জেনারেল ও খাঁচা বিষয়ক জটিলতা ।। মিলন আশরাফ

হেলিকপ্টারে আসবেন জেনারেল। নানা রঙে সজ্জিত হচ্ছে শার্শা বাজারের ছোট্ট স্টেডিয়ামটা। পোস্টার আর রঙিন কাগজে মুড়ে ফেলা হয়েছে পুরো বাজার। বাতাসে পত্পত্ করে উড়ছে পোস্টারের মাঝ বরাবর জেনারেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ছবির নিচে লেখা জনবন্ধু। দেশের প্রধানতম এক রাজকবি এই তকমাটা নামের আগে জুড়েছেন খুব যত্নের সঙ্গে। জনবন্ধুও তার নজরানা হাতে হাতে দিয়েছেন। গুলশানে আলিশান এক বাড়ি। ছেলে-বুড়ো সবার হাতে হাতে বিলি হচ্ছে লিফলেট। স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় পড়ে থাকা লিফলেটগুলো নিয়ে কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে শার্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের পুকুরটাতে। পানার মতো শ শ জনবন্ধুর ছবি সংবলিত কাগজের নৌকা ভাসতে থাকে পুকুরে। সেসব নৌকা টপাটপ গিলে ফেলে পুকুরে চাষ করা বিদেশি মাগুরেরা।
এলাকাজুড়ে সবকিছুতে চলছে তোড়জোর। স্টেডিয়ামের মাঠে আনা হয়েছে স্টিম রোলার। হালকা পানি ছিটিয়ে গেদে গেদে ভেতরে ঢুকানো হচ্ছে মাটিগুলো। হেলিকপ্টার নামলে পরে মাটি যেন দেবে না যায় সেইটার আগাম প্রস্তুতি আর কি। দূর থেকে লোকজন অবলোকন করছে সেইসব দৃশ্যালোক। মেশিন দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক মাপায় ব্যস্ত সেনাবাহিনীরা। সেই সঙ্গে সঙ্গে হাত লাগিয়েছে দলীয় লোকজন। আট দশ গাড়ি আর্মি সকাল দুপুর চক্কর দিয়ে টহল মারছে এলাকা। পানি দিয়ে স্টেডিয়াম ভিজিয়ে সেগুলো শুকানোর জন্যে আবার আনা হয়েছে বড় বড় টেবিল ফ্যান। বাতাসের তোড়ে নুইয়ে পড়ছে আশেপাশের গাছপালা। তারাও যেন কুর্নিশ করতে সদাব্যস্ত। জেনারেলের পা পড়বে এই মাটিতে, এটা কী কম কথা ! দূরে দাঁড়িয়ে পালে পালে স্কুল ফেরত ছেলে মেয়েরা ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়িয়ে দেখছে এসব কা-কারখানা। গত দু’দিন ধরে তাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। এ নিয়ে বাড়িতে হালকা বকাবকি হলেও থেমে যাচ্ছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হাজার হোক জেনারেল আসবে বলে কথা ! মা বাবারা চুপ থাকলেও প্রচার প্রচারণা তো আর থেমে থাকবে না। মাইকের আওয়াজে কানপাতা দায় হয়ে যাচ্ছে শার্শা থানার সব গ্রামের মানুষের। প্রত্যেক গ্রামে জোয়ান তাগড়া যুবকরা মিলে জটলা বেঁধে মিটিং করছে বিরতহীনভাবে। ছোট ছোট মিছিলও বের করছে ভক্ত আমজনগণ। ঘরের মেয়েরাও আলুকফালুক মারছে বেড়ার ফাঁক গলিয়ে।
শার্শা বাজারের বুলেট বঙ্কারও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পাগলপ্রায়। ও হ্যাঁ, এই গল্পে তার অ্যান্টির আগে একটু পরিচয় দেবার প্রয়োজন মনে করছি। নামটা তো আগেই বলা হল, এবার আসি তার মটরসাইকেল প্রসঙ্গে। এলাকার লোকজন তাকে কখনো মটরসাইকেল ধীরে চালাতে দেখেনি। চোখের পলকে সবার নাকের ডগায় উপর দিয়ে মুহূর্তে শো করে উধাও হয় সে। সত্যিই দেখবার মতো সেই ক্যারাবাজি। সে জানে এবং বলেও যে, ‘যেদিন আমি অ্যাক্সিডেন্ট করবো, হাঁড়গোড় ছাড়া কিছুই পাবি না তোরা।’ মূলত এই মটরসাইকেল চালানোর ক্যাপাসিটির কারণেই সে থানাখ্যাতি থেকে শুরু করে জেলাখ্যাতি পর্যন্ত পেয়েছে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এই খ্যাতি এখনো পৌঁছয়নি। তবে সে আশায় থাকে জেনারেল এসে তার নৈপুণ্য দেখে জাতীয়ভাবে একটা সার্টিফিকেট দিবেন। বঙ্কার তার মটরসাইকেলকে আদর করে বুলেট নামে ডাকে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ বুলেট নামটা মটরসাইকেলকে নয়, বরংচ তারা আনন্দ লাভ করে বঙ্কারের নামের আগে বুলেট শব্দটা সংযোজন করতে। সুতরাং সে হয়ে যায় এলাকার বুলেট বঙ্কার। এবার চলুন ফিরি মূল গল্পে।
