দিয়েগো মারাদোনা: মানুষ, না ঈশ্বর? | রুহুল মাহফুজ জয়

ডিসেম্বর, ২০২০

ব্যাগশট, সারি, যুক্তরাজ্য।

প্রিয়তমাসু,

মানুষের ধারণা থিকা ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের ধারণা হ’তে মানুষের মৃত্যু হলো। বয়স আর কত, তখনও পুরুষের যৌবন থাকে—মাত্র ষাট। আর ঈশ্বরের ধারণা তো অনন্তযৌবনা। জন্মেছিলেন বুয়েনোস এইরেসের লাগোয়া এক বস্তিতে, গুয়ের গন্ধ লেগে থাকা ভিলা ফিউরিতোতে। মানুষের কাছাকাছি থাকা ঈশ্বরেরা সাধারণত এমন দুর্গন্ধময় বস্তিতে, নাইলে গাঁয়ের কুঁড়েঘরেই জন্মায়—অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে অনেক; সিদ্ধার্থের কথা কিভাবে ভুলে যাই, বলো! না গো, আমারে আবার অই পর্যায়ের লোক ভেবে নিও না। আমি ঈশ্বর-টিশ্বর গোছের কেউ না, অতিসাধারণ একজন। ঈশ্বর হ’তে গেলে দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা হওয়া লাগে। হ্যাঁ, মারাদোনার কথাই বলছি। এক হাতে হাভানা চুরুট, অন্য হাতের মধ্যমা আসমানের দিকে তাক ক’রে পুঁজিবাদীগোষ্ঠীরে ‘ফাক ইউ’ বলা শিখতে হয়। আমি এখনও পুঁজির তলে চ্যাপ্টা হৈয়া আছি। এই চ্যাপ্টাবস্থা থিকা মুক্তি চাই বটে, তয় মুক্তি পাওয়া একখান অলীক ঘটনাই হবে। এখন কথাটা হলো, মারাদানা ঈশ্বর নাকি মানুষ? দুনিয়ার কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমী, আর্হেন্তিনা আর নাপোলির লোকজনের মানসে লোকটা এখনও ঈশ্বর—যিনি রক্ত-মাংসে তৈরি ছিলেন। তিনি চিরকালই হয়ত তাদের কাছে ঈশ্বর হয়েই থাকবেন। তয় আমি ওনারে মানুষ হিসাবে দেখি, একদম দোষে-গুণে ভরপুর একজন মানুষ। কে কি বললো বা মনে করলো, অইসবের দিকে না তাকায়ে কেবল নিজের মর্জিরে পাত্তা দিয়ে একটা জীবন কাটায়ে যাওয়া একজন মানুষ। আবার ব্যক্তিসত্তার বাইরে মারাদোনা যখন কেবলই ফুটবল মাঠের, তখন তার ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতাগুলিরে অস্বীকার করতে পারি না, করার উপায় থাকে না। দুইটা ব্যক্তিসত্তারে তিনি সমান্তরালে চালায়ে নিয়ে গেছেন। একজন দিয়েগো, আরেকজন মারাদোনা। দিয়েগো সেই ব্যক্তি, যিনি বস্তি থিকা উঠে আসা বিনয়ের অবতার, পরিবার আর বন্ধু-বান্ধবের প্রতি বিশ্বস্ত, পরিবারের সুখ-শান্তির জন্যে যে লোকটা সবই করতে পারে। অপর দিকে মারাদোনা মহাতারকা। যিনি ফুটবল বিজনেস আর মিডিয়ার হটকেক, নারী আর ড্রাগস নিয়ে যার লাগামহীন এক জীবন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সাম্রাজ্য আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়ে রাজনৈতিকভাবে ন্যায়ের পক্ষে থাকা লোকটা দিয়েগো নন—তিনি মারাদোনা। চে গেভারাকে অনুসরণ ক’রে ফিদেল কাস্ত্রো আর উগো শাভেজের বন্ধু হয়ে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে ভোকাল হ’তে গেলে এমন ফিগারের লোক হওয়া লাগে—দুনিয়ার মানুষজনের নিকটে যার গ্রহণযোগ্যতা আছে, সকলেই যারে নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। এই লোকটা দিয়েগো নহেন, তিনি মারাদোনা। কাস্ত্রো-শাভেজদের মত নেতাগো বন্ধু হ’তে এলিট হওয়া লাগে, মারাদোনার মতন সেলেব্রিটি হওয়া লাগে—দিয়েগোর মতন সাধারণ লোকের পক্ষে তা সম্ভব ছিলো না। দিয়েগো কেবলই তাঁর পরিবার আর বন্ধুদের। আর দুনিয়াব্যাপি ফুটবল ভক্তদের কাছে তিনি মারাদোনা বা ম্যারাডোনা। ফুটবল খেলায় তিনি আমজনতার প্রতিনিধি। দিয়েগোর একমাত্র স্বপ্ন ছিলো বাবা, মা আর পাঁচ ভাই-বোনসহ নিজেরে ভিলা ফিউরিতোর বস্তি থিকা চিরতরে বের ক’রে ভদ্রসমাজের যাপন উপহার দেবেন। ফুটবল খেলার পেছনে দিয়েগোর আর কোনো উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন ছিলো না। সেই স্বপ্ন আর উদ্দেশ্যটা তিনি ষোল বছর বয়সেই পূরণ ক’রে ফেলেছিলেন। মারাদোনার স্বপ্ন ছিলো বিশ্ব জয় করা, নাঙা উচ্ছ্বাসে বন্ধন-শৃঙ্ক্ষলহীন যাপিত এক জীবন। আমি আলাপ দিতাছি মারাদোনারে নিয়া। তিনি যে ঈশ্বর, আবার আশ্চর্য এক মানুষ—আজ তোমারে সেই কথাই কইতে চাই।

