‘ডুবোপাহাড়’ বই থেকে কবিতা ।। খান রুহুল রুবেল

অরণ্যভ্রান্তির দিকে
 
অরণ্যভ্রান্তির ঠিক নিচে, তুমি খুলে ফেলো হে নাবিক,
তোমার নিবিড় টুপি, তার্পিন, এরপর কাঠের সীমানা,
কিছু পরে কুঠারের দিন এইদিকে শুরু হয়ে গেছে।
ডেকে উঠছে পাথর, তার মোম, এ শীতে জরজর
শ্বাপদ অক্ষম হিংসা হাতে হেঁটে গেল কিছুদূর,
তাকে পেয়ো না ভয়, বরং তোমার আশ্রয়, ময়ূরের-
স্বভাবের কাছে রয়ে গেছে, তাকে দিও কিছু অনুমান,
কাঠের গন্ধের নিকটে, জাহাজের কোন ঋণ আছে কিনা,
সেই কথা জিজ্ঞেস করো, তারপর দেখো তোমার লবণ-
ঘিরে কি করে পাতারা বসে প্রার্থনায়, জানায় আর বেশী
বাকী নেই ক্ষমা, রাতের প্রবারণা শেষ হয়ে এল, চলো-
কুঠারের নিকটে যাই, ডেকে আনি কুঠারের হাসি।
এই ধ্যানে নত হল কাকাতুয়া, বিজড়িত ঠোঁটে,
হাহা শব্দে হেসে উঠল কুঠার, যেভাবে চিতারা ছোটে
সহসা রাশি রাশি শবদেহ, সুগন্ধে তোমাকে ডেকেছে,
কাঠের অনেক আগে, কাঠুরিয়া মরে পড়ে আছে!
অরণ্যভ্রান্তির ঠিক নিচে, তুমি খুলে ফেলো হে নাবিক,
তোমার নিবিড় টুপি, তার্পিন, এরপর কাঠের কামনা,
কিছু পরে কুঠারের দিন এইদিকে শেষ হয়ে গেছে।
 

আয়না
 
আয়নার নিকটে যাই, গিয়ে কখনো দাঁড়াই না,
আয়না তার নিজস্ব সঞ্চয়ে কিছুটা নত হয়ে আছে।
 
সে দেখেছে উদ্ভিদ, দেয়ালের পাশে থেকে ছায়াময়,
আরো ছায়া হয়ে ওঠে, তবু পরাজিত কার ছায়ার নিকটে,
তাকে ছোট বলে মনে হয়, যেন অজস্র শীত,
ভেঙে গুঁড়ো হলো, পাহাড়ের চুড়ো থেকে নেমে এসে,
রোদের নরম দিয়ে বিছালো ভূমিতে!
 
তার নিজস্ব শরীরে নয়, পারদের প্রতিভায়,
অপরের শরীরময় জুড়ে সে দেখে পুরস্কার,
অঙ্গের প্রতিচ্ছবি, অংকের শোভা নিয়ে বলে যায়-
যুবতীর নির্বাপিত দেহ, খুলে ফেলা বাসী অলংকার!
সুবাসিত করে গেছে, পুরনো করে রেখেছে কতকাল?
জলও তো আয়না? পারদের বদলে শুধু রয়েছে শৈবাল!
কতদিন সাঁতারে নেমে দেখেছি ধরা পড়ে গেছে,
আমার মলিন ছায়া, কৃশ নুন, জলচক্ষুর কাছে।
 
আয়ানার নিকটে যাই, গিয়ে কখনো দাঁড়াই না,
আয়না তার নিজস্ব সঞ্চয়ে, কিছুটা উঁচু হয়ে আছে।
 

ইলিশ
 
অরুন্ধতী তুমি, মনোরম ইলিশ আমার!
প্রাচীন জল ভেঙে কল্লোল তুলে আছ,
দেখিয়েছ, জলের বিছানো শরীরে
চাঁদের সহিস নেমে ধীরে ধীরে ডুবে গেছে।
 
এতটা রূপালি ছিলে তুমি? বালির জলজ শাসনে?
তবে এই বুদ্বুদগুলো কার? এই পুত্রশোকভার?
পুত্রহীন মাতার মতো বিদ্যুৎ কোমলতা
আজও দেখি জলে, শুনি সেই উপকথা-
 
