ধারাবাহিক উপন্যাস – তারাদের ঘরবাড়ি । অলোকপর্ণা ।। ১১ পর্ব

                                     তারাদের ঘরবাড়ি ১১

 

সকাল আটটা নাগাদ বাইরের বারান্দায় কিছু মানুষের পায়ের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে ইন্দিরার। সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, দেওয়ালে একটা গাছের ফ্রেস্কো থাকার কথা ছিল যেন,- গাছটা নেই। তখনই ইন্দিরার খেয়াল হয় সে কোলকাতা থেকে সতেরোশো কিলোমিটার দূরে একটা হলঘরের সোফায় শুয়ে আছে। আজকে হোলি। বাইরে বারান্দা দিয়ে সমীকের বন্ধুরা ছাদে যাচ্ছে, সেখানে পার্টি আছে। আনন্দী, রুবাঈ আর হিরণের সাথে ইন্দিরাও সেই পার্টিতে যোগ দেবে কিছু পরে।

ইন্দিরা সামনের দেওয়ালটাকে ভালো করে দেখে। ঘুমের ঘোরে একটু আগে তার মনে হয়েছিল, যে গাছটা যত্ন করে তার কোলকাতার ঘরের দেওয়ালে সে এঁকেছিল গত বছর সারাটা জুন মাস ধরে, সেই গাছটারই যেন থাকার কথা ছিল এই দেওয়ালে। গাছের পাতাগুলোকে একেকটা চোখ বানিয়ে দিয়েছিল ইন্দিরা, যাতে চারদিকে পাতা মেলে ধরা গাছটা সব সময় চেয়ে থাকতে পারে ইন্দিরার দিকে, ইন্দিরাকে পাহারা দিতে পারে। আর গাছের যে পাতাগুলো ঝরে পড়ছিল, সেগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল ইন্দিরা, বোজা চোখের আদলে গাছের পায়ের কাছে কিছু শুকনো পাতা এঁকে দিয়েছিল। বড় ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটায় কোনো ফুল নেই। হঠাৎ এই গাছটার কথা আনন্দীকে জানাতে খুব ইচ্ছে হয় ইন্দিরার। ধীর পায়ে উঠে এসে সে আনন্দীর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়।

দরজায় হাত রেখে স্থির হয়ে যায় ইন্দিরা, ভাবে, আজ কেন ওই গাছটার কথা মনে হল তার… সাথে সাথে তার মনে পড়ে যায়, প্রথম যেদিন রঞ্জনা গাছটার ফটোগ্রাফ দেখেছিল কি ভীষণ রেগে গিয়েছিল,- “কেন এঁকেছিস এটা?!”

“এমনিই, সব কিছুর কি কারণ থাকতে হয়…”, মৃদু স্বরে বলেছিল ইন্দিরা।

“হয়, সব কিছুর কারণ থাকে, তোর কিসের অভাব, কিসের অসহায়তা, হ্যাঁ? যার জন্য একটা গাছের আশ্রয়ের প্রয়োজন পড়ে?!”

“আশ্রয়!” অবাক হয়ে গিয়েছিল ইন্দিরা।

“আশ্রয় নয়? পাতাগুলো দেখিসনি তুই? সারাক্ষণ তাকিয়ে আছে তোর দিকে, তোর অস্বস্তি হয় না? যখন তুই ঘুমোস তোর সারা শরীরে গাছের পাতাগুলো নজর রাখে, নজর দেয়…”

“গাছের অধিকারবোধ নেই জিজি”, অস্ফুটে বলেছিল ইন্দিরা, রঞ্জনা শোনেনি, শুনতে পায়নি, আরো অনেক কিছুর মতই। ইন্দিরাও কি সব শুনতে পেয়েছে? অত দূরে দূরে সরে থাকলে কেউই কাউকে শুনতে পায় না।

সাদা দরজাটা থেকে দূরে সরে আসে ইন্দিরা। ওপারে যে ঘুমিয়ে আছে, এসব তার না জানলেও চলবে।

 

 

“তোমার সাদা জামা নেই কোনো!” অবাক হয়ে হিরণ তাকিয়ে আছে ইন্দিরার দিকে।

“না, তোমরা ঠিকই বলেছিলে, আমার ওয়ার্ডরোব নীল রঙে ভর্তি”, ইন্দিরা জবাব দেয়।

“আমি সেদিন পিজিতে ফিরে গুগল করেছিলাম, জানো কি দেখলাম?”