মারাদোনা যখন নাপোলিতে যান, তখন ইতালিয়ান লিগ-ই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ফুটবল লিগ। সারা দুনিয়ার সেরা ফুটবলাররা তখন ইতালিতে খেলতে মুখিয়ে থাকতেন। হয় এসি মিলান, ইন্টার মিলান, লাৎসিও নাহয় য়্যুভেন্তাসের জার্সিতেই খেলতে চাইতেন সবাই। মিশেল প্লাতিনি, রুদ খুলিতরা তখন ইতালিয়ান লিগে খেলেন। ইতালি তো বটেই, নাপোলি ছিলো পুরা ইউরোপের-ই অন্যতম দরিদ্র শহর। এই দল তখনও লিগ জেতার স্বাদ পায়নি। দল রেলিগেশন এড়ায়ে মিড টেবিলে থেকে লিগ শেষ করতে পারলেই সমর্থকরা বিরাট সাফল্য হিসাবে দেখতো। তারপরেও, মারাদোনা নাপোলিতে গেলেন। এর একটাই কারণ— যেভাবেই হোক, তিনি স্পেন ছাড়তে চাইছিলেন। বিশ্বসেরা হবেন, এমন স্বপ্ন অন্তরে নিয়ে প্রিয় বোকা জুনিয়র্স ছেড়ে বার্সেলোনায় এসেছিলেন। দুই মৌসুম থাকলেন, একটা মৌসুমেরও পুরাটা খেলতে পারলেন না। প্রথম মৌসুমে ভয়াবহ নোংরা এক ট্যাকলে পা ভেঙে দীর্ঘদিনের জন্য মাঠ ছাড়লেন, পরের বছর করলেন মারামারি। মাঠ আর মাঠের বাইরে কোথাও সুখি হ’তে পারছিলেন না। যে কারণে মন্দের ভালো হিসাবে চুরাশিতে পাওয়া নাপোলির অফারটা লুফে নিতে দুইবার ভাবেন নাই। বার্সা থিকা নাপোলিতে যাওয়াটারে মারাদোনা নিজে দেখতেন এভাবে— ‘বার্সেলোনা একটা বিপর্যয় ছিলো। আমি নাপোলি চিনতাম না, ইতালিও চিনতাম না। চাইছিলাম একটা বাড়ি, পাইছি ফ্ল্যাট; একটা ফেরারি চাইছিলাম, পাইছি একটা ফিয়াট। বার্সা আমারে নিঃস্ব কইরা দিছিলো’। বার্সায় তিনি এতটাই অসুখি ছিলেন যে, নাপোলি আসলে ক্লাব না, মারাদোনার নিকটে এসেছিলো দেবদূতের রূপে। বিশ্বসেরা হ’তে চাওয়া মারাদোনা ইতালির দরিদ্রতম নগরী নাপোলিতে গিয়েছিলেন শান্তি আর সম্মানের জন্য, বার্সেলোনায় যা ছিলো না। যে সময়ে বিশ্বরেকর্ড ট্রান্সফারে মারাদোনাকে সাইন করানো হয়, দেনার দায়ে নাপোলি ফুটবল ক্লাব তখন জর্জরিত। অই অবস্থা থিকা ক্লাবটারে টেনে তুলতে জাদুকরি ব্যাপার-স্যাপারের সাথে একজন সত্যিকার জাদুকরের দরকার ছিলো। মারাদোনার চাইতে বড়ো ফুটবল জাদুকর তখন আর কে হ’তে পারতেন! কেউ না। তাস খেলার টেবিলে সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কার সময়ে অলৌকিক ট্রাম্প খেলার মতই মারাদোনা-কার্ড খেলেছিলেন নাপোলি প্রেসিডেন্ট। ফুটবলীয় প্রতিভা নিয়া বিন্দুমাত্র সংশয় নাই, কিন্তু মাঠের বাইরের জীবনের কারণে মারাদোনা ছিলেন ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ এক বাজির ঘোড়া। ভাগ্যিস, কোরাদো ফারলেইনো ট্রাম্পকার্ডটা খেলেছিলেন!

কন্যার সঙ্গে দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা

নাপোলিতে মারাদোনার পয়লা সংবাদ সম্মেলনে, স্টেডিয়ামের বাইরে প্রায় এক লাখ মানুষ যখন দিয়েগো দিয়েগো শ্লোগানে মুখর ক’রে রেখেছে, পয়লা প্রশ্নটাই ছিলো মারাদোনা কামোরা সম্পর্কে জানেন কিনা, অই জায়গাটার (নাপোলি) চারপাশে কামোরার টাকা-পয়সা, এমনকি ফুটবলেও। বিব্রত মারাদোনাকে উদ্ধার করেছিলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। উনি সোজা অই সাংবাদিকরে সম্মেলন থিকা বাইর কৈরা দিছিলেন। এটা অন্যায়ই হৈছিলো, সন্দেহ নাই। মিস্টার কোরাদো বলেছিলেন, প্রশ্নটা মারাদোনার জন্য অপমানজনক। ক্রিমিনালগো লগে নাপোলি ফুটবল ক্লাবের কোনো সম্পর্ক নাই। অনেক কাঠ-খড় পোড়ায়ে যে খেলোয়াড়টারে (মারাদোনা) আনা হৈছে, তারে শুরুতেই আজাইরা প্রশ্নবানের সামনে ফেলা রুচিগর্হিত কাজ। সংবাদ সম্মেলন শেষে স্তাদিও সান পাওলোর ঘাসের গালিচায় ফুটবল হাতে যখন মারাদোনাকে হাজির করা হয়, ততক্ষণে গ্যালারিতে তিল পরিমাণ জায়গা খালি নাই। কোনো খেলোয়াড়রে সাইন কৈরা সমর্থকদের সামনে হাজির করার সময়ে এমন উন্মাদনা আর কখনোই দেখা যায় নাই। পরিস্থিতি কি হৈতে যাইতেছে, তা অবশ্য তিনি স্টেডিয়ামে যাবার সময়েই, রাস্তাতে টের পাইছিলেন।

তখন ইতালিয়ান ফুটবলের রিদম, গতি সবই ছিলো বাকি দুনিয়ার ফুটবল থিকা আলাদা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি, খেলোয়াড়রা খুবই ফিজিক্যাল—ট্যাকলের যেন মা-বাপ নাই! শুরুর দিকে মানায়ে নিতে কষ্টই হলো, স্বয়ং মারাদোনারও! তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই রিদমের লগে খাপ খায় এমন একটা খেলার স্টাইল তাঁর তৈয়ার কৈরা নিতে হবে। তিনি ভাবলেন, এক দিক দিয়ে খেলে গতি বাড়ালে আকাইম্মা খেলোয়াড় হয়ে যাইতে পারেন। আবার এইটাও বুঝলেন, নিজের টেকনিকে সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়ালে অই টেকনিক কার্যকর থাকবে না। যে কারণে খেলার স্টাইলে ভারসাম্য তৈয়ার করার পন্থা খুঁজছিলেন। ছোট্ট একটু পরিবর্তন আনলেন। নিজের গতি বাড়ালেন, সেটা কেবল বল প্লেয়িংয়ের সময়। আর ড্রিবলিংয়েও আপস করলেন না। ব্যস! তাতেই জাদুকর মারাদোনাকে খুঁজে পেলো ইতালিয়ান ফুটবল। মারাদোনা সেই ফুটবলার, যিনি কোনোকালেই শারীরিক শক্তিরে কাজে লাগায়ে খেলেন নাই। তিনি ঈশ্বরপ্রদত্ত অবিশ্বাস্য প্রতিভা দিয়ে ফুটবল খেলার অই গোল বলটারে নিজের বাঁ পায়ের গোলাম বানাইছিলেন। আর শিখেছিলেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ধোঁকা দিয়া বল পায়ে এগিয়ে যাবার জাদু।