তো বুলেট বঙ্কার তার বিকট শব্দের মটরসাইকেল নিয়ে ঘন ঘন চক্কর মারছে আশেপাশের প্রায় সব গ্রাম। মটরসাইকেলের আওয়াজ কানে আসলেই ছেলেমেয়েরা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার দিকে দৌড় লাগায় তাকে দেখতে। কিন্তু বুলেট বঙ্কার এতো স্প্রিডে গাড়ি চালায় যে চোখের পলকে উধাও। বিরক্ত হয়ে কিশোর’রা বলে, ‘ধুর বাড়া, আর একটু আগে আসলি দেখতি পাতাম’। তাদের এই আপসোসের জবাব দিতে পর পর দুটো হেলিকপ্টার বঙ্কারের বুলেট মটরসাইকেলের চেয়েও দ্বিগুন শব্দে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। মুহূর্তে বালকদের আগ্রহ মোড় নেয় সেই হেলিকপ্টারের দিকে। তারা পড়িমড়ি করে সঙ্গীদের ডাকতে থাকে দৌড়ে দৌড়ে।
শার্শা থানার ১৬৮টা গ্রামের সকল মানুষের চোখ আজ আকাশপানে। মাটির দিকে খেয়াল থাকে না তাদের। নিজামপুর বাজারে গিয়ে বঙ্কার থামে ঐ একই কারণে। অথচ এর আগে সে যখন যে গ্রামে গেছে তখন সবার নজরের একমাত্র লক্ষবস্তু সেই। কিন্তু আজ তার ভাত মার। বাজারের চায়ের দোকানে এ নিয়ে আলাপ জমে ওঠে এবং সেই গল্প বঙ্কারকে দেখে আরও দ্বিগুন হয়। বঙ্কারের মনে হয় তাকে দেখে বোধহয় সবাই মশকরা করছে। আগেপিছু কিছু না ভেবে দোকানে বসা মানুষদের মুখের অভিব্যক্তির উপর সজোরে আঘাত হেনে বলে, ‘হেলিকপ্টার না গাড়্। আমার বুলেটের কাছে ও ধোন কিছু ?’ দোকানদার বঙ্কারকে দেখে বলে ওঠে, ‘বঙ্কার ভাই বসেন, কড়া লিকারে একখান দুধ চা দিই।’ তার কণ্ঠেও ঠাট্টার আভাস পায় বঙ্কার। রেগে গিয়ে বলে, ‘তোর ও বালের চা খাওয়ার জন্য আমার লেওড়া কানছে।’ অবস্থা বেগতিক দেখে উপস্থিত দোকানে উপবিষ্ট লুঙ্গিপরা খাজুরে আলাপের লোকজন তাকে আর ঘাটলো না। মোটা শরীরের বঙ্কার গো গো করতে থাকে। কেউ কিছু বলছে না এ অবস্থা দেখে তার রাগ বাড়ে আরও। সোজা মটরসাইকেলে বসে গায়ের জোরে স্টার্ট দেয়। একসঙ্গে ৪টা গিয়ার মেরে ডান হাতের পিকআপ ছাড়ে জোরে। গো গো করে ওঠে তার বুলেট। বিকট শব্দ শুনে বাজারের লোক সবাই সেদিকে তাকায়। বঙ্কার মানেই তাদের চোখে বিস্ময়! নতুন ক্যারাবাজি দেখতে দোকান থেকে উঠে রাস্তায় দাঁড়ায় উৎসুক লোকজন। শরীরের সমস্ত শক্তি আজ যমে রূপ নিয়েছে বঙ্কারের। সামনে একটি ট্রাককে দেখে ক্ষেপে যায় সে। দুই বার হর্ন বাজালেও সাইট দেয় না ট্রাকটি। গালাগালি দেয় বঙ্কার, ‘মাদারচোদ, সর বলছি। আজ আর ফিরবোই না’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলো কড়া। মুহূর্তে লাফিয়ে উঠল বুলেট। ভুমভুম শব্দে চারপাশে ধূলায় ভরপুর হয়ে যায়। ধূসর সেই ধূলার বুকে এক বিভ্রমের খেল্ দেখায় বঙ্কার। উপস্থিত সবার চোখের সম্মুখে উধাও হয়ে যায় সে। ট্রাকটা পড়ে থাকে পেছনে। মানুষের দৃষ্টিভ্রম হয়। কেউ বলে, ট্রাকের উপর দিয়ে উড়ে গেছে, আবার কেউ বলে নীচে দিয়ে। কিন্তু গাল খাওয়া চা দোকানদার বলে, ‘ও আমার বাল ছিঁড়েছে। এক সাইট দিয়ে গেলো যে !’ সবার এই বলাবলিতে যে কথাটি প্রতিষ্ঠা পেলো সেটি হল, বঙ্কার আজ দুপুরের একটু আগে নিজামপুর স্কুলের সামনে এক ট্রাকের উপর দিয়ে উড়ে ডিগবাজি খেয়ে পার হয়ে গেছে।

২.