“কি দেখলে?”

হিরণ বলে, “নীল খুব একটা খারাপ রঙ নয়, নীল মনকে শান্ত করে”

ইন্দিরার চোখের সামনে দিয়ে তার কোলকাতার নীল ঘর একপাক ঘুরে যায়। অল্প হাসে সে হিরণের দিকে তাকিয়ে।

হিরণ বলে, “কিন্তু তোমার মত মানুষেরা অন্যের কাছে নিজেকে খুলে ধরতে পারে না, যার ফলে অন্যের কাছে আসতেও পারে না”

“এটাও কি গুগলে লেখা ছিল?” হেসে বলে ইন্দিরা

“না, গতকাল আনন্দীর সাথে কথা হচ্ছিল আমার”

একটু দূরে দাঁড়িয়ে রুবাঈ আর সমীকের সাথে গল্পে ব্যস্ত আনন্দীকে দেখে ইন্দিরা বলে, “তোমরা আমাকে নিয়ে চিন্তিত মনে হচ্ছে?” হাসি লেগে থাকে ইন্দিরার ঠোঁটে।

“খুব যে চিন্তা করি তা নয়, আমরা আজ আছি, কাল কে কোথায় যাবো ঠিক আছে? যতটুকু একসাথে থাকি, বেঁধে বেঁধে থাকতে চাই”

হিরণের কথাটা শুনে ইন্দিরা নিমেষে উদাস হয়ে যায়। আড়চোখে রুবাঈ আর আনন্দীকে দেখে, “ক্ষণিকের মানুষ…”

হঠাৎ সাউন্ড সিস্টেমে জোরে গান বেজে ওঠে, অমিতাভ বচ্চনের চিরপরিচিত রঙিন কন্ঠস্বর ছাদ ছেয়ে ফেলে। মঞ্জুনাথের থেকে পারমিশন করিয়ে ছাদে পুরো আয়োজন সেরে ফেলা হয়েছে। উত্তরভারতীয় হোলি পার্টির মতো একদল মানুষ অমিতাভর গলার সাথে পা মিলিয়ে নাচতে শুরু করেছে। হিরণ ইন্দিরাকে সেই নাচের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে, পারে না। হতোদ্যম হয়ে সে একাই সেই ভিড়ে মিশে যায়। ইন্দিরার চোখের সামনে একদল সুখী মানুষ নেচে চলে। তাদের সুখ দেখে ইন্দিরারও ভালো লাগে।

“নাচতে অস্বস্তি হয়, না ভিড়ে মিশতে?”

চমকে উঠে ইন্দিরা দেখে আনন্দী দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে, তার সাদা কুর্তিতে এখনও আবিরের দাগ লাগেনি।

ইন্দিরা বলে, “ভিড়ে মেশাটা কঠিন নয়, ওটা আমি পারি”

“তার মানে নাচ…”

“হ্যাঁ, হ্যাপি হোলি” ইন্দিরা হাসিমুখে বলে।

“রঙ না দিয়েই উইশ করছো?”

ইন্দিরা আশেপাশে তাকায়, কাছেই একটা টেবিলে নানা রঙ সাজানো আছে। টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই আনন্দী তাকে আটকায়, ইন্দিরা কিছু বলার আগেই আনন্দীর এক হাত তার গাল ছুঁয়ে ফেলে, সেহাতের লাল আবির আনন্দী খুব আলতো করে মাখিয়ে দিতে থাকে ইন্দিরাকে, যেন সাজিয়ে দিচ্ছে রঙে। আস্তে আস্তে ইন্দিরার কপাল, দুটো গাল আর নাকে যত্ন করে আবির মাখিয়ে দেয় সে, প্রতিমায় রঙ পড়ার মত ইন্দিরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রঙিন হয়ে যায়। ইন্দিরাকে রাঙিয়ে দিয়ে আনন্দী বলে, “হ্যাপি হোলি…”

টেবিল থেকে দুই মুঠো ভরা আবিরে আনন্দীকে রাঙিয়ে দিয়ে ইন্দিরাও বলে, “হ্যাপি হোলি।”