নাপোলিরে নিয়া য়্যুভেন্তাস সমর্থকদের গানের লিরিক ছিলো এরকম— নাপোলিয়ানরা আইলে / এমনকি কুত্তারাও দৌড়ায়ে আসে / কলেরার রোগী / ভূমিকম্পের শিকার / শরীর ধোয় না কখনো সাবানে / তোমরা গু / তোমরা কলেরা / তোমরা পুরা ইতালির শরম / বেগার খাটো তোমরা / মারাদোনাও বেচবে তোমাগো পাছা / নাপোলিতানরা ইতালির আফ্রিকান… অন্য ক্লাবগুলির সমর্থকরাও যে তাগো ভিন্ন চোখে দেখতো, তা না। মিলান, লাৎসিও, তুরিনোর সমর্থকরাও নাপোলিরে নোংরা, চাষাগো ক্লাব, ইতালির নর্দমা বলেই খেপাতো। তাগো চুপ করায়ে শোধ তুলেছিলেন মারাদোনা। তিনি যখন নাপোলিতে আসেন, তখন ক্লাবটা রেলিগেশন ফাইট দেয়। একের পর এক হারের পরেও মৌসুমের শেষ দিকে ফাইট দিয়া আট নম্বরে থেকে লিগ শেষ করে। নাপোলিতানরা মূলতঃ পরের মৌসুম থিকাই মারাদোনার জাদু দেখতে শুরু করে।

য়্যুভেন্তাসের সাথে মারাদোনার ফ্রিকিক গোলের পর পাঁচ নাপোলি সমর্থক আনন্দের আতিশয্যে জ্ঞান হারান, স্ট্রোক করেন আরও দুইজন। বহু বছর পর অই গোলেই নাপোলি তুরিনের ওল্ড লেডিরে হারায়। অই ম্যাচের পরই নেপলসে মারাদোনা ঈশ্বর হয়ে যান। প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে, বিছানা ঘেঁষে যীশুর ছবির পাশে মারাদোনার ছবি জায়গা পেয়ে যায়। শহরের দেয়ালগুলি ভরে ওঠে মারাদোনাকে আঁকা অবতারে, সকাল-সন্ধ্যা তাঁর বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড় করাটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যায়। নাপোলির মানুষজন জানতো না, পরের বছর এমন কিছু হবে, যার স্বাদ তাদের অজানা।

নাপোলিতে এমন একটা ফিগার তৈয়ার হবে আর কামোরার বস কারমাইন গিউলিয়ানো তারে নিজের দিকে ভেড়াবেন না, তা হয় না। ব্যাপারটা ইজ্জতের ইস্যু। কামোরা তখনকার নাপোলির ড্রাগস আর অপরাধজগতের সবচাইতে ক্ষমতাবান গ্রুপের নাম। পতিতালয়গুলাও কামোরার দখলেই ছিলো। বার্সেলোনায় একটা পাবে মারাদোনা পয়লা কোকেইনের স্বাদ নিছিলেন। তাঁর ভাষায়, মাত্র একটা পুরিয়া তারে অন্য জগতে নিয়ে গেছিলো। বার্সার তুলনায় নাপোলি তো ড্রাগসের স্বর্গরাজ্য। সেই স্বর্গরাজ্যের সম্রাট কারমাইনের দাওয়াত মারাদোনা ফেরাতে পারেন নাই। কোকেইন আর নারী—দু’য়ের সাপ্লাই-ই দিতো কামোরা। ফুটবল মাঠের বাইরে রাতের জীবনে মারাদোনার সঙ্গী হলো কামোরার লোকজন। যে জীবনে রঙিন দুনিয়ার কোনোকিছুর অভাব নাই, কেবল ফড়িংয়ের-দোয়েলের সাথে সে জীবনের হয় নাকো দেখা। মারাদোনা হয়ে উঠলেন কামোরার অলিখিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। দ্যাখো—শহরের সবচাইতে পপুলার লোকটাও আমার কাছের মানুষ—নাপোলিবাসীরে কারমাইনের এটা দেখানো হলো, আর মারাদোনা পেলেন কোকেইন পাবার নিরাপদ মাধ্যম। সাংবাদিকরা তো জানতোই, নাপোলির সাধারণ লোকেরাও মারাদোনার এই ওপেন সিক্রেট জানতো। কিন্তু মাঠে ফুটবল পায়ে এমন সব মুহূর্ত তৈয়ার করছিলেন যে, মারাদোনা তাদের মানসপটে কেবল ঈশ্বর হয়ে উঠলেন। এমন এক ঈশ্বর—যার মাদক আর যৌনতার লোভ আছে। দ্যাখো, তিনি যদি ঈশ্বরগোত্রীয় কেউ হতেন তাহলে নাপোলিতে পা রাখার পরে পয়লা সংবাদ সম্মেলনেই যাদের নিয়া প্রশ্ন করায় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট খেপে গেছিলেন, পয়লা দিনই কামোরা নামের মাফিয়াগোষ্ঠীর কথা জানার পরেও তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিতেন না। তিনি মানুষ বলেই, দুর্নামরে পরোয়া করতেন না বলেই কামোরারে ধরা দিছিলেন। তিনি এর পরিণাম অবশ্যই জানতেন। তারপরেও ফরচেলায় কারমাইনের বাড়িতে নিয়মিত যেতেন। ক্যান যাইতেন? উত্তর খুব সোজা, নেশা মেটাতে। নারীসঙ্গ আর নেশার স্বর্গীয় সুখের চূড়ায় উঠে নিজেরে মানুষের কাতারে রাখতে।

নাপোলিতানদের চোখে সন্তু মারাদোনা

ঈশ্বরগোত্রের লোকেরা তাঁর সঙ্গীর সাথে প্রতারণা করে না, মিছা কথা কয় না। একজন মারাদোনা দু’টিই করেছেন। নানাবিধ প্রতারণা করেছেন—জেনে-বুঝেই করেছেন। ঈশ্বরের অত আবেগ থাকে না। কেবল নিজের স্তুতি চায়, পূজার অর্ঘ্য চায়, প্রার্থনা চায়। মারাদোনা এর কোনোকিছুকেই পরোয়া করতেন না। আবেগ তাঁকে কাবু করে ফেলতো, মিথ্যা বললে চোখ-মুখ দিয়ে সত্যটা ঠিকরে বেরোতো। আশির দশকের মাঝের সময়টায়, তিনি যখন নাপোলির জনপ্রিয়তম মানুষ, স্বাভাবিকভাবেই নারীদের পরম প্রার্থিত পুরুষ ছিলেন মারাদোনা। নারীরা কোনো ঈশ্বরের প্রতি যৌনকাতর হয় না। তিনি এতটাই যৌনতাড়িত মানুষ ছিলেন যে, শৈশবের প্রেমিকা ক্লদিয়ার অনুপস্থিতিতে বোন মারিয়ার বান্ধবী ক্রিস্তিনা সিনাগ্রার পেটে বাচ্চা দিতে, সেই বাচ্চার পিতৃত্ব অস্বীকার করতে একটুও ভাবেন নাই। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকতে নিশ্চয় বিতর্ক চান নাই, ক্লদিয়ার সাথে সম্পর্কটাও ঠিক রাখতে চাইছিলেন। বৈষয়িক ব্যাপারে সতর্কতা, জেনে-বুঝে অন্যায় করা, আবার অনুতাপের আগুনে ঝলসে গিয়ে জন্মের প্রায় তিরিশ বছর পর ক্রিস্তিনার জন্ম দেওয়া সন্তানেরে বুকে জড়ায়ে স্বীকৃতি দেওয়াও প্রমাণ করে তিনি মানুষ। নাপোলিতে অসংখ্য নারী তাঁর শয্যাশঙ্গিনী হয়েছেন, হিদার পারিসি নামের এক টিভি উপস্থাপিকার সাথেও নিয়মিত শুয়েছেন। ক্লদিয়া-মারাদোনার প্রেম ছিলো সর্বত সুন্দর। হলে হবে কি, ক্লদিয়া নাপোলিতে চলে আসার পরেও নাইটক্লাব, পরনারীসঙ্গের যে জীবন—মারাদোনা তারে বিদায় করেন নাই। অন্ধকার রাতের জগতে তিনি ছিলেন উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের একজন, রাতের জগতে যদি কোনো ঈশ্বরতার রূপ থেকে থাকে, তবে তাঁর নাম দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা। নাচে মারাদোনা ছিলেন তুখোড়, নিজে নাচতেন, চারপাশের সবাইরে নাচাতেন। ঈশ্বর তো বহুদূরের ব্যাপার, ব্যক্তি মারাদোনা নিজেরে সন্তু বলে স্বীকার করতেও নারাজ ছিলেন।

