তারাদের ঘরবাড়ি – ১৬
চোখ খুলতে ইন্দিরা দেখল, ওর খুব কাছেই একটা তিল ঘুমিয়ে আছে। আবছাভাবে তিলটার দিকে তাকিয়ে থেকে ইন্দিরা কি যেন মনে করার চেষ্টা করল, অথচ মনে পড়ল না। মনে মনে আনন্দীর বুকের তিলটার উদ্দেশ্যে সে বলল, “বন্ধু হবি?”
ইন্দিরা ঘুমন্ত আনন্দীর দিকে তাকাল। ভারি ঘন চোখের পাতার নিচে মেয়েটার ঘুম এসে বসে আছে। আনন্দীর চোখের পাতায় চুমু খেল ইন্দিরা। আনন্দী জেগে উঠল, “এখন রাত না সকাল?”
“whatever you think it is”, হেসে বলল ইন্দিরা।
স্নান সেরে কিচেনে এল ইন্দিরা। পনিরের টুকরোগুলো গরম জলে রেখে মটরশুঁটি ছাড়াতে বসল। তারপর ছোটো ছোটো করে পেঁয়াজ কেটে ফেলল। গ্যাসে অল্প আঁচে তেল গরম করতে বসাতে ইন্দিরা টের পেল না আনন্দী কখন যেন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
“তুমি আমায় জানো, কিন্তু আমি তোমাকে জানি না, is that fair?”
চমকে উঠল ইন্দিরা, “মানে?”
“Tell me about yourself”
“কি বলব, বলার মতো তেমন কিছু তো নেই…”
“আমি তোমায় নীলেশের কথা বলেছি, আমার ছোটোবেলার কথা বলেছি, কিন্তু আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না”
ইন্দিরা অসহায়বোধ করে। বুকের ভেতর নরম যে জায়গাটায় সবসময় ব্যান্ডেজ বাঁধা থাকে আনন্দীর কথাগুলো সেখানে ঢুকে পড়ছে।
সে বলে, “কোথা থেকে শুনতে চাও বলো…”
“শুরু থেকে”, স্থির চোখে আনন্দী তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে।
রোদ চকচকে একটা সকালে ফিরে যায় ইন্দিরা। তাকে ছাদের মাটিতে বসিয়ে রেখে পিকলু সেখানে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। একটা এরোপ্লেন দেখিয়ে দেড় বছরের ইন্দিরা পিকলুকে বলে, “তাত”
পিকলু হেসে বলে, “কাক না ওটা, ওটা প্লেন, আকাশে শোওওও করে উড়ে যায়, বলো এরোপ্লেন”
ইন্দিরা জবাব দেয়, “তাত, তাত দাকে তা তা”
হঠাৎ করে কে যেন ছোঁ মেরে তাকে কোলে তুলে নেয়। মুখ ফিরিয়ে ছোট্ট ইন্দিরা দেখে মাথায় গোল সিঁদুরের টিপ পরা জয়তী, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, “তিতির পাখি, উড়বি নাকি?”
জয়তীর কথা শুনে ইন্দিরা খিলখিল করে হেসে ওঠে।
জয়তীকে দেখামাত্র লাটাই ফেলে রেখে পিকলু নিচে ছুটে যায়। ইন্দিরাকে কোলে করে জয়তী ছাদের পাঁচিলের কাছে চলে আসে। দূরে উড়তে থাকা কাক দেখিয়ে বলে, “ওই দেখ, কারা উড়ছে, তুই উড়বি?”
ইন্দিরা বলে, “তা তা”
ইন্দিরাকে পাঁচিলে বসিয়ে রেখে জয়তী পাঁচিলে উঠে পড়ে।
“জয়তী!” পিছন থেকে পিসির চিৎকার শুনতে পায় ইন্দিরা। পিসির দিকে ফিরে সে জয়তীকে দেখিয়ে বলে, “তাত”
জয়তী পিসির দিকে তাকিয়ে বলে, “দিদিভাই, এসো উড়ি!” দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে জয়তী পাঁচিল থেকে নিচে ঝাঁপ দেয়।
“জয়তী!”, পিসি চিৎকার করে ওঠেন। পাঁচিল থেকে ইন্দিরাকে কোলে তুলে নেয় পিকলু। নিচের দিকে তাকিয়ে ইন্দিরা দেখে, দোতলার ছাদে জয়তী ঘুমিয়ে আছে। জয়তীর মাথা থেকে লাল ছড়িয়ে পড়ছে ছাদের মেঝেতে। আঙুল দিয়ে জয়তীকে দেখিয়ে ইন্দিরা বলে ওঠে, “তা তা।”
কিচেনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দিরা। কোথাও একটা প্রচন্ড কষ্ট বোধ করে সে। আনন্দীকে বুঝিয়ে বলতে পারে না। তার দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় যেন চিৎকার করে কেঁদে উঠতে পারলে রেহাই মিলত।
“are you alright? Why are you shaking!”