পরস্পরকে রাঙিয়ে দিয়ে তারা ভিড়ের দিকে তাকায়। রুবাঈ আর হিরণকে চেনা যাচ্ছে না রঙিন ভিড়টার মধ্যে। একটু পরে রুবাঈ এসে আনন্দীকে নিয়ে নাচতে চলে যায়, ইন্দিরা একা দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে থাকে।

উৎসবের দিনে যদি পৃথিবীকে দেখা যায়, মনে হবে কোনো শোক-তাপ নেই। বীতশোক। শোকহীন হওয়া ভালো না খারাপ? আবার শোককে আনন্দের বিপরীত বলে ধরা হয় কেন? পর পর অনেক প্রশ্ন এসে ইন্দিরাকে দিশেহারা করে তোলে। সে এই মুহূর্তে একই সাথে একটা বিষাদ আর আনন্দ টের পায়। আগেও অনেকবার পেয়েছে। শুধু কি সে-ই এমন? বাকীদের আনন্দ কি বিষণ্নতার থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে? সারা মুখে লাল আবির মেখে সবার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ভাবে ইন্দিরা। উত্তর পায় না কোনো।

 

“তোমার দাদা কি করছেন?” নাচের মাঝে বিরতি নিতে এসে জানতে চায় রুবাঈ।

“ওকে যথেচ্ছ বই আর দুপুরের খাবার দিয়ে এসেছি, তাই নিয়েই আছে”

“কোনো অসুবিধা হবে না তো? সেরকম হলে ওঁকে উপরে এখানে নিয়ে এসো”

“না, ওখানেই বরং ও স্বচ্ছন্দ্য বোধ করবে”

“আচ্ছা, তুমি ঠিক আছো তো?”

হাসে ইন্দিরা, বলে, “ঠিক না থাকার মতো কিছু নেই”

“আচ্ছা, তাহলে এসো রঙ দিই তোমাকে একটু”, এক মুঠো হলুদ আবির নিয়ে রুবাঈ বলে, “কিন্তু জায়গাই তো নেই, কোথায় মাখাবো?”

পাশ থেকে হিরণ বলে, “এর উপর দিয়েই মাখিয়ে দাও”

ইন্দিরা দেখে আনন্দী চুপ করে তাদের কথোপকথন শুনছে, তার ঠোঁটে হালকা একটা হাসি লেগে আছে।

হিরণ আর রুবাঈ মিলে ইন্দিরাকে রঙ দেওয়ার পর তাকে আর চেনার উপায় থাকে না কারোর। সমীককেও কিছুক্ষণ ধরে বেঁধে আবির মাখানো হয়। সবাই রঙিন হয়ে গেলে গ্লাসে করে ভাং আসে। সাথে সাথে ইন্দিরা সচেতন হয়, সমীকের জন্মদিনের পার্টির কথা তার মনে পড়ে যায়।
রুবাঈ একটু কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “ভয় পাচ্ছো?”

“কিছুটা… গতবার খুব অশান্তি করেছিলাম, তাই নিজেকে কথা দিয়েছি আর কখনও নেশা করবো না”

“অশান্তির ভয়ে, না ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে?”

ইন্দিরা বলে, “দুটোই”

“তোমায় বলেছিলাম মনে আছে, হাত ধরার কথা?”

মাথা নেড়ে ইন্দিরা সায় দেয়, তারপর কি ভেবে একটা গ্লাস তুলেও নেয়।

বেশ সুস্বাদু পানীয়টা গলায় ঢালতে ঢালতে ইন্দিরা দেখে আনন্দীও একটা গ্লাস তুলে নিয়েছে। সমীকের কয়েকজন কলিগের সাথে সে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। রুবাঈ, হিরণ আর ইন্দিরা নিজেদের পানীয় শেষ করে।

হিরণ বলে, “কিছুই তো হচ্ছে না, তোমার কিছু হচ্ছে?”

ইন্দিরা বলে, “না, রুবাঈ, তোমার?”

“না, আমারও না, এটা কি তবে শুধু শরবৎ ছিল?”