৮৬-তে মারাদোনা যখন নেতৃত্বের আর্মব্যান্ডসহ আর্হেন্তিনা দলকে নিয়ে মেহিকোতে যান, তখন ক্রিস্তিনার গর্ভধারণের ব্যাপারটা তাঁরে বেশ পেরেশানিতে রেখেছিলো। অই সময়ে যেকোনো পেরেশানিতে কলিজা ঠান্ডা করতে লোকটা তিনজনের কাছে আশ্রয় নিতেন। মা, বাবা অথবা ক্লদিয়া। মাকে খুব ভয় পেতেন, ভালোও বাসতেন সবচেয়ে বেশি। তুমি তো আর্হেন্তিনা ফুটবল দলের সমর্থক; হয়ত জানো, লা আলবিসেলেস্তে দল যখন কোথাও খেলতে যায়, প্রচুর পরিমাণে গোরুর মাংস নিয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তাজা রাখতে নিয়মিতই বারবিকিউ পার্টি করে, পানাহারে প্রধান আহার থাকে স্টেক বা কাবাব। এটা আর্হেন্তিনা দলের ঐতিহ্য। সেবার মারাদোনার বাবাও মেহিকোতে ভ্রমণ করেন। আর বুঝতে পারেন, পুত্রের হৃদয় বিক্ষিপ্ত। বাবা পুত্রকে শান্ত করেন, খেলায় মনোযোগ দিতে বলেন। মারাদোনা সিনিয়র ৮৬-তে মেহিকোতে না গেলে হয়ত ফুটবল ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হ’তো। ফুটবল পায়ে সারা দুনিয়াকে মন্ত্রমুগ্ধ করা, আর্হেন্তিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো—শৈশবের স্বপ্ন পূরণ না-ও হ’তে পারতো। মাঠের বাইরে মারাদোনা মানুষ বলেই অস্থির সময়ে মা, বাবা বা প্রেয়সীকে দরকার পড়তো—ঈশ্বরেরা তো একক শক্তি! আর্হেন্তিনার এক বরপুত্র ইতালির ফুটবল মানচিত্র বদলে দিয়েছেন, সেই আর্হেন্তিনার সাথেই ছিয়াশি বিশ্বকাপে ইতালির দেখা। ওরা তখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আর খোদ আর্হেন্তিনার মানুষেরাই নিজেদের দলকে নিয়ে কোনো আশা করে নাই। সেই বরপুত্রের গোলে তখনকার চ্যাম্পিয়ন ইতালির সাথে ১-১ ড্র করার পরেই দলটার ওপর বিশ্বাস ফিরে এলো, বিশ্ব মিডিয়াও আর্হেন্তিনার দিকে নজর দিলো। ইতালিয়ান এক সাংবাদিক ম্যাচ শেষে মারাদোনাকে জিজ্ঞেস করলেন, এবারের বিশ্বকাপটা কী মারাদোনার? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি এটা চাই। বিশ্বকাপটা মারাদোনার হলে আর্হেন্তিনারও বিশ্বকাপ হবে এটা’। অধিনায়ক পুরাপুরি জানতেন, কাপ জিততে হলে খেলোয়াড় হিসাবে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় উঠতে হবে। তাই তিনি শুধু নিজেই খেললেন না, খেলালেন পুরা দলকে। একেকজন খেলোয়াড়কে মানসিকভাবে দৈত্য বানালেন। ফুটবলের চিরায়ত রূপকথা হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডের সাথে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটার গল্প নিশ্চয় শুনেছো, পরে হয়ত দেখেছো-ও। দুই দেশের যুদ্ধ, রাজনীতির উত্তাপ চলে এসেছিলো খেলার মাঠেও। ফকল্যান্ড যুদ্ধে হেরে, দ্বীপটা বৃটিশদের কাছে হারিয়ে পুরা আর্হেন্তিনা রাষ্ট্র-ই তেঁতে ছিলো। অই তাপ আর্হেন্তিনা ফুটবল দলেও লেগেছিলো। মারাদোনা—যিনি আজীবন রাজনীতিসচেতন মানুষ, দলের ভিতরে যুদ্ধভাবটা ছড়ায়ে দিছিলেন। মাঠে নামার সময় টানেল থেকেই সবার শরীরী ভাষায় সেই যুদ্ধ-যুদ্ধভাবটা দেখা গেলো। মারাদোনার চোঁয়াল এতটাই শক্ত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো যে, ইংল্যান্ড ফুটবল দল যেন বারবিকিউর কাবাব আর তিনি হাড্ডিগুড্ডিসহ চিবায়ে খাবেন! আর্হেন্তিনা ২-১ গোলে জিতলো। লাফায়ে উঠে মাথার নাগাল পাননি, তাই প্রথম গোলটা মারাদোনা দিয়েছিলেন হাত দিয়ে। রেফারি বা লাইন্সম্যান—কেউই তাঁর হাতের ব্যবহার ধরতে পারেন নাই। পরে আবেগের চোটে বলেছিলেন, ওটা ছিলো ঈশ্বরের হাত। এমনকি ইংল্যান্ডের মানুষজনও হাত দিয়ে করা গোলটার কলঙ্ক মেনে নিয়েছে তাঁর দেওয়া দ্বিতীয় গোলটার মুগ্ধতায়। অমন তীব্র উত্তেজনাকর ম্যাচে মারাদোনা এমন এক গোল করেছিলেন যে, মাঠ আর টেলিভিশনের দর্শকরা তাজ্জব বনে গেছিলো। অবিশ্বাসে চোখ কপালে না তোলাটাই বরং অস্বাভাবিক হ’তো। অমন কিছু যে আর কখনোই দেখা যায়নি! নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে ডান প্রান্ত ধরে দিলেন এক পাগলা দৌড়—যেন পুরাণের কোনো গল্পে সহস্র বছরের ভূখা এক যুবা দৌড়াচ্ছে, গোলে বলটা পৌঁছে দিতে পারলেই খিদা মেটানোর পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যাবে; শুধু তাই না, সেই খাবারে মিলবে অমরত্ব। মারাদোনার পা হয়ে গেলো চুম্বক, বলটা অই চুম্বকের আকর্ষণে প্রেমিকার মত নাছোড়। একের পর এক ইংরেজ খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে, গোলকিপারকে পরাস্ত করে বল জালে পাঠালেন তিনি, আর পেলেন অমরত্বের খিদা মেটানো খাবার, পৃথিবীর মানুষেরা শত বছরের সেরা গোলটা দেখে ফেললো। সেমিতে বেলজিয়াম দলটাকে বলতে গেলে একাই নাচালেন, জার্মানির সাথে ফাইনালটাও জেতালেন। কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের অমন একক নৈপুণ্যে ফুটবল বিশ্বকাপ জেতানোর ঘটনা আগে ঘটেনি। আগে যা ঘটবে, অমন কিছু মারাদোনা করবেন কেন! ইংল্যান্ডের সাথে এই গোল দুটিই ব্যক্তি আর ফুটবলার মারাদোনার যে মিথ, তা রূপকভাবে তুলে ধরে। মানুষ ও ঈশ্বরের যুগলবন্দিত্বের উদাহরণ হিসাবে সমগ্র মারাদোনাজীবনকে অই গোল দুটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বিশ্বকাপ জেতার পর যা করলেন, তা-ও মারাদোনাসুলভ। বৃটিশ পরিচালক আসিফ কাপাদিয়ার বানানো দিয়েগো মারাদোনা সিনেমায় আমরা দেখতে পাই, আর্হেন্তিনা দলের কোনো এক কর্মকর্তাকে তিনি বলছেন, উদযাপনের জন্যে একটা শাদা লিমোজিন চাই। ক্লদিয়াকে কথা দিয়েছেন, বিশ্বকাপ জিতলে শাদা লিমুজিনে করে ঘুরে বেড়াবেন। হোটেলে ফিরে প্রথম ফোনটা তিনি মাকে করেছিলেন। যে রুমে বসে শাদা লিমুজিনে চড়ে প্রেমিকাকে নিয়ে বিশ্বকাপ জয় উদযাপনের কথা বলছেন, অই রুমে কার কার ছবি ছিলো জানো? ক্লদিয়া, আর্হেন্তিনার বিখ্যাত গায়িকা ও অভিনেত্রী ভ্যালেরিয়া লিঞ্চ—যিনি মারাদোনার ছোটবেলার প্রেম, মাতা মেরি আর একজন ন্যুড মডেলের ছবি। এই হলেন আদি ও অকৃত্রিম মারাদোনা। সাংবাদিকের ক্যামেরাকেও সামান্য পরোয়া করেন নাই। বিশ্বকাপের পুরা মাসই তাঁর রুমে অই ন্যুড মডেলের ছবিটা ছিলো। আধা-মাতাল মারাদোনা ছবিটি দেখায়ে এ কথা বলেছিলেন। কে না জানে, মদ খেয়ে মানুষ মিছা কথা কয় না!