কিচেনের মাটিতে বসে পড়ে ইন্দিরা, বলে, “আমি তৈরি নই, এখনও, সবটা বলতে, ভিতরটা… চারদিকে… ক্ষত আনন্দী”
আনন্দী বসে ইন্দিরার পাশে, ইন্দিরার মাথাটা বুকে টেনে নেয়।
কিছুক্ষণ পরে ইন্দিরা বলে, “আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি একটা suicide attempt এর”
আনন্দী কিছু বলে না, ইন্দিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“আমার জ্যেঠি, যাকে আমি জয়তী বলে ডাকি, সে নিজেকে একবার শেষ করে দিতে চেয়েছিল, যখন আমার দেড় বছর বয়স, আমার চোখের সামনে। এটাই আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি”
আনন্দী কিছু বলে না।
ইন্দিরা বলে চলে, “আমার যখন ছ মাস বয়স, মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন। মা’কে নিয়ে আমার ছোটবেলার কোনো স্মৃতি নেই। পিসি নিজের হাতে মানুষ করেছেন আমায় আর দাদাকে। আমি জানতাম আমাদের মা মারা গেছেন। পিসি অসুস্থ হওয়ার ঠিক দুদিন আগে আমায় ডেকে জানালেন মায়ের কথা। বোধ হয় পিসি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি আর থাকবেন না। হয়তো পাপস্খালন করতে চাইলেন।… বাবা সারাজীবন একা কাটালেন আমাদের নিয়ে। পরে ভেবেছি, বাবা কি মা’কে এখনও ভালোবাসেন? নাহলে বাবা সারাজীবন কিসের অপেক্ষায় থাকলেন? মা তো অপেক্ষা করেননি। মা এক প্রখ্যাত কবিকে বিয়ে করেছেন, তাকে নিজের “বিশেষ বন্ধু” বলে পরিচয় দেন দুনিয়ার সামনে, হয়তো ভিতরে ভিতরে কোথাও ওনার অপরাধবোধ আছে। কয়েক বছর আগে জানতে পেরেছি, সেই কবির ও ওনার এক মেয়ে আছে। তাকে মা খুব যত্নে মানুষ করেছেন। অথচ আমি… আমার তো কোনো অপরাধ ছিল না আনন্দী!” ইন্দিরা টের পায় কখন নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করেছে। আনন্দী ইন্দিরার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে। ইন্দিরা কিছু বলতে পারে না। তার ইচ্ছে হয় আনন্দীর বুকের ভিতরের খাঁচাটায় ঢুকে বসে থাকতে, যেখানে ভাস্বতী মুখার্জী কোনোদিনও এসে পৌঁছোতে পারবেন না। আনন্দী শক্ত করে ধরে থাকে ইন্দিরাকে। ইন্দিরা ভাবে, কই রঞ্জনা তো এভাবে বোঝেনি তাকে কোনোদিন।
উঠে বসে ইন্দিরা, “তুমি আমাকে নীলেশের কথা বলেছো, আমি তোমাকে রঞ্জনার কথা বলবো।”
বহুদিন পরে ইন্দিরা সারারাত জাগল, রঞ্জনার সাথে আলাপের প্রথমদিকে যেমন জাগতো। আনন্দীর চোখেও সারারাত ঘুম নামেনি। একে অপরের উত্তাপে রাত গলে গিয়ে ভোর হয় হাওয়াশহরে।
আনন্দী বলে, “তুমি কি ওকে মিস করো?”
“নাহ। আমি বোধ হয় কাউকেই মিস করিনা। এর একটা কারণ হতে পারে যে, সবটাই আমার ভিতরে ভরা আছে। আবার হয়তো, কোনো কিছুই আমার ভিতর অবধি পৌঁছোয় না।”
আনন্দীর বুকের তিলটায় হাত রাখে ইন্দিরা। আনন্দী তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে।
“চলো, তৈরি হতে হবে”
“তৈরি? কিসের জন্য?” ইন্দিরা জিজ্ঞেস করে।
“অফিস যাবে না?”
