দস্যু । মূলঃ জেমস মলিসন । অনুবাদঃ আশিক হোসেন

কয়েক বছর আগের কলম্বিয়া ভ্রমণের সময় আমার একটা কারাগারের ফটো তোলার প্রয়োজন পড়ে। ফলে আমি ভালেইদুপারে উপস্থিত হই। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় এবং অর্থায়নে নির্মিত একটি সর্বাধুনিক ব্যবস্থাসম্পন্ন কারাগার। সেখানে আমার সাক্ষাৎ হয় ‘পপাই’ ছদ্মনামধারী এক লোকের সাথে। পপাই তার প্রায় পুরোটা কর্মজীবন কাটিয়ে দিয়েছে পাবলো এসকোবারের      ‘নিরাপত্তা-প্রধান’ হিসেবে। পাবলো এসকোবার তথা ‘মেন্ডেলিন’ কোকেইন পাচার কার্টেলের গডফাদার।

all of photofit
এসকোবারের সম্ভাব্য ছদ্মবেশসমূহ দিয়ে কলম্বিয়া পুলিশের ওয়ানটেড পোস্টার; ১৯৯২ সাল

পপাইকে অন্তত ১৫০টি খুনের জন্য দায়ী করা হয়। কারাগারটির ‘ হাই সিকিউরিটি ’ অঞ্চলে আমি তাকে হোমারের ইলিয়াড পাঠরত অবস্থায় দেখতে পাই। পপাই ছিল একজন মিষ্টভাষী পেশাদার খুনি এবং এসকোবারের অধীনস্থ থাকাকালীন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার নিখুঁত বর্ণনাকারী।পাবলো এসকোবার তথা কলম্বিয়ার তৎকালীন মোট প্রধানতম বিচারপতিদের অর্ধেকের হত্যা, প্রমাণ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টে হামলা, জাতীয় নিরাপত্তাসংস্থার সদরদপ্তরে বোমা হামলা , প্রধানতম একটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ে বোমা হামলা এবং একটি  যাত্রীবাহী উড়ন্ত বেসামরিক বিমানকে আকাশেই বিধ্বস্ত করার মতোন দুর্ধর্ষ অপরাধের প্রধান হোতা।

outside EC11-6
বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া পত্রিকা অফিসের ধ্বংসচিহ্ন

১৯৮৯ সালে পাবলো এসকোবার ‘শহরের পুলিশের মৃত্য চাই’ বলে আদেশ দিলে পপাই এক বিশালসংখ্যক ভাড়াটে খুনিদের নিয়োগ করে এমন সব হত্যাকাণ্ডের জন্য যা সে একা করতে পারছিল না। পপাইয়ের ভাষায়, ‘পুলিশ মারতে পারলে দেয়া হতো দশ লাখ পেসো, কর্পোরাল মারতে পারলে বিশ লাখ, সার্জেন্ট মারতে পারলে ত্রিশ লাখ, লেফটেন্যান্ট মারতে পারলে চল্লিশ লাখ, ক্যাপ্টেন মারতে পারলে পঞ্চাশ লাখ, মেজর মারতে পারলে এক কোটি, কর্ণেল  মারতে পারলে পাঁচ কোটি আর জেনারেল মারতে পারলে দশ কোটি।পাবলো এসকোবারের চিন্তা সবসময় বড় ছিল।’

হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত মুখোশ

রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের চরম পর্যায়েও এসকোবার মাদক পাচার নিয়ে যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও বেশি ভেবেছিল মাদক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার ব্যাপারে। এবং বিশেষ করে কলম্বিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তির ব্যাপারে। তাকে ঘর থেকে তুলে এনে পরদেশে পাঠানো হতে পারে বিচারের জন্য, এমন চিন্তাই এসকোবারকে বেশি রাগান্বিত করেছিল। সে ঘোষণা দিয়ে বলেছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারের চেয়ে আমরা কলম্বিয়ার কবরকে শ্রেয় মনে করি’ এবং ওয়াদা করেছিল যে, যেইদিন কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা বন্দি-বিনিময় চুক্তি বাতিল করবে সেইদিনই সে আত্মসমর্পণ করবে। ফলাফলে কলম্বিয়া চুক্তি বাতিল করে এবং এসকোবার তার নিকটতম সহযোগীদের সাথে কারাগারে যেতে সম্মত হয়। যদিও কারাগার, তবু এই কারাগার ছিল তার ব্যক্তিগত এবং নিজের হাতে নিজ শহর মেন্ডেলিনেই বানানো।

floor plan 9423
নিজ শহরে এসকোবারের নিজের জন্য বানানো কারাগারের নকশা

এমন এক কারাগার, যেখানে সে পার্টির আয়োজন করতে পারত, তার অপরাধচক্র চালিয়ে যেতে পারত এবং  যেখান থেকে পরিশেষে পালিয়ে গিয়েছিল। তার জীবনের শেষ দুইটি বছর সে কাটিয়েছে এক প্রবল ফেরারী শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে। তাকে গ্রেফতার করার হাজার হাজার অভিযানকে সে ব্যর্থ করে দিয়েছে লুকিয়ে থেকে। লুকিয়ে থাকলেও তাকে দিনে-দুপুরেই দেখা যেতো মেন্ডেলিনের রাস্তায় পপাইয়ের সাথে নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করতে। এই দৃশ্য দেখে  মনে করার উপায় ছিল না যে, পৃথিবীর মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনালদের মধ্যে এই দুইজন আছে। পপাইয়ের ভাষ্য, ‘একেবারে ঠাণ্ডা লোক ছিলেন পাবলো। অনেকটা ভৌতিক প্রকৃতির ’।   