কুসুমকম্পিত দেশ ভেবে বাণিজ্যে গেছে তরী,
তারপর সে নাবিক যেন কার ছেলে, দিকবিদিক
ভুলেছে, ডুবেছে মল্লার দল, সব সঞ্চিত কানাকড়ি
ঠাঁই নিয়ে নেমেছে প্রবালে, প্রেতপ্রচ্ছায়াময়
সে কাদের বিলাপ, সাগরের দূরদেশে আজো শোনা যায়!
তারা দেখেনি কোনো ঢেউ, তবু কিসে ডুবে গেলে তরী?
ছিল কি ইলিশ ছায়া? রূপালি রেণুর ঋণ, মৎসকুমারী?
অরুন্ধতী তুমি, মনোরম ইলিশ আমার,
গ্রীবার রূপা তুলে হাসো, এ কথা জানো না?
রূপালি মৃত্যু হলে, ইলিশও বাঁচে না!
 

পাললিক
 
তিনভাগ জীবন দৌড়ে যাই, একভাগ অরণ্যমাছির
নদীর কথা ভেবে এতটা গমন, ততটা বেশী নয় জানো,
যদিও সমুদ্র ডাকে, তথাপি তুলে আনি নদীরই ব্যাধি,
প্রকৃত জলজ হলে, নদীই নিকটে আসে, আর সমুদ্র কামনার-
আশ্বাস ভুলে যায়, জানায়- লবণ নয়, পলি রক্তই প্রিয় তোমার!
তা জেনেও নাবিকের চলাচল, আদি শুশুকের পিঠে স্থির
ভেসে চলে, ভাবে, যথার্থ পরিধি এঁকে, সমুদ্রকে পাবে।
 
যে নদীর দিকে গেছি, অরণ্যমাছি খেয়ে নিল দ্বিতীয় গমন
সৌর তলোয়ার তার ফোয়ারা ভেঙে দেয়, ছিন্ন সন্ধায়-
যে আগুন, তাকে সূর্য বলে ভুল করে ডুবোজল, প্রগমন!
যথেষ্ট কানাকানি বলে দেয় ,ওই বাকীভাগ স্থল, খুঁজে নিও
এইভাবে মৃত নদী , তুলে নিয়ে চলে যায় সবটা ফসল!
তিনভাগ জল এক ভাগ ডাঙা, এ কেবল রটনা, প্রতিভা-
বাতাসের, শুনে রাখো নাবিকী নব এই, নতুন ভূগোল-
নদী নাম যার, তিনভাগ জল তার এবং একটি অতল!
 

 


তোমাকে
 
অপর সমুদ্র থেকে আমি তার
ছড়িয়ে দিয়েছি শরীর, শরীরের ভার,
তীরে তীরে তার যত ছড়ানো আবীর
লুকনো প্রভা তুলে তাকিয়েছে।
 
অপর সমুদ্র থেকে আমি তার
ডুবিয়ে রেখেছি শরীর, শরীরের ভার,
তীরে তীরে তার যত প্রেতিনী হাসির
ক্ষমাহীন ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়েছে!
 

প্রবাহ
 
প্রবাহের সাথে দেখা হলো সহসা
গতকাল বিংশতি দশকে!
আমাকে দেখালো সে, সিন্ধুচন্দ্রিমার জল
গ্রহমদের মহিমা, সৌরসুরভিত ফল।
দেখে আমার কিছু হাসি পায়
কিছুটা স্রোতরক্ত ছুটে যায়-
জানে না যে মরে গেছি,
ডুবে গেছি, কবে কখন, উনিশশ কতোতে…
 

গাছ
 
কাঠের দিকে তাকালে স্বভাবতই
কয়েকটি গাছ দেখতে পাওয়া যায়,
কাঠের শরীর দিয়ে ধীরে ধীরে
আসা যাওয়া করে কয়েকটি গাছ।
মূলত কাঠ আয়নার চেয়েও স্বচ্ছ-
এখন কাঠই হয়ে উঠছে আমার প্রধান আয়না!
 