“ও, হ্যাঁ, অফিস…” দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্দিরা, “ভুলেই গেছিলাম”
আনন্দী ইন্দিরার চুল ঘেঁটে দিয়ে উঠে পড়ে।
“আনন্দী,”
“কি?”
“Can I take her with me,”
আনন্দী দেখে ইন্দিরা তার বুকের তিলটার দিকে ইশারা করছে, প্রশ্রয়ের হাসি হেসে সে বলে, “পাগল মেয়ে!”
লাঞ্চে রুবাঈ আর ইন্দিরা বাকিদের থেকে একটু দূরে এসে বসে। চামচে নুডলস জড়িয়ে নিয়ে রুবাঈ বলে, “তারপর?”
“আমরা দুজন মুখোমুখি বসলাম, অন্ধকারে”
“বনলতা সেন?”
ইন্দিরা হেসে ফেলে, বলে, “বনলতা সেনকে কি ছোঁয়া যায়? তিনি নিজেই তো ওই অন্ধকারটা। আমি- আনন্দী অত দুরূহ নই। পাখপাখালির মত আমরা একে অপরের ছোঁয়ায় আছি”, ইন্দিরার ফোন বেজে ওঠে, সে দেখে স্ক্রিনে ‘নীলেশ, আনন্দী ফিয়ন্সে’ ভেসে উঠছে, শেষ না হওয়া কথাটার সাথে ইন্দিরা যোগ করে বলে, “আপাতত” তারপর ফোন হাতে উঠে আসে।
ফোনটা ভাইব্রেট করছে আনন্দীর হাতে। তাদের পাশের টেবিলে তার চোখ চলে যায়। হিরণ আর আনন্দী কাজের কথা আলোচনা করছে সেখানে। আনন্দীর চোখে চোখ পড়ে ইন্দিরার। আনন্দী হাসে তার দিকে তাকিয়ে। অদ্ভুত আগুনের মত সে হাসি ইন্দিরার চারদিকে যেন রোশনাই ছড়িয়ে দেয়। এমনভাবে কতদিন কেউ তার দিকে তাকায়নি! ইন্দিরা আবার নিজের হাতে ফরে আসে। ফোনটা তখনও রিং করে চলেছে। ইন্দিরা ফোনটা কেটে দেয়।
“কিছু সমস্যা?” টেবিলে ফিরে আসলে রুবাঈ জানতে চায়।
“তোমাকে একটা কথা জানানো হয়নি…” ইন্দিরা দেখে নেয় আনন্দী হিরণের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত, “গত পরশু নীলেশ আমায় ফোন করেছিল। আনন্দীকে ফোনটা দিতে পারিনি।”
“নীলেশ… মানে আনন্দীর…”
“ফিয়ন্সে। কোথা থেকে আমার নম্বর পেল জানি না।”
রুবাঈ চুপ করে তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে। তারপর বলে, “আনন্দীকে বলেছো?”
