তিনটি খুতবা | সোহেল হাসান গালিব

এবারের বইমেলায় ‘উজান’ থেকে প্রকাশ হচ্ছে কবি সোহেল হাসান গালিবের গদ্যের বই ‘আমার খুতবাগুলি’। সাহিত্যের রাজপথ, চোরাগলি, মিথ, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদিকে নিজের কৌতুকীয় ও তীব্র শ্লেষাত্মক ঢঙে গদ্যে রূপ দিয়েছেন গালিব। আমার খুতবাগুলি থেকে তিনটি খুতবা শিরিষের ডালপালায় প্রকাশ করা হলো।


ছফার কবিতা

আহমদ ছফার কবিতা কেমন লাগে আপনাদের? আমার কাছে করুণ ও ক্লিশে। শুরু করলেই মনে হয় তাড়াতাড়ি শেষ লাইনটা পড়ে ফেলি। আহমদ ছফা ও হুমায়ূন আজাদ দুজনেই বাংলা ভাষার করুণ কবি—যাদের কবিতা কেবলই করুণা জাগায়। প্রগল্ভ প্রাণের প্রলাপ মনে হয়।

কবি হিশেবে ছফা সম্ভবত আজাদের নিচে পড়বেন। তার যে কোনো কাব্য অলৌকিক ইস্টিমারে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যাবে, সলিলশয়নে ঘুমাবে লেনিন। এমনকি তার বহুল আলোচিত একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা-ও। যেটি পড়লে মনে হয় আমরা যেন ১৯৩০ সালে পৌঁছে গেছি। মাঠে আন্দোলন করছে কৃষকশ্রমিকপ্রজা পার্টি।

ছফার আরেকটি মশহুর কাব্যচেষ্টা কবি ও সম্রাট। যেটি পড়লে আপনাকে অবশ্যই মোঘলের সাথে না হোক, আফগানের সাথে খানা খেতে হবে। সলিমুল্লাহ খান বলেন, প্রত্যেক কবির জন্য এটি পড়া ফরজ। আমি তো ফরজ আদায় করেছি নিজ গরজে অনেক আগেই। তাতে বুঝেছি, খান সাহেব নফলকে ফরজ জ্ঞান করে কবিজীবন বরবাদ করেছেন গত শতকের আশির দশকের শুরুতেই এক আকাশের স্বপ্ন নিয়ে।

আহমদ ছফা কেমন কবি? অবশ্যই নিম্নমাঝারি মানের। দগদগে ও রগরগে চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরলেই ভালো কবি হওয়া যায় না। এর শোচনীয় উদাহরণ সলিমুল্লাহ খান।

আহমদ ছফার কবিতায় আমরা পাব কথা বলার নারীসুলভ চপলতা। কোন জায়গায় থামতে হয়, সে ব্যাপারে তার আছে টলোমলো অসংযম।

কথা বলাটাই কবিতা না। কথা না বলাও কবিতা। কিভাবে বলছেন আপনি? আহমদ ছফা কবিতায় কথা বলেন আধা-রাবীন্দ্রিক মুদ্রায়।

যেমন : অত্যাসন্ন অন্ধকারে চিরস্থায়ী হোক/ গম্ভীর জমাটবাঁধা স্তব্ধতর শোক—/ অনাদি অনন্তকাল নয় পরমায়ু/ প্রাণের সন্তাপ নেবে জল আর বায়ু।/ এই প্রাণ অন্ধকারে কোন একদিন/ সময়সিন্ধুর বুকে হয়ে যাবে লীন… ইত্যাদি। [‘সময়সিন্ধু’ একবিন্দু জীবনদাশ বটে]।

আহমদ ছফার কবিতার ভাষা আইএ-পাশ বাঙালি মুসলমানের শৌখিন কাব্যচর্চার উদাহরণ মনে হয় আমার কাছে। চিন্তাতে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে করুণ ও ক্লিশে।

তাহলে চিন্তা ও ভাষা বিপরীতমুখী হতে পারে? পারে বৈ কি। যেমনটা হয় অনুবাদের ক্ষেত্রে। বোদলেয়ারের কবিতা যখন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের দস্তানায় ঢুকে পড়ে।


জসীম মাহমুদ

কাব্যরসিকদের দিলে আর জখম করতে চাই না।

তাই বিনয়ের সঙ্গে বলি, যারা মনে করেন আল মাহমুদ জসীম-জমজম পান-করা কবি, তারা আশলেই উপরিতলের রসিক। কষ্ট করে একটু গভীরে নামতে চান না। আর যারা ভেবে বসে আছেন নক্সী-কাঁথার মাঠ থেকেই জেগে উঠেছে রূপসী বাংলা, তারা এতটাই বেরসিক, এ নিয়ে কথা বলতে গেলে যথেষ্ট সোমরস পান করতে হবে।

আপাতত সোনালী কাবিনে-র ফয়সালা করা যাক।

আমাদের মাহমুদ ভাইটি জসীমের প্রেতাত্মা নয়, বরং জসীমের ক্রিটিক। বাঙালির জসীম-জজবা যে একটি করুণ ফ্যাশন তা বোঝা যাবে আল মাহমুদের ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতাটা পড়লেই :