মারাদোনা, যিনি ছিলেন জনতার চ্যাম্পিয়ন

১০ মে ১৯৮৭—নাপোলির মানুষ যে দিনটাকে কোনোদিনই ভুলবে না। তারা এক অনন্ত সুখের স্বাদ পেয়েছিলো এই দিন। তারা যে স্বাদ কখনোই পায় নাই, তারই সাথে পরিচয় করালেন মারাদোনা। বিশ্বকাপ জিতে আসার পরে ৮৬-৮৭ মৌসুমে নাপোলিকে তাদের ইতিহাসে প্রথম লিগ শিরোপা জেতালেন। সেদিন ফিওরেন্তিনার সাথে ম্যাচটা জিতলেই নাপোলি লিগ চ্যাম্পিয়ন হবে। সমর্থকদের মনে বিশ্বাস ছিলো, ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছে। সান পাওলোর গ্যালারিতে আর রাস্তায় রাস্তায় সমর্থকরা উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলো। গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন মারাদোনার পিতা দন দিয়েগো, পুত্রের কীর্তি দেখতে হবে না! এক সমর্থক শার্টের ভিতরে লুকিয়ে এনেছিলেন পুরান জুতা, খেলা শুরুর আগে সেই জুতাজোড়া দেখিয়ে এতদিন অপমান-গঞ্জনা দেওয়া প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের দিকে যেন যন্ত্রণাগুলিই ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে ওরা এ-ও ভুলে গেছিলো, ঘৃণা দিয়ে ভালোবাসা আদায় করা যায় না! মারাদোনা, জিওর্দানো, কারেকারা সমর্থকদের হতাশ করেননি। নীল রঙে ছেয়ে যায় নাপোলির অলিগলি, বাড়িগুলি। শহরের কবরখানার দেয়ালে কেউ একজন ব্যানার টানায়ে দিয়েছিলো, তাতে লেখা—তোমরা জানো না, কি মিস করেছ!’

নীল বেদনার রঙ—কি যে ফালতু একটা কথা! অমন উচ্ছ্বাসের রঙ কে কবে আর দেখেছে! মারাদোনার ঈশ্বরত্ব নাপোলিতে নতুন মাত্রা পেলো। লোকজন যীশুর পাশে তাঁকে রেখে প্রার্থনা করা শুরু করলো। অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যে, মারাদোনার নামে কোনো বাজে কথা কেউ সহ্য করতে পারতো না। কেননা সে ঈশ্বর আর ঈশ্বরেরা সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে। নাপোলির মানুষজন এমনটাই বিশ্বাস করতো। ঈশ্বরের মানুষিক আচরণ—অর্থাৎ ড্রাগস আর যৌনজীবন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। আজ থেকে একশ বছর পরেও যদি আমরা নাপোলিতে যাই, কোনো সমর্থককে জিজ্ঞেস করি, তোমার ঈশ্বর কে? হয়ত উত্তর দেবে—মারাদোনা! অই সময়ে শহরটার যেকোনো নারীকে একজন স্বপ্নের শয্যাসঙ্গীর নাম বলতে বললে অবধারিত যে নামটি উচ্চারণ হতো, সেই নামটা মারাদোনা। ফুটবল মাঠে তিনি ঈশ্বর, তাঁর বাম পা-টা ঈশ্বরেরই পা, কিন্তু মাঠের বাইরে তিনি মানুষ। নাপোলির তরুণীরা ঈশ্বর মারাদোনাকে পূজা দিতো আর মানুষ মারাদোনাকে শয্যায় চাইতো। যেন দিয়েগো আর মারাদোনার দু’টি সত্তা এই দ্বন্দ্বেও বিদ্যমান। এরপর  ইতালির কলেরা নাপোলি হয়ে উঠলো দেশটার ফুটবল রাজধানী। ৮৯-এ গিয়ে ইউরোপ সেরা হলো, পরের বছর আবার লিগসেরা। মারাদোনার নাপোলি ততদিনে ট্রফি জেতাটা অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছে। প্রথমবার ইতালিয়ান লিগ জেতার পরে নাপোলির খেলোয়াড়রা ড্রেসিংরুমে শ্যাম্পেনে ভেসে নাচতে নাচতে কি গান গেয়েছিলো জানো? – ‘ও মাম্মা, মাম্মা, মাম্মা! / ও মাম্মা, মাম্মা, মাম্মা / তুমি কি জানো ক্যানো / আমার হৃদয় ফাল দিচ্ছে? / আমি মারাদোনাকে দেখেছি! / আমি দেখেছি মারাদোনাকে! / আর মা! / আমি প্রেমে পড়েছি তার! / ও মাম্মা, মাম্মা, মাম্মা… আর নাপোলি সমর্থকদের সৃষ্ট এই গান সতীর্থদের কান্ধে হাত রেখে নাচতে নাচতে মারাদোনা নিজেও গাইছিলেন। লোকটা চিরকালই এমন ছিলেন—আত্মপ্রেমি, আবেগি, কিছুটা অহঙ্কারি আবার সরল। তা মারাদোনার অহং না থাকলে মানায়, বলো?