যদি কোথাও দেখ চীর্ণ হয়ে যাচ্ছে কাঠ
অথবা গাছের শরীর শুয়ে আছে মৃত
জানবে, আমিই মরে আছি পাশাপাশি শয়নে,
কোন এক করাতকলের সন্ত্রাসে।
ধীরে যেতে যেতে তোমার মৌনতা তাকে দিও-
যদি সবুজ রক্তের গন্ধ ভেসে আসে…
 

ছায়াকুকুর
 
তোমার স্বভাবে এই দুপুর,
আর আমি অন্ধস্বভাবী
রাত্রির তৃতীয় বাদুড়-
ছুটে যেতে দেখি,
দেখি প্রেতপ্রতিভায়
এইসব অন্ধকার ছায়া-
বাদুড়ের মতো হয়ে ওঠে
এক জানালা থেকে আরেক জানালা
ছোটে রহস্যময়!
 
 
আমারও অন্তর্গত,
রয়ে গেছে দুপুর, তার মোহ
চৈত্রমেঘ ভেঙে এক সারমেয়
তাকে পুড়ে যেতে দেখি,
তার দ্বিতীয় কুণ্ডলী ছেড়ে
আবার দাঁড়াবে কি?
তুমি পরহিত অচতুর
তুমি ভাই, তুমি বৈমাত্রেয়-
কিছুটা কুণ্ডলী আমাকে দিও তুমি ছায়াকুকুর,
কিছুটা কুণ্ডলী আমাকে রেখো তুমি ছায়াকুকুর!
 

মন্ত্র
 
মন্ত্র শিখে নাও, বাতাসে মন্ত্রধ্বনি আছে
আর, কফির কাপ থেকে গড়িয়ে দাও-
লাল নীল বসন্ত রঙের বাষ্প, তাপ
বাষ্পের শোভাই সুন্দর, কেননা দৃষ্টিহীন-
তারাও বুঝে যায়, এ বাতাস,উত্তাপ।
 
শব্দের জন্ম শিখুক, জলেই জন্ম শব্দের,
বাতাস ফুটতে থাকুক, নরম রক্তের-
ফোয়ারা দেখ, জেনে নাও পরিমাপ-
কতটা শব্দ ছিল তার কতটা সঙ্কেত?
 
বাগানে যাও, বাগান রাতের দিকে গেছে,
যথাসম্ভব ঠোঁটে, বাজাও অন্ধ ও অর্গান-
যদিও ভাবছ আছ সঙ্গীতের কাছে,
শব্দের মূলাধারে আছ ঠিক সপ্রমাণ,
তথাপি দেখো এই রাত্রির আনাচে
ওরা সঙ্গীত নয়, আসলে বাজাচ্ছে বুলেট!
 

কামনা
 
দাঁড়িয়ে রয়েছে দেয়াল, তার দিকে কাছাকাছি
সঞ্চারণ করে পাখা ওড়ে এক প্রখর মৌমাছি
নীরবে ডুবে যায় দেয়ালে, এমনই তাড়না-
 
দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়
তার চারপাশে শুধু রয়ে যায়,
অতীতের এক মাছি, মাছির কামনা!
 

বিপরীত অগ্নি
 
চোখের দিকে তাকালো আরেকটি চোখ
জ্বলে ওঠে চকমকি, সাদা দিবসের খুন,
লেখে আদিপিতা পাথরের গান, বহুদূরগামী-
ধান, জলে জলে ফলে ওঠে জলজ শ্লোক!
এভাবে জলই জ্বেলেছিল প্রথম আগুন!
আমিও বিপরীতে জলে নেমে দেখেছি একাকী
আগুনে আগুন ঠুকে কিছুটা পাথর পাবে নাকি?
 

চিঠিযুগ
 
বলো পোস্টম্যান, চিঠিযুগ এখনো থামেনি
উতরোল শর্ষের ক্ষেতে ফুলে ওঠে হাওয়া
কিছুটা বিরতি দিয়ে ধাবমান কালো ট্রেন
ঠিক এসে থামে, তুমি চেনো ট্রেনের চাহনি?
এখনো রয়েছে পূব, তার বিপরীতে পশ্চিম
কিছুটা ডাইনে হাওয়া, আরো এগোলে হিম
নর্তকীর প্রদক্ষিণ ঠিক লেগে আছে কম্পাসে
তোমাকে মনে নেই, লেখার ঠিকানা পড়ে আছে।
 

প্লানচেট
 
ছুঁড়ে দাও প্লানচেট, তার থেকে নামুক-
অভিজ্ঞ আঙুর, কিছুদূর বিনিময়ী ফল
এবং দেখো বেদনার্ত এক পুরুষের দেশ,
প্রেমিকার আলিঙ্গনেও যারা অস্ফূট স্বর-
“কুমীরের আয়ু এত কেন দীর্ঘ কোমল!”
 
