দশটি কবিতা ।। মীর নিশাত তাসনিম তানিয়া

সুলেখা বানু

আজ সকালে পোস্টমাস্টার একটা চিঠি পেয়েছে।
সেটা সে পৌঁছে দেবে সুলেখার বাড়িতে। সুলেখা —
হয়ত তখন ধান মাড়াবে। অথবা অন্দরে বসে বটি নিয়ে
মেতে থাকবে রান্নার ঝামেলায়। অথচ-
চিঠিটা হাতে পেতেই সুলেখার জীবন বদলে যাবে।
সুলেখা বানু —
তেত্রিশ বছর যার বয়স। যার-ঘরে পাঁচটা সন্তান।
স্বামী থাকে শহরে। চিঠিটা
খুলতেই সে জেনে যাবে —
তার স্বামী নতুন একটা বিয়ে করেছে।
জেনে যাবে-এ জগতে তার ভরসা কেবল বাড়ির পেছনে
একটা প্রকান্ড বটের গাছ!
সে জেনে যাবে—জোর করে বিয়ে করা দশ বছরের
কিশোরী, তেত্রিশে পা দিলে-ফেলনা হয়ে যায়।
সে জেনে যাবে —
কেন তার স্বামী গত দু’বছর ঘরে ফেরেনি।কেন-
তার দু’বছরের কন্যার মুখ দেখেনি আজো।

সুলেখা বানু-
জীবন বড়ই দুর্বোধ্য! আলু ভর্তায়
কতখানি তেল বরাবর-
শরবতে কতটুকু চিনি সঠিক-
এটুক জানলেই-আঁচলে পুরুষ বেঁধে রাখা যায় না!
সুলেখা বানু-
সংসার না শিখলে—
বিয়ের তেইশ বছর পরে-চিঠি পেতে হয়
বাড়ির পেছনে বটগাছের তলায় যেতে হয়
হাতে নিয়ে যেতে হয় —
বিয়ের শক্তপোক্ত একটা মাত্র শাড়ি।

 

গাছেরা

দুটো গাছ-
একে অপরকে ভালবাসে।
দুটো গাছ-
নিজেদের ফুলে ঘটায় পরাগায়ন।
দুটো গাছ-
পারে না-দূর থেকে ছুটে এসে আলিঙ্গন করতে
একে অপরকে।পারে না-
শেষ প্রহরে বিমুগ্ধ চুমু খেতে।
দুটো গাছ-
একে অপরকে ভালবাসে।
দুটো গাছের-
একটি গাঁয়ের মেটে চুলোয়।
আরেকটি-
শ্মশানঘাটে পোড়াচ্ছে শব।
দুটো গাছ-
একে অপরকে কেবলি ভালবাসতো।
দুটো গাছ-
একে অপরকে ছোঁয়নি কখনোই।

 

ঘাসফুলের ঘর

শৈশবে হাত ফসকে উড়ে যাওয়া লাল বেলুন —
আজ হাতে এসে পড়েছে।এসে পড়েছে —
দশম শ্রেণীর শেষ ফলাফল, গণিতে শূন্য।
বিয়ের সানাই বাজছে —
যদিও মেট্রিকে ফেল মেয়ের বিয়ে
কোন ভালো ঘরে হয় না। মেয়ের মা বিদায় বেলায় কাঁদছেন।
সুখে-না দুঃখে! কে জানে!
হঠাৎ-মাঝরাতে প্রসববেদনায়
হাতে এসে পড়েছে শৈশবে প্রিয় সেই লাল ফিতে —
হারিয়ে যাওয়া একটা বেলুন। নারী-
বিছানাকেন্দ্রিক খেলনা।
মাটিতে শুলে-মাটিও বিছানা হয়ে যায়।

 

বয়স

আমার কিশোরী বয়স কেটেছে-ঘরের কোণে।
ব্যক্তিগত অশ্রুতে জবজবে ভেজা মেঝেতে আমি ঘুমোতাম,
আর –
আমার বাবার মধ্যবয়স কেটেছে—আমার স্তনে হাত রেখে।
মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সৎমা এবং আমি, আমরা দুজনেই—
বাবার স্ত্রী।

 

বিছানা

বিছানাটাকে রোজ রোজ কফিন মনে হয়। সারাবেলাই শুয়ে থাকি। কেউ আমায় মনে করে না আর। ফোনে কোন কল আসে না। মনে হয়—সবাই আমাকে প্রয়াত ধরে নিয়েছে। কখনো কখনো দেখি-মা আমার জন্যে জায়নামাজে চোখের পানি ফেলছেন। তখন আরো বেশি মৃত অনুভব করি।শুনেছি-কাছের মানুষ মরলে নাকি লোকে লাশের সামনে বসে কাঁদে! তবে কেন কাউকে আমার বিছানার পাশে বসে কাঁদতে দেখি না?

 

ইবাদত 

প্রিয়তম,
তুমি আমার কোরআন। তোমায় মধ্যরাতে পড়ে পাই
হাজারগুণ সওয়াব, প্রতিবার খতম শেষে ঠোঁটে নামে নিগূঢ় প্রশান্তি।
তুমি আমার কোরআন। বারংবার তোমার নামেই, আমি নত
হই ঈশ্বরের কাছে। যিনি তোমায় নাযিল করেছেন।
তোমার প্রতিটি হরফে আমি আংগুল ছোঁয়াই-পবিত্রতায়,
পড়া শেষে বুকে জড়িয়ে চুমু খাই—তুলে রাখি গোপন বাক্সে।
তুমি আমার কোরআন।
প্রতি মধ্যরাতে আমি তোমায় গুণ গুণ সুরে পড়ি।

 

বিশ্বাস

স্বজনের মৃত্যুতে লোকজন ঈশ্বরে দ্বিগুণ বিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

 

ঘুমন্ত বালিশ

সন্তানকে কবরে রেখে—একজন মা রোজ রাতে
বালিশকে ঘুম পাড়ায়। শোনায়
ঘুম পাড়ানি গান!
শিশুরা মরে গিয়ে আকাশের তারা নয়-বরং মায়ের বালিশ হয়ে যায়।

 

প্রত্যাবর্তন

তুমি চলে গেলে, মাটিতে কান রেখে
শুনেছি, তোমার পদধ্বনি
কিছু মানুষ কেবল চলে-চলেই গ্যাছে,
কখনো ফিরে আসেনি।

 

আমার মৃত্যুর পর যদি

আমি মরে গ্যালে যদি জানতে পারো—আমার খুন হয়েছিল—
তবে দোষী বোল না আমার প্রাক্তন প্রেমিকদের। কারণ, তারা হয়ত
ক্ষোভ মেটাতে ভুলবশত আমায় মেরে দিয়েছে। অথবা,
আমার বন্ধুদের সন্দেহ কোর না। যাদের প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
তোমরা আমার বাবাকে জিজ্ঞাস করো না— আমার মৃত্যুতে
তার কেমন লাগছে! আমার ক্রন্দনরত মাকে
তোমরা ভুলেও বোল না— তার কষ্ট তোমরা বুঝতে পারো।
আমি মরে গ্যালে—যদি জানো আমার খুন হয়েছিল, তবে-
চেপে ধোর না আমার উত্তরসূরিদের টুঁটি। অথবা,
কোন রাজনৈতিক সংঘটনের নামে কেলেঙ্কারি আরোপ কোর না।
আমার খুনের খবর ফলাও করে প্রচার না করে —
গোপনই রেখো। হন্তারককে খুঁজে পেলে, তাকে দিও আমার লেখা
অভিনন্দন পত্র। বোল —
আমি তাকে ভালবাসি। আমার মা বাবা আর আমার ঈশ্বরের চাইতেও বেশি।
সে আমার চোখে সর্বোচ্চ সম্মানী ব্যক্তি। পারলে —
তাকে লাল গালিচায় করে পৌঁছে দিও স্বর্গে। তার মঙ্গলের জন্য
জাতিকে প্রার্থনা করতে বোল। আমার খুনিকে শাস্তি দিও না। আমি-
ক্ষমা করেছি তাদের—যারা জীবন্ত আমাকে জ্বালিয়েছে কোটিবার। তাই –
আমার হন্তারককে আমি স্নেহ করি।
আমি চাই-তাকে একবার! কেবল একবার! পরম আদরে জড়িয়ে ধরতে।

 

 

শেয়ার