরার, মনে হয় হাওয়াশহরের বাতাস তার পাঁজরে ঢুকে এসেছে। ইন্দিরার ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে, আনন্দীর মেসেজ এসেছে, “রঙ পাওয়া গেছে, চলে এসো”
ফোনটা পকেটে রেখে ইন্দিরা বলে, “চল, যাওয়া যাক”
পিকলুকে নিয়ে ইন্দিরা ধীরে ধীরে আনন্দীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে,- দিন শেষে যেভাবে পাখিরা ঘরের দিকে ফেরে। ফিরতে চায়। (চলবে)