ছুড়ে দিলে প্লানচেট, তার থেকে দেখো
গতিময় ছায়াকৃতি, প্রকারন্তরে পুরুষপ্রতিম
শ্রমক্লান্ত পথ পায়ে দুয়ারে সমাসীন-
“এসেছি অন্নপূর্ণা! দাও অন্ন দাও জল!”
নিলে আলিঙ্গনে তবু শোন তার অস্ফূট স্বর!
“কুমীরের আয়ু এত কেন দীর্ঘ কোমল!”
 

অসুখ
যতদূর চোখ যায়, ততদূরই চলে যাবে-
এই জ্বর প্রতিভা-পাথর,
এই পাথর পেরোবে পাথার,
আর পাথার পেরোলে পাথর।
কবোষ্ণ শীতের ট্রেন, তুমিও রেখেছ সন্দেহ
যতদূর আলো যায়, ততদূরই দেখে যাব,
এই ঘর গৃহ-বিগ্রহ!
তবে কি আমিই শুয়ে বিছানায়-
নাকি শুয়ে আছে আমার বিরহ!
 

কথোপকথন
 
“-কে?
-কাঠুরিয়া।
-কর্ম?
-কাটি কাঠ।”
 
“ -কে?
-কবি।
-কর্ম?
-কাটি কালান্তর”
 
 
“ বেশ, আমরা তবে সহোদর
তোমার যেটা কবিতা, আমার সেটা কুঠার”
 

প্রতি-উত্তর
 
বলো স্ফটিক, বরফের শরীর কেন কালো হলো?
-জলের শরীর তার তাই কিছু মরিচা ছড়ালো।
 
বলো বিভঙ্গ, কেন সুড়ঙ্গ এই এত অন্ধকার?
-ভিতরে ছড়ানো আছে শাদা খোকনের হাড়।
 
বলো জলস্তম্ভ, জল কেন দেখা দিল জলে?
-জলের স্বভাবই এই, ধীরে ধীরে ভরেছে ভূতলে।
 
বলো মাছের দিন, মাছে কেন এত সফলতা?
-রূপালি সাঁতার জানে, চেনে বুদ্বুদ, জলদস্যুতা।
 
বলো স্ফটিক, বরফের শরীর কেন কালো ছিল?
জলের শরীর তার, তাই কিছু মরিচা ছড়ালো।
 

অন্নপূর্ণা
 
“খাবার!” শব্দটি শুনলো রাষ্ট্র, বললো-
আমরা কেবল পাকস্থলী সরবরাহ করি,
খাবার ব্যাপারটি দেখে অন্য লোক, এছাড়া-
খাবার শব্দটি কেমন বিজাতীয়, অশোভন!
অতএব, হে দ্রাবিড়, মানুষের ক্রুদ্ধ বিপণন,
তুমি শুদ্ধ হয়ে ওঠো!
আর, মনে রেখো আমাদের কাছে, তোমাদের যে ঋণ।
মানুষ শুনে বলে, আজন্মে তবে প্রভু, জন্মাবো পাকস্থলীবিহীন!
 

বরাহপ্রদেশ
 
লোকটিকে প্রায়ই দেখি, কাঁদায় গভীর গড়াগড়ি খায়,
মাঝে মাঝে মেটেআলুর খেতে গিয়ে পাত পাতে
জিজ্ঞেস করলে লাজুক হাসে, তেমন কিছু বলে না।
জানায় পাড়াতেই থাকে, বীমা অফিসে সামান্য কেরানি।
অফিস কামাই করে কখনো সখনো, কেননা দেখা যায়-
ঠিক দুপুরবেলায় কাঁটাঝোপের পাশে উবু হয়ে আছে,
মধ্যরাতে বাতাসে ঘরঘর তুলে নিদ্রা যায়, আত্মীয়-
পরিজন কেউ আছে , এরকম কিছু কেউ কখনো শোনেনি।
মাঝে মাঝে বাজারে যায়, চাল ডাল কেনে না কোনদিন,
এক আধটু কচুলতা, বিনিপয়সায় আর্দ্র শিশির-
এই নিয়ে বাড়ি ফেরে, কোন ভোজসভাতে নেই-
অথবা নিমন্ত্রন করে না কেউ, অন্তত দেখিনি তেমন?
লোকটিকে প্রায়ই দেখি, আনত হয়ে দৌড়ে যায়,
কাঁদা মেখে বসে আছে রোদে, আমাদের জনপদে,
কি করে সে, জিজ্ঞেস করে দেখি, তেমন কিছু বলে না,
কিছুটা লাজুক হাসে, কোনদিন ইচ্ছে হলে জানায়-
শুয়োরের বাচ্চাদের দেশে, সেই হতে চায় বৃহত্তম শুয়োর!
 