“সমীক যে সার্ভ করার সময় বলল ভাং…”, হিরণকে হতাশ দেখাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা ইন্দিরার মজাদার লাগে।

“তবে খেতে কিন্তু বেশ ভালো, তাই না?” আরো একটা গ্লাস তুলে নিয়ে বলে রুবাঈ।

ইন্দিরা দেখে আনন্দীও তার প্রথম গ্লাস শেষ করে পরেরটা তুলে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

হিরণ আর ইন্দিরাও দ্বিতীয় গ্লাস তোলে।

যেহেতু আনন্দী মুহূর্ত জমাতে ভালোবাসে, ভাঙের গ্লাস হাতে তাদেরও সেলফি তোলা হয়।

দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করার পর ছাদের উপরের ছোট ছাদটায়, যেখানে অনেকখানি আকাশ আছে, সেখানে উঠে আসে তারা চারজন। প্রবল হাওয়ায় নিজেকে হালকা লাগে ইন্দিরার। রেলিঙের ধার ঘেঁষে বসে সে চোখ বোজে। সাথে সাথে তার মনে হয় যেন সে আর মাটিতে নেই। চোখ খুলতে ইন্দিরা দেখে তার কাঁধে আনন্দী মাথা রেখেছে, তার চোখ বন্ধ। হিরণের গলা কানে আসে তার, যেন অনেক দূরে বসে সে কথা বলছে, “আমার খুব ভয় করছে”

রুবাঈ বলে, “কিসের ভয়?”

“মনে হচ্ছে আমরা সবাই মরে যাবো”

“হ্যাঁ, সে তো একদিন মরবই”

“না, একদিন না, আজকেই, আজকেই মরে যাবো”

“আজকে কেন?”

“আজকে হোলি তাই”

“হোলি তো কি হয়েছে?”

“হোলির দিনে আমরা সবাই মরে যাবো”

হিরণের অসংলগ্ন কথা শুনতে বেশ মজা লাগে ইন্দিরার। সে আনন্দীকে বলে, “শুনছো হিরণ কি বলছে?”

আনন্দী মাথা তোলে, “কি বলছে?”

“বলছে আজকে নাকি আমরা সবাই মরে যাবো”, হাসতে হাসতে বলে ইন্দিরা।

“তাই?” আনন্দীও হাসে, “ওর চড়ে গেছে মনে হয়”

ইন্দিরা হাসতে থাকে, আর টের পায় তার হাসি থামছে না, হাসতে হাসতে সে বলে, “আমারও মনে হচ্ছে চড়ে গেছে”, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে ইন্দিরা, চোখ ফেটে তার জল বেরিয়ে আসে। একটা সময় পর তার সমস্ত পেশী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, হাসতে হাসতেই ইন্দিরা বলে, “এর জন্যই আমি খেতে চাইনি”

“কিসের জন্য? মরে যাবে বলে?” হাসতে হাসতে বলে আনন্দী।

“না না,” একটু হেসে নিয়ে ইন্দিরা আবার বলে, “আবার হ্যাঁও,”

হাসতে হাসতে চোয়াল ব্যথা হয়ে গেলে ইন্দিরা অনেক কষ্টে নিজেকে থামায়। তারা শুনতে পায় হিরণ আর রুবাঈয়ের কথোপকথন।

রুবাঈঃ আমি মুসলিম হয়েও নামাজ পড়ি না, মহাপাপ করি

হিরণঃ আমি শিখ হয়েও সেবা করি না, গুরদ্বারা যাই না, মহাপাপ করি

রুবাঈঃ হয়তো তাই আমরা মরে যাবো

হিরণঃ আমি মরতে চাই না, তুমি চাও?

রুবাঈঃ না, আমিও চাই না

হিরণঃ এসো তবে নামাজ পড়ি

রুবাঈঃ হ্যাঁ, চলো, এই ইন্দিরা, পশ্চিম দিক কোনটা?

অজু না করে আকাশের নিচে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে রুবাঈয়াৎ আক্রম, কোনো জায়নামাজ ছাড়াই। তার দেখাদেখি পাশে বসে হিরণ। রুবাঈকে নকল করে হিরণজিৎ কৌর নামাজ পড়ার চেষ্টা করে।

রুবাঈঃ এই তুমি নামাজ পোড়ো না

হিরণঃ কেন?

রুবাঈঃ পাপ হবে

হিরণঃ ভোসড়ীকে…

 

হিরণকে গালি দিতে শুনে আনন্দী বিস্মিত হয়ে বড় বড় চোখে ইন্দিরার দিকে তাকায়, তারপর দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসতে হাসতে আকাশের নিচে শুয়ে পড়ে আনন্দী, তার পাশে ইন্দিরাও শুয়ে পড়ে।

আকাশে নরম মেঘ আর পেলব রোদ। ইন্দিরা চোখ বোজে। কিছুক্ষণ পরে সে বলে, “আনন্দী, যদি আজকে মরে যাই কি হবে?”

