রবীন্দ্রনাথ
প্রত্যেক পাড়ায় একজন করে রবীন্দ্রনাথ থাকেন। তাঁকে দেখলেই পাড়ার লোকজন বলে ওঠেন— ওই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসছেন। লোকটি কিছুটা রাগান্বিত হন। কারণ, রবীন্দ্রনাথের নাম দিয়ে তাঁকে তুচ্ছ করা হচ্ছে। তিনি কবিতা লেখেন, এই তাঁর অপরাধ… অথচ, লোকটি লিখতে এসে রবীন্দ্রনাথ হতেই চেয়েছিলেন। তাঁর লম্বা চুল, ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি তাঁকে রবীন্দ্রনাথ করেনি। তবু তিনি এই ভেবে আনন্দ পেয়েছিলেন— কবিতালেখকদের ‘রবীন্দ্রনাথ’ বলে, পাড়ার লোক তা জানে…
অংক মাস্টার
ছাত্র-ছাত্রীদের সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র বোঝাতে গিয়ে—
তিনজন প্রেমিকার কথা মনে পড়ে
লম্ব বরাবর যে প্রেমিকা ছিল তাকে গলা টিপে খুন করেছি
ভূমি বরাবর যে প্রেমিকা ছিল তাকে জলে ফেলে দিয়েছি
অতিভুজ বরাবর যে প্রেমিকা ছিল তাকে রেখে এসেছি মরুভূমিতে
এরপরও আমি ভালো অংক মাস্টার, তারিফ করে!
আমি চুপিচুপি হাসি
ওরা জিজ্ঞাসা করে: স্যার হাসছেন কেন?
এত ভালো সমকোণী ত্রিভুজ বোঝালেন!
‘ঝড়ে মাজা-ভাঙা গাছ’— এভাবে আগে কেউ বোঝায়নি
স্যার, আপনি ‘ঝড়ে পড়া মাজা-ভাঙা গাছ’ সত্যি সত্যি দেখেছেন?
আমি চুপচাপ থাকি
শরীর থেকে ক্রমশ ভেঙে পড়ে ডালপালা
গাছ ও পাখি
একটি গাছ ভালোবাসার জন্য পাখি হল
আর একটি পাখি ভালোবাসার জন্য গাছ হল
এখন পাখি কি গাছের ওপর বসবে?
মাটিতে পড়ে থাকা বীজগুলো ফেটে বার করবে
তার মুখ
নাকি, কোনো বর্ষাকাল— জলের অভাবে
পাখির ডানা ভেজাতে না পেরে ভিজিয়ে দেবে চ্যালাভর্তি উনুন?
সাদা পায়রা ও বাবারা
১
প্রত্যেক বাবা কাঁধের উপর একটা সাদা পায়রা রাখেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন— যা, উড়ে যা। কোনো কোনো পায়রা আবার ফিরে আসে। কোনো পায়রা আর ফেরে না। তবুও বাবারা সাদা পায়রার জন্য কাঁধ প্রশস্ত করেন!
২
প্রত্যেক বাবা জানেন, পায়রার জন্য খোপ সঠিক নয়। ঝড়-বৃষ্টিতে আহত ডানার দিকে তাকিয়েও বাবারা ভুলে যান, খোপই একমাত্র আশ্রয় হতে পারত।
৩
সাদা পায়রারা কালো মেঘে ঢোকার সময় কি ভাবে
ফেলে আসা খোপের ভিতর বাবারা জলপানি চান না!