“না, এখনও বলিনি, একটু আগের ফোনটা নীলেশের ছিল, আমি রিসিভ করিনি, কি করব বুঝতে পারছি না”
“Tell her”
ইন্দিরা আড়চোখে আনন্দীর দিকে তাকায়। দেখে আলতো আঙুলে নিজের মুখের উপর এসে পড়া চুল কানের পিছনে গুঁজে দিচ্ছে আনন্দী। মন দিয়ে দৃশ্যটা দেখে ইন্দিরা, তারপর রুবাঈকে জবাব দেয়, “পারবো না রুবাঈ।”
রুবাঈ আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে, তারপর বলে, “নিজের বুকে ছুঁড়ি তুমি তো প্রথমবার বসাচ্ছো না ইন্দিরা,”
“জানি প্রথমবার নয়, তবু… আমার জীবনে আজ অবধি কোনো নারী থেকে যাওয়ার জন্য আসেনি রুবাঈ, মা চলে গেছে জানার আগে, পিসি আমার বড় হওয়াটা না দেখেই বয়সের আগে চলে গেল, জয়তী থেকেও নেই, রঞ্জনা… ছেড়ে চলে গেছে। আমি পারবো না রুবাঈ, যদি ও নিজের থেকে চলে যায়, যাবে। তার আগে যতটা রোদ্দুর পাই, যতটা আলো, আমি তার এক কণাও ছাড়তে পারবো না।”
রুবাঈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ক্ষত কিন্তু গভীরতর হবে ইন্দিরা”
প্লেট হাতে উঠে পড়ে ইন্দিরা বলে, “জানি, আবার এও জানি, কবি বলেছেন, bleed gladly, willingly. আমি তৈরি থাকব রুবাঈ, ক্ষত তো এই প্রথম নয়। এক ক্ষত বুজিয়ে ফেলতে আরেক ক্ষত তৈরি হয়, চাঁদের কলঙ্কের মত একটা হৃদয় নিয়ে বসে আছি, তোমাকে তো তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।”
মিটিং থাকায় ইন্দিরার ফিরতে রাত হয়, আপার্টমেন্টে ঢুকতেই আনন্দীর গন্ধটা নাকে আসে তার। আজকাল শুধু গন্ধ দিয়েই ইন্দিরা বুঝতে পারে আনন্দী ধারে-কাছে আছে কিনা। আন্দাজে ইন্দিরা চলে আসে নিজের ঘরে। দেখে বিছানায় একরাশ ছবি সাজিয়ে বসে আছে আনন্দী। তাকে দেখে সে বলে, “দেখো তো, কেমন এসেছে?”
ইন্দিরা দেখে তার আর আনন্দীর ট্রেনিং ও অন্যান্য সময়ের অনেক ছবি সাজিয়ে বসে আছে মেয়েটা।
“কি হবে এত ছবি দিয়ে?”
“হলঘরের দেওয়ালটা খুব খালি লাগছিল কদিন ধরে, তাই ভাবলাম,” সম্মতির আশায় আনন্দী তাকিয়ে থাকে ইন্দিরার দিকে।
হেসে ইন্দিরা বলে, “কিন্তু ধরো আমাদের মধ্যে খুব লড়াই হলো, মুখ দেখাদেখি- কথা বলা বন্ধ, তখন?”
“আমার ছবি আমি নিয়ে চলে যাবো, তোমার ছবি তুমি রেখে দিও”, মজার ছলে বলে আনন্দী।
ইন্দিরার বুকটা ধক করে ওঠে, কেন সে বোঝে না, জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে সে বলে, “চলো”
হলঘরের দেওয়ালে পরপর অনেকগুলো ফটোফ্রেম সাজিয়ে দেয় তারা। দেওয়াল জুড়ে স্মৃতি সেজে উঠলে আনন্দী বলে, “আমি তোমাকে না বলে একটা কাজ করেছি”
“কি?”
“তোমার ফাইল ঘেঁটে এই ছবিটা বের করেছি, তুমি কি রাগ করবে আমার উপর?”
ইন্দিরা দেখে আনন্দীর হাতে ধরা একটা পুরোনো লাল হয়ে আসা ছবি, তাতে ছোট্ট পিকলু অপরেশের কোলে, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তরুণ ভাস্বতী, পিছনে মহিষাসুরের বিরাট এক মূর্তি।
ছবিটা আনন্দীর হাত থেকে নিজের হাতে নেয় ইন্দিরা, বলে, “রাগ করবো কেন, হঠাৎ আমার ফাইল খুঁজতে গেলে?”
“ভাবলাম যদি তোমার ছোটোবেলার কোনো ছবি পাই…”
“আমার ছোটোবেলার কোনো ছবি নেই আনন্দী, কেউ তোলেনি, মায়ের চলে যাওয়াটা সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল আমার দিক থেকে। বাবা দিনকে দিন উদাসীন হয়ে পড়ছিলেন, পিসি আমাদের সামলাতে নাজেহাল, জ্যেঠু আমাদের খেয়াল রাখতেন, কিন্তু ওই যে আমার দেড় বছর বয়স নাগাদ জয়তী ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়, তারপর বছর খানেক শয্যাশায়ী ছিল সে। জ্যেঠু তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উপায় ছিল না, আমাকে বড় করে তোলা ছাড়া অন্য কোনো দিকে আমার বাড়ির বড়রা মন দিতে পারেননি।”
আনন্দী চুপ করে কিছু ভাবতে থাকে।
“কি ভাবছো? আমি আর এই নিয়ে শোক করি না। ছোটবেলায় অভিমান হত খুব। এখন বুঝতে পারি ওঁদের মনোভাব।”
আনন্দী বলে, “ইন্দিরা, আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে”
“হঠাৎ? কাল অফিসে কাজ আছে?”