কেউ কেউ মনে করেন, নাপোলির মানুষদের অতি ভালোবাসায় মারাদোনার ব্যক্তিজীবন শিকায় উঠেছিলো। বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসার ঠ্যালায় দিনের বেলায় তিনি কোথাও যেতে পারতেন না। অনেকেই মনে করেন, এ কারণেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাতের উদাম জীবন, কামোরা মাফিয়াগোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। হতে পারে, নাও হতে পারে—রাতের জীবন তিনি বুয়েনোস এইরেস আর বার্সেলোনাতেও কাটিয়েছেন। আজকের মেসির সাথে মারাদোনাকে তুলনা করলে মারাদোনাকে শ্রেষ্ঠত্ব দেবো আমি। মেসি আর্হেন্তিনাকে যদি কাতার বিশ্বকাপ জেতায়, তারপরেও। দলীয় বা ব্যক্তিগত, মেসি অনেক বেশি ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু মেসি সর্বজয়ী বার্সেলোনায় খেলেছেন। তার আশেপাশে জাভি, ইনিয়েস্তা, রোনালদিনিয়ো, এতো’ও, আলেক্সিস সানচেজ, অঁরি’র মত তারকা খেলোয়াড়রা ছিলেন। মেসির বার্সার তুলনায় তখনকার নাপোলি ছিলো বড়জোর ঢাকার আরামবাগ ক্রীড়াচক্র মানের ক্লাব। সেই ক্লাবকে প্রথমবার ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়ন করা, ইউরোপ সেরা করা রূপকথার গল্পকেও হার মানানোর মতো। ছিয়াশির আর্হেন্তিনা দলের কথাও যদি বিবেচনা করা হয়, অই দলকে নিয়ে বিশ্বকাপ জেতা অতিমানবীয় সাফল্যের উদাহরণ বিবেচনা করা যায়। মেসি, ক্রিস্টিয়ানোরা সারাটা জীবন যথাযথ ডায়েট আর ট্রেনিংয়ের মধ্যে থেকেছেন, অনিয়ম একেবারেই করেননি। তাঁরা সদা সর্বদা সিক্স প্যাক বডির ফিট ফুটবলার। আর মারাদোনা? কোনো নিয়মের পরোয়া করেন নাই। সেরা সময়ের মারাদোনার শরীরেও জার্সি খুললে হাড্ডি দেখা যেতো না, ভালো করে খেয়াল করলে মাংসের ভাঁজও খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিলো। থলথলে মাংসের মেসি, ক্রিস্টিয়ানোদের কল্পনা করে দেখো, তারা কতটা কী করতে পারতেন, সংশয় জাগবেই। অনিয়ন্ত্রিত জীবনকে যোগ করো, বুঝবে, মারাদোনা আসলে মিথ—তাঁর বাস্তবতাও এক প্রকার মিথ, তাঁর সকল বাস্তবতা-ই অবিশ্বাস্য যে! মারাদোনার আগে একজন ফুটবলারই অমন মদনতাড়িত জীবন কাটিয়েছেন আর মাঠে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নাই—তিনি জর্জ বেস্ট। মাঠের বাইরে ‘মারাদোনা-লাইফ’ কাটাতে গিয়ে রোনালদিনিয়ো গাউচোর মতন অমিত প্রতিভার ফুটবল-জীবন অকাল মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে।

নাপোলির কবরস্থানের ব্যানারে লেখা, ‘তোমরা জানো না কি মিস করেছে’

৮৯-এ উয়েফা কাপ জেতার পর মারাদোনা ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে জানান, তিনি আর নাপোলিতে থাকতে চান না, নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চান। কিন্তু সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কে ছাড়ে! ফুটবলার মারাদোনার জন্যে এটাই কাল হলো। মনের মর্জির বিরুদ্ধে নাপোলিতে সময় কাটতে লাগলো, কোকেইন আর রাতের জীবন হয়ে উঠলো লাগাম ছাড়া। রবিবার ম্যাচ শেষের পর থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত কোনো প্রকার ট্রেনিং করতেন না। ফুটবলে পা ছোঁয়াতেন না, ফিটনেস নিয়েও ভাবতেন না। দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়ে বুধবার বিকাল থেকে পরের ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি শুরু করতেন। আর কি আশ্চর্য, মাঠের মারাদোনাকে দেখে তা বোঝার উপায় ছিলো না! মাঠের বাইরে অমন জীবন কাটানোর পরেও মাঠে এর প্রভাব না পড়ার পেছনে যে লোকটা আসলে মহানায়ক, তার নাম ফার্নান্দো সেনোরিনি। মারাদোনা নিজে যারে আখ্যা দিছেন জিনিয়াস হিসাবে। নাপোলিতে এসে এই সেনোরিনিরে পাওয়া ব্যক্তি মারাদোনা তো বটেই, আর্হেন্তিনা ফুটবল দলেরও উপকার করেছে। এই লোক মারাদোনারে ফিজিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার লগে লগে মানসিকভাবেও তৈয়ার করেছিলেন। নিয়মিত কোকেইন নিয়াও মাঠে মারাদোনা অদম্য ছিলেন মূলত সেনোরিনির ট্রেনিং পদ্ধতির কারণে। এই লোক না থাকলে হয়তো ফুটবলার মারাদোনার অর্ধেকটাই আমরা দেখতে পেতাম।