ডুবোপাহাড়

 
১/
নিবিড় পাথর তুমি
তবুও যেনবা,
ভুল করে ভাবি,
সকলই পাথর শুধু-
তুমিই প্রতিমা!
 
এবার পরিক্রমায়
পর্বত, দেখেছি তোমায়,
ছুড়েছি একটি পয়সা
সামান্য তামার!
যেখানে রেখেছ পা-
ডুবেছে পাহাড়!
 
 
২/
চলো যাই, এই মহিমান্বিত
পাহাড়ের নিকটে দাঁড়াই,
গিয়ে বলি, দেখো দেখো পাহাড়
আমরা সকলেই এসেছি।
আর সেই শুয়োর শুয়োর খেলায়
সকলেই দারুণ জিতে গেছি!
 
 
৩/
পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ি
প্রায়শঃ এমন হয়, পাহাড় জানায়-
অনেকেই ওঠে, এমনকি খোঁড়ে, কাটে
সমুদ্রবাতাস মুঠোতে নিয়ে ছোটে
বানায় এমনও বাড়ী। খুবই কি আনাড়ি?
কেননা ছিটকে পড় প্রতিবার, প্রতিসময়।
আমি বলি, আমার একটি পা হারিয়েছি-
গত সৌরযুদ্ধে, আরেকটি পা নিয়ে তাকে
জাহাজডুবির শেষে ভেলা করেছে এক নাবিক-
আমার একটি হাত পুড়ে গেছে চন্দ্রপ্রতিহিংসায়,
বাকী হাতটুকু দিয়ে এখন উঠছি পাহাড়ে।
পাহাড় এটুকু শোনে, এরপর থেকে দেখি প্রতিবার-
আমার সাথে সাথে পিছলে পড়ছে, কিছুটা পাহাড়!
 
 


চতুষ্কোণ কবিতাবলী
 
১/
ছুঁড়েছি বিক্ষিপ্ত তুলো, বিছানার ছড়ানো পরিহাসে,
তাতে আরো সজ্জিত হলো শয্যার নিবিড় ভ্রুকুটি
এলো কালবৈশাখী, দাঁড়ালো আমারই নিঃশ্বাসে!
সামান্যই ঘুমোবো, তবু প্রয়োজন প্রতিমা, কিছুটা প্রস্তুতি।
 
২/
ছিপি খুলে দিচ্ছ, ঘুরে ঘুরিয়ে যেমন নর্তকীর কোমরের প্রতিভায়,
যেন চোখ খুলে গেছে, এভাবে ছিপি খুলে বোতলের ঘুম ভেঙে যায়,
যতটা শিশি দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি টেবিলে, ততদূর ঘুমের মৌসুম
সহসা খুলে গেল প্যাঁচ, মূলত ছিপি নয়, খুলে দিলে বোতলের ঘুম।
 
৩/
কোন কোনদিনে পাখিদের রোপন করেছি
দেখেছি ফিরেছে পালক, কিভাবে নিরাকার-
সৌর কুণ্ডলী তুলে সূর্যের সংহতপাহাড়-
সহসা জাহাজ পেয়ে, বলে গেছে- “যাই।”
যদিও সন্ধ্যা ছিল? কিছুটা বাকী ছিল ষাড়ের লড়াই!
 
৪/
বিকেলতুলোর কাছে দাঁড়াও হে সন্ধ্যাপ্রেমিক,
মনে রেখো আমিও মানুষ ছিলাম, কনিষ্ঠ
আঙুল তাক করে সুদীর্ঘকাল, গরিষ্ঠ দুঃখ
দেখে দেখে দীর্ণ করে আছি গোপন পিস্তল।
যদিও উড্ডীন সমাগত, তবুও তো মানো
চিরকাল খুঁজেছিল সহিষ্ণুতা, অবতরণ,
ঘুমন্ত চাষের মাঠে ছুড়ে দিয়ে বিতরণ
দেখি কবোষ্ণ বীজে হাওয়া, ফুটেছে ফসল!
 