নিজের চিড়িয়াখানায় এসকোবার
নিজের চিড়িয়াখানায় এসকোবার

আমার আরো অনেক কিছু জানার ছিল। কলম্বিয়াতে আমার পরবর্তী প্রজেক্ট ছিল মাদকস্থাপত্যের ফটোগ্রাফি করা। মাদকস্থাপত্য বলতে দেশটির স্থাপত্যে মাদকের অর্থের প্রভাব। মেন্ডেলিনের মাদক পাচারকারীদের অর্থে গড়া বলে কথিত বেশ কিছু জায়গায় আমি গিয়েছিলাম । লোকজনে বলাবলি করতো এইসব জায়গায় নাকি আছে  অভিজাত সব রিজোর্ট , জৌলুশপূর্ণ নাইটক্লাব আর একাধিক ফ্ল্যাটবাড়ি যেগুলোর উঠানে সুইমিংপুল। আসলে গালগল্পের তুলনায় এইসব বিল্ডিং ছিল অপেক্ষাকৃত কম মনোরম, কিছু ছিল এমনকি বেহাল দশায়। সবচেয়ে বেহাল দশায় ছিল ‘এডাফিশিও মোনাকো’ নামক বিল্ডিংটি। প্রতিদ্বন্দ্বী ‘কালি’ কার্টেলের বোমা হামলার আগ পর্যন্ত এই বিল্ডিংই ছিল এসকোবারের বাসস্থল। বাসস্থলের চাইতে একে অনেকটা কংক্রিট অফিসভবন কিংবা ছয়তলা বাঙ্কারের মতোন দেখাতো। কুৎসিত এবং বিশেষত্বহীন। আমি আমার ট্রাইপড সেট-আপ করেছিলাম সেই বাসার ধারের রাস্তায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়ে যাই। তারা আমার ক্যামেরা জব্দ করে আর আমাকে ধরে  ‘বস’-এর সাথে দেখা করতে নিয়ে যায় ।

hunt poster 9328
এসকোবারকে ধরিয়ে দেবার জন্য কলম্বিয়া সরকারের পুরস্কার ঘোষণা করে প্রচার করা ওয়ান্টেড পোস্টার

দেখা গেলো , এই বিল্ডিং এখন কলম্বিয়ার পাবলিক প্রসিকিউশন সার্ভিস ‘ফিসকালিয়া’র স্থানীয় সদরদপ্তর আর আমি তাদের নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘন করছিলাম।  আমি তাদের প্রধান, ম্যানুয়েল দারিও আরিস্টাজাবালকে বললাম যে, আমি ফটো তুলছিলাম কারণ এটা একসময় পাবলো এসকোবারের বাড়ি ছিল। এটা শুনে তিনি সগর্বে আমাকে জানালেন যে, তার এখনকার অফিস একসময় পাবলো এসকোবারের বেডরুম ছিল। আর যে ক্ষয়ে যাওয়া চামড়ার সোফায় আমি বসেছিলাম সেটা নাকি ছিল এসকোবারেরই ব্যক্তিগত সোফা। তারপরে তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার কাছে এক ব্যাগভর্তি পাবলো এসকোবারের ফটোগ্রাফ আছে। আপনি কি সেগুলো দেখতে চান? ’

ফটোগুলো এসকোবারের পুলিশ ফাইল থেকে নেয়া হয়েছিল। এসব ফটোতে ছিল পলায়নের পরে  মেন্ডেলিনের তার ব্যক্তিগত কারাগারের দৃশ্যাবলি। আরিস্টাজাবালের সাথে আমি যে ঘরে বসে ছিলাম ঠিক তার মতো এইসব ফটোগুলোতেও আমি কোনো কথিত আন্ডারওয়ার্ল্ড আভিজাত্যের চিহ্ন দেখি নি। কিছু কিছু ফটোতে গোপন আস্তানার বিভিন্ন বন্দুক আর সেক্সটয়ের দৃশ্য থাকলেও কিছু কিছু ফটোতে ছিল এসকোবার আর তার পরিবারের মধুর দৃশ্য, তার গ্যাঙের ফুটবল খেলার দৃশ্য অথবা কারাগারের ‘ডিস্কো’-তে মদ্যপানের দৃশ্য। এবং তার মিকি মাউজ স্লিপারের ফটো আমার সামনে তার এক ভিন্ন ছবি দাড় করিয়ে দিল। এমন এক এসকোবার যে একই সাথে জটিলতর এবং আমার ভাবা সেই বিলাসি গডফাদারের চাইতে অনেকটা সাদামাটা। এসকোবারের প্রাক্তন বেডরুমে বসে থাকা অবস্থায়, অনেকটা লোকগল্প আর বাস্তবতার মাঝখানে বসে, আমার মন চাইলো যে, পাবলো এসকোবারের গল্প ফটোগ্রাফে বিনির্মাণ করে আমি তার রেখে যাওয়া স্মৃতি ভ্রমণ করি। 