উয়েফা কাপ, যা বর্তমানের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ—জেতার পরে নাপোলির জার্সিতে সবই জেতা হয়ে গিয়েছিলো। ড্রাগ, ক্রমাগত কামোরার অন্ধকার রাজ্যে বিলীন হওয়া, সিনাগ্রার জন্ম দেওয়া বাচ্চাকে নিয়ে ব্যক্তিজীবনে মানসিক টানাপোড়েনে তিনি তখন ক্লান্ত; তাই ইতালি ছাড়তে চাইছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন ইতালিতে থাকলে তিনি সামলে নিতে পারবেন না। বিশেষ প্রতিভাবান যারা- যারা নিজের মর্জিতে চলেন, তাদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে তার ফলাফল ভালো হয় না; মারাদোনার ক্ষেত্রেও হয়নি। ৮৮-৮৯ মৌসুম শেষে মারাদোনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে নাপোলি প্রেসিডেন্ট তাঁকে ছেড়ে দিলে আমরা হয়ত মারাদোনার ক্যারিয়ারটা আরেকটু উজ্জ্বলভাবেই লম্বা হতে দেখতাম। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হবার পরে ক্লাবের পক্ষ থেকে স্বপ্নের ফেরারি গাড়ি পেলেন বটে, মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইতালিতে থেকে যাওয়ায় ফুটবলার মারাদোনার এক প্রকার মৃত্যু হলো। এরপর যত বছর খেলেছেন, তা ছিলো নিজের তৈরি করা মিথের ওপর। নাপোলি হয়ে উঠলো মারাদোনার জেল—মুক্ত, আবার যেন ঘুটঘুটে অন্ধকারে বন্দী—দিশাহীন, সৎসঙ্গহীন। রাতের জীবন আর কন্যাদের সঙ্গটুকু ছাড়া উপভোগ্য কিছুই রইলো না তাঁর। পিঠে একের পর এক ইঞ্জেকশন নিয়ে, মিথের ওপর দাঁড়িয়েই খেলে, নাপোলি দলকে খেলিয়ে গেলেন, দলটা আবারও লিগ জিতলো। মজার ব্যাপার, ততদিনে ইতালিয়ান লিগে ডোপ টেস্ট চালু হয়ে গেছে। ডোপ টেস্টের নমুনার জন্যে মারাদোনার নামের শিশিতে অন্যের পেশাব সাপ্লাই দিয়েছিলো নাপোলির খেলোয়াড়রা। একথা স্বয়ং নাপোলি প্রেসিডেন্টই বলেছেন পরে।

দেখতে দেখতেই এলো নব্বই বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপটা ইতালির মাটিতে। ড্রাগ থেকে নিজেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নিলেন, সেনোরিনির অধীনে কঠোর পরিশ্রম করে, শরীরের সব মেদ ঝরিয়ে নিজেকে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত করে তুললেন। খুব ইচ্ছা ছিলো ছিয়াশির সাফল্য ধরে রাখবেন। নজরকাঁড়া ফুটবল না খেললেও মারাদোনার আর্হেন্তিনা উঠে গেলো সেমিফাইনালে। খোদার কি লীলা, সেমিফাইনালের খেলা পড়লো স্তাদিও সান পাওলোতে, প্রতিপক্ষ ইতালি! সেটাই কাল হলো মারাদোনার জন্যে। নেপলস দুই ভাগ হয়ে গেলো। মারাদোনাই ভক্তদের পরীক্ষায় ফেলে দিলেন। তিনি সংবাদমাধ্যমে বললেন, তাঁকে ভালোবাসলে নেপলসের লোকজন আর্হেন্তিনাকেই সমর্থন দেবে। তাতে অনেক নাপোলিয়ানই নিজদেশ ইতালির বদলে লা আলবেসিলেস্তে দলকে সমর্থন দেয়। ইতালি কাগজে-কলমে স্বাগতিক হলেও স্তাদিও সান পাওলো যার বর্তমান নাম দিয়েগো মারাদোনা স্টেডিয়াম—ছিলো মারাদোনার ঘরবাড়ি। ওখানকার প্রতি ইঞ্চি ঘাস মারাদোনার পায়ের স্পর্শ চেনে, সেই মাঠে সত্যিকার স্বাগতিক হয়ে উঠলো আর্হেন্তিনা দল, আর আজ্জুরিরা নিজভূমে অতিথি। সেই ম্যাচে গয়কোচিয়ার নায়কোচিত গোলকিপিংয়ে ইতালি হারলো আর মারাদোনার সর্বনাশটা হলো। পুরো ইতালি, নাপোলি মারাদোনার অন্ধকার জীবনের ব্যাপারটা জানতো। কিন্তু মাঠ ও মাঠের বাইরে ইতালিয়ান ফুটবলের পোস্টার বয় হবার কারণে সকলেই ছিলো চুপচাপ। সংবাদমাধ্যম, কর বিভাগ, মাদক বিভাগ আর চুপ রইলো না। মারাদোনাকে শয়তান, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি শিরোনাম করে কুকীর্তিগুলি প্রকাশ হতে লাগলো। এক পত্রিকার জরিপে উঠে এলো ইতালির সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তির নাম মারাদোনা! পত্রিকায়, টিভিতে একের পর এক রসালো গল্প প্রকাশ হতে লাগলো, সরকার মারাদোনার ফোন কল রেকর্ড করা শুরু করলো। মাদক ও নারী কেলেংকারির মামলা হলো তাঁর নামে। দেড় বছরের জেল হলো রায়ে, পাঁচ মিলিয়ন লিরা জরিমানা দিয়ে জেল খাটা থেকে বাঁচলেন। এর ভিতরেই লিগ শুরু হলো। মার্চে নাপোলি-বারি ম্যাচের পর বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্টের জন্যে ডাক পড়লো, স্বাভাবিকভাবেই মূত্রনমুনায় কোকেইনের অস্তিত্ব পাওয়া গেলো। খেলার মাঠে ১৫ মাসের জন্যে নিষিদ্ধ হলেন মারাদোনা। অই ঘটনার পরই ফিফাও বাধ্যতামূলক ডোপ টেস্টের নিয়ম করে। মাঠের বাইরের জীবনটা আগেই নরক হয়ে গিয়েছিলো, আনন্দ ছিলো কেবল খেলায়—এবার সেটাও কেঁড়ে নেওয়া হলো মারাদোনার কাছ থেকে। এক মধ্যরাতের নীরবতায় ইতালি ছাড়লেন তিনি। যেদিন নাপোলি এসেছিলেন, ৮৫ হাজার লোক তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলো, ফেরার বেলায় ছিলো না কেউ। বাঁ পায়ের জাদুকরি ফুটবল দিয়ে লেখা নাপোলি রূপকথা এভাবেই বেদনাভরে শেষ করেছিলেন মারাদোনা। এর দুই সপ্তাহ পরেই বুয়েনোস এইরেসে দেড় গ্রাম কোকেইনসহ গ্রেফতার হন। ফুটবল ছাড়া পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কে জানে, মারাদোনার অনুরোধ শুনে ৮৯ মৌসুমের পর নাপোলি প্রেসিডেন্ট তাঁকে ছেড়ে দিলে হয়ত মারাদোনার জীবন এতটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হতো না, ড্রাগের পাইথন তাঁকে পুরোপুরি গিলে ফেলতে পারতো না।