“কি আর হবে, মরে যাবো”

“তোমার শেষ ইচ্ছা নেই কোনো?”

“আছে তো…”

“কি?” চোখ খুলে ইন্দিরা আনন্দীর দিকে পাশ ফিরে শোয়।

আনন্দীও ইন্দিরার দিকে ফেরে।

ইন্দিরা জানতে চায়, “বলো…”

“বলবো” ইন্দিরার চোখে চোখ রেখে বলে আনন্দী।

“কি?”

“যা যা বলার থাকবে…”

ইন্দিরা অপলক তাকিয়ে থাকে আনন্দীর দিকে। টের পায় আনন্দীর চোখ ইন্দিরার ভিতরে ঢুকে আসছে। আনন্দী যেন আজকেই জেনে ফেলবে তার সবটা, একটা চাপা আনন্দ ইন্দিরার মনের ভয়গুলোকে তাড়িয়ে দিতে থাকে।

“আর তুমি??” আনন্দী জানতে চায়।

“হয়তো লিখে ফেলতে চাইবো,… সব কিছু”

আনন্দীর একটা হাত উঠে এসে ইন্দিরার আবির মাখা কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে থাকে। ইন্দিরার ঘুম পায়। সে চোখ বুজে ফেলে। মনে পড়ে, কোথায় যেন পড়েছিল, জীবনের সব থেকে প্রিয় মুহূর্তে মানুষ চোখ বন্ধ করে থাকে,- চুম্বন, প্রার্থনা বা প্রণাম করার সময়, কামনার সময় মানুষের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তখন আর তার চেয়ে থাকার প্রয়োজন থাকে না। মানুষটার সব কিছু তখন তার দৃষ্টির এপারে পৌঁছে গেছে।

নিজের ভিতরে ঢুকে এসে ইন্দিরা নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। আনন্দীকে আসতে দেখে, নিজের মধ্যে। আসতে দেয়।

 

কার ডাকে যেন ইন্দিরার চোখ খুলে যায়। সে চেয়ে দেখে আনন্দী চোখ বুজে গুনগুন করে কিছু একটা গাইছে। একটু দূরে একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে হিরণ আর রুবাঈ। চোখ বন্ধ করে তারা বসে আছে বলে, ঘুমিয়ে পড়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে ইন্দিরা উঠে দাঁড়ায়, আর দাঁড়াতেই যেন শুনতে পায় কে যেন নীচ থেকে ডেকে উঠল, “তিতির! তিতির! নিচে আয়!”

কে তাকে ডাকছে দেখার জন্য ছাদের রেলিঙের কাছে এসে স্থির হয়ে যায় ইন্দিরা, দেখে উল্টোদিকের একটা ছাদে পাশাপাশি অনেক অনেক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন, পিছু ফিরে, একটু ঝুঁকে, হাতদুটো পিছনে জড়ো করা, পায়চারি করার সময় যেমন থাকে। ইন্দিরার মনে হল, তিনি যেন রুষ্ট হয়েছেন তার প্রতি, যেন তাঁর অভিমান হয়েছে। ইন্দিরা পিছু ফিরে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথদের ডাকে, “এই! এই! শুনছেন!”

“কাকে ডাকছো, ইন্দিরা?”

নিচে তাকিয়ে সে দেখে নিচের ছাদ থেকে সমীক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

মাথা তুলে রবীন্দ্রনাথদের দেখাতে গিয়ে ইন্দিরা দেখতে পায় সামনের বাড়িটার ছাদে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ধোঁয়া ওঠার চিমনী, যাদের সে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিল। সে জবাব দেয়, “একটা পাখি… উড়ে গেল”

সমীক বলে, “নিচে এসো তোমরা”

“আসছি”