৫/
দিকচিহ্ন এই ফুল, ভুল কোনদিকে ছোটে ?
জানে না কি, তোমার ক্রমশঃ ঠোঁটে
রেখে দিলে- পাথরও বড় হয়ে ওঠে
দুর্বাদল এই ফল, জল কোনদিকে নামে?
ভাবেনি কি, তোমার ক্রমশঃ প্রণামে
নত হয়, তারাদল নোঙর এসে থামে!
 
৬/
একটি যোগ সমন্বিত হলো আরেকটি যোগে,
অপর বিয়োগচিহ্ন, দৌড়ে গেল তৃতীয় বিয়োগে
ভাঙা অংশের মোহে বিচ্ছুরিত হলো ভাগ, আর
প্রবৃদ্ধ অসুখ নিয়ে উপগত হলো গুনন।
এই শোকে, তবুও দুটি রেখা নিরিবিলি মিশে যায়!
আমারো ধারাপাত জেগে রয় এই রাত্রির গণিতে…
 

একা চিতার উপাখ্যান
 
চিতা ও চাতুরীর বহুদেশ পার হয়ে এসে; কাজলরেখা, তোমাকে মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, কতটা বিদ্যুৎরেখা তুমি ধরো, অথচ বহুকাল নিদ্রিত আছ, বহুকাল চোখ মেলে আমাকে তাকাবে, এমন অবসর দূরতর বাণিজ্যে চলে গেছে।
আমার সমস্ত গোলাকার ডোরা মুছে গেছে, কেবল নখ ও দাঁতের বিস্ময় নিয়ে, দেখি খলকৌশল সব ভুলে গেছি, যত রক্তস্রোত আমাকে টানে, তেমন বাগানে আপেলের নির্জনতা দেখে ফিরে আসি। আজও শঠতা যত জমি ও ঘাসের, যত নিশিচারণ লঘু ক্ষীপ্রতার, ভুলে গেছি, কবে কোন তাসের দান হেরে গিয়ে বলেছিল- তুমিও শিকারি।
চিতা ও চাতুরীর বহুদিন পার করে এসে মনে হলো, মানুষ হয়ে গেলে ভালো হতো খুব। মানুষ হয়ে গেলে জানা যেত সোনা ও রূপোর সেই পুরনো সমন্বয়, কাঠিবদল করে নিলে, কিভাবে রেখা ও কাজলের ঘুম ভেঙে যায়।
কাজলরেখা, মানবশরীর পেলে তোমার নিকটে, চলে যাওয়া যেত একা একা।
 

নার্সিসাস
 
ভাবা যাক, আমি একটি জেব্রা , বহুপ্রস্থ রাস্তা পার হতে গিয়ে-
জেব্রাক্রসিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, যেন নিজেকে দেখছি আয়নায়।
 
দূরে একটি ট্রাফিক, মুখ যার ময়ূরের মুখোশ, যে বাজিয়ে চলেছে সর্বশেষ বাঁশি, মনে হবে তোমার এসেছে মড়ক , অথবা নেমে গেছে আদিগন্ত ইস্রাফিল! কারণ আচমকা দেখ, আমার দুপাশে দুটো সিংহরঙ ট্রাক, টায়ারের লৌহগর্জন তুলে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, অর্থাৎ এক স্থির জেব্রার দিকে।
 
মনে করো আমি একটি অনিচ্ছুক রূপান্তর, অরণ্য আফ্রিকার সোঁদা তৃণের শরীর থেকে তোমাদের বহুচল পৃথিবীতে এসে ভুলে গেছি সমস্ত সমাধান, যত চারণকৌশল! এখন জেব্রাক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে নিরুপায় জেব্রা হয়ে গেছি, অথবা হয়ে গেছি এক নিহৃদয় নার্সিসাস, আমার দুপাশে দুটো শহুরে সিংহ, পেট্রলের লেজ তুলে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে- এক অনড় ডোরাকাটা জেব্রার দিকে!
শেয়ার