টুনা মাছের কাবাব ও একটা পৃথিবী | লুনা রুশদী

গতকাল বহুদিন পর রোদ ছিলো। একদম জীবনানন্দের কবিতার মতন… “অনেক কমলা রঙের রোদ”।

আমি ঘরে, বাইরে, অফিসে এবং ইন্টারনেটে কারো কাছ থেকে কোনো পাত্তা না পেয়ে মনের দুঃখে হাঁটতে বের হইছিলাম। বাতাসে দুনিয়া অস্থির, যতো হাঁটতেছি, মুখে এসে এসে ঝাপটা লাগতেছে। নিজেরে মনে হইতেছিলো বাদামের গায়ের থেকে ফুঁ দিয়ে উড়ায়ে দেয়া লাল খোসার মতন – তুচ্ছ এবং অদরকারী, থাকলেই কি না থাকলেই কি? বাতাসে মিশে যাওয়ার মতন গুড়া গুড়াও হয়ে যাইতে পারতেছি না, আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মতন আলাদাও হইতে পারতেছি না…

ইয়ারফোন কানে দিয়ে গান শুনতেছিলাম। আর দেখছিলাম আমাদের অফিসের ক্যাফের সামনের গাছটার এক অংশে একদম পিচ্চি পিচ্চি সবুজ পাতা আসছে, আরেক অংশ এখনো হাড্ডিসার…একসাথে হাজার কথা মাথায় আসে, কোনটাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না।

ভাবতেছিলাম আমি ইদানিং এত অস্থির কেন? আমার কি খুব দুঃখ? আমি কি প্রেমে ব্যর্থ ? দেশ ও জাতি এবং বর্তমান পৃথিবীর দুরবস্থা আর অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত? দুনিয়ার কোথায় কোথায় কি কি ঘটতেছে তাতে আমার সত্যি কিছু কি আসে যায়? আমি তো হাঁসের মতন পানির ভেতর থেকে উঠে এসে এমনভাবে গা ঝাড়া দেই যেন পানি কাকে বলে তা-ই জানি না!…তারপর প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে দুনিয়া উল্টায়ে ফেলি। আমার মতন স্পয়েল্ট আর কে আছে এই দুনিয়ায়? সকালে বোন চা’য়ের সাথে ব্রেড-এর উপরে কটেজ চিজ লাগায়ে দেয়, সেইগুলা গাড়িতে নিয়ে গান শুনতে শুনতে এবং অর্ধেক নাচতে নাচতে অফিসে আসি, রাতে আম্মা টুনা মাছের কাবাব বানায়ে অপেক্ষা করে…

তাইলে সমস্যাটা কি? হয়তো এই অস্থিরতা দিন আর রাতের মাঝের সময়টুকুর মতন কিছু একটা…আমি বুড়াও না – কচিও না, বাংলাদেশিও না – অজিও না, সুন্দরীও না – বান্দরীও না, আওয়ামীলীগও না- জামাতীও না, শেখ হাসিনার কিশোরী বয়সের বেণী দোলানো ছবি দেখলে আমি হা করে মুগ্ধ হয়ে তাকায়ে থাকি, একইভাবে খালেদা জিয়ার একটা ছবি আছে জিয়াউর রহমানের সাথে, ইয়ং কাপল উনারা তখন, উনি ক্যামেরার দিকে তাকায়ে অল্প হাসতেছেন – কী যে সুন্দর, সুখী আর গর্বিত একটা ভঙ্গি! দেখলে মনে হয় মাথায় হাত বুলায়ে আদর করে দেই।  আমি মুসলিম হিসাবে আইডেন্টিফাই করি, অথচ মনে করি রাষ্ট্রের হওয়া উচিৎ সেকুলার…

আমার একই সাথে ব্রাত্য রাইসু এবং বুদ্ধদেব বসু ভালো লাগে, মওলানা ভাসানী এবং জাসিন্দা আর্ডেন ভালো লাগে, পৃথিবীতে কারো মৃত্যুই আমাকে বিরিয়ানি খাওয়ার মতন আনন্দিত করে না…ইনফ্যাক্ট বিরিয়ানি আমি খাইও না, কারণ আমি মাংসাশী না, অথচ আমি পুরাপুরি ভেজিটেরিয়ানও না, নিজেকে বাঁচায়ে রাখার জন্যই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ হিংস্রতা আমার ভেতরেও থাকতেই হবে, মানবিকতা বলতে ছোটবেলায় যেমন ভাবতাম ‘ফুল পাতা ছবির খাতা” টাইপ একটা বিষয়, সেইরকম যে আসলে মোটেই না, বরং মানবিক মানেই কিছুমাত্রায় পাশবিক এই উপলব্ধি আমারে অসহায় করে দেয়।

যেভাবে অসহায় লাগে এরকম ভাবলে যে ঠিক বয়সে যে প্রেমগুলা হইলো না, সেইগুলা আর ইহজনমে হবে না, যেসব সুন্দর সুন্দর আর ভালো ভালো ছেলেগুলি লায়েক হইতেছে পৃথিবীতে তাদের একটাও আমার না! হায়! আমারে তারা নিশ্চয়ই খালাম্মা ডাকবে। কি বাজে!