জেলখানা থেকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহৃত মাধ্যম
জেলখানা থেকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহৃত মাধ্যম

অধিকাংশ কলম্বিয়ান তাদের ইতিহাসের এই মর্মদায়ক অধ্যায়কে পুনর্জীবিত না করে বরং দাফন করতেই চাইবে। আন্তর্জাতিক কোকেন ব্যবসায় এসকোবারের আধিপত্য এবং একজন ভয়ানক খুনি হিসেবে তার কুখ্যাতি দেশটির ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। যে আড়াই বছর আমি এই প্রজেক্টে সাংবাদিক রেইনবো নেলসনের সাথে কাজ করেছি এই সময়ে আমরা যেখানেই গিয়েছি সেখানেই বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। যদিও প্রধান প্রধান কুশীলবেরা কথা বলতে আগ্রহী ছিল (আমরা এসকোবারের ব্যাপারে শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়েছিলাম), তাদের দেয়া বর্ণনার প্রমাণস্বরূপ ফটো খুঁজে বের করা দুষ্কর ছিল।     

যদিও এসকোবারের আত্মসম্মান, লোভ এবং সহিংসতা জনমানুষের মনে তার একটা বৃহৎ ছবি দাড় করাতে সক্ষম হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে সে কংগ্রেস নির্বাচনেও দাড়িয়েছিল, সে তার জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়েছে্ অগোচরে লুকিয়ে এবং সে সবসময় তার ফেলে আসা পদচিহ্ন মুছে দিতেও ছিল পারঙ্গম। তার জীবনের সচিত্র রেকর্ড খুবই সামান্য এবং যেসব নথিপত্র ও ফটো আছে তাদের অবস্থাও কোনো ফরেনসিক কেসবুকের মতোন।    

warning255448-11- 1
বোনের গাড়িতে এসকোবারের সাক্ষর দেয়া নোট, “এই গাড়ির মালিক আমার বোন আলবা মারিয়া এসকোবার। কেউ এটা চুরি করলে ফেরত দিয়ে যেও, যদি না নিজের ক্ষতি চাও।”

এইসব প্রমাণাদি সংগ্রহের সময় আমাদের সাথে জেনারেল হুগো মার্টিনেজের দেখা হয়। মার্টিনেজ যখন একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ছিলেন তখন তিনিই সেই সুদক্ষ পুলিশ ইউনিটের প্রধান ছিলেন যেটি অবশেষে ১৯৯৩ সালে এসকোবারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে এসকোবার ও তার লোকদের গোপনে রেকর্ডকৃত শত শত ঘন্টার কথোপকথন শুনে শুনে মার্টিনেজ মেন্ডেলিন কার্টেলের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে যেকোনো বহিরাগতের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এসকোবারের ব্যাপারে বলেন, ‘সে যেকোনো দস্যুর মতোই ছিল। আমি সবসময়ই  দোষারোপ করে এসেছি বিদেশী সংবাদসংস্থা আর এজেন্সিদের যারা বিশ্বমঞ্চে তাকে একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ গডফাদার হিসেবে তুলে ধরেছে। তারা তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাকে নিয়ে ফোর্বস ম্যাগাজিনে নিউজ করেছে। তারা আগুনে কেরোসিন ঢেলেছে। তারা ভেবেছিল যে, সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বাসও করা শুরু করেছিল যে, তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপ্রার্থীদের , মন্ত্রীদের হত্যা করার অধিকার আছে। যেন তার যেকোনো কিছুই করার অধিকার আছে।’

পাবলো এসকোবারের লেখা প্রার্থনাপত্র। পুলিশের হাতে নিহত হবার পর পকেট থেকে এটা পাওয়া যায়।
পাবলো এসকোবারের লেখা প্রার্থনাপত্র। পুলিশের হাতে নিহত হবার পর পকেট থেকে এটা পাওয়া যায়।

জেনারেল মার্টিনেজের উক্তি ছিল নিন্দায় ভরপুর। কিন্তু এসকোবার একবার পোপাইকে বলেছিল যে, সে এমন একটা সমাধিফলক চায় যেখানে লেখা থাকবে : ‘আমি যা হতে চেয়েছিলাম তাই হয়েছি। একজন দস্যু ’।

শেয়ার