লম্বা মানুষের গল্প
১
লম্বা মানুষের ছায়া যে লম্বা হবে— এমনটা ব্যাপার না
ছায়া দীর্ঘ হওয়ার জন্য শরীর টান রাখা বা ঝুঁকে পড়া
কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই
তিনিই একজন লম্বা মানুষ
যিনি মসলিন কাপড়ের মতো দেশলাই বাক্সে ঢুকে যেতে পারেন
২
লম্বা মানুষের গল্পে ঝিনুক খোঁজার গল্প নেই
পাড় আছে, আর পাড় জুড়ে পড়ে থাকা হাহাকারে নিঃসঙ্গ ঢেউ
পর্যটকের ভিড়ে একজন লম্বা মানুষ আরেকজন লম্বা মানুষের কপাল হাত ছুঁয়ে দেবে ভেবেও
সমুদ্রের নুন নিয়ে ফিরে যায় বাড়ি
৩
আমিও চেয়েছি একজন লম্বা মানুষ হয়ে
বেঁটে মানুষের সঙ্গে গল্প করি
পাতা ওলটাতে ওলটাতে কখন একজন লম্বা মানুষ
একজন বেঁটে মানুষ হয়ে
লম্বা মানুষের গলায় ঢুকিয়ে দেয় পোষা টিকটিকি—
ধরা যায় না
দ্বিধা
দ্বিধা, তোমার ভিতর আয়না রেখে বলে দেবে না, প্রতিটি দৃশ্যে একজন করে নতুন ফটোগ্রাফারের জন্ম নেবে। রিল থেকে রিলে, সিনেম্যাটিক একজন খুনি আলোড়ন তুলবে বলে মুষ্ঠিবদ্ধ দু-হাত কি খুলে রাখছ? তালির মাধুর্য শূন্যতা জানে না। শূন্যতা, হাতকে আলোড়িত করবে বলে ভাঙা কাচ জুড়ে জুড়ে তৈরি করছে নতুন আয়না… দ্বিধা বিসর্গের মতো দুঃখী। দ্বিধা, চিরুনির কাছে তোমার ঠিকানা চেয়ে ভেঙে ফেলেছে একটা একটা দাঁত…
সম্পর্ক
সম্পর্কের ভিতর আজান দেওয়া মানুষটা আর নেই
সম্পর্কের ভিতর অঞ্জলি দেওয়া মানুষটা আর নেই
একটা ডানা ভাঙা পাখি এসে দাঁড়িয়েছে জানালায়
একটা বোঁটা খসা পাতা এসে দাঁড়িয়েছে জানালায়
দু-জনেই বলতে চায়: ধার্মিক হও না কেন?
উত্তর দিই না
একটা একটা প্রশ্ন এলোপাথাড়ি কাদা ছোড়াছুড়ি করে
কাদায় ডুবে অর্ধেক গলা বাড়িয়ে থাকে আরেকটি সম্পর্ক
শাড়ি
মনখারাপ ফেলে আসিনি
তোমার কাছে রেখে এসেছি কাঁটাতার
ভাগের ফসল মাঠে। পাখিদের করুণা তোমার ওই দুই ঠোঁট
কবেকার কোন জলজোনাকি
আলো ছড়িয়ে ডাঙায় রেখেছে প্রেম?
উড়ে উড়ে যায় দেশ… তোমার শাড়ি
সারি সারি বক হয়ে মেঘের ভিতর ঢুকে যায়
আধখোলা
এলোমেলা
আধভেজা
বাঘ
বাঘ হয়ে ওঠার আগে অন্তত নিজের থাবার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে বুঝে নিতে হয়
পেশি কতটা জোরালো
নকল দাঁত আর নকল নখ— রোদ পড়ে যতই আলো পড়ুক
ছায়া কালো হলুদ খেলবে সেই রাতে
যে রাতে তুমি তোমার ছালের রং দেখে নিজেই আঁতকে উঠবে
চাঁদ
প্রতিটি বিকেলের টিপে ঝুলে পড়া সূর্যকে, আমি চাঁদ বলে ডাকি…
নদিয়ার চাপড়াতে থাকেন। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও গদ্য লেখেন। ‘তবুও প্রয়াস’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। প্রকাশিত বই ‘মায়াজন্ম’, ‘লবণ খেতের জোনাকি’, ‘কাঁচা মাংসের বাড়ি’ ও ‘এই পথ পরিকল্পিত’। সম্পাদিত বই ‘ছাদ পেটানোর গান’।