যে কাউকেই সবার সামনে অপমানিত হইতে দেখলে আমার কষ্ট হয়। সে আমার বিশাল শত্রু হইলেও। ৪৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার উপরে পরতে পরতে ক্রমাগত জমতে থাকা…ঘটমান আরো আরো হাজারে বিজারে মৃত্যু, নির্মমতা, দায়িত্বহীনতা, লোভ, উপেক্ষা এবং স্বার্থপরতার পরম্পরা আমাকে ভারাক্রান্ত করে… কিন্তু সেইটাই বা আর কতক্ষণ? আমরা ডিজিটাল যুগের মানুষ। আইফোন-এ একটা ঘষা দিলেই চেরাগের দৈত্য এসে আগের সব কথা মুছে দিয়ে নতুন নতুন ভয়াবহ ঘটনা এনে হাজির করে…একদম হরর মুভি দেখার মতন উত্তেজনাময়!

ভাবতেছিলাম কোথাও ক্লিক করে বসে যাওয়ার মতন কোনো ডেফিনিট গ্যাপ কি আমার জন্য নাই? নাকি আমি মার্ক স্ট্র্যান্ড-এর কবিতার মতন সারাজীবন খালি ছটফট করতে করতে এইদিক থেকে ওইদিক থেকে সেইদিক যাইতেই থাকবো যাতে আমার অস্তিত্ব যা কিছুকে অদৃশ্য করে ফেলতেছে, সেই সব কিছু আবার দৃশ্যমান হইতে পারে?…

এমন সময় ইয়ারফোনে গান বাজতে শুরু করলো, ইকবাল বানুর কণ্ঠে  “হাম দেখেঙ্গে…”  এই দুইটা শব্দের সাথে সাথেই হাততালি… “হাম দেখেঙ্গে, লাজিম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে…উয়োহ দিন কে জিস কা ওয়াদা হ্যায় হাম দেখেঙ্গে…”  …আমি যেহেতু মহামূর্খ টাইপ মানুষ, দুনিয়া যা আজকে জানে আমি তা সাত বছর পরে জানি, তাই এই গানের কথা আমি প্রথম জানলাম অরুন্ধতী রায়-এর ব্রোকেন রিপাবলিক অনুবাদ করার সময়।  সেখানে এক অংশ ছিলো এইরকম…

“জঙ্গলে আমার শেষ রাত্রিটাতে একটা পাহাড়ের পাদদেশে ক্যাম্প করলাম। সকালে এই পাহাড় পার হয়েই রাস্তায় বের হতে হবে যেখান থেকে একটা মোটরসাইকেল তুলে নেবে আমাকে। জঙ্গলের চেহারা আমার সেই প্রথম প্রবেশের দিন থেকে অনেক আলাদা। চিরঞ্জি, রেশম আর আম গাছে ফুল এসেছে।

কুদুর গ্রামের লোকেরা বিরাট এক হাড়ি ভর্তি মাছ ধরে পাঠিয়েছে ক্যাম্পে। আমার জন্য একটা লম্বা ফর্দে লিখে দিয়েছে একাত্তর রকমের ফল, সবজি, ডাল এবং পোকার নাম, যা তারা এই জঙ্গল থেকে পায় এবং নিজেদের জমিতে উৎপাদন করে, পাশে প্রতিটা সামগ্রীর বাজার মূল্য লিখে দেওয়া আছে। শুধুই একটা ফর্দ…আবার তাদের পৃথিবীর মানচিত্র…

কমরেড সুখদেব জানতে চাইলেন আমার আইপডের গানগুলি তাঁর কম্পিউটারে নামিয়ে নিতে পারেন কিনা। আমরা ইকবাল বানুর গাওয়া, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লেখা ‘হাম দেখেঙ্গে…” শুনলাম একসাথে। গানটা ধারণ করা হয়েছে লাহোরের এক বিখ্যাত কনসার্ট থেকে – জিয়াউল হক-এর দমননীতির বছরগুলো যখন তুঙ্গে।

হাম আহেলে সাফা মারদুদে হারাম
মাসনাদ পে বিঠায়ে যায়েঙ্গে
সাব তাজ উছালে যায়েঙ্গে
সাব তাখত গিরায়ে যায়েঙ্গে
হাম দেখেঙ্গে…