প্রত্যাগত পুরুষ সে-জন

কী মুস্কিল! দেখলো যে, নগরের নিভাঁজ পোশাক

খামচে ধরছে হাঁটু। ঊরতের পেশী থেকে সোজা

অতদূর কোমর অবধি

সম্পূর্ণ যুবক যেন বন্দী হয়ে আছে এক নির্মম সেলাইয়ে।

যা কিনা এখন তাকে স্বজনের সাহচর্যে, আর

দেশের মাটির বুকে, অনায়াসে

বসতেই দেবে না।

কবিকে বাধ্য হয়ে তাই এখন শোনাতে হবে পানের বরজ পার হয়ে যাওয়ার গল্প। সে গল্প আর নিটোল গ্রামের সবুজ টিয়েপাখির রাঙা ঠোঁট নয়।

দুজন কবিই গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির কাছে শান্তি খুঁজে ফিরেছেন, এটা সত্য। কারণ তারা দুজনেই মফস্বল। কিন্তু একটু পার্থক্য আছে। একজন ভাবছেন, শহরের মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে গ্রামে নিয়ে যেতে পারলেই কাম সারা। মানে মুক্তি। গ্রাম তার কাছে কামরূপ কামাক্ষা। আরেকজন জানেন, গ্রামে যাওয়া মানেই গ্রামে ফেরা নয়। এই ফিরতে না পারাটাই আধুনিকতার ছেদ ও হাহাকার। এবং তা স্বীকার করার মধ্যেই কবিতার মুক্তি। কারণ, একটি ব্যর্থতা কবুল না করলে অসম্ভব তার বিকল্পের প্রস্তাবনা।

এই যে পাল্টে যাওয়া সময়, তাকে অ্যাড্রেস করা একটি প্রগাঢ় অজসীমীয় ব্যাপার।


তত বড় নন

হাসান আজিজুল হককে যত বড় লেখক মনে হয় তত বড় তিনি নন।

গল্পকার হিশেবে আল মাহমুদের চেয়ে পানসে। এবং হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে কম চিত্তাকর্ষী। কিন্তু কী এক অলৌকিক ভাবগাম্ভীর্যে তিনি ছাপিয়ে গেছেন এদের সবাইকে।

তার গল্পের সমস্যা দুটি—

১. ম্যাজিকাল ম্যাডনেসের অভাব :

তার অধিকাংশ গল্পের এক-তৃতীয়াংশ পড়লেই বোঝা যায় তিনি কী বলবেন বা কী করবেন। ফলে বাকি দুই-তৃতীয়াংশ পড়তে হয় হিশাব মেলাবার জন্য। আনপ্রেডিক্টেবল কিছু ঘটে না। তাকে দেখি—পারাপারের ঘাটে-লাগা শান্ত ফেরির যাত্রী একজন।

২. ভাষা ও গল্পশৈলীর দারিদ্র্য :

তার ভাষায় আছে প্রাবন্ধিকের সংহতি ও সজ্জা। কিন্তু নেই কবিত্বের সংকেতময়তা। কিংবা সংরাগ-সিঞ্চিত সংবেদনা। নিরেট গল্পই লেখেন তিনি। তৈরি করেন নিপাট চরিত্র। নিছক ছকে-বাঁধা। তার গল্প বাংলা ভাষায় নতুন কিছু সংযোজন করে নি। শৈথিল্যের সংকোচন করেছে মাত্র।

কিন্তু সেক্ষেত্রেও তিনি ওয়ালীউল্লাহর চেয়ে ঊন।



সোহেল হাসান গালিব

জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৭৮, টাঙ্গাইল। বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম, ঢাকা।

প্রকাশিত বই :
কবিতা—
চৌষট্টি ডানার উড্ডয়ন [সমুত্থান, ২০০৭]
দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে [শুদ্ধস্বর, ২০০৯]
রক্তমেমোরেন্ডাম [ভাষাচিত্র, ২০১১]
অনঙ্গ রূপের দেশে [আড়িয়াল, ২০১৪]
তিমিরে তারানা [অগ্রদূত, ২০১৭]
ফুঁ [বাতিঘর, ২০২০]
চৌষট্টি পাখুড়ি (আদর্শ, ২০২২)
দরজায় আইভিলতা [ঐতিহ্য, ২০২৩]
প্রেমের কবিতা [ক্রিয়েটিভ ঢাকা, ২০২৩]

প্রবন্ধ—
বাদ-মাগরিব (ভাষা-রাজনীতির গোপন পাঠ) [অগ্রদূত, ২০১৮]

সম্পাদিত গ্রন্থ—
শূন্যের কবিতা (প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা) [বাঙলায়ন, ২০০৮]
কহনকথা (সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার) [শুদ্ধস্বর, ২০০৮]

সম্পাদনা [সাহিত্যপত্রিকা] : ক্রান্তিক, বনপাংশুল।

ই-মেইল : galib.uttara@gmail.com

শেয়ার
সর্বশেষ সংখ্যা