বিকাল ৩টায় পৌঁছবেন জাদরেল জেনারেল। দলে দলে মানুষজন শার্শা স্টেডিয়ামের দিকে ছুটছে। শার্শা পাইলট হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও লাইন ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে স্যালুট করার মোশনে। বাঁশি বাজিয়ে তাদেরকে কন্ট্রোলে রেখেছেন শারীরিক শিক্ষার স্যার আলতাপ হোসেন। লাইন একটু বেঁকে গেলেই সেনাবাহিনির স্টাইলে পিঠের উপর দমাদম বসিয়ে দিচ্ছেন দু’এক ঘা। স্কাউটের ব্যান্ডদলও সমানে বাজিয়ে যাচ্ছে বাজনা। হাজার হাজার মানুষ আজ কর্মকাজ ফেলে ছুটছে জেনারেলকে দেখতে। চাষাভূষা- ক্ষেতমজুর-রিকশা চালক-কামারকুমার-জেলে-মুচি-সুদখোর-ঘুষখোর-মাগিখোর-সুন্দরী তরুণ তরুণী এরকম হাজারও ছেলে বুড়ো হাবড়া সব্বাই হুমড়ি খেয়ে দৌড়াচ্ছে। স্টেডিয়ামের ঘাসগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ভারি গাড়ির চাপে। মাঠের দুই পাশে লাল পাতার কচাগাছগুলো কুর্ণিশ করার স্টাইলে দোল খাচ্ছে হালকা বাতাসে। দক্ষিণ দিকের মাঠ মাড়িয়ে আলপথ ধরে সারিসারি মানুষ হইজকার করতে করতে ছুটছে স্লোগান সমেত। যেন বিরাট সার্কাসের আয়োজন আজ। পড়িমরি করে কিছু মানুষ লুঙ্গিতে গিঁট বেঁধে কাদার মধ্যে পা ডুবিয়ে পচপচ শব্দে গন্তব্যের দিকে হামলে পড়তে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন মিছিল প্রদক্ষিণ করছে মাঠের চৌদিকে। জেনারেলকে অভ্যর্থনা জানাতে সকল প্রকার আয়োজনের যেন কমতি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি প্রশাসনের।
আয়োজন সম্পন্ন। এখন শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গুনার পালা। জটলার ভেতর গাদাগাদিতে দু’একজনের মধ্যে হাতাহাতি লেগে যায়। বাঁশি বাজিয়ে ভলেন্টিয়ার’রা দ্রুত সেখানে গিয়ে থামায় জনগণকে। পিনপতন নীরবতায় চারপাশ আতংকে ভরে উঠেছে। সবাই একটি বিশেষ শব্দের অপেক্ষায় দ-ায়মান। এইমাত্র বুমবুম শব্দে বাঁশি বাজিয়ে দুটি সেনাবাহিনির গাড়ি প্রবেশ করলো মাঠে। মাইকে ঘোষণা করা হল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে মাননীয় জেনারেল সাহেব এসে উপস্থিত হবেন মাঠে। মানুষের হুড়োহুড়ি বাড়তেই লাগলো। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না চিৎকার চেচামেচি। বাঁশ দিয়ে মেয়েদের লাইন আলাদা করা হয়েছে। মাঠের চারিদিকে জেনারেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দড়ি দিয়ে টাঙানো হয়েছে গোলাকৃতি করে। চিকন গোঁফের আড়ালে মৃদু হাসির ঝলকানিতে পুরো মাঠ ছেয়ে গেছে পোস্টারে পোস্টারে। কিছু সময় পর পর স্লোগান দিচ্ছে উপস্থিত আমজনতা। প্রথম লাইন মাইক থেকে ‘জেনারেলের আগমন’ সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম’ ধ্বনিত হচ্ছে। গমগম করে আকাশে বাতাসে সেই শব্দ ছড়িয়ে তৈরি হচ্ছে এক আশ্চর্য বলয়। তারি মধ্যে পড়ে মাঝে মাঝে লাঠি ও মানুষের গুঁতা খাচ্ছে গোবেচারা গোছের হাবদাগাবদা চেহারার কিছু নীরব দর্শক। ইতোমধ্যে কুচকাওয়াজের জন্য স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেছে স্কাউটের ব্যান্ডদলসহ।
উত্তরপাশের মেয়েদের মধ্যে কী একটা গণ্ডগোল দেখে বাঁশি বাজাতে বাজাতে ভলান্টিয়ার’রা দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে একটি মেয়ে সামনে দাঁড়ানোর জন্য ৪/৫ জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ফেলেছে। দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা এই রকমটিই অভিযোগ দিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেখে একদল আর্মি সেখানে স্বশরীর ও স্বপোশাকে হাজির। আর্মিকে দেখে সবাই থতমত খেয়ে জবুথবু হয়ে যায়। কিন্তু দমল না ধাক্কা দেওয়া মেয়ে সোনামুখী গ্রামের সোনাভান। গায়ে গতরে অন্যদের তুলনায় বেশ বলিষ্ঠ সে। এই সুযোগটাই সে গ্রহণ করেছে। দেখতেও রূপসী তন্বী। এটাও তার বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি সে। আর্মিরাও ভেবে দেখলো এমন একজন চাক্ষুস দেহপল্লবী তরুণী সামনে দাঁড়ালে জেনারেল আহ্লাদে আটখানা হবেন। সুযোগ যখন সামনে স্বয়ং দেহ দুলিয়ে হাতছানি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখন মিছে কেনো তাকে পেছনে ঠেলে পাঠাবে তারা। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সামনেই থাকবে সোনামুখীর সোনামুখ সোনাভান। এই রায় প্রদান করে সঙ্গে আরও যুক্ত করলো যে, তাকে কেউ যেন পেছনে ঠেলে না পাঠায়। এহেন সতর্কবাণীতে সবাই স্তব্দ হয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে চওড়াবুকের সোনাভান সেখানেই দ-ায়মান হয়ে বাঁশ ধরে দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে দেখে নিচ্ছে মাঠের পজিশন।
জনগণের ধৈর্যের বাধ ভাঙতে না ভাঙতেই আকাশে কান পাততে হলো সবার। দূর থেকে শব্দ বাতাসে তরঙ্গ হয়ে ভেসে আসছে এদিকে। শব্দটা ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততায় রূপ নিল। আনন্দে জনগণ স্লোগান দিতে থাকলো ঘনঘন। মুহূর্তে বিকট শব্দে সবার কান তালা লাগার উপক্রম হল। পাখির মতো ডানা মেলে শার্শা বাজারের উপরে প্রদক্ষিণ করতে লাগল দুটি হেলিকপ্টার। মানুষের চোখ তখন কপালের উপর দিয়ে সোজা আকাশ পানে। দুই চক্কর মেরে তৃতীয় চক্করে শো করে নেমে পড়ল একটি। আরেকটা তখনো উপরে চক্কর মেরে টহল দিচ্ছে। মাটিতে নেমে পড়া হেলিকপ্টারের পাখা তখনো বো বো করে ঘুরছে। সেই বাতাসে লালচে রঙের কচাগাছের পাতা ফত্ফত্ করে ছিঁড়েফুঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পাক খেয়ে দূরে ছমিরের জমির দিকে উড়ে গিয়ে উধাও হয়ে যায় মুহূর্তেই। স্কাউট দল তাদের নিজস্ব স্টাইলে লেফট রাইট করতে ব্যতিব্যস্ত। সবাই নজর তখন হেলিকপ্টারের সদর দরজার দিকে। এখনি জেনারেল সাহেব নামবেন। সবাইকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাবেন। আবার যদি তার একটু দয়া হয় মাঠটা প্রদক্ষিণও করবেন। এমন আশায় সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো নিজেদেরকে ভেতরে ভেতরে তৈরি করে নিচ্ছে। হাতটাও একটু প্যান্টে কিংবা কেউ কেউ লুঙ্গিতে মুছে চকচকে করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েদের চোখেও হ্যান্ডসাম জেনারেলকে দেখার বিস্ময় খেলা করছে। চনমন করে উঠছে দেহমনপ্রাণ। হাতের আন্দাজে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে কপালে পড়ে থাকা চূর্ণ চুলগুলো। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘দেখতো বু, সব ঠিক আছে তো ? ’ সম্মতিসুচক শব্দ শুনলে আনন্দে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে নিজেকে সুন্দরী ভাবা মেয়েরা। কিন্তু ওমা ! হেলিকপ্টার থেকে একের পর এক চকরাবকরা পোশাকের মানুষ নামলো। জেনারেলকে কেউ নামতে দেখলো না। সবাই হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে এক ধরনের বিলাপে ফেটে পড়ে। হায় ! কোথায় জেনারেল ? এ ওর মুখের দিকে চেয়ে হট্টগোল বাধায়। মাইকে ঘোষণা হল, ‘আপনারা শান্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। জেনারেল সাহেব এসেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবেন তাকে। গ্যানজাম করবেন না কেউ।’ মাইকে ঘোষণা শেষ হতে না হতেই বিকট শব্দে আরেকটি হেলিকপ্টার নামল মাঠে। পাখার ঘূর্ণায়নে রশিতে বাঁধা জেনারেলের বড় বড় পোস্টার গুলো ছিঁড়ে বাতাসে গায়ে ধাক্কা মারতে মারতে জনগণের মাথার উপর দিয়ে নাই হয়ে গেল নিমিষেই। এমন রসিকতায় জনগণ তেমন মজা পেল না। তাদের অপেক্ষা শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। এই সাতদিনে তারা তেমন কাজে মনোযোগী হতে পারিনি। স্কুলের শিক্ষকরাও বাচ্চাদের পড়ালেখা শিকেয় তুলিয়ে মুখে মুখে জেনারেল জেনারেল শব্দে ফেনা তুলিয়ে ছেড়েছে। এমন ইয়ারকিতে শিক্ষকদের মনেও চোট লাগে। এমতবস্থায় সেখানে মলম লাগাতে দ্বিতীয় হেলিকপ্টার থেকে জেনারেল হাত নাড়াতে নাড়াতে চিরচেনা স্টাইলে মুখ দেখাল। তাকে দেখার আবেগে এ ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে লাগলো। সপাং সপাং লাঠির বাড়িতে শান্ত হয়ে গেল জনগণ। পান্তাপাড়ার ছাদেক বলল, ‘শালার জেনারেলের কায়দায়-ই আলাদা ! কিরাম ম্যাজিক দেকালো দেকলি।’ তার কথার কেউ কর্ণপাত করে না। সুতরাং সেটি স্বগোক্তির মতোই রয়ে যায়। জেনারেল স্যুটবুট পরিহিত অবস্থায় নামলেন। হাত তার অটোমেটিক নড়তে থাকে। নেমেই ভাবলেন চারদিক এক চক্কর দিয়ে তবেই স্টেজে উঠবেন। গটগট পায়ে এগোতে থাকলেন তিনি। গোফের নীচে মুচকি হাসি লেগেই আছে। বাঁশ দিয়ে ঘেরা চারপাশ। বাঁশের ওপাশে আমজনতা। স্কাউট দল বাদ্য বাজিয়ে কান ঝালাফালা করে দিচ্ছে। তাদেরকে থামতে নির্দেশ দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে স্তম্ভ হয়ে গেল। গলায় ফাঁস লাগার মতো চুপ সবাই। শুধু বাঁশের ওপাশ থেকে শ্লোগান ভেসে আসছে। জেনারেল এতে আমোদ অনুভব করছেন। বুকটা তার ফুলে ফেঁপে দ্বিগুন চওড়া হয়। বুক ফুলিয়ে সামনে পা বাড়ান। সঙ্গে থাকা প্রটোকলের হঠাৎ মনে পড়ল এই যা জেনারেলকে বরণ করতে মালাটা তো পরানো হল না। কাউকে তো প্রস্তুত করতেও ভুলে গেছে তারা। মালাটা স্টেজের কাছেই রাখা আছে। একজন নিম্ন পদস্থ ঊর্ধ্বতন একজনের কানে কানে কী যেন বলে সোজা দৌড় লাগাল স্টেজের দিকে। জেনারেল আস্তে আস্তে হাঁটছেন। আর অনুভূতির সকল দরজা খুলে শুষে নিচ্ছেন সকল অভিনন্দিত স্লোগান। দু’শ গজ সামনে যেতেই জেনারেলকে থামতে হল। মালা সমেত এক সুন্দরী তন্বী নয়নের বহ্নি শিখা তার সামনে দণ্ডামান। জেনারেল বিস্মিত হলেন। খুশিতে গদগদ হয়ে গলাটা দিলেন বাড়িয়ে। আত্মহারা সোনাভান কালবিলম্ব না করে সোজা জেনারেলের গলায় মালাটা পরিয়ে লজ্জায় ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। জেনারেলেরও চক্ষু চড়ক গাছ ! একটা আদিম গন্ধ মেয়েটির শরীর থেকে এসে নাকটা ঝাঁঝিয়ে দিল জেনারেলের। সুন্দরের এই অযত্ন তার প্রাণে বড় বেশি দাগা দেয়। এমন পাড়া গায়ে পড়ে থাকবে এমন হুর। মনে মনে বললেন, হায় আল্লাহ! এই রূপসী তো আমাকে আদিম গন্ধে ডুবিয়ে মারার ক্ষমতা রাখে !
বাংলার সব সুন্দরীদের জন্য একটা বড় প্রাসাদ বানানোর ইচ্ছে তার বহুদিনের। আদিম গন্ধের মেয়েটিকে দেখে বুকের বামপাশে কিছু হাওয়া ঢুকে তোড়পাড় করতে লাগল তার। নীরবতা ভাঙল স্লোগান শুনে। নিজেকে সংবরণ করে আবার সামনে দিকে এগোতে থাকলেন তিনি। মাঠের চারপাশ চক্কর দিতে অনেকের সঙ্গে হাত মেলাতে হল জেনারেলের। গাড়িতে ভাড়া করা লোকজন একের পর এক আসছে তো আসছেই। স্টেজে উঠে ভাষণ দেবার আগে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে শান্তির প্রতীকরূপী ৪টা সাদা কবুতর উড়িয়ে দিলেন সবাই মিলে। কবুতরগুলো কিছু পাখনা ফেলে ফত্ফত্ শব্দে হাজার হাজার মানুষের মাথার উপর ঘুরতে থাকে। দিশেহারা মানুষ একযোগে সবাই হাততালিতে মুখরিত করে স্টেডিয়াম। মাইকে জেনারেলের ভাষণ শুরু হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উড়ন্ত কবুতর চোখের পলকে কাগজের হেলিকপ্টার হয়ে শো করে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় কাছের মাঠেই। স্টেজের পাশে দলীয় চামচারা স্লোগানে স্লোগানে জেনারেলের ভাবমূর্তি আকাশে বাতাসে, পারলে যেন পাতালেও পাঠিয়ে দিবে ঠিক এরকম হাম্বিতাম্বি। স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকে ধূ ধূ মাঠ। মাঠের মাঝখানে তালগাছের নিচে একসঙ্গে তিনটি বালক জেনারেলের পড়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল ছবির পোস্টারের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করছে আর আড়চোখে মেপে নিচ্ছে নিজেদের বিশেষ অঙ্গের আকার। তরল পদার্থের কাটাকাটি খেলায় মেতেছে ওরা। ওদিকে জেনারেল বলছেন, ‘আপনারা জানেন, এখানে আমার আত্মার বন্ধন আছে। আমার ছেলে (পাতানো বা ধর্মছেলে) আপনাদের সবার প্রিয় নেতা। সেই বন্ধন অটুট রেখে আপনাদের সঙ্গেও জড়াতে চাই গভীর বাঁধনে।’ কথার এইখানটাই এসে স্টেজে রাখা বড় টেবিল ফ্যানের বাতাসের তোড়ে জেনারেলের শার্টের উপরের দিকের প্রথম বোতামটি গেল ফট করে ছিঁড়ে। বিরক্ত ও অস্বস্থিতে পড়লেন তিনি। বক্তব্য দীর্ঘায়িত না করেই বসে পড়লেন নিজের আসনে এসে। এরপর একে একে বড় নেতা-ছোট নেতা-পাতি নেতা-উঠতি নেতা-শিক্ষানবিশ নেতা কেউ বাদ পড়লো না স্টেজে উঠতে। প্রতিশ্রুতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে জন¯্রােত। স্টেজ দুলে দুলে জানান দিচ্ছে জেনারেলের ক্ষমতা বহরের দাম্ভিকতা। ট্রাকে করে আসা দূরগামী গ্রামের মানুষেরা জেনারেলের বক্তৃতা না শুনতে পেয়ে মন খারাপ করে স্টেডিয়ামের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ধুর বাড়া, আসল বক্তিতাটাই তো শুনা হলো না। চল্ বাড়ি যাই। ও ধোনেদের কতা শুনে লাব আচে কোনো ?’

৩.
মঞ্চে যেসব কথা বলা নিষেধ সেইসব বিষয় নিয়ে মিটিং বসেছে জেনারেলের ধরমপুত্র মো. আখলাস উদ্দীন দফাদারের নিজস্ব মহলে। প্রাসাদসম এই মহল। জেনারেল তার ধরমবাপ হওয়াতে সে বাগিয়েছে অনেক কিছু। দলীয় লোকজন সব বসে আছে গোলটেবিলে গোল হয়ে। ইন্ডিয়া থেকে আনা হলদিরামের শন্ পাপড়ি, চানাচুর প্লেটে প্লেটে সাজানো। কয়েক ব্রান্ডি বোতলও যথানিয়মে থরে থরে বুকচেতিয়ে টেবিলে আসনগেড়ে রয়েছে। জেনারেল গোফের নিচে মুচকি মেরে হেসে বললেন, ‘শোনেন, সব কথা তো আর মঞ্চে বলা যাবে না। মঞ্চ হল মিথ্যাচারের বেদি। সত্যের গোপন আসল কথাটি শুরু হবে এখন। মনে রাখবেন, রাজনীতির সত্য সবসময়ের জন্য গোপন। এটাই রাজনীতির মূলমন্ত্র।’ উপস্থিত নেতাদের ঘাড় নেড়ে সায় দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি আছে বলে মুখ দেখে বোঝার উপায় আপাতত নাই।
ওদিকে সন্ধ্যা প্রায় গত। জেনারেল হাই তুলছেন। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমাদের পরবর্তী কার্যপ্রণালী কী কী হবে সবই দলীয় গোপন সংবিধানে লেখা আছে। আখলাস ওগুলো আপনাদেরকে পার্ট বাই পার্ট বুঝিয়ে দেবে। আপনাদের এখানে ডাকা হয়েছে জাস্ট একসঙ্গে বসে একটু মদমাস্তি করার জন্য। আমার বয়স হয়েছে, এখন আর বিশেষ খাইতে পারি না। ওই একটি জিনিস বাদে।’ গোফের নীচে আবারও মুচকি হাসলেন জেনারেল। ওই একটি জিনিস বলতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির মনে পড়ে গেল, ‘এই যা, জেনারেল সাহেব তো বিকালেই সোনাভানের কথা বলেছিলেন। এখনো তো তাকে আনা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে সে স্থান পরিত্যাগ করে। এই কাজটির উপর তার দলীয় পদটা একটু উপরে ওঠার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে। টেবিলের উপর ঠোকাঠুকির আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। ওদিকে জেনারেল লাগোয়া বারান্দায় অপেক্ষা করছে ওই একটি জিনিসের জন্য। ফুরফুরে বাতাস তার অল্প চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। তিনি বারবার চেষ্টা করছেন কপালের টাকটাকে ঢাকতে কিন্তু পারছেন না। শরীরটাও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে অন্যরকম বাতাসে। নিজেকে সামাল দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন তিনি। খাটের উপর গা’টা একটু এলিয়ে পা টানটান করে হেলান দিলেন খাটের পিঠে। খুব বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হল না। খটখট শব্দ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে গেলেন দরজার কাছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেই আদিম গন্ধ তার সমস্ত গা ভিজিয়ে দিল। কিছুটা লাজুক সুরে তিনি বললেন, ‘ওহ্, শেষ পর্যন্ত তুমি এলে তাহলে !’ লজ্জায় মুখটা নিচু করে আছে সোনাভান। বুক ফুলিয়ে নিজের অবস্থান কত শক্ত এমনটি বুঝিয়ে বড় নেতা হবার স্বপ্নে বিভোর পাতি নেতা বিদায় নেয়। জেনারেল বসতে আহ্বান জানালেন সোনাভানকে। সারা ঘরময় আদিম মাটি-মাটি গন্ধের সঙ্গে যোগ হয়েছে এবার বাবলা ফুলের গন্ধ। সোনাভান পায়জামায় গুঁজে আনা একগুচ্ছ বাবলা ফুল উপহার দিলো জেনারেলকে। ফুল দেখে জেনারেলের আনন্দ আর ফুরায় না। মুখের উপর টগবগ করে ফুটতে থাকে আনন্দ জোয়ারের পানি। এ যেন অন্যরকম গ্রহণ। জেনারেলের মাথার মধ্যে ধা ধা করে ঘুরতে থাকে কামনার বাতাস। পূর্বে কখনো তিনি এভাবে গ্রহীত হন নি। তিনি পুরো মাতাল, (যদিও তিনি একপেগের বেশি খাননি আজ) আনন্দে বিভোর। হুইস্কির গন্ধে নয়, তিনি আজ ডুববেন শরীরের গন্ধে। দরজা বন্ধ হবার পর মুখ খোলে সোনাভান, ‘আচ্ছা সবাই বলে আপনার নাকি নলের দোষ ?’ জেনারেল ষোড়শী সোনাভানের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘সেটা আবার কী ? একটু বুঝিয়ে বলো ?’ সোনাভান বলে, ‘মানে আপনি নাকি লুচ্চো ?’ কথাটি আগুনের হলকা হয়ে জেনারেলের কান পুড়িয়ে ফেলে। কোনোরকম নিজেকে সামাল দেন তিনি। বাস্তবে যায়-ই হোন, তিনি তো আর এসব কথা মুখে শুনে অভ্যস্ত নন। রাগে গরগর করতে থাকলেন তিনি। মুখে বললেন, ‘ওসব শুয়োরের বাচ্চাদের কথা বাদ দাও। তোমার কেমন লাগছে আমাকে ?’ ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে বাম গালে টোল বসিয়ে সোনাভান বলে, ‘আমার কাছে তো বোম্বের হিরোদের মতন লাগছে আপনাকে ?’ থানা শহরে এতো সুন্দর এক মেয়ের মুখে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা দেখে জেনারেল আরও মুগ্ধ হলেন। উচ্ছ্বাসে বললেন, ‘তো দূরে কেনো? কাছে আসো, আরও কাছে।’ একটু আড়ষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে কাছে যেতে থাকে সোনাভান। ওদিকে জেনারেল সুখের আবেশ মাখবে, এমন ভাব করে চোখ দুটো বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন ধবধবে রঙিন চাদর বিছানো খাটের উপর। পরণে সাদা পায়জামা। সোনাভান বুকে হাত রাখল জেনারেলের। এরপর আস্তে আস্তে বুক থেকে পেট, পেট থেকে নাভিমূলের কাছে পায়জামার দড়িতে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুঁকড়ে গেলেন জেনারেল। তারপর আবার পা’টা সটান করলেন। দেহে তার অন্যরকম পুলক এখন। কামনা জড়ানো কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘জানো সোনাভান, আজকাল মানুষ ভালোবাসতেই ভুলে গেছে।’ এমন আবেগময় কথায় সোনাভানের কেমন জানি লাগে। কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয় সে। জেনারেল বললেন, ‘কই আসো?’ এবার সোনাভান সরাসরি মাথা রাখল জেনারেলের বুকের উপর। আবেশে জেনারেল আবারও চোখ বন্ধ করলেন। সোনাভান পায়জামার গিঁট থেকে বের করল পলিথিনে প্যাঁচানো বাবলা গাছ থেকে পাড়া ফুল ও বিষপিঁপড়া রাখা প্যাকেট। ফুলটা আলাদা করে জেনারেলের ইতোমধ্যে খালি হওয়া বুকটাতে রেখে বুলাতে লাগল। প্রথমে একটু সুড়সুড়ি লাগলেও পরে বেশ আরামবোধ হয় জেনারেলের। গভীর আরামে জেনারেল তখন চূড়ান্ত মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। একবার চোখদুটি খুলে আবার বন্ধ করলেন। চোখ খুলে নয়, তিনি ভাবলেন চোখ বন্ধ করেই অনুভব করবেন চূড়ান্ত মুহূর্তের প্রথম অংশগুলোর অনুভূতি। সোনাভান সুকৌশলে প্যাকেটের মুখ খুলে বিষপিঁপড়া চালান করে দেয় জেনারেলের পায়জামার ভেতরে। জেনারেল প্রথম ভাবলেন, সেই জংলি হলুদ রঙের ফুল। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তার ভুল ভাঙল। চিৎকার করে উঠে তিনি বলতে লাগলেন, ‘কে কোথায় আছো, আমাকে বাঁচাও, এ ডাইনী আমাকে মেরে ফেলল।’ যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল দৌড়ে এলো রুমে। সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে ঢোকার কারণে খুব সহজে এক ফাঁক গলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সোনাভান। সবাই তখন জেনারেলকে নিয়ে ব্যস্ত। সোনাভানকে পাকড়াও করতে হবে একথা ভুলে যায় সবাই। নিজের গোপনাঙ্গ মুঠোর ভেতর ধরে আছেন জেনারেল সাহেব। এদিক ওদিক খুঁজে কে একজন আবিষ্কার করল বড় এক কালো রঙের বিষপিঁপড়া। উপস্থিত নেতাগণ বুঝতে পারলো কাজটা দুষ্টু সোনাভানের। কিন্তু তাকে কিছু বলার আগে জেনারেলকে শান্ত করতে হবে। ডাক্তারের কাছে গেলে ব্যাপারটি জানাজানি হলে লজ্জার শেষ রবে না, সেই ভেবে সবাইকে নিষেধ করল জেনারেলের ধরমপুত্র আখলাস। ওদিকে পাজামা ফুঁড়ে গোপনাঙ্গটি ফুলে বের হচ্ছে। একে একে কথা বলে আপাতত এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, জেলে পাড়া থেকে মুচি ডেকে এনে বাঁশের এক খাঁচা বানানো হবে। তারপর ফুলে ওঠা জেনারেলের বিশেষ অঙ্গ যাতে বেশি নড়াচড়া করতে না পারে, সেই জন্যে খাঁচার মধ্যে পুরে রাখা হবে এটি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুচি এসে হাজির। ফিতে দিয়ে মেপে নিল পরিমল মুচি। সেই মোতাবেক আধাঘণ্টার মধ্যে দ্রুত বানিয়ে ফেলল খাঁচা। এখন এটার মধ্যেই ঢুকানো হবে জেনারেলের বিশেষ অঙ্গ। খাঁচা হাতে পরিমল এগিয়ে গেল জেনারেলের দিকে। একজন মুচি জেনারেলের বিশেষ অঙ্গে খাঁচা পরাবে ! ব্যাপারটি চোখে লাগে ধরমপুত্র আখলাসের। সে সঙ্গে সঙ্গে খাঁচাটা পরিমলের হাত থেকে একপ্রকারের কেড়ে নিয়ে নিজেই পরাতে উদ্ধত হল। কিন্তু বিধিবাম ! খাঁচা তো ছোট হয়ে গেছে। আখলাস গালাগালি করে বলল, ‘কী ধোন বানাইছিস ?’ ভয়ে ভয়ে পরিমল বলে, ‘মাপ তো ঠিকই নিইলাম, ছারের ওটা আগের থেকে বড় হয়ে গিলি আমি কী করবো ?’ আখলাস চিৎকার করে বলে, ‘আবার বানা।’
ভয়ে ভয়ে আবার বানাতে বসে পরিমল। আধাঘণ্টা পর তৈরি হল নতুন খাঁচা। সেটিরও একি দশা। ছোট হয়ে গেল। এভাবে সারারাত একবার বানায়, আরেকবার ভাঙে। চলতে থাকে ভোর পর্যন্ত। অবশেষে ভোর রাতে জেনারেলের বিশেষ অঙ্গ আর না বেড়ে বরংচ কিছুটা চুপসে যায়। এইবার পরিমল মুক্তি পায়। খাঁচাটা লেগে যায় খাপে খাপে।

৪.
লুঙ্গি পরে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন জেনারেল। এখনি হেলিকপ্টার আসবে তাকে নিতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। ঢাকায় ফিরে করাতে হবে গোপন ট্রিটমেন্ট। প্রয়োজনে তিনি হাসপাতালকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন, তবুও হাসপাতালে যাবেন না। ব্যাপারটি খুবই গোপনীয়। ইজি চেয়ারে বসে হালকা দুলতে দুলতে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে গোপনাঙ্গে চাপ লাগলো। উহু করে উঠলেন। এতে তিনি দমলেন না তেমন। আখলাস উদ্দিনের বাড়ির বিরাট ছাদ। সেখানেই ল্যান্ড করল জেনারেলের ব্যক্তিগত ছোট হেলিকপ্টারটি। বাড়ির আশেপাশে জনগণ দাঁড়িয়ে আছে জেনারেলকে শেষ দেখা দেখতে।
কিন্তু তারা কোনোক্রমেই বুঝতে পারবে না আজ জেনারেল তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াবেন না। কোনোরকম দু’ঠাং ফাঁক করে কোমরটা একটু নিচু করে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যাবেন তিনি। অতঃপর হেলিকপ্টারে উঠেই তাড়াতাড়ি স্টার্ট দিতে বলবেন। এরপর সিটে বসে দ্বিতীয় নির্বাচনী প্রচারণা করতে এখানে আসতে হবে, এটি ভেবে উত্তেজনা বশত কড়াৎ করে টান পড়বে তার বিশেষ অঙ্গে। অন্য দিকে সোনামুখী গ্রামের ছেলেমেয়েরা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে সবাই যখন আকাশের দিকে তাকাবে, ঠিক তখন আলোচ্য গল্পের আদিম গন্ধের ষোড়শী-একরোখা-রাগি-গালে টোলপড়া বালিকা সোনাভান একদলা কাঠের কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হেলিকপ্টারের দিকে একবার তাকিয়েই মাটিতে ফেলবে একদলা কয়লা মিশ্রিত থুতু।

শেয়ার