ফুটবল মাঠে এমনই অদম্য ছিলেন মারাদোনা

এরপরও ১৯৯৭ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে গেছেন মারাদোনা। সেভিয়া, নিউওয়েল ওল্ড বয়েজ হয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন বোকা জুনিয়র্সে এসে। কিন্তু নব্বই সালের পর যে মারাদোনা ফুটবল খেলেছেন, তিনি কিছুতেই ফুটবলের ঈশ্বর নন, খেলেছে তার ছায়া। ৯৪ বিশ্বকাপের গল্পও আমরা জানি। দুই ম্যাচ খেলার পর ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় মারাদোনার। একের পর এক বিতর্ক নিয়েই তিনি পথ চলেছেন। সাংবাদিকদের গালিগালাজ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পিটিয়েছেনও। এতই মোটা হয়েছিলেন যে, মাত্র সাড়ে পাঁচ ফুটের শরীরটাকে ১৩০ কেজি ওজনের বানিয়ে ছেড়েছিলেন! নেশাদ্রব্য ও নারী কখনোই তাঁকে ত্যাগ করেনি, তিনিও ছাড়তে পারেননি। একের পর এক অসুখ বাসা বেঁধেছে শরীরে। ২০০৭ সালে একবার কোমায় চলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুসংবাদও ছড়িয়ে পড়েছিলো। এরপর কিছুটা শৃঙ্ক্ষলায় ফিরেছিলেন, আর্হেন্তিনা দলের কোচ-ও হয়েছিলেন। মারাদোনাকে হাভানায় নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে নতুন জীবন দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। সারাজীবন কিউবা চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে পাশে না দাঁড়ালে হয়ত ৬০ বছরের আয়ুও পেতেন না তিনি। মুখে হাভানা চুরুট, হাতে চে আর কাস্ত্রোর ট্যাটো নিয়ে ফুটবলহীন জীবনের অনেকটা সময় হেসে-খেলে পার করেছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে ঠিকঠাক হাঁটতেও পারতেন না, পা দু’টি হয়ে গিয়েছিলো পাটকাঠির মতন। তবু ফুটবল থেকে দূরে থাকেননি। মেহিকোতে দ্বিতীয় বিভাগের এক দলের কোচ হয়েছেন, আর্হেন্তিনায় তৃতীয় বিভাগের ক্লাবে চাকরি করেছেন। মারাদোনার মেহিকোর জীবন নিয়ে নেটফ্লিক্সের একটা চমৎকার সিরিজ আছে। এখানে তাঁর নেতৃত্বগুণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। চিঠির শুরুটা করেছিলাম মারাদোনা ঈশ্বর নাকি মানুষ—সেই বিতর্ক দিয়ে। আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতেই পারি, ব্যক্তি মারাদোনা অবশ্যই সর্বময় মনুষ্যচরিত্রের একজন মানুষ। কিন্তু ফুটবল মাঠে তিনি ঈশ্বর বা ঈশ্বরগোত্রীয়। সারা দুনিয়া তাঁর মাদক আর নারীতে ডুবে থাকা জীবনের কথা জানে, বিশ্বকাপে খেলা দেখতে এসে গ্যালারিতে অস্বাভাবিক আচরণ করাও দেখেছে, তবু কেউ মারাদোনাকে ঘৃণা করতে পারে না। ক্যানো পারে না? ফুটবল মাঠের অই ঈশ্বরত্বের জন্যেই। মানুষ মারাদোনার এত এত দুর্নামের পরেও রোজারিওতে ১৯৯৮-এ প্রতিষ্ঠা হয়ে এখনও ইলাসিয়া মারাদোনা বা মারাদোনা গির্জা টিকে আছে। মারাদোনাকে ধর্মজ্ঞান করা ভক্তরা মজা করেই এই গির্জা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জেনে অবাক হতে পারো, মারাদোনাধর্ম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। স্পেনে নয় হাজারের মতন মানুষ এই ধর্ম পালন করেন। এমনকি তারা মারাদোনার জন্মসাল ১৯৬০ সালের পর থেকে এই ধর্মের বয়স গণনা করে। এসব পাগলামি ফুটবল খেলা আর মাঠে ঐশ্বরিক মারাদোনার জন্যেই জন্মেছে। মারাদোনা যখন ফুটবল পিচে নামতেন, তাঁর সমস্ত জীবন পিছনে পড়ে থাকতো, সমস্ত দুঃখ-ব্যথা-ক্লেদ মুছে যেতো। গ্যালারি আর টিভি সেটের সামনে বসা দর্শকরাও কি নব্বই মিনিট আর সব ভুলে হর্ষময় এক জগতে ঢুকে যেতো না? সেসব ভাগ্যবান দর্শকদের জন্য আমি এই সময়টারে বলবো দুনিয়ায় কাটানো বেহেশতি সময়। শতাব্দীসেরা অই গোলটা দেবার পর ধারাভাষ্যকার আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে হিস্পানিতে বলছিলেন, ‘দুঃখিত, আমি কাঁদতে চাই! হায় ঈশ্বর, ফুটবল অনন্তের খেলা হোক! গোওওওওওওওল! দিয়েগোল! মারাদোনা! আপনাকে (দর্শককে) কাঁদাতে এটুকুই যথেষ্ট, আমাকে মাফ করুন। কি এক অবিস্মরণীয় দৌড়! কি এক অতিলৌকিক ঘুড্ডি! কোন জগৎ থেকে তুমি এসেছ যে সমগ্র দেশ মুঠি জড়ায়ে আর্হেন্তিনা বলে চিৎকার করছে? ধন্যবাদ ঈশ্বর: ফুটবলের জন্য, মারাদোনার জন্য, এই কান্নার জন্য’।

ফুটবল মাঠে এসব মিথের জন্ম দেওয়ার জন্যেই ঐশ্বরিক মারাদোনার কাছে বিতর্কিত ব্যক্তি মারাদোনা হেরে যাবে বারবার, মানুষ তাঁর ফুটবল জাদু মনে রাখবে। আমি বলি দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা হলেন মানুষেশ্বর—একইসাথে তিনি প্রচণ্ডরকমের মানুষ আর ঈশ্বরের মতন অবিনাশী।

ডিসেম্বরের শেষ সময়, এখন রাত গভীর। আমি মারাদোনার ধ্যানে আরেকটু নিমজ্জিত হ’তে চাই। জানি, বাহিরে ঠান্ডায় পৃথিবী জমে আছে, কিন্তু মারাদোনার দেওয়া স্মৃতিগুলি বরফ করে দেবার শক্তি এ শীতের নাই। তোমাকে ভালোবাসার পরে, ফুটবল আর মারাদোনাকে ভালোবাসার পরে আর কোনো বরফ আমার অন্তরে জমাট বাঁধে না। মানুষেশ্বরের মৃত্যুতে আমি তবু শোকের কাছে আশ্রয় নিয়েছি। ফের লিখবো।

ইতি,

মারাদোনা ধর্মে বিশ্বাসী একজন ব্রাজিল সমর্থক।

বৈভব থেকে প্রকাশিতব্য ‘পড়ো, তোমার প্রেমের নামে’ বই থেকে…


রুহুল মাহফুজ জয়


জন্ম: ৩১ মার্চ, ১৯৮৪, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ধামর মহিষমারা গ্রামে।

প্রকাশিত বই:

আত্মহত্যাপ্রবণ ক্ষুধাগুলো (কবিতা, ২০১৬, ঐতিহ্য); কালো বরফের পিস্তল (কবিতা, জেব্রাক্রসিং, ২০১৮); কূটালাপ (সম্পাদনা, ২০১৮, ঐতিহ্য); বিদ্যুতের প্রাথমিক ধারণা (কবিতা, ২০১৯, তবুও প্রয়াস); মান্দার ফুলের সখা (কবিতা, ২০২১, ঢাকাপ্রকাশ); আব্বাস কিয়ারোস্তামি কবিতাসমগ্র (অনুবাদ, ২০২৩, বৈভব ও ছাপাখানা)

শেয়ার