“না, কাল আমরা সিক লিভ নেবো”
“মানে?! কেন!”
“do you trust me?”
“হ্যাঁ, কিন্তু…”
“একদিনের জন্য যা যা দরকার তা প্যাক করে ফেলো একটা ব্যাগে, কাল ভোরে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে”
হলঘর থেকে আনন্দী কিচেনে চলে যায়। ইন্দিরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
বাসে ওঠার পরেও ইন্দিরা বুঝতে পারে না কোথায় চলেছে তারা। বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশ দেখে তার মন ভালো হয়ে যায়। সেমি স্লিপার বাসে সিট এলিয়ে দিয়ে আনন্দীর কাঁধে মাথা রেখে শোয় ইন্দিরা।
“বুঝতে পারলে কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“না, বোঝাটা কি দরকারি?”
“একেবারেই দরকারি নয়”
চোখ বোজে ইন্দিরা।
মাইসোর শহরে পৌঁছতে ঘন্টা চারেক লেগে যায়। প্যালেসের সামনে বাস থেকে নেমে পড়ে তারা। লোকাল বাসে পাহাড়ের কোল বেয়ে চামুন্ডা হিলে উঠে আসে আনন্দী আর ইন্দিরা।
বাস থেকে নেমে ইন্দিরা দেখে মানুষের ভিড় মন্দির চত্বরে। আশে পাশের দোকান থেকে অনবরত পুজোর সামগ্রী কেনার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেসব অগ্রাহ্য করে আনন্দী ইন্দিরার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। ভিড় একটু হালকা হয়ে যেতে ইন্দিরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“তুমি কিভাবে জানলে?!”
উত্তরে আনন্দী হেসে মহিষাসুরের বিরাট মূর্তির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ইন্দিরাকে। ঠিক যেখানে বছর ত্রিশ আগে অপরেশ ছোট্ট পিকলুকে কোলে করে দাঁড়িয়েছিলেন, আর সাথে ছিলেন ভাস্বতী মুখার্জী, ঠিক সেখানে।
ইন্দিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মূর্তির পায়ের কাছে। চোখে সানগ্লাস থাকায় কেউ টের পায় না, তার চোখ জলে ভরে উঠেছে। ইন্দিরার ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে আনন্দীর পায়ের কাছে বসে পড়ে।
ইন্দিরার কয়েকটা ছবি তুলে আনন্দীও যোগ দেয় নিজস্বী তোলার জন্য। একহাতে আনন্দীর কাঁধ শক্ত করে ধরে থাকে ইন্দিরা। যাতে মুঠো আলগা হলেই পালকের মত সে উড়ে না যেতে পারে।
মাইসোর চিরিয়াখানার জিরাফ, শিম্পাঞ্জি, হরিণ ও ইত্যাদি দেখার পর একটা রেস্ট্যুরেন্টে খেতে ঢোকে তারা। খাওয়ার টেবিলে বসতে আনন্দীর ফোন বেজে ওঠে, হিরণ তাদের দুজনকে অফিসে না পেয়ে ফোন করেছে। আনন্দী তার সাথে কথা বলতে থাকলে ইন্দিরা নিজের ফোনটা টেবিলে রেখে খাবারের অর্ডার দিতে উঠে আসে।
হালকা কিছু ভেজ খাবার অর্ডার দিয়ে ইন্দিরা টেবিলে ফিরে আসে। দেখে ইন্দিরার ফোন হাতে নিয়ে তার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আনন্দী চুপ করে বসে আছে।
“কি হল?”
“তোমার কাছে একটা ফোন এসেছে”, বলে আনন্দী ইন্দিরার দিকে ফোনটা এগিয়ে দেয়।
ফোনটা হাতে নিয়ে ইন্দিরা দেখে স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে নাম, ‘নীলেশ, আনন্দী ফিয়ন্সে’ কলিং।
ইন্দিরা কিছু বলে ওঠার আগেই আনন্দী টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রেস্ট্যুরেন্ট ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায়।
বাজতে থাকা ফোন হাতে নিয়ে ইন্দিরা তার চলে যাওয়া দেখে।