(এই বিদ্রোহী আর শাপভ্রষ্টরাই
যখন সমাদরে বসবে মসনদে
সব রাজমুকুট কেড়ে নেয়া হবে যখন
আর সিংহাসন হবে অপসারিত
আমরা তখন দেখবো…)

পাকিস্তানের সেই কনসার্টের পঞ্চাশ হাজার দর্শক শুরু করে স্পর্ধিত উচ্চারণ – “ইনকিলাব জিন্দাবাদ! ইনকিলাব জিন্দাবাদ!” আজ এত বছর পরে সেই একই উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই জঙ্গল ঘিরে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! সত্যিই কি অদ্ভুত এইসব যোগাযোগ!”

…এই গানটা কালকে যখন আমার ফোনে বাজতেছিলো, আমি সেন্ট কিল্ডা রোড ধরে হাঁটতেছিলাম। বাতাসের সাথে মেপলের ঝরে যাওয়া শুকনা পাতা ছোট ছোট ঘুর্ণি হয়ে উড়তেছিলো। আমার ইয়ারফোনে গানের সুর ছাপায়ে শুনতেছিলাম হাততালি আর ইনকিলাব জিন্দাবাদ! প্রতিটা তালির সাথে সাথে আমার আত্মা ঢিপ ঢিপ করে বাজতেছিলো, আমার অজান্তেই হাত মুঠ হয়ে গিয়ে নখ বসে যাচ্ছিলো হাতের পাতায়, প্রায় দৌড়ানোর মতন জোরে হাঁটছিলাম…মনে হচ্ছিলো বিপ্লব মানে সবসময় রক্তারক্তি হইতে হবে এমন না, কখনো একটা কালো শাড়ি পরাই যথেষ্ট…পঞ্চাশ হাজার মানুষ…মানে কি রকম আমি ভাবতে ভাবতে দিশা পাচ্ছিলাম না…মনে হচ্ছিলো এই গানটা এখন কাশ্মীরের…হার্টবিটের তালে তালে শুনতে পাচ্ছিলাম ‘আজাদি আজাদি আজাদি…” …যেন ‘হাম দেখেঙ্গে…” র ভেতরে যে প্রমিজটুকু আছে, সেটা এখন তাদের জন্য।

সমানে চোখের পানি পরতেছিলো। দুপুরে কত মানুষ বের হয় রাস্তায়, সবার সামনে এইরকম কান্না সাধারণভাবে বেশ বিব্রতকর, অথচ তখন সেরকম কোন বোধ ছিলো না। মনে হচ্ছিলো এই কান্না বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে ভুগতে থাকা সেই মায়ের জন্য যার বাচ্চা মেয়েটা এরমধ্যেই মারা গেছে, তাকে কবরও দেয়া হয়ে গেছে, কিন্তু সেই মা কিছুই জানে না। অস্কার এবং ভ্যালেরিয়ার জন্য, যে দুই বছরের মেয়েটার লাল প্যান্ট, কালো জুতা আমি ঘুমের মধ্যে দেখি আর মৃত্যুর পরেও কিভাবে তার হাত জড়ায়ে ধরে ছিলো বাবাকে…সমুদ্রে ভেসে ওঠা আয়লান কুর্দির জন্য…ত্বকী, বিশ্বজিত, অভিজিত আর দীপনের জন্যও…যাদের আর দেখার কিছু নাই…আর আমার জন্য যে খুব গোছালোভাবে সাদা বা কালো কোনো বাক্সেই ঢুকতে না পেরে মাটি এবং আকাশ দুইদিকেরই অনাত্মীয় হয়ে আছি…

(এই লেখাটা ২০১৯ সালে লেখা যখন কাশ্মীরে আবার স্বাধীনতার ডাক উঠতেছিল, আর বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে বহু মানুষ মারা যাচ্ছিল)


লুনা রুশদী

জন্ম ১৯৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর করোটিয়ায়। ১৯৮৯ সাল থেকে মেলবোর্ন প্রবাসী। অর্থনীতিতে মেলবোর্নের লাট্রোব ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক, স্কলারশিপ নিয়ে সিডনির ইউটিএস ইউনিভার্সিটিতে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ মাস্টারস পড়েছেন। প্রথম প্রকাশিত লেখা কলকাতার দেশ পত্রিকায় একটা কবিতা ১৯৯৪ সালে। প্রথম ইংরেজি গল্প প্রকাশিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের লিসেনার পত্রিকায় ২০১১ সালে। প্রকাশিত উপন্যাস – আর জনমে (প্রথমা, ফেব্রুয়ারি ২০২৪), বইবাহিক (বাতিঘর, ফেব্রুয়ারি ২০২৪)

শেয়ার