অভিমানী চিমনীগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ রঞ্জনার জন্য মন খারাপ করে ইন্দিরার। মেয়েটা কি করছে, কি লিখছে কে জানে… রঞ্জনা যদিও হোলিতে বিশ্বাস করে না, তবু ইন্দিরার ইচ্ছে হয়, এক ফোঁটা আবির ওর কপালেও লাগিয়ে দিতে। আকাশের দিকে মুখ তুলে ইন্দিরা রঞ্জনার জন্য এক ফোঁটা আবির কামনা করতে এক ফোঁটা জল এসে পড়ে ইন্দিরার কপালে, শহরে আবার অসময়ের বৃষ্টি নামছে। চিমনীগুলোর মাথার উপর ছাতার মত ডানা মেলে এসে বসছে কাক, কাকের দল। তার খেয়াল হয়, জয়তী তাকে কাকের কথা কিছু একটা বলেছিল, কি বলেছিল? ইন্দিরার মনে পড়ে না। নিজের উপর রাগ হয় তার, নিজের অন্যমনস্কতার উপর রাগ হয়, ইন্দিরা বিরক্ত হয় নিজের উপরে। 

ছাদের মাটিতে শুয়ে থাকা আনন্দী, রুবাঈ আর হিরণকে দেখে ইন্দিরা। ওদের উপরেও অকারণ রাগ হতে থাকে তার। কিছু না জানিয়ে লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচের ছাদে, নিচের ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে ইন্দিরা। ঘরে ঢুকে দেখে পিকলু বিছানায় আধশোয়া হয়ে জিবরানের দা প্রফেট পড়ছে। তাকে দেখে মুখ তুলে সে বলে, “চলে এলি যে? সব শেষ হল?”

“প্রায়…” বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দিরা।

“কিছু বলবি?”

“আমি কি রঞ্জনার সাথে অন্যায় করেছি দাদা?”

“আমি কি জানি, আমি জানি না, ওসব আমার জানার কথা নয়”

“আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতিস?”

“আমি তো তোর জায়গায় নেই… আমি তোর জায়গায় নেই… আমি কখনই তোর জায়গায় থাকব না”

“তবু?”

“আমি তোর জায়গায় থাকলে আজ এই মুহূর্তে হোলি পার্টি না করে, নেশা না করে, সবকিছু ভুলে গিয়ে এমন আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে কোলকাতার কোনো এক নার্সিংহোমে থাকতাম”, একটানা কথাগুলো বলে পিকলু হাঁফাতে থাকে।

“নার্সিংহোমে?!”

“হ্যাঁ, যেখানে রঞ্জনা আছে…”

“মানে! নার্সিংহোমে! কেন?!” ইন্দিরার পা টলে যায়, বেসামাল হয়ে সে বিছানায় বসে পড়ে।

বইয়ের দিকে মুখ তুলে পিকলু বলে, “গত সপ্তাহে, অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে… একটা ট্যাক্সি… ট্যাক্সির সামনে এসে পড়েছিল, অন্যমনস্ক তো…”

“তারপর!”

“তারপর আমি বাপিকাকুকে ডাকলাম… ফ্লাইট… টিকিট কাটতে হত…”

“কেমন আছে ও এখন! তুই আমায় আজকে এটা জানাচ্ছিস!” ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইন্দিরা।

“you chose to stay happy… you chose to stay happy… you chose…”

ইন্দিরা দেখে বিছানা সমেত পিকলু হঠাৎ হঠাৎ তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ক্যামেরার লেন্সে জুমআউট করলে যেমন দেখায়, তেমন। দূরে চলে যাওয়া পিকলুর কাছে পৌঁছাতে চেয়ে ইন্দিরা চেঁচিয়ে জানতে চায়, “রঞ্জনা কেমন আছে দাদা?!” ইন্দিরার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জলে আবির মিশে যায়, দেখে মনে হয় চোখ থেকে জল নয়, রক্ত ঝরছে। ইন্দিরা চিৎকার করে জানতে চায়, “রঞ্জনা ঠিক আছে তো!?”

জবাব না দিয়ে দা প্রফেট পড়তে পড়তে, ইন্দিরার থেকে হঠাৎ হঠাৎ দূরে সরে যেতে যেতে, পিকলু নিজের মনেই দুলতে দুলতে বলে, “রঞ্জনা আর রঞ্জিশ… শব্দ দুটো একে অপরের বেশ কাছাকাছি, অনেকটা এক রকম… একই শুনতে- না?” পিকলুর ঠোঁটে হালকা হাসি লেগে থাকে। (ক্রমশ…)



দশম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার