বৈরাগ্য
যেদিন থেকে জেনেছি সাপুড়েরা আমায় সাপ ভাবে এবং সাপেদের কাছে আমি এক মস্ত বড় সাপুড়ে
সেদিন থেকেই সাধারণের চিরকালীন কিছু দুঃখ আমার কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে
মানুষ ভুল বুঝলে এখন বড়জোর আমার ঘুম পায়
বস্তুত এমন এক বণিকের সন্ধান আমি পেয়েছি যার কাছে কয়েকটি দুঃখের বিনিময়ে পাওয়া যায়
ব্রহ্মাণ্ডের সবটুকু আলোর স্বত্ব
তাই সব উদ্দেশ্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে আমি এখন একটিমাত্র উদ্দেশ্যের আঙুল ধরে
হেঁটে বেড়াই
সাঁতার কাটি সমাজচ্যুত এক চিন্তাসাগরে
আর অসংজ্ঞায়িত কোন সুরার নেশায় আকাঙ্ক্ষাদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসলে
আমি মেতে উঠি আমারই উপাসনায়।
প্রত্যাবর্তন
স্মৃতিনগরে আমার সুখের বাড়ি, যেখানে দুঃখের ঘর বারান্দা উঠোন মিলে এক বিস্তৃত কারাগার
সাজাভোগের অজস্র বছর সব অজানা সময়কালে
সেখানে আর নয়, এবার যেতে চাই নিজগৃহে
দেলক্বাবায় বাজে তার সুরেলা আহবান
নিজেকে ডিঙিয়ে নিজগৃহে যাবার পথ জ্বলজ্বল করে ধ্যানে, বুক ভরে ওঠে আশায়
বর্তমান শোকে আমার আর চোখ ভেজে না
মৃত্যুহীন দোজখের খরতাপে শুষ্ক জীবন শুধু আগুন লাগে না, পুড়িয়ে দেয় না চিরতরে
আদিপ্রেমের সন্ধানে ছুটে চলে মন, যেন এক তৃষ্ণার্ত কুকুর
এই ক্লান্ত মানসে যদি ঘুম হানা দেয়? খুব ভয় হয়
আরও কত ক্লান্ত হলে এই পথ ফুরাবে দয়াময়?
টান
ছোটবেলায় মনে হতো আমাদের পাশের গ্রামেই বুঝি পৃথিবীর সীমানা
ভয়ে গ্রাম থেকে তাই কখনো বাইরে যেতে ইচ্ছে করেনি।
এরপর একদিন ভুলভাঙা বয়স আমাকে নিয়ে এলো এই শহরে
শেখালো মানুষের ব্যবহারিক সংজ্ঞা
একে একে আমি আবিষ্কার করতে থাকলাম প্যাকেটে মোড়া সব দুঃখ,
মানুষ খেকো মানুষ, ধস্তবিধ্বস্ত দেশ-মহাদেশ
আর ধর্ষিতা নারীর মতো একটি বিক্ষত পৃথিবী।
এ শহরকে এখন আমার উঁচু দরের বেশ্যার মতো মনে হয়
বিনিময় ছাড়া যেকোন সুখ এখানে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
আসলে ছোটবেলায় বাড়ির পাশের মাঠ থেকে দেখা সীমানাটি ছিলো মূলত সুখের।
আটটি পাড়া মিলে আমার যে গ্রামটি, তার পরিসীমাকে এখন আমি আটটি বেহেশতের সাথে তুলনা করি;
নিজেকে ভাবি অচেনা গ্রহে নির্বাসিত প্রথম মানব।
আপন ঘরের খবর নে না
বাড়ি যাও মাতাল
খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে যেখানে তুমি যাও
সেও এক মস্ত খাঁচা
আকাশ কিংবা পাতাল
বাড়ি যাও মাতাল।
জীবনের বহুমুখী ব্যবহার
মাঝে মাঝে আমাদের জীবন উঠে বসে ত্রুটিপূর্ণ রিক্সার সীটে, অভিকর্ষের বিপরীতে বল প্রয়োগ করেই তখন টিকে থাকতে হয়।
জীবিত হয়েও মাঝে মধ্যে কিছুকালের জন্য আমরা বাধ্যতামূলকভাবে মূর্তি হয়ে যাই
চোখের সামনে পৃথিবীর নড়াচড়া দেখি
দেখি মানুষের আনন্দ অথবা দুর্গতি
এবং সমস্ত দিন আমরা শুধু দেখে দেখেই তৃপ্ত হই।
অনেকদিন অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে আমরা কেউ কেউ পেশাদার মুচি হয়ে উঠি
সযত্নে সেলাই করি ছেঁড়া-ফাঁটা জীবন।
কখনোবা আমরা হয়ে উঠি অপ্রাপ্তবয়ষ্ক প্রবীণ কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক শিশু
চেনা অচেনা চরিত্রে চলে আমাদের নিরন্তর অভিনয়।
কিছু সময় আসে যখন আমাদের আর কিছুই বুঝতে ইচ্ছে করে না, জানতে ইচ্ছে করে না
দুর্বোধ্যতাই হয়ে ওঠে জীবনকাব্যের মূল উপজীব্য,
আমরা তখন দলবেঁধে কবি হয়ে যাই।
মাঝে মাঝে যখন তীব্র অসহায়ত্ব আসে জীবনে, তখন আমরা পূজারি হয়ে যাই
জাগতিক আর মহাজাগতিক দেবদেবতায় সমর্পণ করি স্রোতে ভাসা জীবন
খড়কুটো পেয়ে গেলে আমরা আবার নিজে নিজেই সর্বশক্তিমান হয়ে উঠি
এভাবে পালাক্রমে চলে আস্তিকতা-নাস্তিকতা
আর কঠিন পেশাদারিত্বের সাথে যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে জীবনের বহুমুখী ব্যবহার।
পরিচয়
একদিন নিজের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে দেখলাম কতটা প্রেম ছেড়ে মজেছি গহীন অন্ধকারে
সত্য উন্মোচনের লজ্জায় মিথ্যেরা মরে গিয়ে স্পষ্ট হল একটি ভগ্ন কায়ার পরিচয়
আরও একটু গভীরের আলো থেকে জানা গেল,
হাওয়ার স্পর্শেই আদমের প্রবল মৃত্যুভয়।
অসময়
লুকিয়ে পড়ো প্রেম
ঘুমিয়ে পড়ো নেশা
জীবনের জলে লুটেরা হাওয়া
ভেস্তি শরাবে মৃত্যু মেশা।
পলানটুক
একটি ভয় একজন মানুষকে এড়িয়ে চলে
একজন মানুষ সেই ভয়কে ভালোবাসে
কখনো ভয় মানুষটির কাছে গেলে,
লোকটি ভয় পেয়ে নিজের ভেতর লুকিয়ে পড়ে।
প্রতিদান
আমার খুন হয়ে যাওয়ার হাস্যজ্জ্বল প্রত্যক্ষদর্শী যিনি
তার দীর্ঘশ্বাসেও আমার প্রবল আপত্তি ছিল
ঠোঁটে হাউজে কাউসারের ধারা দেখে আমি তাকে ভালোবাসলাম আর
দোজখের ত্রিমুখী কাঁটা হয়ে সে আমার চিন্তায় আটকে গেল
অতঃপর এ সমস্ত নির্মমতাই যদি তাদের নির্মলতা হয়
তবে বুঝে নেব- বিষের দাম বেড়ে গেলে মানুষেরা প্রেম কিনে খায়।
যদি হৃদয় পাতো কানে
তোমার দেহে যে আবহমান রূপের সম্মেলন
তার প্রতিটি ভাঁজেই আমি খুঁজে পাই ইবাদতের ভাষা
আমি যে তোমায় এত ডাকি এত যে জপি তোমার নাম
তুমি তার প্রতিবাদ করেছিলে,
অথচ তুমি জানো না- ও দেহের ভাষা জানলে যেকোন কাফেরও মগ্ন হবে কঠোর উপাসনায়
মুশরিকেরা সব বসে যাবে অনির্দিষ্টকালের ই’তেকাফে
তুমি বরং তোমার হৃদয়ের সাথে একটা কান জুড়ে দাও
অথবা কানের সাথে একটা হৃদয়
তাহলেই শুনতে পাবে- কতটা মর্মস্পর্শী আমার এই একাগ্রতার আজান।